মায়ামঞ্জরী পর্ব-২৯

0
1

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব- ২৯

মায়ামঞ্জরীতে বিকেলের ছায়া পড়তেই চারদিক ভারি মনোমুগ্ধকর মনে হতে লাগল। বড় বড় গাছগুলোর মাথায় শেষ বিকেলের মিহি রোদ আর উঠানে ঘনিয়ে আসা ছায়া বড্ড আদুরে লাগতে লাগল। শরতের শেষদিকে এদিকটাতে গরমটা কমে গেছে। দুপুরের রোদের আঁচ কমে আসতেই আরামদায়ক আবহাওয়া মনটাকে আরও ফুরফুরে করে দিল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারদিকে চেয়ে অধরার ইচ্ছে হলো এখানে একটা টুল পেতে সারা বিকেল বসে থাকে। কিন্তু সবাই মিলে ঘুরতে যাবার প্ল্যান হয়েছে। মামাতো বোনেদের সাজগোজ শেষ হয়নি বলে সে সামান্য ফুরসত পেয়েছে এখানটায় দাঁড়াবার।

সবাই চলে এলে বের হতে হলো। শাওন আর শাওলী আসবে কি না ওরা নিশ্চিত ছিল না, কিন্তু তারা সময়মতোই বেরিয়ে এলো। মায়ামঞ্জরীতে অধরা চব্বিশ ঘন্টাও থাকেনি, বের হয়ে তার কেমন যেন মন কেমন করতে লাগল। কেন কে জানে!

গেট থেকে বেরিয়ে ডানের রাস্তা ধরে মিনিট দশেক হাঁটার পর নদীর ঘাট পড়ল। এখানে বেশকিছু নৌকো পারাপার হচ্ছে। আর ওপাড়ে যাবার মানুষের ধুম লেগে গেছে। এমনিতে এত লোক পারাপার সবসময় দেখা যায় না। ওরা জিজ্ঞেস করে জানতে পারল ওপাড়ে মেলা বসেছে। কালীপূজা উপলক্ষে মেলা। প্রতি বছর বহু লোকের সমাগম হয় এই মেলায়। মেলা হচ্ছে শুনে সবারই মেলা দেখার আগ্রহ হলো। ওরা আর কোনোদিকে না গিয়ে পছন্দমতো একটা নৌকায় চড়ে বসল পার হবার জন্য।

শিশির আর অধরা পাশাপাশি বসল। অধরার পাশে শাওলী, তার পাশে শাওন। উল্টোপাশে অদিতি আর বোনেরা৷ আরো লোক উঠেছে ওদের সাথে। সবাই গল্পগুজব করছে। নদীতে এখন জোয়ার এসেছে।স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে নৌকা। বড় বড় ঢেউ ধাক্কা দিচ্ছে নৌকায়। ভেসে যাচ্ছে দু’চারটে বিচ্ছিন্ন কচুরিপানা। পানিটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হলো অধরার৷ কিন্তু পানির রঙ মোটেও সুন্দর নয়। কালো পানি৷ এমন না যে এটাই পানির রঙ। বরং অদূরে ক্রমশ গজিয়ে ওঠা কলকারখানার বজ্র পানিকে ক্রমাগত দূষিত করে তুলছে৷ প্রকৃতির সেই স্বাভাবিকত্ব আজ কোথায়?

ঢেউয়ের ধাক্কায় এবার নৌকোটা বেশ জোরেই দুলে উঠল। শিশির খপ করে অধরার হাত ধরে ফেলল। ওদিকে শাওলী ওঠার পর থেকেই কাঁদো কাঁদো সুরে কেন উঠল সেজন্য নিজের ওপরেই অভিযোগ করে যাচ্ছে। শাওন ওর কথা শুনছে আর হাসছে। ওকে জড়িয়ে রেখেছে দুই হাত দিয়ে। তবুও শাওলীর ভয় কমছে না৷

শিশির আর অধরার হাতটা ছাড়ল না৷ অধরা ভাবল শাওন শাওলীকে ধরে রেখেছে বলে হয়তো শিশিরের ইচ্ছে করছে তার হাত ধরে রাখতে। এদিকে শিশিরের যে ভয় ভয় করছে সেটা সে স্বীকার করল না। শুধু শাওলী না, সে নিজেও প্রথমবার এরকম ডিঙি নৌকায় উঠেছে। এর আগে বড় বড় ইঞ্জিনচালিত বোট কিংবা জাহাজেও চড়া হয়েছে তার৷ তবে এতগুলো মানুষ নিয়ে এত ছোটো দোদুল্যমান নৌকায় বসে তার সত্যিই ভয় করতে লাগল। সে স্বর খাদে নামিয়ে অধরাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি সাঁতার পারো?”

“উঁ?” ভুরু তুলে তেরছা দৃষ্টিতে অধরা শিশিরের দিকে তাকাল। “ভয় পাচ্ছো নাকি? কী মনে হয় ডুবে যেতে পারি?”

“আরে নাহ, সাঁতার পারো কি না তাই জানতে চাইছি। সেফটি পারপাজে।”

“নাহ্! তুমি পারো?”

“হুম! কিন্তু এই স্রোতের মাঝে তোমাকে নিয়ে সাঁতরে পাড়ে যেতে পারব কি না সন্দেহ!”

“আশ্চর্য! কেন মনে হচ্ছে নৌকা ডুবে যাবে? কত লোক নিয়ে সারাক্ষণ পারাপার করছে তারা!”

“তাতে কী? দুর্ঘটনা হঠাৎই ঘটে।”

“তা ঠিক।” বলে অধরা আবার প্রকৃতি দেখায় মনোযোগ দিল। মুক্ত বাতাসে তার চুল উড়ে মুখের ওপর পড়ছে। সে চুলগুলো বারবার কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে। তার চোখ ওপাড়ে আবছা দেখা যাওয়া কাশবনের দিকে যেটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে নৌকা এগিয়ে যাবার সাথে সাথে। অধরার হাতভর্তি কাচের চুড়ি। স্বর্ণের মোটা মোটা চুড়িগুলো খুলে এগুলো পরে এসেছে সে। কাচের টুংটাং শব্দ হচ্ছে প্রতিবার হাত নাড়াচাড়ায়। ওর মুখে অদ্ভূত এক প্রশান্তি খেলা করছে। জগতের কোনোকিছু নিয়ে কোনো চিন্তা নেই, এক নির্ভার জীবন যেন তার!

শিশিরের এতক্ষণ ভয় পাওয়া মনটা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল স্ত্রীকে দেখতে। বিয়ের পর এক দিনেই কি মেয়েটা আরো সুন্দর হয়ে গেল নাকি?

নৌকা ওপাড়ে পৌঁছুতে হাঁপ ছাড়ল দু’জন। একজন প্রকাশ্যে, একজন গোপনে। শাওলী নৌকা থেকে নেমে প্রথম কথা যেটা বলল সেটা হলো, “অন্য কোনো উপায় নদী পাড় হতে না পারলে আমি এখানেই থাকব। ফিরে যাব না।” সবাই সমস্বরে হেসে উঠল ওর কথা শুনে।

ওরা মেলার দিকে না গিয়ে আগে কাশবনের দিকে গেল। এমনিতে এখন ফুলে ফুলে সাদা কাশবন লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে। তবে আজ বোধহয় ভ্রমনার্থীদের একটা বড় অংশ মেলার দিকে শিফট হয়ে গেছে৷ এদিকটা একটু নিরিবিলি দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া কাশেদের আয়ুষ্কালও শেষের দিকে। অত ঘন কাশের বন আর নেই। জায়গায় জায়গায় গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা ফুল হাসিমুখে এবছরের জন্য বিদায় নিতে চাচ্ছে।

কাশবন দেখে শাওলীর মন ভালো হয়ে গেল। সে সাদা রঙের জামা পরে এসেছিল। কাশের সাথে মিলে যাওয়ায় অনেক ছবি তুলল সে। মামাতো বোনেরাও নিজেরা নিজেরা ছবি তুলতে লেগে গেল। অদিতির প্রকৃতির ছবি তোলার শখ আছে। সে এঙ্গেল খুঁজতে লাগল যেখানে সাদা তুলোর মতো মেঘপূর্ণ আকাশের সাথে কাশবন সবচেয়ে ভালো দেখাবে, কোথায় নদী আর কাশফুল একসাথে ক্যাপচার করা যাবে। আর অধরা প্রকৃতির থেকে চোখ সরাতেই পারছে না। তার কৌতুহলী মুগ্ধ চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে৷ আর শিশিরের মোবাইলের ক্যামেরা অধরার অজান্তেই তার ক্যান্ডিড ছবি তুলে যাচ্ছে একের পর এক। সব মিলিয়ে সবারই মনটা সতেজ হয়ে গেল জায়গাটায় ঘুরে।

শাওনের তাড়া খেয়ে কাশবন থেকে বের হয়ে মেলার দিকে চলল সবাই। বছর ঘুরে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ ঝুঁকে পড়ছে সূর্যের দিকে। উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোতে ছোটো হয়ে আসছে দিন। সন্ধ্যার সাজে আকাশ সেজে ফেলেছে। আকাশের পটে ভেসে উঠেছে লালচে রেখা। লালচে রেখার নিচে বেগুনী লাইনিং, তার ওপর হালকা গোলপির শেড। আকাশটা রোজই যেন নবরূপে সাজে। খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসা সন্ধ্যাটা হাঁটতে হাঁটতেই যতটা সম্ভব ক্যাপচার করে ফেলল অদিতি।

ওরা যখন মেলায় ঢুকল তখন চারদিকে আঁধার নেমে গেছে। মেলায় চকমকে সব জিনিস দেখে ওরা অবাকই হলো। এদিকটা গ্রাম এলাকা। তবুও বেশ শহুরে কসমেটিক, গয়নাগাটির পসরা সেজে বসেছে। তাছাড়া তাঁতের শাড়ি, মাটির গয়না, খেলনা, খাবারের দোকানও আছে।

মামাতো বোনেরা জেঁকে ধরে শিশিরকে। বিয়ে উপলক্ষে তাদের ইচ্ছেমতো কেনাকাটা করে দিতে হবে। শিশির সম্মতি দিলে তারা খুশিমনে ঘুরতে শুরু করল। ওদের নজর দামী জিনিসের দিকে।

অধরার সেই মুহূর্তে মনে হলো শিশিরের কতগুলো খরচ হয়ে গেছে বিয়েতে। এমনিতেও ওদের অবস্থা পড়তির দিকে, তার মাঝে এত খরচা করে শেষে সমস্যায় পড়ে যাবে না তো সে? এখানে হয়তো খুব একটা খরচ হবে না, তবুও অভাবের সময় অল্প টাকাও অনেক কিছু। অধরার নিজের কাছে টাকা আছে। টিউশন ছেড়ে দেবার পর আন্টি ওকে বিয়ের উপহার হিসেবে বেশকিছু টাকা দিয়েছিলেন, বাবা কিছু টাকা দিয়ে দিয়েছেন আসার সময়। সে পার্সে ভর্তি করে টাকা নিয়েও এসেছে যদি লেগে যায় তাই ভেবে। অধরা হঠাৎ বলে বসল, “আজকে আমি ট্রিট দেব। তোমরা যা কিনবে বা যা খাবে আমি কিনে দেব, আমি খাওয়াব৷ এটা নতুন ভাবি হিসেবে উপহার।”

সবাই হৈ হৈ করে মেনে নিল। শিশির আপত্তি করলেও অধরা ওকে খুব একটা পাত্তা দিল না। অধরা সবাইকে পছন্দমতো জিনিস কিনে দিলেও শিশির অধরার জন্য লুকিয়ে একটা শাড়ি কিনে ফেলল। শাড়িটার কোয়ালিটি অত ভালো না হলেও রঙটা এত সুন্দর যে অধরাকে পরলে দারুণ লাগবে। অধরা নিজেই শাড়িটা পছন্দ করেছিল৷ কিন্তু দাম শুনে আর কোয়ালিটি দেখে রেখে দিয়েছিল। বলছিল, একবার ধুলেই শেষ। শিশিরের সত্যিই টাকাপয়সার এখন সমস্যা চলছে, তাই বলে বউকে এতটুকু দিতে সে আর দু’বার ভাবল না৷ একবার পরে ফেলে দিতে হলে দেবে, তাতে কী?

খাবারের দোকানে প্রচুর ভিড়। কোনোরকমে একটা চটপটির দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়ে অর্ডার দিতে পারল ওরা। চটপটিটা বেশ ভালো বানায় এরা৷ সবাই মজা করে খেলেও শাওলী প্রথমটায় খেতে চাইল না। সে বড় বড় রেস্টুরেন্টে খেয়ে অভ্যস্ত৷ এখানে খেতে তার খারাপ লাগছিল। শাওন জোর করে ওকে নিজের প্লেট থেকে দুই চামচ খাইয়ে দিলে শাওলীর এত ভালো লাগল যে সে নিজের জন্য এক প্লেট অর্ডার করে ফেলল। তারপর আরো এক প্লেট। তৃতীয় প্লেট অর্ডার করতে গেলে শাওন তাকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে এলো। পরে পেট খারাপ হলে আর দেখতে হবে না!

ওরা যখন ফেরার জন্য ঘাটে এলো তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। ঘড়িতে আটটা বাজে। তখনো সারি সারি নৌকা পারাপার হচ্ছে, তবে বিকেলের তুলনায় ভিড় কম। ওরা একটা নৌকায় চড়ে বসল যেটায় আর কেউ উঠল না৷ এবার খানিকটা নিরিবিলিতে যাওয়া গেল। ফুরফুরে বাতাস বইছে৷ বিকেলের মতো বড় বড় ঢেউয়ের ধাক্কা নেই। নদী এখন শান্ত। দূরে দূরে একেকটা নৌকার আলো ভেসে আছে জলের মাঝে। দু’দিন আগেই অমাবস্যা গেছে। শুক্লপক্ষের চিকন চাঁদটা ডুবে গেছে এরই মধ্যে। আকাশ ভর্তি শুধু তারা। চাঁদ না থাকায় তারাগুলো আরো প্রকট হয়ে দৃশ্যমান। সবাই খোলা নৌকায় বসে তারা দেখতে লাগল মুগ্ধ হয়ে। শহুরে মানুষ সবাই। এই নির্জন গ্রামের প্রান্তে শহুরে জমকালো আলোর ভিড় নেই বলেই তারার আলো এত সুন্দর হয়ে ধরা দিয়েছে। এক আকাশে এত তারা ওরা এর আগে দেখেনি। ফেরার সময়টা এত সুন্দর ছিল যে শাওলী পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে গেল।

ওরা ঘাটে নেমে যখন হেঁটে বাড়ি ফিরল তখনো কেউ কোনো কথা বলল না। শিশির তখনো অধরার হাত ধরে রেখেছে।

মায়ামঞ্জরীর কাছাকাছি যখন ওরা এলো, দেখল বড় বড় কয়েকটা গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে। কারা এসেছিল এখানে?

ভেতরে ঢুকতেই মাকে গেটের সামনে দেখা গেল। মুখ গম্ভীর। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে আছেন তিনি। শিশির এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কারা এসেছিল মা?”

মা কঠিন গলায় বললেন, “তোর চাচা চাচীরা। দেড় ঘন্টা বসে থেকে গেছেন নতুন বউ দেখবে বলে। নতুন বউয়ের এরকম গ্রাম্য এলাকায় এত রাত বিরাতে ঘুরে বেড়ানো নিয়ে কতকিছু ইনিয়ে বিনিয়ে শুনিয়ে গেলেন তোর চাচীরা। এমনিতেই এখন তারা কথায় কথায় দেমাগ দেখায়। কত অপমান হলাম তাদের সামনে! আর কতকিছু যে দেখতে হবে আল্লাহ জানে!”

মা গজগজ করতে করতে চলে গেলেন ভেতরে৷ রাত এখন প্রায় নয়টা বাজে। অধরার আগে থেকেই খারাপ লাগছিল এতক্ষণ বাইরে থাকতে। কিন্তু সবার এত আনন্দের মাঝে সেটা বলতে পারছিল না সে। এখন খুব খারাপ লাগতে লাগল মন৷ ভ্রমণের আনন্দ যেন মাটি হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তেই।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু