#মায়ামঞ্জরী
পর্ব- ৩০
পরদিন ভোরে জমজমাট বাড়িটা খালি হয়ে গেল। মামা মামী মেয়েদের নিয়ে চলে গেলেন৷ শাওন চলে গেল ডিউটিতে। সাথে শাওলীকেও নিয়ে গেল তার বাবার বড়িতে দিয়ে আসবে বলে। শিশির সকাল সকাল বাজার করে দিয়ে চলে গেল অফিসে। বাড়িতে রয়ে গেল শুধু অধরা, মা, বাবা আর রুনু খালা।
সবাইকে নাস্তা খাইয়ে বিদায় দেয়ার কাজটা অধরাই করল। মায়ের মেজাজ গতকাল খারাপ ছিল, তা থেকে প্রচন্ড মাথাব্যথা হয়েছে। সকালে আর উঠতেই পারেননি। রুনু খালার অভ্যাস নেই মেহমান সামলানোর। তবে তিনি সাহায্য করলেন যতটা সম্ভব৷
সকালের কাজ শেষে নাস্তা করে অধরা চা বানালো। গরম পানিতে বেশি করে আদা, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ থেতলে দিয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে চা পাতি দিয়ে নামিয়ে নিল। ট্রে হাতে উঁকি দিল মায়ের ঘরে। মা বিছানায় শুয়ে আছেন। এক হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছেন। বাবা জানালার পাশে বসে একটা বই পড়ছেন। অধরা চায়ের ট্রে বেডসাইড টেবিলে রেখে বলল, “মা, আপনার জন্য মসলা চা বানিয়েছি৷ খেলে আপনার ভালো লাগবে।”
মা চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে অধরার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে চাইলেন৷ গতকালের রাগ তার এখনো যায়নি৷ শুধু অধরা না, শাওন, শিশির, প্রত্যেকের ওপরে তিনি বিরক্ত হয়ে আছেন৷ আক্কেল বলে কিছু নেই এদের? ছেলেরা নাহয় বোঝে না, মেয়েটাও বুঝবে না নাকি? জা’দের মধ্যে এতদিন তার অবস্থাই সবচেয়ে ভালো ছিল। এই এরাই তাকে কত খাতির করে চলত, খুশি রাখার চেষ্টা করত! আর এখন ছোটো করে কথা বলতে একটুও বাঁধে না। অর্থবিত্ত, প্রতিপত্তি চলে গেছে বলে সাধারণ ঘরের মেয়ে বিয়ে করিয়েছেন, সেই মেয়ে পরিবারের সম্মানের কথা ভাববে কী, তাদের চালচলন বুঝবেই না, এধরনের অনেক কথা বলেছে ওরা। তিনি জবাব দিতে পারেননি। কখনোই পারেন না। স্বভাবে বড্ড নরম তিনি। তবে ভেতরে থাকা কষ্টটা তাই ফুটন্ত পানিতে বাষ্পের বুদবুদের মতো ফুটছে। অধরার বানিয়ে আনা চা তার খেতে ইচ্ছে হলো না৷ কিন্তু ভাবলেন চা খাবার সুযোগে মেয়েটাকে কিছু কথা বোঝানোর প্রয়োজন আছে। তিনি উঠে বসলেন। বললেন, “বসো, কথা আছে।”
অধরা ততক্ষণে বাবাকে এক কাপ চা দিয়ে এসে বসল মায়ের পাশে। মা চায়ে চুমুক দিলেন৷ চুমুক দিয়ে তার মন কিছুটা শান্ত হয়ে এলো। এক চুমুকেই মাথাটা একটু হালকা হলো যেন। তবুও তিনি রাগটা দমে যেতে দিলেন না। গলা পরিষ্কার করে পূর্ণ দৃষ্টিতে অধরার দিকে চেয়ে বললেন, “দেখো, বিয়ে মানুষের দায়িত্ব অনেক বাড়িয়ে দেয়। তুমি নিজের বাড়িঘর, বাবা মা ছেড়ে এসেছ, জানি অনেক কষ্ট হবে মানিয়ে নিতে। কিন্তু যত দ্রুত তুমি এই বাড়ি আর বাড়ির মানুষগুলোকে আপন করে নিতে পারবে তত তোমারই ভালো হবে। আর আপন করে নেয়া মানেই দায়িত্ব বাড়িয়ে নেয়া। বাড়ির অতিথিদের সম্মান করা, কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলা, সবাইকে ভালোবাসা। গতকালের কাজটা ভালো হয়নি তুমিও জানো৷ এটা নিয়ে আমি জলঘোলা করতে চাই না। শুধু বলব, এরপর থেকে এসব ছোটো ছোটো বিষয় খেয়াল রাখবে। আমরা তোমার থেকে খুব বেশি কিছু আশা করি না৷ বাড়ির বউদের আমরা মেয়ের মতোই যত্ন করি। শাওলী কোনোদিন শ্বশুরবাড়িতে একটা কাজও ছুঁয়ে দেখেনি৷ তুমিও যদি সেই পথে হাঁটো আমার কিছুই বলার থাকবে না। আমি কোনো পার্থক্য করব না দু’জনের মাঝে। কিন্তু তোমার কারনে কোনো ধরনের অসম্মান যেন এই পরিবারের না হয় সেটা সবসময় খেয়াল রাখবে।”
অধরা চুপচাপ শুনল। তার বলতে ইচ্ছে হলো, পরিবারের সম্মানের বিষয়ে সে নিজেই সচেতন। আর চাচা চাচীরা আসবেন সেটা তো আগে জানা ছিল না যে ওরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। বরং আগে জানলে সে যেতই না। ওই জায়গায় নেটওয়ার্ক ছিল না বলে ওদের কাউকে ফোনেও পাওয়া যায়নি। সব তো তার দোষ হতে পারে না। তবে সে আগুনে ঘি ঢালার জন্য মুখ খুলল না। অভদ্রতা সে করতে পারে। নিজের মায়ের মুখের ওপর কথা বলতেই বাঁধে, আর ইনি তো শাশুড়ি।
কথাগুলো বলে চা শেষ করে মা আবার শুয়ে পড়লেন৷ অধরার শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে তার একটু খারাপ লাগছে। কিন্তু এখন আহ্লাদ দেখালে কথাগুলো বলার কোনো অর্থ থাকবে না।
অধরা মা বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাগানে চলে গেল। নিজের জন্যও চা বানিয়েছিল সে, কিন্তু খাওয়ার ইচ্ছে নষ্ট হয়ে গেছে। বরং গাছগুলোর খানিক পরিচর্যা করে মন ভালো করা যাক৷
আপনমনে কাজ করছিল অধরা। এই বাড়িতে অনেক কাঠবিড়ালি। গাছে গাছে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে এরা। দেখতে এত ভালো লাগে! সে কাজ করতে করতে গুনগুন করে একটা সুর ভাজছিল, সাথে কাঠবিড়ালিদের খেলার দিকেও মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ কারো শুনে চমকে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে।
বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন। অধরা চমকে যাওয়াতে হেসে বললেন, “ভয় পেয়েছ?”
অধরা লজ্জা পেয়ে বলল৷ “না না বাবা, ভয় পাইনি।”
“শিশিরের কাছে শুনেছি তোমার বাগান করার খুব শখ। আমার নিজেরও ভালো লাগে বাগান৷ কিন্তু তোমার শাশুড়িটা একেবারেই নিরামিষ। তার গাছপালা নিয়ে কোনো কারবার নেই। তাই বাগানের আশা মনের মধ্যেই ছিল। এখন একজন পাওয়া গেল বাড়ি সাজানোর মতো।”
অধরা হাসল, কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না৷
বাগান বলতে গাছগুলো এখনো সেরকম সাজানো হয়নি৷ এলোমেলো হয়ে টবগুলো পড়ে আছে। সব ঠিকঠাক করতে অনেকটা সময় দিতে হবে। তবুও বাবা ঘুরে ঘুরে সবগুলো গাছ দেখলেন৷ দুয়েকটা গাছ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। অধরা উত্তর দিল।
শেষে তিনি বললেন, “মন খারাপ করে থেকো না৷ তোমার মাকে দেখবে একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। গতকালের ঘটনাটাতে সে খুব শক পেলেও আমি কিন্তু খুশি হয়েছি।”
বাবার কথা শুনে বেশ অবাক হলো অধরা। “খুশি হয়েছেন মানে?” না বলে পারল না সে।
“তোমার মাকে তো বলিনি ঘটনা। যখন আমাদের বিজনেসের খারাপ অবস্থা সে সময়ে একবার আমার ছোটো ভাইয়ের কাছে কিছু টাকা ধার করতে গিয়েছিলাম৷ অবস্থা তখন একেবারেই খারাপ। যেদিন আমার স্ট্রোক হলো সেদিনকার কথা। সেদিন আমার ভাই আমার সাথে দেখা করেনি। আমিও ঠিক দেড় ঘন্টা এদের ড্রইংরুমে বসে ছিলাম। তারপর ফিরে এসেছি। সময় প্রতিশোধ নিয়ে নেয়। তোমার দ্বারা তোমার অজান্তেই একটা কাজ হয়েছে যেটা অন্তত আমাকে অদ্ভূত আনন্দ দিচ্ছে।”
অধরা কষ্ট পাবে নাকি খুশি হবে বুঝতে পারল না। তবে বাবার চোখে বাচ্চাদের মতো আনন্দ দেখা যাচ্ছে। যেন কোনো কম্পিটিশনে হারতে হারতে জিতে গেছেন। সেটা দেখে অধরার মনটা আক্ষরিক অর্থেই ভালো হয়ে গেল।
সে বলল, “বাবা, আপনি মাকে কিছু বলেননি কেন?”
“বললে সে খুবই কষ্ট পাবে৷ নিজের অপমানের চেয়ে আমার অপমান তাকে অনেক বেশি আঘাত করবে। তুমিও কিছু বলো না। সে যদি তোমাকে কষ্ট দিয়ে দু’চারটে কথা বলে ফেলে তবুও না। প্লিজ! তার হয়ে আমি নাহয় ক্ষমা চাইছি।”
অধরার চোখে পানি চলে এলো৷ এরকম একজন মানুষের কাছে এতটা বিনয় সে আশা করেনি। মাথা নিচু করে শুধু বলল, “বলব না বাবা। কাউকেই বলব না।”
বাবা আরো কয়েকটা কথা বলে চলে গেলেন। অধরা আপাতত কাজগুলো সমাপ্ত করে চলে গেল একটু জিরিয়ে নিতে। তার ইচ্ছে আজ দুপুরের রান্নাটাও সে করবে। শিশির সবসময় বলত রুনু খালার রান্না ভালো না। অধরার ইচ্ছে যে ক’টা দিন সে আছে, ততদিন নিজেই রাঁধবে। ওর ক্লাস শেষ হয়ে গেছে৷ পরীক্ষার আগে এক মাসের প্রিপারেটরি লিভ দিয়েছে, এর মধ্যেই বিয়ে হলো। সময় কম। এক সপ্তাহ এখানে থেকে গেলে হাতে থাকবে পনেরো দিন। খুব পরিশ্রম করতে হবে তখন। এরপর পরীক্ষার প্রায় এক মাস তো আছেই। দেড় মাস পর ফের আসা হবে মায়ামঞ্জরীতে। তখন তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা হলেও এখন মনে হচ্ছে একেবারে পরীক্ষা শেষে বিয়েটা হলেই ভালো হতো। শিশিরকে ছেড়ে যেতে হবে বলে এখনই খারাপ লাগছে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৩১
ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। অধরা যখন রান্নাঘরে গেল তখন রুনু খালা সবে মাত্রই সকালের আনা বাজার ঢেলে বসেছেন রান্নার ব্যবস্থা করতে। তিনি নিজেই অতটা সুস্থ নন। সকালে খেয়ে একটু শুয়ে না নিলে কোমর সোজা করতে পারেন না। অধরা যখন বলল সে আজকের রান্না করবে, তখন খালা খুবই খুশি হয়ে বললেন, “করো মা, পারলে করো৷ আমি আর পেরে উঠি না। জীবনে কি রান্না করেছি নাকি? কী রান্না করব তাই বুঝি না। একটা কিছু করে রাখি যা পারি। প্রায়ই আপা, ভাই কেউ মুখে তুলতে পারে না৷ আবার আপা নিজেও এদিকে আসে না৷ তার নাকি এই রান্নাঘর দেখলে খালি কান্না আসে।”
অধরা একবার চারদিকে তাকাল। এই রান্নাঘরের একটা স্নিগ্ধ ব্যাপার আছে। শিশিরদের আগের বাড়ির মতো অত্যাধুনিক সরঞ্জামে ঘেরা ঝকঝকে তকতকে রান্নাঘর এটা নয়, তবে এতও খারাপ নিশ্চয়ই নয়। তবুও মায়ের অনুভূতি হয়তো সে চাইলেও বুঝতে পারবে না। কারন নিজের রান্নাঘর শুধু সাজ সরঞ্জামের জন্য নয়, তার সাথে যে আবেগ জুড়ে থাকে তার জন্যও অনেক প্রিয়। তাছাড়া মায়ের মানসিক অবস্থাও হয়তো ভালো নেই সব মিলিয়ে।
এদিকে বাবাও অতটা সুস্থ নন। তার ভালো খাবারদাবার প্রয়োজন। অধরার মনে হলো, পরিবারটা কোনোরকম চলছে। এখানকার সবকিছুই ছন্নছাড়া।
তাদের নিজেদের বাড়িতে এতক্ষণে মায়ের অর্ধেক রান্না হয়ে গেছে হয়তো। এর মাঝে মা ঘরদোর গুছিয়ে ফেলেছেন, ছুটা বুয়া এসে ঘর ঝাঁট দিয়ে মুছে দিয়ে গেছে। অদিতি হয়তো ক্লাসে চলে গেছে। না, আজ ও ক্লাসে যাবে না বলে গেছে। ভোরে শিশিরের সাথে বেরিয়ে গেছে সে। শিশির তাকে বাড়ির কাছে ছেড়ে দিয়ে অফিসে চলে গেছে। ও হয়তো এখন পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। কিংবা কোনো অর্ডার পেয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ওদের ছোটো রান্নাঘরে ওর আর মায়ের কাজ করা নিয়ে ঠেলাঠেলি হচ্ছে। ও হয়তো কেকের কাজ করছে, মা কোনো ফল কেটে নিয়ে এসে ওর মুখে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ভাবতে ভাবতে ঢোক গিলল অধরা। চোখে পানি চলে এসেছে। বুকে ব্যথা করছে মৃদু। নিজেকে বোঝাল সে, এই তো মাত্র পাঁচদিন পরেই সে বাড়ি যাবে।
মেঝেতে ছড়ানো বাজারগুলোর দিকে চাইল সে। শীতের সবজি উঠে গেছে। আলু, শিম, ফুলকপি, টমেটো আর পালং শাক আনা হয়েছে। এছাড়া ফ্রিজ খুলে মিষ্টি কুমড়া পাওয়া গেল। ডিপ ফ্রিজে মাছমাংসও আছে। সে রুনু খালাকে জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কাটা, ধোঁয়া সব আপনি করেন?”
“বড় মাছ তো কেটেই আনে, আমি শুধু ধুয়ে রাখি। এই বাড়ির কেউ ছোটো মাছ খায় না৷ আর মুরগি কাটতে হয়।”
“আজ কী রান্না করা যায় বলুন তো?”
খালা হেসে মাথা নেড়ে বললেন, “জানি না গো, জানি না। তোমার রান্না তুমিই ভাবো। এই ভেবে ভেবে মাথা আবার খারাপ হয়ে গেছে।”
অধরা হেসে ফেলল। তার নিজেরও কনফিউজড লাগছে। কী রাঁধবে? সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে মা’কে ফোন করল।
মা ওকে আইডিয়া দিলেন অনেকগুলো। এছাড়াও অনেক গল্প হলো ওদের। ফোন রেখে অবাক হয়ে গেল অধরা। আধঘন্টা কথা বলে ফেলেছে! আগে তো কোথাও গিয়ে মাকে ফোন করলে পাঁচ মিনিটও কথা হতো না। সব গল্প জমা থাকত বাড়িতে গিয়ে চা খেতে খেতে বলার জন্য। এখন বুঝি অবচেতন মন বুঝতে পেরেছে, সেই পথ বন্ধ।
বারোটা বেজে গেছে। দ্রুত হাত চালাল সে। চিংড়ি দিয়ে পালং শাকের ঝোল, রুই মাছ দিয়ে আলু-শিম-ফুলকপির তরকারি, মিষ্টি কুমড়া ভাজি আর ডাল। এসব করতে করতে প্রায় আড়াইটা বেজে গেল। অধরা ঘড়ি দেখে জিভ কেটে বলল, “ইশ! সবার ক্ষুধা লেগে গেছে কত! আরো আগে শুরু করা উচিত ছিল।”
রুনু খালা মলিন গলায় বললেন, “আজ তো আগেই হলো, আমার রাঁধতে রাঁধতে তিনটাও বেজে যায়। খেতে খেতে চারটা। তুমি তাড়াতাড়ি গোসল করে আসো, আমি খাবার বেড়ে ফেলি।”
“হুম যাই।”
সবাই একসাথেই খেতে বসল। বাবা বেশ আরাম করে খেলেন৷ মন খুলে প্রশংসাও করলেন। মা রান্না নিয়ে তেমন মন্তব্য না করলেও তার যে রাগ পড়ে গেছে এটা বোঝা গেল। স্বাভাবিক গলাতেই টুকটাক কথা বললেন অধরার সাথে। তবে শেষ পাতে ডাল নিয়ে খেতে খেতে চোখ বুজে ফেললেন৷ চোখ খুলে অধরার দিকে চেয়ে বললেন, “আমার মায়ের ডালটা ঠিক এরকম হতো। কোথায় শিখলে বলো তো?”
******
বিকেল বেলাটা এলো একঝাঁক পাখির ডাক আর সোনা রঙা আলো নিয়ে। টানা বারান্দায় হেলানো চেয়ারে একটা বই নিয়ে বসল অধরা৷ কিন্তু বই পড়া হলো না। খোলা বইটা বুকের ওপর রেখে সে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল গাছে গাছে পাখিদের ছোটাছুটি, গান আর চেঁচামেচি। কাঠবিড়ালিও দেখা যাচ্ছে। স্বল্পায়ু বিকেলের রোদ কমলা হয়ে আসছে ক্রমশ। বাতাসটা সতেজ। নদী কাছে বলে এমন প্রবল বাতাস কি না কে জানে! পুরো দোতলায় সে একা। নিজেকে খুব ফুরফুরে লাগছে। নেচে বেড়াতে ইচ্ছে করছে অকারনেই।
তবুও ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত একাকীত্ব কাজ করছে৷ এত একা সে কখনো থাকেনি। যেন পুরো জগতেই সে একা। সাথে পাখি আর কাঠবিড়ালিরা। মানুষের বাড়ি এত নিস্তব্ধ হতে পারে? মা, বাবা, রুনু খালা, সবাই যার যার মতে শুয়ে আছে হয়তো ঘরে। শিশির থাকলে এখন দুকাপ চা নিয়ে বসে জমিয়ে প্রেম করা যেত। ইশ! শিশির কখন আসবে? অফিসে যাবার পর একবার ফোন করেছিল সে। এরপর কয়েকবার মেসেজে কথা হয়েছে৷ শেষবার কথা হয়েছে একটু আগেই। জানিয়েছে আজ আসতে দেরি হবে। বিয়ের কথা শুনে কলিগরা নাকি ট্রিট চেয়েছে। এতক্ষণ এখানে একা একা থাকতে হবে ভেবে চোখে পানি চলে আসতে চাইছে৷ সন্ধ্যা হয়ে গেলে তো পুরোপুরি কবরখানা হয়ে যাবে এই এলাকা।
বসে বসে তন্দ্রামতো চলে এসেছিল, হঠাৎ একটা শব্দে চমকে জেগে উঠল সে। কিসের শব্দ প্রথমে বুঝতে পারল না৷ নিচ থেকে এসেছে শব্দটা। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে রেলিংয়ে ভর দিয়ে নিচে তাকাল সে। তাকিয়েই মনটা অপ্রত্যাশিত আনন্দে নেচে উঠল। শিশির চলে এসেছে! তবে কি দেরিতে আসার কথা বলে ওকে সারপ্রাইজ দিল? শিশির ওপরদিকে চেয়ে ওকে দেখে হাসল। অধরা এই শেষ বিকেলের আলোয় বোধহয় এই প্রথমবার খেয়াল করল হাসলে শিশিরকে ভীষণ সুন্দর লাগে! ওর আকাশী-নীল শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো, ফর্সা হাতে গাঢ় কালো রঙের ঘড়ি, চুলগুলো সামান্য এলোমেলো। ওকে দেখে অধরার পেটের ভেতর যেন প্রজাপতি উড়তে লাগল। হাত পা অবশ হয়ে আসতে চাইল। আগে তো কখনো হয়নি এমন! এ কেমন অনুভূতি! যেন কতদিন পর সে মানুষটাকে দেখল।
অধরা নিজের অজান্তেই ছুটে গেল নিচের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকল তড়িৎগতিতে। শিশিরও উঠছিল৷ তাকে প্রবল বেগে নামতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। পরক্ষণেই আস্ত একটা মানুষ ঝর্ণার মতো আছড়ে পড়ল তার বুকে৷ অধরার ধাক্কায় সামান্য পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল সে। তারপর জড়িয়ে ধরল ওকে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৩২
সন্ধ্যার পরপর বাড়িটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। অধরার এটাই আশঙ্কা হচ্ছিল। শহরের জাঁকালো আলো নেই, আশেপাশে বাড়িঘর নেই, লোকের কোলাহল নেই, শুধু আছে নিশিপোকাদের ডাক আর রাতের ছমছমে নিরবতা। সে নিচে নেমেছে চা বানাতে। দু’বেলা চা না খেলে তার ভালো লাগে না। সকালে মন তেঁতো হয়ে যাওয়াতে চা খাওয়া হয়নি। এখন না খেলে চলছে না৷ শিশির গেছে গোসল করতে। এই সুযোগে সে চলে এসেছে চা নাস্তার ব্যবস্থা করতে৷ এই বাড়িতে সন্ধ্যায় নাস্তা বা চায়ের আয়োজনও বোধহয় হয় না। সে একবার মা বাবার ঘরে গিয়ে দেখে এসেছে তারা কী করছেন৷ মা তখনো সকালের মতো শুয়ে আছেন৷ আর বাবা বই পড়ছেন। অধরার মনটা বারবার খারাপ হয়ে যায় ওদের এই নির্জিব জীবনের দিকে তাকালে। ইচ্ছে করে একটু রং ঢেলে দিতে। কিন্তু কী করে সম্ভব?
রান্নাঘরটা যেন আরো বেশি গা ছমছমে। জানালার বাইরে একটা প্রাণী তারস্বরে ডাকছে! ছোটোবেলায় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এই ডাক শুনেছে সে। তক্ষকের ডাক৷ এ কোন জঙ্গলে আসা গেল রে বাপু! এজন্যই শাওলী দু’দিন থেকে পালায়৷ কিন্তু তার তো পালালে চলবে না। নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করে পালানো যায়ও না৷ আর তার ইচ্ছেও নেই। তবে এই মুহূর্তে ভয় ভয় লাগছে। অধরা ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে কাজে মন দিল।
চা বসিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগল নাস্তার জন্য কী করা যায়৷ রান্নাঘরে বিস্কুট বা কেক জাতীয় কিছুই পাওয়া গেল না৷ ময়দা আছে৷ মোগলাই পরোটা বানিয়ে ফেলা যায়। ভাবনারা আসতেই অধরা আর দেরি করল না। কাজ শুরু করে দিল। আবার মনে হলো, বাবা কি তেলে ভাজা জিনিস খেতে পারবেন? জিজ্ঞেস করতে ছুটল তাদের ঘরে। বাবা শুনেই বললেন, “নিষেধ টিষেধ বাদ। কতদিন খাই না ওসব। বানালে তো ভালোই হয়।”
অধরা আবার এসে কাজে মনোযোগ দিল। কিন্তু বাইরের তক্ষকের ডাকটা ক্রমশ যেন কানের কাছে চলে আসছে। বাইরে শো শো বাতাস শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যে। শীতল বাতাস। বৃষ্টি হবে রাতে। জানালার পাল্লা একটা আরেকটার সাথে ধাক্কা খেয়ে খটাখট শব্দ করছে। অধরার হাতে ময়দা মাখা বলে জানালা বন্ধও করতে পারছে না৷ তার গা ছমছমে ভাবটা প্রতিবার বাতাসের ঝাপটার সাথে সাথে বাড়ছে।
হঠাৎ তার মনে হলো থপ করে যেন জানালার বাইরে থেকে কিছু ভেতরে এসে পড়ল। অধরা পেছনে তাকানোর সাহস করতে পারল না৷ জিনিটা কি তার দিকে আসছে? হালকা পায়ের শব্দ হচ্ছে। বেড়াল কি? এদিকে সাধারণ বেড়াল থাকবে নাকি বনবেড়াল? ভাবার সময় পেল না আর সে। ঝপ করে জিনিসটা তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরল৷ অধরা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। জিনিসটাও ওকে ছেড়ে দিয়ে সরে গেল। অধরা পেছনে তাকিয়ে দেখল জিনিসটা আর কিছু নয়, শিশির!
বেচারা একটু প্রেম করতে এসে একেবারে হকচকিয়ে গেছে। অবাক হয়ে চেয়ে আছে অধরার দিকে৷ এদিকে অধরার চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই চলে এসেছে রান্নাঘরে। অধরার ইচ্ছে করল লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে! ইশ এটা কী হয়ে গেল?
সবাই জিজ্ঞেস করতে লাগল, “হয়েছেটা কী?”
শিশির কিছুই বলল না৷ চুপচাপ অধরার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অধরা ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “ট…ট…টিকটিকি… হঠাৎ গায়ের ওপর এসে পড়েছে।”
কথাটা শুনে একেকজনের একেক রকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। বাবা ওর কথা শুনে হো হো করে হেসে ফেললেন। মা নাক কুঁচকে চারদিকে দেখতে লাগলেন৷ রুনু খালা খুশি হলেন এই ভেবে যে টিকটিকিটা অধরার গায়ে পড়েছে, খাবারে পড়েনি। আর শিশির চোখ গরম করে ওর দিকে চেয়ে রইল।
বাকিরা খানিকক্ষণ থেকে চলে গেলেন। শুধু শিশির রয়ে গেল। সবাই বের হয়ে যেতেই কটমট করে অধরার দিকে চেয়ে বলল, “আমাকে টিকটিকি বললে তো?”
অধরা মুখ টিপে হেসে বলল, “স্যরি!”
“তুমি আগে বলো চেঁচালে কেন? আমি কি গুন্ডা বদমাশ নাকি তোমার বিয়ে করা বর? তুমি যখন একটু আগে প্রজাপতির মতো উড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলে তখন কি আমি চিৎকার করেছি?”
“না না ভুল বুঝছ কেন? আমি ভেবেছিলাম আমাকে জাপটে ধরেছে একটা বনবেড়াল।”
“হোয়াট? বনবেড়াল কোথা থেকে এলো?”
“মনে হয়েছে। আমার কী দোষ? বাড়িটাই সন্ধ্যার পর এমন ভুতুড়ে হয়ে গেছে।”
“সেজন্য আমার রোমান্সের বারোটা বাজিয়েছ। কোথায় ভাবলাম সুযোগ বুঝে একটু প্রেম করে আসি। আর সে আমাকে একবার টিকটিকি বানাচ্ছে, একবার বনবেড়াল বানাচ্ছে। ধুর!”
অধরা নরম চোখে শিশিরের দিকে চেয়ে ওর দিকে এগিয়ে এলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে শিশিরের খুব কাছাকাছি চলে এলো। চোখ চোখ রাখল। শিশির ওর কোমরে হাত রাখতে যাচ্ছিল, তার আগেই সে চট করে ময়দা মাখা হাত দিয়ে শিশিরের নাকে ময়দা মাখিয়ে দিয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে সরে গেল।
শিশির নাকের ময়দা মুছতে মুছতে বলল, “আজ শাওন ভাইয়া ভাবিদের বাড়িতে যাবে৷ এখানে আসবে না৷ দোতলার পুরোটায় তুমি আর আমি একা। দেখব আজকে তোমাকে এই বনবেড়ালের হাত থেকে কে বাঁচায়! আজকে তোমার খবর আছে।”
অধরার কৃত্রিম ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “না না প্লিজ! আমার এমন সর্বনাশ করো না।”
শিশির উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “বনবেড়ালরা কোনো কোনোকিছু কনসিডার করে না। তৈরি থেকো খুন হবার জন্য।”
অধরা আর কিছু বলতে পারল না৷ সে ভীষণ লজ্জায় একেবারে চুপ হয়ে গেল।
শিশির রুনু খালাকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিল অধরা যাতে আবার ভয় না পায় সেজন্য। নিজে মা বাবার ঘরে চলে গেল। মায়ের সাথে গতকালের পর কথাই হয়নি৷ এখন রেগে বোম হয়ে না থাকলেই হয়।
মা শুয়েছিলেন৷ শিশিরকে দেখে উঠে বসলেন৷ বাবাও এগিয়ে এসে বসলেন৷ হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “তো ইয়াং ম্যান, কেমন লাগছে বিয়ে করে?”
শিশির হেসে বলল, “ভালোই তো লাগছে।”
মায়ের রাগ সকালেই পড়ে গেছে। গতকালের ব্যাপারটা তাই আর তুললেন না। অন্যান্য বিষয়ে কথা বলতে লাগলেন৷
ওদের গল্পের মাঝেই অধরা চা নাস্তা নিয়ে এলো। মা বাবার ঘরে বসেই খাওয়া হয়ে গেল। গল্পগুজব চলল৷ বাবা আর শিশির মিলে খানিকটা হাসি মজাও করলেন৷ সব মিলিয়ে সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ পেয়ে এতক্ষণে অধরার বুকের ভেতরটা একটু হালকা লাগতে লাগল।
******
রাতের খাবার শেষ হতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির সাথে বাতাসটা এত কনকনে ঠান্ডা যে দু’মিনিট বারান্দায় এসে দাঁড়াতে পারল না অধরা। ঘরে ঢুকে বারান্দার দিকের দরজা বন্ধ করে দিতে হলো। শিশির ল্যাপটপে কী যেন কাজ করছে। অধরা ওর মোবাইলটা নিয়ে বসল। দেখল শিশির কিছুক্ষণ আগে ম্যারিড স্ট্যাটাস দিয়েছে। সেখানে লাভ রিয়েক্টের চেয়ে স্যাড রিয়েক্ট বেশি। প্রচুর মেয়ে কমেন্ট করেছে, “মানি না”, “দিল টুট গ্যায়া”, ” তুমি এমনটা করতে পারলে শিশির?”, “আই হেইট ইউ”, “তুমি একটা স্বার্থপর ছেলে”, ” আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য তুমি দাওনি, তোমার ভালোবাসার মূল্যও পাবে না” ইত্যাদি!
অধরার চোখ কপালে উঠল। সে মোবাইলের স্ক্রিনটা শিশিরের দিকে ফিরিয়ে বলল, “এসব কী?”
শিশির মুখ টিপে হেসে বলল, “সবাই বনবেড়ালের ভালোবাসা পেতে উদগ্রীব হয়ে ছিল৷ কিন্তু বনবেড়াল চেয়েছিল তার বেড়ালীকে। তাই সবাই কষ্ট পেয়েছে।”
অধরা মুখ গোমড়া করে বলল, “কাজ বাদ৷ এদের এখনই আনফ্রেন্ড করো।”
“কেন? ওরা আমার সব পোস্টে লাইক কমেন্ট করে৷ ওদের আনফ্রেন্ড করলে কী করে হবে?”
“ও আচ্ছা! তোমার কাছে লাইক কমেন্টটাই বড় হয়ে গেল? আর ওরা যে আমাদের নজর লাগিয়ে দিচ্ছে তার কী হবে?”
“ধুর! নজর লাগালাগি বিশ্বাস করি না।”
“প্লিজ! আমার জন্য করো…”
শিশির দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, “করব, এক শর্তে।”
“কী শর্ত?”
“তোমাকে এই পোস্টে ‘I love you’ লিখে কমেন্ট করতে হবে।”
অধরা গরম হয়ে বলল, “দেখো, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু! এসব শর্ত মানব না।”
“আমিও কাউকে আনফ্রেন্ড করব না।”
অধরা রাগ করে উঠে চলে গেল জানালার ধারে। একটা পাল্লা খুলে দিল। বৃষ্টির ছাট আছে। ঠান্ডা বৃষ্টিকণা গায়ে লাগতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। তবুও জানালা বন্ধ করল না সে। এখন সত্যিই মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
হঠাৎ বিদ্যুতের চমকে চারদিক আলো হয়ে গেল। পরক্ষণেই বজ্রপাত হলো। ছিটকে জানালার সামনে থেকে সরে গেল অধরা। তখনই পুরো বাড়ির আলো নিভে গেল। লোডশেডিং হয়েছে। বারবার বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল আর তারপরেই চারদিক ঘুটঘুটে আঁধার৷ অধরা জানালার পাল্লাটা কোনোমতে বন্ধ করে দিয়ে ছুটে গেল বিছানার দিকে। গিয়ে একেবারে শিশিরের কোলের ওপর পড়ল।
শিশির আগেই ল্যাপটপ রেখে দিয়েছিল। অধরা ওর ওপরে এসে পড়তেই সে ওকে জাপটে ধরে বলল, “বলেছিলাম না তুমি আজকে শেষ!”
অধরা শিশিরকে আরেকটু ভালোমতো জড়িয়ে ধরে বলল, “না প্লিজ! ক্ষমা করো আমাকে।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু