#মায়ামঞ্জরী
পর্ব- ২৩
ডেভিড অফিসে ঢুকে চারদিকে চাইল। সুসজ্জিত ঘরটা। নেভানো ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে আছেন তার সাম্প্রতিক বস লেইজি রকম্যান। লোকটার সাথে কাজ করে মজা আছে। এর মতো ক্ষুর বুদ্ধিসম্পন্ন লোক ডেভিড আগে দেখেনি। কাজের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তি যেমন বন্ধুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনই কোনো ভুলচুক হয়ে গেলে ভয়ঙ্কর। এর জন্যই ডেভিডের চাকরিটা যেতে বসেছে। তার আগের বস এত কড়াকড়ি ছিল না। তবে রকম্যানের সবচেয়ে ভালো গুণ হচ্ছে সে মাথা ঠান্ডা রেখে অন্যের কথা শোনে। দ্বিমত হলে হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে নিজের মতামত চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে না।
ডেভিডের মাথায় মোটামুটি একটা প্ল্যান আছে। প্ল্যানটা সে ডিপার্টমেন্ট বা তার বসকে না জানিয়েও এক্সিকিউট করতে পারত, কিন্তু সমস্যা হলো প্ল্যানটা কার্যকর হতে সময় বেশি লাগতে পারে। তার বাঁধাধরা ছয় মাসের মধ্যে না হলে তারপর চাকরি খোয়াতে হবে, মাঝখানে বেকার খাটুনিও হবে। তারচেয়ে বসকে বলে দেখা যাক তার প্ল্যান সাকসেসফুল হওয়া পর্যন্ত সময় বাড়ায় কি না৷
লেইজি রকম্যান ডেভিডকে দেখে ঠোঁট সামান্য বাঁকিয়ে হাসার ভঙ্গি করলেন, কিন্তু ঠিক হাসলেন না৷ কোনো সম্বোধনও করলেন না৷ ডেভিড নিজেই হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে বলল, “হ্যালো স্যার৷ হাও আর ইউ?”
“ফাইন! হোয়াট আর ইউ ডুইং নাও? এনি প্রোগ্রেস?”
“একচুয়েলি, নো স্যার। বাট আই হ্যাভ আ প্ল্যান৷ অ্যান্ড হ্যাভ টু ডিসকাস ইট আর্জেন্টলি!”
“সিট ডাউন মিস্টার স্পাইক।”
ডেভিড সামনের চেয়ারটাতে বসলে লেইজি খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, “নাও ইউ ক্যান স্টার্ট।”
ইভা সে রাতে অনেকবার ডেভিডকে ফোন করল, কিন্তু কল ঢুকল না। তার কেন যেন খুব চিন্তা হচ্ছে। পেটের ভেতর পাক খেয়ে উঠছে অদ্ভুত সব বদ খেয়াল। কেন যেন মনে হচ্ছে ডেভিড বিপদে পড়তে যাচ্ছে। তার সাথে কথা বলা দরকার। কিন্তু কী কথা বলবে তা জানে না ইভা।
********
এ বাড়িতে আসার পর থেকেই শিশিরের ভোরে ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে। সে উঠে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। টানা বারান্দা। দোতলার প্রতিটা ঘরেই এই বারান্দার দিকে একটা দরজা আছে। যে কেউ চলে আসতে পারে। কিন্তু এত ভোরে কেউ ওঠে না। ভাইয়া রাত জেগে পড়ে, সকালটা ঘুমায়৷ শিশির এদিকে যত রাতেই ঘুমাক না কেন, জেগে ওঠে কাকভোরে। কত পাখি যে ডাকে আশেপাশে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। নদীর দিক থেকে ভীষণ ঠান্ডা বাতাস আসে এ সময়। শরীর জুড়িয়ে যায়। এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করে এখানে বসে। কিন্তু অত ভোরে কে চা বানিয়ে দেবে? সে নিজে বানাতে পারে, তবে তেমন ভালো হয় না, তাই চেষ্টাও করে না। ভোর হওয়া দেখে সে বেরিয়ে যায় হাঁটতে। আধঘন্টা হাঁটাহাঁটি করে এসে গোসল করে সকালের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ে।
এতদিন এই ছিল তার রুটিন। রুটিনে হঠাৎ করেই সামান্য অদল বদল হলো। সেদিন অধরার সাথে দেখা করে আসার পরদিন ভোরে উঠেই অধরাকে মেসেজ পাঠাল সে, “শুভ সকাল।”
অধরা তখন প্রস্তুতি নিচ্ছে বাগানে যাবার। টুং করে মেসেজ আসায় সে মোবাইলটা তুলে নিল। ঘুম ঘুম চোখে মেসেজটা পড়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার৷ কোন আহাম্মক এই সকালবেলা শুভ সকাল লিখতে এসেছে? যখন খেয়াল করে দেখল মেসেজটা এসেছে শিশিরের নাম্বার থেকে, তখন আপনাতেই মেজাজটা ঠিক হয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠল সলজ্জ হাসি৷
সে উত্তরে লিখল, “শুভ সকাল। এত সকালে ওঠো বুঝি?”
“হুম। পাখিদের কনসার্টে ঘুম ভেঙে যায়।”
“অনেক পাখি বুঝি তোমাদের বাড়িতে?”
“অনেক মানে অনেএএএএএক…”
“দারুণ তো!”
শিশির ভিডিও করে পাঠাল পাখির ডাকাডাকি।”
অধরার ভিডিওটা দেখে এত ভালো লাগল! “ইশ! তোমাদের বাগানটা কত্ত বড়!”
“হুম। কিন্তু জঙ্গল হয়ে আছে।”
“এত বড় বাগান পেলে আমি যে কত গাছ লাগাতে পারতাম!”
“সেজন্যই পরিষ্কার করছি না। তোমার জন্য রেখে দিয়েছি।”
অধরা লজ্জা পেয়ে হাসল। কথা ঘুরিয়ে বলল, “আমার বাগানে গাছ আছে, তবে এত পাখি নেই।”
“এখন কী করছো?”
“বাগানে কাজ করতে যাচ্ছি।”
অধরা ওয়্যারলেস ইয়ারফোন কানেক্ট করে কল চলা অবস্থাতেই চলে গেল বাগানে।
টুকটাক কাজের সাথে সাথে চলতে থাকল কথা। শিশির এক পর্যায়ে জানাল, “চা খেতে ইচ্ছে করছে জানো? কিন্তু বানাতে পারি না।”
“ওমা বলেন কী? চা বানাতে পারো না?”
“নাহ৷ তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। রোজ সকালে তোমার হাতের চা খেতে খেতে ভোর দেখব।”
“আচ্ছা? ততদিন অপেক্ষা করবে সামান্য চায়ের জন্য?”
“তো কী করব?”
“যেভাবে বলি সেভাবে করো। কিচেনে চলে যাও, বলে দেই কিভাবে বানাবে।”
শিশির বাধ্য ছেলের মতো রান্নাঘরে চলে গেল। অধরা একটার পর একটা ইন্সট্রাকশন দিয়ে গেল।
“চায়ের পটে দেড় কাপ পানি নাও।”
শিশির চায়ের পটটা চেনে। এটা সে নিজেই কিনে এনেছে৷ আগে ওদের বাড়িতে চমৎকার একটা কাচের কেটলি ছিল। মায়ের খুব শখের জিনিস। বাড়ি বদল করতে গিয়ে সেটা ভেঙে গেছে৷ এটা নিয়েও মায়ের আক্ষেপ ছিল প্রচুর। রুনু খালা এরপর ওকে বলিয়ে চা বানানোর জন্য পাত্র কিনে আনায়।
শিশির চুলায় আগুন ধরিয়ে পটটা বসিয়ে দেড় কাপ পানি দিয়ে বলল, “ডান।”
“মসলা চা খেলে গরম মসলা দিয়ে দাও।”
“গরম মসলা মানে? যে মসলাটা হাতে ধরলে গরম লাগে?”
“উফ ফাজলামি করবে না তো।”
“আমি সিরিয়াস৷ গরম মসলার নাম শুনেছি, কিন্তু সেটা কী জিনিস?”
“বিরিয়ানি খেয়েছ কোনোদিন?”
“অবশ্যই। কেন খাব না?”
“মুখে এলাচ পড়েছে?”
“তা পড়েছে।”
“ওটা গরম মসলার একটা উপকরন। সাথে লম্বা লম্বা দারচিনি আর ছোটো ছোটো ফুলের মতো লবঙ্গ।”
“যেটা বিরিয়ানিতে খেতে চাই না সেসব খামোখা সেধে সেধে চায়ে দিতে যাব কেন? এসব বাদ।”
“আরে ওটা তো ছেকে ফেলে দেবে।”
“প্লেইন চায়ের রেসিপি বলো তো!”
“কী চা খাবে সেটা তো বলো! দুধ চা, র-চা, আদা চা, লেবু চা কোনটা?”
“লেবু চা খাওয়া যায়। বাগানে লেবু আছে।”
“ওকে, লেবু নিয়ে এসে কেটে ফেলো, ততক্ষণে পানি ফুটে যাক।”
লেবুটা কাটতে একটু কসরত হলো, শেষে মনে হলো কাটা হয়নি, তবে যেমনই হয়েছে, সেটা চিপে দিয়ে রস বের হচ্ছে। ততক্ষণে চা প্রায় এক কাপ হয়ে গেছে। সে জিজ্ঞেস করল, “এরপর?”
“এক চামচ চা পাতি দাও। এক মিনিট ফোটাও।”
“ডান!”
“এবার ছেকে কাপে ঢালো।”
“লেবু?”
“ওটা পরে অ্যাড করবে।”
“কাপে ঢেলেছি।”
“এবার লেবু আর চিনি খেলে কাপে দিয়ে নাড়লেই হয়ে গেল।”
শিশির চিনি পছন্দ করে না। লেবু দিয়ে নেড়ে চা নিয়ে চলে গেল দোতলার বারান্দায়। তখন চারদিক বেশ আলো হয়ে গেছে। তবে পাখিদের কিচিরমিচির কমেনি। অধরা কল রেখে দিয়েছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। একটা চেয়ারে আরাম করে বসে চায়ে চুমুক দিয়ে শরীর জুড়িয়ে গেল শিশিরের। “আহ! আজকের সকালটা এত সুন্দর কেন?”
সে মেসেজ করে দিল অধরাকে, “থ্যাংস ফর ইয়োর রেসিপি!”
অধরা একটা স্মাইলি পাঠাল।
নতুন সম্পর্কের রঙ আস্তে আস্তে মিশে যেতে থাকল তাদের জীবনে। সেই সাথে মিষ্টতাও একটু একটু করে বাড়তে লাগল। রোজ যেন এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে ভালোলাগা যোগ হতে থাকল তাদের মাঝে।
তেমন কিছু না, এইযে লাঞ্চের সময় ছোট্ট একটা মেসেজ দিয়ে বলা, “খাওয়া হয়েছে?” সপ্তাহান্তে বিকেলে দেখা করে এক প্লেটে ঝালমুড়ি খাওয়া, ঝালে শিশিরের চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে এলে যত্ন করে অধরার ওড়না দিয়ে মুছে দেয়া, ছোট্ট ঘাসফুল ছিঁড়ে অধরার কানের পাশে গুঁজে দেয়া এসব মিঠে স্মৃতি যোগ হতে থাকল তাদের স্মৃতির ঝুলিতে।
কোনো ছুটির সন্ধ্যায় শিশির যখন বাবা মায়ের সাথে গল্প করতে বসে, নিজের ভেতর অধরার ইনপুট করে দেয়া পজিটিভিটি বাবা মায়ের মধ্যেও সে একটু একটু করে সঞ্চার করতে পারে, তখন ভীষণ ভালোলাগায় মন ভরে যায়।
এমনই এক সন্ধ্যায় সে বাবা মাকে অধরার ব্যাপারটা খুলে বলল। তারা আগেই জানতেন, এবার ছেলের দিক থেকে জেনে বললেন, অবস্থা আরেকটু স্থিতিশীল হলে তারা ব্যবস্থা নেবেন। শিশিরেরও তাই ইচ্ছে। এর মাঝে সে পছন্দমতো একটা কোম্পানিতে ঢুকে গেছে। কাজ শুরু করেছে জুনিয়র পদে। বাবার অফিসের মতো উঁচু পদ, অত স্যালারি বা আরামদায়ক পরিবেশ এখানে নেই। তবে যা আছে তা হলো স্বস্তি। সেখানে সবসময় বাবার কোটায় উচ্চ পদে চাকরি পাবার একটা হীনমন্যতা কাজ করত তার, নিজের চেয়ে বয়ষ্ক অথচ পদে জুনিয়রদের অপছন্দের কারন হতো খামোখাই, তার বদলে এখানে আছে বন্ধুত্ব, কলিগদের সাথে সখ্যতা, আর যোগ্যতা দিয়ে ওপরে ওঠার চ্যালেঞ্জ। কাজটা উপভোগ করছে সে।
শিশির নিজে সবকিছুর সাথে মোটামুটি এডজাস্ট করে নিয়েছে। শুধু বাবা মায়ের দিকে চাইলে খারাপ লাগে। সে জানে এই পরিস্থিতি থাকবে না। একদিন শাওন দাঁড়িয়ে যাবে, সেও হয়তো কিছু করবে। আবার হয়তো তারা আগের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে, কিংবা নিজেরাই আরেকটা বড় বাড়ি করতে পারবে। আগের লাইফস্টাইলে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু ভয় হয়, ততদিন বাবা মা না থাকলে?
কথাগুলো একদিন অধরাকে বলল সে। অধরা তখন খুব সুন্দর করে বোঝাল, “ভাগ্য আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। শত চেষ্টা করেও তা বদলানো যায় না। বাবা তো ওই বাড়িতে থেকেই মৃত্যুর মুখে পড়ে গিয়েছিলেন৷ এখানে ঠিকই বেঁচে আছেন। কোন বাড়িতে থাকছি সেটা বড় বিষয় না, বরং যেখানে থাকছি সেখানে ভালো থাকছি কি না, বাঁচার মতো বাঁচতে পারছি কি না সেটা বড় কথা।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব- ২৪
শাওলী যখন শিশিরের সাথে অধরার বিয়ের খবরটা শুনল তখন সে বেশ অবাক হলো। তার ধারণা ছিল শিশির পছন্দ একটু উঁচুদরের। বরাবরই সে দেখেছে ছেলেটা দামী জামাকাপড়, ব্র্যান্ডের জুতো, ইম্পোর্টেড পারফিউম, দামী ঘড়ি ছাড়া চলে না৷ এমনকি ওদের সবচেয়ে লাক্সারিয়াস গাড়িটাও ছিল শিশিরের। শাওনই বরং অনেকটা উদাসীন, সাদামাটা ছিল। সরকারি মেডিকেলে পড়ে হলে থাকা ছেলেটাকে এক দেখায় কেউ আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত ছেলের থেকে আলাদা করতে পারত না৷ এখনো ওর অনেকটা সেরকম স্বভাবই রয়ে গেছে।
শাওন যদি মধ্যবিত্ত ঘরের কোনো মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করে ফেলত তাহলে অবাক হবার কিছু ছিল না। এমনকি শাওলীর সেরকম আশঙ্কাও ছিল। তাই ছোটোবেলার ভালোবাসা সে হারাতে দেয়নি, আগেভাগে প্রপোজ করে ফেলেছে৷ শাওন সেজন্য হাতছাড়াও হয়ে যায়নি। কিন্তু শিশির তো আলাদা। সে কেমন করে অধরাকে পছন্দ করে বসল?
শাওলী দোতলার বারান্দা ধরে হেঁটে হেঁটে এসব কথা ভাবছিল। একবার এমাথা থেকে ওমাথা আবার ওমাথা থেকে এমাথা আসছিল। মজা লাগছিল তার বেশ! এই বারান্দাটা চওড়া, পুরানো দিনের মতো। মেঝেতে চারকোনা মোজাইক করা। একেকটা ঘরে এক পা করে দিয়ে খানিকটা লাফিয়ে লাফিয়ে পার হচ্ছে সে। তার নানাবাড়ির মেঝে এরকম ছিল। ছোটোবেলার মতো অনুভূতি হচ্ছে। চারদিকে নানারকম পাখি ডাকছে, সূর্যটা এখন নরম আলো দিচ্ছে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে বেলাশেষের রোদ।
সে এসেছে তিনদিন হলো। থাকতে ইচ্ছে করে না এখানে। এসি, গিজার, ওয়াইফাই এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো এখানে নেই। খাওয়াদাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। রুনু খালার রান্না মুখে দেয়া যায় না। সে শুধু রয়েছে শিশিরের বিয়ের খবরে আগ্রহী হয়ে, তবে তারচেয়েও বেশি শাওনের জন্য। সে থাকলে শাওন বেশ খুশি খুশি থাকে। না থাকলে ফোনে ওর গলা শুনেই বোঝা যায় মন খারাপ। শাওনকে সে তার বাবার বাড়িতে যেতে বলে না, জানে হাজার বললেও যাবে না। অদ্ভূত এক লোককে ভালোবেসে বিয়ে করেছে সে। মাঝে মাঝে নিজের ওপরেই রাগ লাগে। আজ সব ঠিক থাকলে তারা হয়তো পাড়ি জমাতো ভিনদেশে। এখন পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে কে জানে!
শিশিরের ঘরের সামনে এসে সে একটু থামল। ভেতরে উঁকি দিল। এখন বিকেল। বিকেলে ছেলেরা বাসায় থাকে না। তার কেন যেন ইচ্ছে হলো শিশিরের ঘরে ঢুকতে। অনধিকার চর্চার অভ্যাস তার নেই, তবুও সামান্য ইচ্ছে হলো, কারন দরজা থেকেই টেবিলের ওপর একটা ফুলদানিতে শুকনো ফুল দেখা যাচ্ছে। তার সামনে একটা প্যাডে কলম দিয়ে কিছু লেখা দেখা যাচ্ছে।
শাওলী ঢুকল, তবে কিছুই ছু্ঁল না৷ শুধু লেখাটা পড়ল। এই লেখার শুরু আরো আগেই হয়েছে। এই পৃষ্ঠার অর্ধেক ভর্তি লেখায়। হয়তো আরো লেখা হবে।
“বাসে তখন মানুষ খুব কম। আমার চোখ জড়িয়ে আসছে ঘুমে। হঠাৎ একটা সুবাস আমার তন্দ্রা পুরোপুরি কাটিয়ে দিল। বাসটা কোনো এক স্টপেজে থেমেছে তখন। কে একজন বাসে উঠল। আমার সামনের সিটে এসে বসল। যে ঘ্রাণটা আমি পেলাম সেটা ঠিক তোমার চুলের ঘ্রাণের মতো। আমি ভেবেছিলাম তুমিই। পরে চেয়ে দেখলাম অন্য কেউ। তোমার চুলের ঘ্রাণেরও ভ্রম হয় এখন…”
আর পড়ল না শাওলী। এত ব্যক্তিগত চিঠি পড়াটা ছোটোলোকী। তার অতিরিক্ত কৌতুহল তাকে এতটুকু পড়িয়ে নিয়েছে। আর প্রয়োজন নেই। শুকনো ফুলগুলোর দিকে চাইল সে। অধরারই দেয়া নিশ্চয়ই? শিশির এত রোমান্টিক তা তার জানা ছিল না। শাওন কোনোদিন তাকে ছোট্ট একটা মেসেজেও ভালোবাসি বলেনি। বুকের ভেতর কেমন একটা ঈর্ষা টের পেল সে। আর টের পেল রাতে ঝগড়া হতে যাচ্ছে। বেচারা শাওন! উহু, বেচারাও নয় সে, চাইলেই তো একটু ভালোবাসার কথা বলতে পারে তাকে! সে জানে শাওন তাকে ভালোবাসে। তাই বলে কি একটুও মুখে বলতে নেই? সবই কি নিজে থেকে বুঝে নিতে হবে?
********
“তাহলে আপনি আমার দুলাভাই হচ্ছেন?” দুই বেনী দুলিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল অদিতি।
শিশির একটু নাক কুঁচকে বলল, “দুলাভাই শুনতে কেমন একটা ব্যাকডেটেড লাগে না?”
অদিতি সব দাঁত বের করে বলল, “তাহলে কী ডাকব? এখন যেসব ডাক চালু হয়েছে সেসব? জিজু? জিজস?”
“না না, এসব হিন্দি ভার্সনের বাংলা অপভ্রংশ চলবে না।”
“তাহলে?”
“সিম্পলি ভাইয়া ডাকো।”
“উহু, আপনি তো স্পেশাল, আপনাকে স্পেশাল কিছু ডাকা উচিত না?”
“আমি স্পেশাল কেন?”
“কারন, আপনি আমার বিজনেস প্রমোটার?”
“আচ্ছা? আমার সেই উদ্যেগের পর তোমার কোনো লাভ হয়েছিল?”
“হয়েছিল মানে! মেজো আপা বলেনি? খুব লাভ হয়েছে। তবে অত্তো বড় কেকের অর্ডার আর পাইনি। বেশিরভাগ ছোটো ছোটো বার্থডে, এনিভার্সারির কেকের অর্ডার আসে। তবে সেল আগের থেকে অনেক বেশি। আর তার বেশিরভাগই হাইফাই কাস্টোমার।”
“তুমি তো তাহলে বড় বিজনেসওম্যান হয়ে যাচ্ছো অদিতি।” হেসে বলল শিশির।
“হুম।” অদিতি বেশ চনমনে গলায় বলল।
শিশির চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা রেখে দিল। আজ সে বাড়ির সবাইকে নিয়ে এসেছে অধরাদের বাড়িতে। সে ভেবেছিল সবকিছু একটু দেরিতেই হবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বাবা অধরার ব্যাপারটা শোনার পর নিজেই বলেছেন তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলতে। বাবার আচমকা তার বিয়ে নিয়ে উৎসাহী হয়ে পড়ার কারন তার মাথায় ঢোকেনি। পরে অবশ্য মা তাকে বুঝিয়ে বলেছিল, মা বাবার বিয়ের পরেই নাকি বাবার ভাগ্য খুলেছিল। বাবা এসবে খুব বিশ্বাস করেন। তাই চাইছেন শিশিরের বিয়েটাও দিয়ে দিতে।
এতদূর জার্নি করে বাবার আসাটা কষ্টকর ছিল, তবুও তিনি আগ্রহ করে এসেছেন। অনেকদিন পর বেশ উৎফুল্ল হয়ে গল্প করছেন অধরার বাবার সাথে। শিশিরের অবাক লাগছে এটা ভেবে যে ক’দিন আগেও যে খুব কেতাদুরস্ত বিজনেসম্যান ছিল সে এখন কলেজ টিচার অধরার বাবার সাথে কী সুন্দর গল্প করছেন! যেন তাদের মাঝে কতদিনের বন্ধুত্ব! সময় সবকিছু বদলে দেয়। হয়তো তাকেও অনেকটা বদলেছে। কতটা সে জানে না। শাওলীর ব্যাপারটাও তাকে একটু অবাক করেছে। সে ভেবেছিল ভাবি আসবে না। কিন্তু তাকে বলতেই দেখা গেল রাজি হয়ে গেছে। এখানেও বেশ আগ্রহ করেই বিয়ের আলাপ শুনছে।
খুব বেশি কথাবার্তার প্রয়োজন অবশ্য হলো না। মিয়া বিবি যেহেতু রাজি, তাই কাজি ডাকতে দেরি না করাই ভালো। ঠিক হলো পরের মাসের শুরুতেই বিয়েটা হয়ে যাবে। শিশিরদের পক্ষ থেকে কোনো জাঁকজমক হবে না। তারা শুধু অল্প ক’জন বরযাত্রা হিসেবে আসবে, বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে যাবে। অধরার বাবা জানালেন, তিনিও সাদামাটা বিয়েট পক্ষে। অতএব, বিয়েতে হতে আর কোনো ঝামেলা রইল না।
বিদায়বেলায় শিশির অধরাকে চুপি চুপি বলল, “বিয়ে সাদামাটা হোক বা না হোক, বউ কিন্তু আমার জমকালো লাগবে। ফাটাফাটি একটা সাজ দেবে বুঝলে? আমার ফটোগ্রাফার বন্ধু আছে। ওয়েডিং ফটোশুট সেই করবে। খুব স্মৃতি রেখে দেব আমরা।”
অধরা হাসল। হাসির সাথে হাসল ওর চোখ। লাল হয়ে গেল গাল। শিশিরের ইচ্ছে হলো এক্ষুনি একটা চুমু খেয়ে নিতে। কিন্তু কাছাকাছি অনেক মানুষ আছে। এমন কিছু করলে তাকে একেবারে ছেঁচে ফেলবে। সবার আগে তাকে পিষবে অধরা নিজে। ইশ্ এটা যদি ইউরোপ আমেরিকা হতো!
শিশিররা চলে গেলে অধরার মা বললেন, “শিশিরের মা একটু সহজ সরল তাই না?”
অধরা একটু ভেবে বলল, “আমারো তাই মনে হয়।”
মা খানিক চুপ থেকে বললেন, “বেশি সহজ মানুষ নিয়েও ঝামেলা আছে রে।”
“মা তুমি বেশি বেশি চিন্তা করো।”
“আমি চিন্তা না করলে আর কে করবে রে?”
“চিন্তার কী আছে? ভাগ্যে যা আছে হবে। এখন অর্ডার তো আর দেয়া যাবে না যে, কঠিন, সরল কোনোটিই নয়, তরল টাইপের শাশুড়ী চাই। যা কপালে আছে তাই সইতে হবে।”
মা বিরক্ত হয়ে বললেন, “ধুর! এত কথা কোথায় শিখেছিস? আয় রান্নাঘরে। থালা বাসনের পাহাড় হয়ে আছে, ধুতে হবে।”
“অদিকে বলো মা। আমি টায়ার্ড।”
মা জোর করে অধরার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে। আস্তে আস্তে বোঝালেন, “এখন অভ্যাস করতে হবে রে মা। শ্বশুরবাড়িতে গেলে কাজ করে খেতে হবে না? যা যা পারিস না সব শিখিয়ে দেব এখন।”
“মা, ওদের যে বড় বউটা আছে না, সে কিন্তু সংসারের কাজ কিছুই পারে না। ডাক্তার। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে পড়ে আছে। আমি ওর থেকে ঢের বেশি কাজ জানি। আমার কী অসুবিধা হবে?”
“তুই তো আর ডাক্তার নোস। তোকে রাজ্যের রোগী সামলাতে হবে না। এখন ঘরটাও সামলাতে না পারলে আর কী করবি?”
“আহা! পড়াশোনা শেষে আমিও চাকরি করবো।”
“অধরা রে, আমি তো এটা ভাবিইনি, বিয়ের পর তুই ক্লাস করবি কিভাবে?”
“মা, আমার ফাইনাল ইয়ারের ক্লাস হবে আর দু’মাস। এরপর ফাইনাল পরীক্ষা হলেই শেষ।”
“তো এই দুই মাস এখানে থাকবি তো?”
অধরা উত্তর দিল না। এখানে থাকলে কেমন করে হবে? মায়ামঞ্জরীতে অনেক কাজ পড়ে আছে যে!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-২৫
সময়গুলো উড়ে গেল পাখির পালকের মতো। এত দ্রুত বিয়ের দিনটা চলে এলো যে গায়ে হলুদের রাতে স্টেজে বসে অধরার বিশ্বাসই হতে চাইল না আগামীকাল তার বিয়ে। মায়ামাঞ্জরীর গল্প শুনতে শুনতেই তার মাঝে ভীষণ আগ্রহ জন্মে গিয়েছিল বাড়িটার প্রতি। তার কেবলই মনে হয় বাড়িটা তাকে ডাকছে। আজীবন এমন একটা নিরিবিলি শান্তিময় বাড়িতে চমৎকার একটা পরিবারের সাথে থাকতে চেয়েছে সে। সবচেয়ে বড় কথা, সেই বাড়িতে শিশির বাস করে। শিশিরকে তার দিন দিন এত বেশি ভালো লেগে যাচ্ছে যে নিজেকে নেশাগ্রস্তের মতো মনে হয়। কোনো অচেনা আকর্ষণে বুনোফুলের ঘ্রাণে মাতাল হয়ে যাওয়া মৌপতঙ্গের মতো লাগে। শিশির তার কতটা বুঝতে পারে? হয়তো একটুও না, কারন অধরা তার অনুভূতি প্রকাশ করে না৷
বিয়েটা যেমনটা ওরা চেয়েছিল তেমনভাবেই ছোটো করে হয়ে গেল। শিশিরদের বাড়ি থেকে শুধু ওদের বাড়ির লোকেরা, ওর কিছু বন্ধু আর মামার বাড়ির লোকজন এলো। অধরাদের দিক থেকে ওদের কিছু আত্মীয়স্বজন এলো। অধরাদের বাড়ির পাশেই ছোটো একটা কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের আয়োজন করা হলো।
শিশিরদের আত্মীয়স্বজনের সংখ্যা এমনিতে অনেক বেশি। কিন্তু তাদের সাম্প্রতিক বিপদের সময় সবাই যেন যার যার মতো মুখ ফিরিয়ে ছিল। ওরা নিজেদের বিপদে কাউকে ডাকেনি ঠিকই, তবে দুধের মাছির মতো আত্মীয়রা যে তাদের অস্তিত্ব বেমালুম ভুলে বসেছিল সেটাও ওরা লক্ষ্য করতে ভোলেনি। না কোনো ফোনকল করেছে, না একদিন দেখা করতে এসেছে। এমনকি যারা ওদের ছোটোখাটো প্রতিটা পার্টিতেও তেলতেলে হাসি নিয়ে উপস্থিত হয়ে যেত, শিশিরের বাবা হাসপাতালে থাকাকালীন সময়েও তারা একবার খোঁজ নেয়নি৷ সত্যিকারের পাশে থাকার মানুষগুলোকে ওরা চিনেছিল হাড়ে হাড়ে। তাই বিয়ের দাওয়াতের লিস্ট যখন করা হলো, তখন বাবা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন সেসব আত্মীয়দের নেবার কোনো প্রয়োজন নেই। মা অবশ্য দয়াপরবশ হয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ভাঙা উচিত না৷ গুনাহ হয়। তখন বাবা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিলেন, বন্ধন ভাঙা হলে তারাই ভেঙেছে। আমাদের কোনো দায় নেই।
অবশ্য লোকজন কম হলেও অনুষ্ঠানে কোনো প্রভাব পড়ল না। বরং সুন্দর করেই সবকিছু হয়ে গেল। অপর্ণা আর অদিতি বাদেও অধরার আরো কিছু বোনেরা মিলে খুব মজা করল পুরোটা সময়৷ দুই পরিবার মিলে ঘরোয়া পরিবেশে নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠান শেষ হলো।
কান্নাভেজা বিদায়ের পর অধরা সব পেছনে ফেলে শিশিরের হাত ধরে চলল নতুন এক ঠিকানার দিকে। গাড়িতে তখন শুধু সে আর শিশির। শিশির কীসব যেন বলতে লাগল, কিন্তু অধরার কিছুই কানে ঢুকল না। হঠাৎই খুব ভয় হতে শুরু করেছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না মায়ামঞ্জরীতে যাবার পথে তার কেন এত ভয় লাগছে! সে তো দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছে সেখানে যাবার জন্য। এটা কি তবে ভয় নয়, উত্তেজনা?
ব্যস্ত শহুরে পথ ছেড়ে গাড়িটা একসময় শহরতলীতে গিয়ে ঢুকল। অধরা চুপচাপ বাইরের দিকে চেয়ে আছে দেখে শিশির আর কিছু বলছে না। পথের দুধারে গাছপালা বাড়ছে, বড় বড় দালান কমে যাচ্ছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামছে একটু একটু করে। বাড়ি পৌঁছে গাড়িটা থামল। শিশিরের হাত ধরে গাড়ি থেকে নামল অধরা।
বেলাশেষের রাঙা আলোয় সে প্রথম বাড়িটা দেখল। মায়ামঞ্জরী৷ গেটের পাশে খোদাই করা পুরানো লেখাটা দেখল সে সময় নিয়ে। বাড়ির লোকজন ওদের আগেই চলে এসেছে। ভেতরে আলো জ্বলছে, তবে বিয়েবাড়ির আমেজ নেই। এক প্রশান্ত সন্ধ্যায় বাড়িটাও একই রকম শান্তির নীড় মনে হচ্ছে। এতক্ষণের উত্তেজনা কিংবা ভয়টা কেটে গেল অধরার৷
ভেতরে পা দিয়ে একপাশে সেই জঙ্গলাকীর্ণ ঝোপঝাড় দেখতে পেল অধরা। গাছপালা কোনটা কী সেটা আঁধারে বোঝা গেল না৷ সে ভেতরে প্রবেশ করল শিশিরের হাত ধরে। ওরা চলে আসায় সবাই বেরিয়ে এলো। বাড়িতে বিয়ের আমেজ যেন হঠাৎ করেই লেগে গেল। বধূবরণ করতে এগিয়ে এলেন শিশিরের মা, ভাবি, মামী, মামাতো বোনেরা, রুনু খালা। বাড়িতে প্রবেশের দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে ওদের মিষ্টিমুখ করানো হলো। তারপর শিশিরকে বলা হলো অধরাকে কোলে তুলে ওপরে ঘরে নিয়ে যেতে।
শালীদের পাল্লায় পড়ে সারাদিন বিয়েবাড়ির উদ্ভট সব নিয়ম পালন করতে হয়েছে শিশিরকে। কিন্তু নিজের বাড়িতে এসেই সবার সামনে বউকে কোলে তুলে নেবার কথা শুনে সে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ওর হতভম্ব মুখের দিকে চেয়ে মামী হেসে বললেন, “করতে হবে বাবা, করতে হবে। শাওনের বিয়ে তো এত হাইফাই করে হলো, এত ক্যামেরা আর বাইরের লোকজনের ভিড়ে কিচ্ছু করতে পারিনি। তোর বেলায় সব নিয়ম হবে। যা বউকে নিয়ে যা ঘরে।”
শিশিরের ঘর দোতলায়। সে অধরাকে তুলে নিতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠল। শিশির সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। যদিও অনেকদিন জিম করা বা বাস্কেটবল খেলা হয় না, তবুও অধরাতে তুলতে তার তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। শিশিরের মেদহীন পেটানো শরীর আর অধরা মোটামুটি ছিপছিপে হালকা। সে অনায়েসে সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলল৷ অধরার গায়ের শাড়িটাই বরং ভারী। আর গয়নাগাটিও গা ভর্তি। মা তার ছোটো বউয়ের জন্য রেখে দেয়া গয়নায় কাউকে হাত দিতে দেয়নি।
শিশিরের মনে হলো অধরাকে যেন শাড়ি আর গয়না দিয়ে প্যাকেট করা হয়েছে। তবে সারাদিন এত ধকলের পরেও খুব কাছাকাছি এসে ওর শরীর থেকে পাওয়া মিষ্টি একটা ফুলের সুবাসে ওর মন ভরে গেল। শিশির মনে মনে জানে, সে যে অধরাকে শুরু থেকেই পছন্দ করে তার বেশকিছু কারনের একটা হলো ওর পরিচ্ছন্নতা। ওর ভেতর কোনো উগ্রতা নেই, না পোশাকে, না ব্যবহারে, না অস্তিত্বে।
শিশির ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। ঘরের দরজা ব্লক করা হয়েছে। মামাতো বোনগুলো কখন যেন ওপরে চলে এসেছে। ভেতরে বাসর সাজানো। দরজার সামনে রঙিন ফিতে বাঁধা। বাসরের কারিগরদের আগে সম্মানী দিতে হবে, তারপর ওরা ঢুকতে পারবে। এতক্ষণে শিশির খানিকটা ক্লান্ত আর বিরক্ত হয়ে বলল, “ধুর! আরো কী কী করতে হবে? এখন আমি অনেক টায়ার্ড। প্লিজ ঢুকতে দে তোরা।”
বোনেরা বলে উঠল, “আহা! শালীদের সব আবদার তো হাসতে হাসতে মেনে নিলে। আর আমাদের এইটুকু দাবী মানবে না? তুমি একদিনেই এত স্বার্থপর হয়ে গেলে?”
শিশির হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “টাকা পেলে চলে যাবি তো? আর জ্বালাবি না তো?”
“টাকা পেলেই ঢুকতে দেব।”
অবশেষে বোনেদের খুশি করে কাচি দিয়ে ফিতা কেটে ভেতরে ঢুকতে পারল ওরা। এখানেও নিয়মের শেষ হলো না। আয়না দেখানো, এক মিষ্টি দুজন খাওয়া, এক গ্লাসে শরবত খাওয়া হলো।
এসব শেষে রাতের খাবার শেষ হতে হতে প্রায় বারোটা বেজে গেল। এতক্ষণে ওদের বাসর ঘরে ঢুকিয়ে সবাই বিদায় নিল।
শিশির অধরা দুজনেই ক্লান্ত। চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে। তবুও কারোই ইচ্ছে করছে না শুয়ে পড়তে। বরং মনে হচ্ছে রাতটা দীর্ঘ হলে খুব ভালো হয়৷
শিশির বিয়ের শেরওয়ানি খুলে গোসল করতে গেল। অধরা একা বসে রইল ফুলেল বাসরের মাঝখানে। তার একটুও শক্তি নেই এসব গয়নাগাটি শাড়িটাড়ি খোলার। বরমশাইয়ের মনে চাইলে তিনিই খুলে দেবেন, নয়তো এভাবেই ঘুমোবে সে৷
মায়ামঞ্জরীতে তখন নেমেছে নিঝুম এক রাত্রি। প্রচুর পোকামাকড়ের ছন্দপূর্ণ ডাক ভেঙে দিচ্ছে নৈশব্দ। সেই ডাকের ভেতরেও ভারী এক নিস্তব্ধতা লুকোচুরি খেলছে। প্রবল মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে আসছে। অধরা নিশ্চিত, এই বাড়ির কোথাও হাস্নাহেনা ফুলের গাছ আছে। ওর ভীষণ পছন্দ হাস্নাহেনা। তার প্রথম রাতের জন্য বুঝি পছন্দের ফুলেরা সুঘ্রাণ ছড়িয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। আবেশে চোখ বুজে এলো অধরার৷
বাথরুমের দরজা খোলার শব্দে তন্দ্রা ভাঙল তার। শিশির বেরিয়েছে। ওর পরনে শুধু ট্রাউজার, ওপরে কিছু নেই, কেবল তোয়ালেটা গলায় ঝোলানো। অধরা যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য পলক ফেলতে ভুলে গেল। তার হৃৎস্পন্দন থেমে থেমে যাচ্ছে। তাকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দেয়া সেই সুদর্শন পুরুষটা আজ তার নিজের। খুব কাছাকাছি, ঘরোয়া সাজে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। বিশ্বাস হয়? বরং আজ ওকে আরো অনেক বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। অধরা ওকে চাইলেই ছুঁতে পারে, জড়িয়ে ধরতে পারে। একটা অজানা শিহরণ বয়ে গেল ওর শরীর জুড়ে।
শিশির ভেজা চুল মুছতে মুছতে আঁড়চোখে লক্ষ্য করছিল অধরাকে। অধরার শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ। লাল শাড়ি, লালচে সাজ আর সোনার গহনায় সাজানো ওর মুখটা প্রতিমার মতো সুন্দর লাগছে। শিশির স্ত্রীর দিকে এগিয়ে গেল মোহগ্রস্থের মতো। কয়েক সেকেন্ড চোখে চোখে অজস্র কথা হয়ে গেল। এরপর আর কোনো কথার প্রয়োজন হলো না।
সে রাতে অধরার আর ঘুম হলো না। প্রচন্ড ক্লান্ত শিশির ঘুমাচ্ছে ওর হাতের ওপর মাথা রেখে, পশ্চিমের জানালা গলে শেষ রাতের চাঁদ প্রবল আলো ছড়াচ্ছে। চাঁদের আলো জানালার একটা খোলা পাল্লা দিয়ে ঢুকে রুপালি আলোর বন্যায় গরাদের কারুকাজের ছাপ তুলেছে মেঝেতে। হাস্নাহেনার ঘ্রাণ তখনো আসছে, যেন আরো প্রবল হয়েছে।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ এক চিৎকারে কেঁপে উঠল সে। শিশিরেরও ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমভাঙা গলায় সে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
অধরা উত্তর দিতে পারল না৷ সে নিজেই বুঝতে পারছে না। পরক্ষণেই নিচতলা থেকে আবারো ভেসে এসো চিৎকার। একটা দুটো করে সম্মিলিত কণ্ঠের চিৎকারে ভেঙে গেল রাতের অপূর্ব নিরবতা।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু