মায়ামঞ্জরী পর্ব-৩৩+৩৪+৩৫

0
2

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৩৩

মায়ামঞ্জরীতে দ্বিতীয় দিনে খানিকটা মন খারাপের বাতাস ছুঁয়ে থাকলেও তার পরদিন থেকে বইতে লাগল ঝিলমিলে রোদ। যেন শরতের শেষাশেষি হেমন্ত নিয়ে এলো মিষ্টি দিনের বার্তা৷

পরদিন সকালটা কাটল স্বপ্নের মতো। যেমনটা তারা বিয়ের আগে কল্পনা করত, ঠিক তেমন। গতরাতে দেরিতে ঘুমালেও অভ্যাসবশত দু’জনেরই ঘুম ভেঙে গেল ফজরের আজান দিতেই। নামাজ পড়ে অধরা যখন বারান্দার দিকের দরজাটা খুলল, একঝলক হিম বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে গেল তাকে। গতরাতের বৃষ্টিতে বারান্দা হালকা ভেজা। বাইরে সদ্য নতুন দিনের আলোর রেখা যাচ্ছে। কুয়াশার একটা পাতলা চাদর ছড়িয়ে আছে প্রকৃতি জুড়ে৷ এই প্রথম আগমনী শীতের কুয়াশার দেখা মিলল! আনন্দে মনটা নেচে উঠল অধরার। বেশ শীত করছে। সে গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে এলো। একটা ন্যাকড়া এনে বারান্দার পানি মুছে ফেলল।

এতক্ষণে শিশিরও হাজির হলো বারান্দায়। বারান্দায় একটাই চেয়ার৷ শিশিরের নিজের রকিং চেয়ার ওটা। সে বসে পড়ে অধরার দিকে দুষ্টু চাহনি দিয়ে বলল, “তুমি কি দাঁড়িয়েই থাকবে?”

“কী আর করব? কপালে যে একটা চেয়ারও জোটেনি!”

“আর এদিকে আমার কপালে একটা শীতের চাদর জোটেনি।”

অধরা মজার ছলে বলল, “আহারে! দু’জনেরই মন্দভাগ্য।”

“চলো মাইনাস মাইনাস মিলিয়ে প্লাস বানিয়ে দেই।”

অধরা কথা বলছিল বাইরের গাছপালার দিকে চেয়ে। সূর্যের আলো একটু একটু করে প্রকট হচ্ছে। কী যে সুন্দর লাগছে! চোখ ফেরানো যায় না৷ এত সুন্দর সূর্যোদয় সে অনেকদিন পর দেখছে। শিশিরে কথাটা শুনে সে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। সামান্য ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করল, “সেটা কেমন করে হবে শুনি?”

শিশির তার দু-হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এসো।”

অধরা ব্যাপারটা ভাবেনি এতক্ষণ। হঠাৎ সে ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল। কিন্তু সুযোগটা হাতছাড়া করল না কিছুতেই। এগিয়ে গিয়ে শিশিরের কোলে বসে পড়ল। নিজের চাদরটা জড়িয়ে দিল দু’জনের গায়ে৷ তারপর গালের সাথে গাল ঠেকিয়ে সূর্যোদয় হতে দেখল। সূর্যের উষ্ণতা আর শরীরের উষ্ণতা মিলে মনে জমে থাকা শীতল কষ্টগুলো দূর করে দিতে থাকল একটু একটু করে। দু’জনেরই মনে হলো, এটা তাদের জীবনের সবচেয়ে চমৎকার সূর্যোদয়।

খানিক পরে চারদিকে আলো ফুটে গেলে অধরা উঠে গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে এলো। আরেকটা চেয়ার এনে পাশাপাশি বসে চা খেতে খেতে গল্প হলো কিছুক্ষণ। এরপর শিশির চলে গেল বাজারে আর অধরা নাস্তার খোঁজ নিতে।

*

একে একে ছয়টি দিন পার হয়ে গেল স্বপ্নের মতো। মায়ামঞ্জরী অধরাকে মায়ায় জড়িয়ে নিতে থাকল ধীরে ধীরে। বাড়িটা চেনা হতে থাকল। হয়ে উঠতে থাকল তার নিজের বাড়ি। বাড়ির পশ্চিমের আমগাছের ডালে কাকের বাসায় তিনটে বাচ্চা, দক্ষিন-পূব কোণে বড় একটা মাকড়সার জালে আটকে থাকা ভোরের শিশির, শ্যাওলা ধরা ছাদের ইটগুলো সব যেন চেনা হতে লাগল। আর তার গাছগুলো তো আছেই।

রান্নাঘরের সাথেও খানিক সখ্যতা হয়ে গেছে। তবে রোজ রোজ রান্না করাটা প্রথম দু-তিনদিন ভালো লাগলেও সেই রুনু খালার মতো রোজ কী রান্না করবে এই চিন্তায়ই যেন সে হাঁপিয়ে উঠল। তবে হাল ছেড়ে দিল না।

যেদিন সে চলে যাবে তার আগেরদিন ভাবল দুপুরে ভালো কিছু রান্না করবে। শুক্রবার দিন৷ শিশির, শাওন সবাই বাসায়। তাই ঠিক করল কাচ্চি রাঁধবে। এর আগে সে কখনোই কাচ্চি রাঁধেনি, তবে ইউটিউব দেখে আজকাল কী না হয়! বুকে আশা বেঁধে সকাল থেকে প্রায় এক কুড়ি ভিডিও দেখে ফেলল অধরা৷ এবার কাচ্চি রান্না কেবল সময়ের ব্যাপার।

কিন্তু রাঁধতে গিয়ে পড়ল বিপাকে। মনে হলো সে পারবে না। ভেতরে আত্মবিশ্বাস কমে যেতে থাকল। শেষে বসানোর সময় তার মনে হলো এটা নির্ঘাত নষ্ট হবে। ওপরে কাচা থাকবে, নিচে পুড়ে যাবে।

কিছুক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে রইল সে৷ তারপর এক ছুটে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে মায়ের ঘরে উঁকি দিল। মা বসেছিলেন হাত গুটিয়ে। কোনো কাজ নেই, সারাটাদিন যেন তার মন খারাপ করে বসে থাকার জন্যই।

অধরা কাচুমাচু মুখ করে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “মা, একটা সমস্যায় পড়েছি।”

এই ক’দিনে মায়ের সাথে সম্পর্কটা বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেছে তার। মা খানিকটা চিন্তিত সুরে বললেন, “কী হয়েছে?”

অধরা বলল, “কাচ্চি রাঁধতে গিয়েছিলাম। সব রেডি। কিন্তু বসাতে সাহস পাচ্ছি না। একটু আসবেন?”

অধরার চেহারা আর কথার ধরনে মা হেসে ফেললেন৷ তারপর কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। অধরা গেল পিছু পিছু৷

মা নিজেই সুন্দর করে রাঁধলেন। অধরাকে কিছু টিপস শিখিয়ে দিলেন। খানিক গল্প করলেন৷ এই রান্নাঘরে নাকি তার সব এলোমেলো লাগত। অধরা এই কদিনে ভালোই গুছিয়ে এনেছে৷ সব মাকে দেখিয়ে দিল সে৷ মা বললেন, “এখন বেশ পরিপাটি লাগছে৷ ভালো লাগছে দেখতে।”

মায়ামঞ্জরীতে আসার পর এই প্রথম মা নিজের হাতে কিছু রান্না করলেন৷

দুপুরে খেতে বসার সময় সবার ধারণা ছিল রান্না করেছে অধরা। কিন্তু খাবার মুখে দিয়েই শিশির অবাক হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে বলল, “মা! তুমি রেঁখেছ!”

মা একগাল হেসে বললেন, “বুঝলি কেমন করে?”

শিশির খেতে খেতে বলল, “তো কী খেয়ে এত বড় হলাম যে সেটার টেস্টই ভুলে যাব?”

শাওন বলল, “মা কতদিন পর রাঁধলে বলো! আজ কব্জি ডুবিয়ে খাব।”

বাবা কিছুই বললেন না৷ শুধু মায়ের দিকে চেয়ে চোখের ইশারা করলেন। সেই ইশারার কী অর্থ তারাই জানেন। অধরা শুধু লক্ষ্য করে মুখ টিপে হাসল।

পরদিন সে চলে যাবে। এর আগের দিন ওরা বেড়াতে বের হওয়ার ঘটনায় মা বেশ রিয়েক্ট করেছিলেন৷ এরপর অধরার সাথে সম্পর্ক সহজ হওয়ার কারনেই কি না কে জানে, দুপুরে খাবার পর তিনি শিশিরকে বললেন, “ওকে নিয়ে একটু ঘুরেটুরে আয়, কাল তো চলেই যাবে।”

শিশির, অধরা দু’জনেই বেশ অবাক হলো৷ তবে মা’কে সেটা বুঝতে দিল না। শিশির হেসে বলল, “তোমরাও চলো। সবাই মিলে কোথাও ঘুরে আসি।”

“নাহ, এত ভারি খাবার খেয়ে নড়তে পারব না। তোরা ঘুরে আয়।”

বিকেলে ওরা সত্যিই ঘুরতে বের হলো। নদীর পাড় দিয়ে বালুর ওপর হেঁটে হেঁটে অনেকদূর চলে গেল। বাজারের কাছাকাছি একটা টং দোকান থেকে মালাই চা খেল, একটা নার্সারি পেয়ে ফেরার পথে অধরা কিনে আনল মধুমঞ্জরীর চারা৷

রাতে গোছগাছ করে ফেলল অধরা। শিশির কিছু না বলে চেয়ে রইল শুধু। অধরা জিজ্ঞেস করল, “কী দেখছ?”

শিশির জবাব দিল, “তোমাকে।”

“কোনোদিন দেখনি?”

“অনেকদিন দেখব না।”

“তুমি গিয়ে দেখা করে আসবে প্রতিদিন।”

“প্রতিদিন শ্বশুরবাড়িতে গেলে শ্বশুর শাশুড়ি শেষে বলবে, জামাই বাবা, একটু নিজের বাড়ির মুখটাও দেখে এসো।”

অধরা খিলখিল করে হাসতে লাগল। শিশির বলল, “তোমার পরীক্ষা না থাকলে জীবনেও যেতে দিতাম না।”

অধরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “আমারও যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু….”

শিশিরের অনেক বলতে ইচ্ছে হলো, “যেও না অধরা।” কিন্তু বলল না। নিজেকে সংবরণ করে রাখল। এতদূর থেকে গিয়ে পরীক্ষা দেয়া সম্ভব না। অথচ তার এখন খুব কষ্ট হবে। এত অভ্যাস হয়ে গেছে এই এক সপ্তাহেই যে মনে হচ্ছে ওর খুব প্রয়োজনীয় কোনো অঙ্গ শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। বুকটা ফাঁকা লাগছে। সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হলো, চোখে পানি চলে আসতে চাইছে। সে কষ্ট করে আটকে রেখেছে৷

রাতে ঘুমানোর সময় অধরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল শিশির। যেন আর কোনদিনই ধরতে পারবে না।

পরদিন অধরা নিজের বাড়িতে চলে গেল। খুব ভোরে বের হয়ে শিশির তাকে বাড়িতে দিয়ে নাস্তা করে চলে গেল অফিসে। বলে গেল দু’দিন পর এসে দেখা করে যাবে।

অধরা সপ্তাহখানেক পর মা বাবা আর বোনেদের দেখা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। বড় আপাও এসেছেন সে আসবে বলে। বাড়িতে যেন উৎসব লেগে গেল। মা,বাবা আর তিন বোন মিলে সারাদিন আড্ডা, গল্প, খাওয়াদাওয়ায় মেতে রইল।

রাতে শিশিরের প্রশ্নের জবাবে অধরা জানাল সে সারাদিন কী কী করেছে। শিশিরের বাড়ি ফিরে সব ফাঁকা লাগছিল৷ ভুতের বাড়ির মতো লাগছিল বাড়িটা। অধরা যেন পুরোটা জুড়েই ছিল৷ এখন সবটা নিয়ে চলে গেছে। তাই অধরা যখন জানাল সে খুবই আনন্দে আছে, আর পড়াশুনার জন্য গিয়ে সারাদিন গল্পগুজবেই কাটিয়ে দিয়েছে তখন তার বেশ অভিমান হলো। সে আর কথা না বাড়িয়ে “ওকে। এনজয়। গুড নাইট।” বলে ফোন কেটে দিল। মোবাইলটা সাইলেন্ট মোডে দিয়ে শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ার চেষ্টা করল। শরীর ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়েও পড়ল একসময়।

এদিকে অধরা কিছুতেই বুঝতে পারল না ছেলেটা হঠাৎ রেগে গেল কেন!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৩৪

ওয়াশরুমের আয়নাতে নিজের চেহারাটা আরেকটু ভালো করে দেখে নিল ডেভিড। ছোটো ওয়াশরুমে বেশি পাওয়ারের সাদা আলো প্রতিফলিত হচ্ছে সাদা দেয়ালে। ঝকঝকে আয়নাতে চেহারার ছোটো ছোটো ডিটেইলিং ধরা পড়ছে। ছদ্মবেশটা তার দারুণ হয়েছে বলতে হবে! এক ধাক্কায় যেন বছর পাঁচেক কমে গেছে বয়স৷ চুলের কাটিং পরিবর্তন হয়েছে, গালে চাপদাড়ি বসে গেছে। চোখে ধূসর লেন্স, কানে দুল, ঘাড়ে ড্রাগনের ট্যাটু। পোশাক থেকে শুরু করে চাহনি পুরোটাই বদলে গেছে৷ এখন সে এই ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। পড়া বলতে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সাথে ভালো বন্ধুত্ব করেছে। বেছে বেছে তাদের সাথে আরো বেশি খাতির করেছে যারা ড্রাগ এডিক্ট। এদের মধ্যও বাছাবাছি হচ্ছে। যারা যারা সেই পাগলা বৈজ্ঞানিকের বিশেষ ধরনের ড্রাগ, যেটার নাম দিয়েছে ওরা ‘হট লেডি’ সেবন করে তাদের সাথে বিশেষ বন্ধুত্ব করার চেষ্টায় আছে সে।

‘হট লেডি’ নামটা আসল নাম নয়। খুব গোপনীয় এই ড্রাগটার পরিচয় লুকিয়ে রাখতেই এরকম নাম, যাতে কেউ শুনলেও হুট করে বুঝে ফেলতে পারবে না কী নিয়ে কথা হচ্ছে। এই ড্রাগ মেয়ে মহলেও জনপ্রিয়। মেয়েদেরও অবশ্য এই নামে আপত্তি নেই৷ তাদের উদার মানসিকতার দেশে মেয়েরাও হট মেয়েদের সঙ্গী বানিয়ে থাকে বৈকি!

ডেভিড টার্গেটের দিকে পৌঁছুচ্ছে বেশ ধীর, তবে কার্যকরী উপায়ে। এভাবে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না৷ তবে সে একটু একটু করে ওদের পুরো র‍্যাকেটটা ধরে ফেলবে। যদি সবকিছু শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক হয় তো!

ইউনিভার্সিটির একটা মেয়ে তাকে বিশেষ পছন্দ করে ফেলেছে। মেয়েটার নাম সোফিয়া৷ আগুন সুন্দরী। কিছুদিন আগে ওর বয়ফ্রেন্ড ছিল ফ্রেড নামের এক আইরিশ ছেলে। সদ্য ব্রেকআপের পর ডেভিডের দিকে সুনজর দিয়েছে। অবশ্য তার কারনও আছে। ডেভিডের সন্দেহ ছিল সোফিয়া ড্রাগ নেয়। তাই ওর সাথে খাতির করতে হয়েছে। কিন্তু পরে দেখা গেছে সেরকম কিছু না৷ ওর মধ্যে মাতাল মাতাল ভাবটা বোধহয় প্রাকৃতিকভাবেই আছে। এদিকে সেফিয়া ধরে নিয়েছে ডেভিড তাকে পছন্দ করে। সে ভালোই পাত্তা দিচ্ছে ডেভিডকে।

এখানে এসে ডেভিডের নাম বদলে গেছে। সে এখন পল জোনস।

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই সোফিয়াকে দেখতে পেল সে৷ করিডোরের এক মাথায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে কী যেন দেখছে। সোফিয়া আজকে পরেছে মিনি স্কার্ট আর ওপরে খোলামেলা টপ। ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে তাকে৷ ফ্রেড ওয়াশরুমে ছিল। বের হয়ে তাকে সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিচু স্বরে বলল, “দেরি করলে মিস করে ফেলবে। ওর মতো সেক্সি মেয়ে আর পাবে না।”

ডেভিড ওরফে পল বলেই বসল, “তাহলে ব্রেকআপ করলে কেন?”

“কে ব্রেকআপ করেছে? আমি তো করিনি। সে করেছে।”

“কেন?”

ফ্রেড এবার একটু ইতস্তত করে বলল, “আমারই দোষ। আই চিটেড অন হার। আসলে পার্টিতে গিয়ে একটু বেশি ড্রিংক করে ফেলেছিলাম৷ তারপর একটা মেয়ের সাথে.. ”

“ওহ।”

“সোফি চিটিং সহ্য করতে পারে না৷ তাই ওর সাথে রিলেশনশিপে গেলে সাবধানে থেকো।”

ডেভিড হেসে বলল, “আমি ওর সাথে রিলেশন করছি না৷ আই হ্যাভ গার্লফ্রেন্ড।”

ফ্রেড অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, “রিয়েলি?”

“ইয়েস।”

ফ্রেড শ্রাগ করে চলে গেল। মনে হলো খুশিই হয়েছে৷ ডেভিডের এখানকার কাজকর্ম নির্ঝঞ্ঝাটই কাটছিল, মাঝে মেয়েটার জন্য সব গুবলেট হতে বসেছে৷ সোফিয়ার পেছনে ছেলেদের লম্বা লাইন৷ এমনকি প্রফেসরদেরও কারো কারো নজর আছে এদিকে৷ ওর সাথে ঘনিষ্ঠ হবার সাথে সাথে সে বিরাট সংখ্যক মানুষের নজরে পড়ে যাবে। কে জানে শত্রুও তৈরি হতে পারে৷ কিন্তু মেয়েটাকে ইগনোরও করা যাচ্ছে না। এখন তাই হঠাৎ মিথ্যেটা মাথায় চলে এলো। এটা প্রচার হলে এই ঝামেলা থেকে নিষ্কৃতি মিলতেও পারে।

আজ এমনিতেই একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই ক্যাম্পাসে ড্রাগ সাপ্লাই হয় বুধবার, মানে আজ। কোন সময়ে আসে সেটা সে জেনেছে, তবে কার মাধ্যমে আসে এটা জানা যায়নি। কী করে জানবে তাও বুঝতে পারছে না।

সোফিয়ার চোখে পড়ে যাবার আগে সে উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল। ল্যাবরেটরিগুলো পেরিয়ে পেছনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ফল শুরু হয়েছে৷ চারদিকে রঙিন গাছপালা আর মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। এমন প্রকৃতির দিকে চাইলে প্রত্যেকবার কেন যেন ইভার কথা মনে পড়ে। মেয়েটা কি তবে প্রকৃতির মতো সুন্দর? কেন সে ইভাকে ভুলতে পারছে না। ভুলে যাওয়া উচিত। কিছুদিন আগেই সে কঠোরভাবে নিজের মনকে বুঝিয়েছে, তার এই বিপজ্জনক জীবনে সে মেয়েটাকে জড়াবে না। ওর সাথে আর দেখাও করবে না।

******

ইভা আজ তাড়াতাড়ি কাজ থেকে বেরিয়ে পড়ল। আজ তার এক বান্ধবী নেলীর সাথে দেখা করতে যাবার কথা। নেলী ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করছে। ইভার কলেজের পর আর পড়তে ইচ্ছে হয়নি। সে ঢুকে গেছে কাজে৷ এটাই ভালো লাগছে।

বের হবার সময় সে ঠিক করেছিল হেঁটে যাবে৷ খুব বেশি দূর তো নয় ক্যাম্পাস৷ আর এই সময়ে হাঁটতে মজা লাগে। কিন্তু সমস্যা হলো হাঁটা শুরু করতেই ডেভিডের কথা মনে পড়ছে৷ খুব একা একা লাগছে। ডেভিডের সাথে আবার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সেই যে সেদিন ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, তারপর আর খোঁজ নেই। মাঝেমধ্যে ইভার নিজের ওপর রাগ হয় মানুষটাকে মিস করার জন্য। কিন্তু মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বারবার শুধু ওর কথাই মনে পড়ে যায় ঘুরেফিরে। সবচেয়ে বড় কথা, তার মনের সেই ভয় পাওয়াটা, ডেভিডের কোনো অঘটন ঘটবে এই মনে হওয়াটা আরো বেশি যন্ত্রণা দেয় তাকে।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চারদিকে ঘুরে ঘুরে তাকায় সে৷ যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তার সাথে!

এই মৌসুমে মানুষের মনমেজাজ ভালো থাকে। সবাই বেশ খুশি খুশি মুখে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ইভার ধারণা তার একারই মুখটা ভূতের মতো হয়ে আছে৷ সে কেন আগের মতো জীবনটা উপভোগ করতে পারছে না?

******

বিকেলের দিকে এক মগ কফি হাতে বসেছিল ডেভিড। এই কফিশপটার পাশেই একটা ঝাঁকড়া গাছ। তার নিচে নেশাখোরগুলো সব বসে আছে৷ সে যে ওদের পিছু নিয়েছে এটা সে বুঝতে দেয়নি। ভাবটা এমন করছে যেন কারো জন্য অপেক্ষা করছে এখানে৷ তাকে আলাদা করে ওদের সন্দেহ করার কথা না যদিও৷ আশেপাশে ভালোই মানুষ ঘোরাফেরা করছে৷ সে একটা মোটা চশমা ঝুলিয়েছে চোখে৷ এই ভণিতাটা সে করা শুরু করেছে এখানে এসে। পড়ার সময় চোখে চশমা ঝুলিয়ে নেয় যেন তার চোখের সমস্যা। এদিকে চশমার ফাঁক দিয়ে কায়দা করে জায়গামতো নজর ঠিকই রাখছে।

নেশাখোরগুলো বসে আছে। না এদের কাছে কেউ আসছে, না এরা কোথাও যাচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ পার হবার পর ডেভিড একটা মৃদু শিষের শব্দ শুনতে পেল। তার কান যথেষ্ট পরিষ্কার বলেই দূর থেকে হওয়া শব্দটাও কানে গেল। এজন্যই লোকটা চোখে পড়ে গেল তার। কফিশপের ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছে সে। ওর সাথে সাথে ওয়াশরুমে ঢুকল নেশাখোরদের একজন। ডেভিড ভেতরে ঢোকার ইচ্ছেটা বহু কষ্টে দমন করল। এখানে এখন ঢুকলে নজরে পড়ে যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না। যদিও মনে হচ্ছে নজরে সে এমনিতেই পড়বেে। কারন এতক্ষণ ঘড়ি দেখতে দেখতে যে কাল্পনিক ব্যক্তির জন্য সে অপেক্ষা করছে সেই ব্যক্তি এখনো এসে পৌঁছায়নি।।

মনোযোগ একদিকে ছিল বলেই প্রথমে তার পাশে এসে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে নজর যায়নি ডেভিডের। সোফিয়া! রাগে লাল হয়ে আছে সোফিয়ার চেহারা। সে চেয়ার টেনে সামনে বসে বলল, “তুমি সেদিন আমাকে বলেছিলে তুমি সিঙ্গেল৷ আজ সবাইকে কেন বলে বেড়াচ্ছো যে তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে? আসলে কোনটা সত্য?

উত্তর দিতে গিয়ে সে খেয়াল করল সোফিয়ার লিপস্টিক খানিকটা ছড়িয়ে গেছে৷ সে বলল, ” সোফি তোমার লিপস্টিক নষ্ট হয়ে গেছে।”

সোফিয়া এসব ব্যাপারে ভীষণ সচেতন। সে দ্রুত উঠে ব্যাগ হাতে ওয়াশরুমের দিকে গেল। ফিমেল ওয়াশরুমের সামনে যেতেই ডেভিডের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে এক লাফে উঠে গিয়ে সোফিয়াকে টেনে নিয়ে মেল ওয়াশরুমের ভেতর চলে গেল৷ ভেতরটা মোটামুটি ফাঁকা। দেয়ালের সাথে সোফিয়াকে চেপে ধরে ওর ঠোঁটে চুমু খেল। সোফিয়াও সেটা এনজয় করল বলেই মনে হলো।

একেবারে মোক্ষম সময়েই এসেছিল সে। এই ফাঁকে তার অভিজ্ঞ নজর দেখে নিয়েছে নতুন আসা লোক আর নেশাখোরের মধ্যে আদান প্রদান হয়েছে একটি নীল রঙের কলম।

সোফিয়া এমনিতে মজা পেলেও ছাড়া পাবার পর পুরুষদের ওয়াশরুমে তাকে ঢোকানোর জন্য বিরক্তিতে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল। ওয়াশরুমের ভেতরের গুটিকয়েক ছেলেও বিব্রত হয়েছে। তারা ডেভিডের দিকে এমন নজর দিল যেন তার মতো পার্ভার্ট এরা জীবনে দেখেনি। অবশ্য তাদের চোখে ঈর্ষাও পরিষ্কার দেখা গেল।

আর ডেভিড বাধ্য প্রেমিকের মতো সোফিয়ার পিছু পিছু গেল যেন রাগান্বিত প্রেমিকার রাগ ভাঙাতে হবে।

সোফিয়া পিছু পিছু আসা ডেভিডের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “এটা লেডিজ ওয়াশরুম। এখানে ঢুকে পড়লে মেয়েরা মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে।”

ডেভিড বলল, “ধন্যবাদ মিস। আমি নাহয় বাইরেই অপেক্ষা করছি।”

সোফিয়া টিস্যু দিয়ে লেপ্টে যাওয়া লিপস্টিক মুছতে মুছতে ভেতরে ঢুকল। তার পাশে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে তাকে সে আগে দেখেনি। সম্ভবত এখানকার নয়। মেয়েটার সাথে কথা বলছে নেলী। নেলী মেয়েটাকে সোফিয়ার একদম ভালো লাগে না। সৌন্দর্যে পুরো ক্যাম্পাসে তার প্রতিদ্বন্দ্বী এই একটা মেয়েই আছে।

এদিকে ঘটনা বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়ায় মিনিটখানেকের মধ্যে সবাই জেনে ফেলল সোফিয়ার নতুন প্রেমিক পল তাকে জেন্টস ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে কিস করেছে। আর এখন বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।

নিজের কাজ শেষে নেলীর হাত ধরে বেরিয়ে পড়ল ইভা। বেরিয়েই চোখে পড়ল দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার ওপর। একটা ধাক্কা খেল ইভা। একে কি সে চেনে? ভীষণ চেনা একটা মানুষের অবয়বে এ যেন আরেকটা মানুষ। ছেলেটাও তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখটা অচেনা, তবে চাহনী চেনা। ইভা মূর্তির মতো কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল৷ নেলী ফিসফিস করে বলল, “ওদিকে চেয়ে আছিস কেন? ওটা সোফির বয়ফ্রেন্ড। এভাবে তাকিয়ে থাকলে সোফি তোর বারোটা বাজিয়ে দেবে। চল জলদি!”

ইভা চলল৷ কিন্তু আরো একবার ঘুরে দাঁড়াল। তার কেন যেন নিশ্চিতভাবে মনে হচ্ছে এই ছেলেটা আর কেউ নয়, ডেভিড। তবে এটা কেমন করে সম্ভব? ডেভিড তার চেনা অবয়বে নেই। তারচেয়ে বড় কথা ডেভিড নিশ্চিয়ই ভোল পাল্টে অন্য মেয়েদের চুমু খেয়ে বেড়াবে না?

চিন্তাগুলো সারাক্ষণ ঘুরপাক খেতে থাকল মনে। এদিকে ডেভিড ইভাকে দেখে এত অবাক হয়েছে যে বাকি সব ভুলে গেছে। ইভা এখানে কেন? সে যে ছদ্মবেশে আছে সেটা পর্যন্ত ভুলে গেল সে। তার মনে হলো ইভা তাকে চিনে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে৷ এখন অভিমানে চলে গেছে৷

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৩৫

ডেভিডের সম্বিত ফিরল সোফিয়ার টানাটানিতে। সে খেয়াল করল সোফিয়া তার বাহু ধরে টানছে আর বলছে, “কাম অন বেইব। হোয়াট আর য়্যু থিংকিং?”

ডেভিড ইতস্তত করে বলল, “নাথিং। লেট’স গো।”

সোফিয়া ওর হাত ধরেই রেখেছে। কয়েকদিন সে বয়ফ্রেন্ড ছাড়া কাটিয়ে ফেলেছে। এখন সত্যিই একা লাগছে। পলকে তার শুরু থেকেই পছন্দ হয়েছিল। ছেলেটা দেখতে ভালো, তাছাড়া ওর ভেতর অন্যরকম একটা আবেদন রয়েছে। ওর চাহনী ভীষণ আকর্ষণীয়। ওর সাথে রোমান্সটা দারুণ জমবে! ভেবেই সোফিয়া রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। পলের হাতটা আঁকড়ে ধরে আরো শক্ত করে।

ডেভিডের হাতে সোফিয়ার নখ বসে গেলে সে মৃদু চিৎকার করে উঠল। সে নিজে ভাবছিল ইভার কথা। সোফিয়া ওর চিৎকারে হেসে স্যরি বলল। কিন্তু সরে গেল না। হাতটা ধরেই রাখল।

একটা জায়গায় বসে কথা বলতে শুরু করল তারা। সময় পার হতে থাকল। সোফিয়া গল্প করে চলল৷ ডেভিড কোনোমতে উত্তর দিয়ে যেতে থাকল। একসময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে একে অপরকে বিদায় জানাল তারা। ডেভিড হাপ ছেড়ে বাঁচল।

সোফিয়া ভেবেছিল পল তাকে আগামীকাল ডিনার ডেটের আমন্ত্রণ জানাবে। আগামীকাল তাদের ক্লাস নেই। দারুণ একটা দিন ছিল। কিন্তু পলের কোনো হেলদোল নেই। অদ্ভুত ছেলে! হঠাৎ চুমু খেয়ে ফেলল! আবার এখন আবার ডেটে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কেন? এর সমস্যা কী? হতে পারে অনভ্যস্ত৷ হতে পারে এর আগে তেমন একটা প্রেম করেনি। যাকগে, ছেলেকেই সবসময় আমন্ত্রণ জানাতে হবে একথায় সোফিয়া বিশ্বাস করে না। সে নিজেই ডাকবে পলকে।

ডেভিড ততক্ষণে অনেকখানি দূরে চলে গেছে। সোফিয়া গলা উঁচিয়ে ডাকল, “পল! হেই প…ল!”

ডেভিড পল নামে অভ্যস্ত নয় মোটেও। ডাকটা তাই তার কানে গেলেও স্বাভাবিক বোধকে নাড়া দিল না। সে নিজের মতো ভাবতে ভাবতে চলে গেল। সোফিয়া বিরক্ত হয়ে ফোন করল তাকে।

সোফিয়ার ফোন দেখে ঢোক গিলল ডেভিড। আবার কী চায় এই মেয়ে? সে ভয়ে ভয়ে ফোন ধরল। সোফিয়া আদুরে গলায় তাকে ডেটের আমন্ত্রণ করল আগামীকাল সন্ধ্যায়৷

ডেভিড প্রমাদ গুনল। সে এতক্ষণ ধরে প্ল্যান করছিল আগামীকাল ইভার সাথে দেখা করে তাকে কিভাবে মানাবে। এদিকে এই মুসিবত তার ঘাড়ে একেবারে জোঁকের মতো চেপে বসেছে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটাকে এখন না করা হলে নিশ্চয়ই ভীষণ রেগে যাবে। এটা ঠিক হবে না৷ সে খুবই খুশি হবার ভান করে বলল, “আমি অবশ্যই আসব। থ্যাংক ইউ সোফি৷ থ্যাংক ইউ সো মাচ!”

হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুদূর চলে গেল সে। এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে চলে আসায় একটা গাড়ি তাকে শেষমুহুর্তে দেখে কোনোমতে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ডেভিডের মাথায় আইডিয়াটা তখনই এলো।

তার কাছে ছদ্মবেশের জিনিপত্র সবসময়ই থাকে। বাসায় প্রচুর ব্যান্ডেজ ছিল। সে তার ডান পা’টা ভালোভাবে ব্যান্ডেজ করে তাতে সামান্য লাল রঙ লাগিয়ে সোফিয়াকে পায়ের ছবি তুলে পাঠিয়ে মেসেজ করল, “এক্সিডেন্ট হয়েছে।”

সোফিয়া ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করল। সে চলে আসতে চাইল ডেভিডের বাড়িতে। কিন্তু ডেভিড নানা কথা বলে পাশ কাটিয়ে গেল। বলল পা ভালো হলে তাদের অবশ্যই দেখা হবে।

কল কাটার পর ডেভিডের মনে হলো, পায়ের ব্যান্ডেজের নাটকটা তাকে চালিয়ে যেতে হবে কালকের পরেও। এক ঝামেলা থেকে বাঁচতে আরেক ঝামেলায় পড়া গেল!

******

ইভা লিফট থেকে বের হতেই চোখাচোখি হয়ে গেল ডেভিডের সাথে। সেই আগের ডেভিড! সেই চেহারা, সেরকম পোশাক। ওর চাহনি দেখে ইভা আরেকবার নিশ্চিত হলো, গতদিন দেখা ছেলেটা ডেভিড না হয়ে যায় না। সে ডেভিডকে দেখেও ওর দিকে এগিয়ে গেল না৷ পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করল। ডেভিড এগিয়ে এসে ওর পথরোধ করে দাঁড়াল৷

“ইভা! কেমন আছো?”

ইভা কোনো উত্তর দিল না। পুনরায় পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো। ডেভিড এবার ওর সামনে এসে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়াল। “কথা বলবে না ইভা?”

ইভা ঠান্ডা দৃষ্টিতে ডেভিডের দিকে চেয়ে ফের পাশ কাটানোর চেষ্টা করল, তবে সফল হলো না৷ হতাশ হয়ে ডেভিডের দিকে চাইল সে। “কী চাও তুমি?”

“কথা বলতে চাই।”

“তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই।”

“আমার আছে। তোমাকে শুনতে হবে।”

“আমার অত সময় নেই।”

“সময় করতে হবে।”

“সমস্যা কী তোমার? শুধু শুধু ডিস্টার্ব করছ কেন?”

“শুধু শুধু না। কথা বলাটা জরুরি ইভা।”

“তোমার সাথে আমার কোনো জরুরি কথা বলার মতো সম্পর্ক নেই। কথা না বললেও কিছু যায় আসবে না।”

কথাটা শুনে ডেভিড এবার একটু থমকে গেল। খুব গায়ে লেগেছে কথাটা। ওদের কথা বলার মতো সম্পর্কও নয়?

ইভা এই সুযোগে জোরে হেঁটে অনেকখানি এগিয়ে গেল। ডেভিডের রাগ হলো এবার। এত করে বলার পরেও একটা মানুষ শুনবে না কেন? এত কিসের দেমাগ? সে এবার লম্বা লম্বা পা ফেলে উপস্থিত হলো ইভার কাছে। ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকল একটা নির্জন রাস্তার ধারে। ইভা প্রথমে অবাক হয়ে গেল। তারপর প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকল হাত ছাড়ানোর। কিন্তু ডেভিডের হাতের শক্ত বন্ধনীর ভেতর থেকে কিছুতেই বের হতে পারল না। ওর ছটফটানি দেখে ডেভিডের মেজাজ আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। সে ওকে রাস্তার পাশে গজিয়ে থাকা লম্বা লম্বা গাছের জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেল। একটা মোটা গাছের সাথে চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে বলল, “ইভা! কাম ডাউন!”

ইভা ভাবেনি ডেভিড এরকম করতে পারে। সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ হয়ে গেল। চোখে চোখ রেখে নিরবে যেন লড়াই চলল বেশ কিছুক্ষণ। ডেভিড এর আগে কখনো পারমিশন ছাড়া ইভার হাত পর্যন্ত ধরেনি। আজ এরকম জোর জবরদস্তি করল কেন? তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল গতকালের কথা। গতকাল সোফি নামের মেয়েটাকে ছেলেদের ওয়াশরুমে টেনে নিয়ে…. ভাবতেই ইভার পেটে পাক খেয়ে উঠল। চোখমুখ বিকৃত করে ফেলল সে।

ডেভিড হঠাৎ ওর মুখের পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

ইভা কাঠ কাঠ গলায় বলল, “তোমাদের অফিসে নতুন ট্রেনিং দিচ্ছে নাকি জোর করে মেয়েদের ধরে ধরে চুমু খাবার?”

ডেভিড খানিক থমকে গিয়ে হেসে ফেলল। “আমি তোমাকে চুমু খেয়েছি?”

“যেভাবে ধরে আছো তাতে খেলেও আশ্চর্য হব না।”

“তারপর কী করবে?”

“তোমাকে একটা চড় মারব।”

ডেভিড হো হো করে হেসে ফেলল। এতক্ষণে সে ইভার হাত ছাড়ল। হাসি থামলে বলল, “ইভা, তুমি আমাকে কেমন করে চিনলে?”

“তোমার মার্কামারা চোখ দেখলেই চেনা যায়।”

“সেকি! আমি তো লেন্স পরে থাকি।”

ইভা এবার মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে বলল, “এমনিতে তোমার ছদ্মবেশ ভালো হয়েছে। খুঁটিয়ে না দেখলে তোমার অতি পরিচিতরাও চিনবে না। পুরোই ভোল বদলে ফেলেছ। কিন্তু চাহনি তো বদলাতে পারোনি। এখন যেভাবে চেয়ে আছো, পল জোনস হয়েও তুমি সেভাবেই তাকাও, বুঝলে?”

“তার মানে চাহনির বদল করতে হবে?”

ইভা হেসে বলল, “ওটা চাইলেও পারবে না। তুমি গোয়েন্দা ঠিকই, তবে শার্লক হোমস তো আর নও।”

“ও আচ্ছা বুঝলাম!”

“এখন বলো আমার সাথে কী কথা? ঝটপট বলবে। অত সময় নেই আমার।”

“কেন কারো সাথে ডেটে যাবার কথা নাকি?”

ইভা ওর দিকে বিষদৃষ্টি দিয়ে বলল, “সেটা তো তুমি গিয়ে বেড়াচ্ছ। আমি আগের মতোই আছি। আমার জীবন অত অ্যাডভেঞ্চারাস না।”

“ওকে ম্যাডাম। এখন আমার কথাটা একটু শুনবেন?”

“বলো।”

ডেভিড এতদিন ওর এই সিক্রেট অপারেশনের কথা ওর বস লেইজি রকম্যান বাদে কাউকেই বলেনি। এই প্রথম ইভাকে বলল। ইভা ধৈর্য ধরেই সব শুনল। কথা শেষে মন্তব্য করল, “সোফিকে চুমু না খেলেও তোমার অপারেশনের কিছু যায় আসত না।”

ডেভিড এবার হেসে ফেলল। গভীর চোখে ইভার দিকে চেয়ে বলল, “তাতে তোমার এত আপত্তি কেন ইভা? তুমি কেন রাগ করে আছো? তুমি তো আমার প্রেমিকা বা স্ত্রী নও। তোমার ভাষ্যমতে তুমি শুধুই আমার বন্ধু।”

ইভা যেন নিজের কাছেই ধরা পড়ে গেল। সত্যিই তো! তার কেন এত খারাপ লাগছে? কেন এত রাগ হচ্ছে? কেন গতরাতে একফোঁটা ঘুম হয়নি? ডেভিডকে কি তবে সে শুধুই বন্ধু ভাবে না?

ইভার এলোমেলো চাহনি দেখে ডেভিড বুঝতে পারল ওর ভেতরের ঝড়টা। সেটাকে কিছুটা স্তিমিত হতে সময় দিয়ে সে বলল, “চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই। খালার সাথেও দেখা হয়ে যাবে।”

ইভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যে উত্তর দিল তা শুনে ডেভিডের হতবাক হবার পালা। ইভা বলল, “খালা এখন আর আমার সাথে থাকে না৷ তার প্রেমিকের বাড়িতে থাকে।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু