#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৩৬
“প্রায় বছরখানেক আগের কথা। খালার অফিসের পাশের অফিসের একজনের সাথে তার পরিচয় হয়৷ ভদ্রলোকের নাম এন্ড্রু টেলর। কিভাবে পরিচয় হয়েছিল সেই কাহিনী আমার ঠিক মনে নেই, সম্ভবত প্রায়ই দেখা হতো তাদের, তারপর একদিন খালাকে সে একসাথে কফি খাবার আমন্ত্রণ জানায়। খালা রিলেশনশিপে একেবারেই বিশ্বাসী ছিল না, তবে ফ্রেন্ডশিপের সম্পর্কে তার চেয়ে চমৎকার আর কেউ হতে পারে না। মি.টেলর যখন তাকে বন্ধুত্বের আমন্ত্রণ জানাল, সে সানন্দে রাজি হয়ে গেল। তারা প্রায়ই অফিস ছুটির পর একসাথে কফি খেত, নানান গল্প করত৷ মি. টেলরের সাথে আমার একবার মাত্র দেখা হয়েছে। খুবই মিশুক ভদ্রলোক। আর দারুণ গল্প বলতে জানেন৷ তার এক্সপিরিয়েন্সও ঢের! প্রতি বছরই হাতে কিছু সময় জমিয়ে বেরিয়ে পড়েন কোনো না কোনো পাহাড় কিংবা সমু্দ্র পাড়ি দিতে। ঝুলিতে জমা হতে থাকে নতুন নতুন এডভেঞ্চারের গল্প। খালা সেসব খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতেন। আমাকে এসে সেগুলোর গল্প বলতেন। আর প্রায়ই বলতেন, তারও ইচ্ছে করে এভাবে বেরিয়ে পড়তে। কিন্তু ওই বলা পর্যন্তই। আক্ষরিক অর্থে বেরিয়ে পড়ার কথা কখনো ভাবেনি খালা।
এভাবে চলতে চলতে তাদের সম্পর্ক আস্তে আস্তে ভালো হতে থাকে। মি. টেলর বিয়ে করেননি, কারন পছন্দমতো জীবনসঙ্গী পাননি। আর খালারও পার্টনার নেই। দু’জনের বেশ ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। কিন্তু মি. টেলর কখনোই ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করেননি। খালা সবসময় খুব আনন্দ নিয়ে বলতেন, “এন্ড্রু কোনোদিন আমার হাত ধরারও বায়না করেনি। কতটা ভদ্রলোক ভাব!”
তাকে আমাদের বাড়িতে আসতে অনেক জোরাজোরি করার পরেও কখনো তিনি এমুখো হননি৷ সব মিলিয়ে তাদের সম্পর্কটা ওই কফিশপে বসে গল্প করার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল।
মাস দুয়েক আগে মি. টেলর ঠিক করলেন তিনি এই বছর ব্রাজিল যাবেন আমাজন অভিযানে। আমাজন নিয়ে তার পড়া যাবতীয় তথ্য আর গল্পের ঝুলি মেলে দিয়ে বসলেন কয়েকদিন জুড়ে। স্বাভাবিকভাবেই খালা প্রচুর আগ্রহ প্রকাশ করল৷ তুমি জানো খালা এখনো কতটা ফিট আর সুন্দরী৷ আমার সাথে দাঁড়ালে আমার বড় বোন বলে মনে হয়। এত সুন্দরী সিঙ্গেল একজন মহিলাকে বেশিদিন বন্ধু বানিয়ে রাখাটা সম্ভব না। মি. টেলরও পারলেন না।
হঠাৎই তিনি একদিন খালাকে প্রপোজ করে বসলেন। খালা তাকে মনে মনে ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছে। কিন্তু এত বছরের ইগো আর নিজের তৈরি করে রুলসের বিপরীতে যাওয়া এতটাও সহজ নয়। চাইলেই নিজের তৈরি দেয়াল শক্ত দেয়াল ভেঙে ফেলা যায় না। খালা তাই তাকে রিজেক্ট করে দিলেন৷
কিন্তু মি. টেলর যখন একবার প্রপোজ করে ফেলেছেন তখন তিনিও আর ছাড়ার পাত্র নন। নানা ছল করতে করলেন তাকে পটানোর৷ খালা বুঝত, আমার সাথে সেগুলো নিয়ে কথা বলতে বলতে হেসে গড়াগড়ি খেত। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম খালা দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ খুব বেশিদিন লাগেনি তার পুরোপুরি ভেঙে পড়তে। একদিন তিনি ভদ্রলোকের প্রপোজাল একসেপ্ট করে ফেললেন৷ মি. টেলর তাকে বললেন তার বাড়িতে গিয়ে থাকতে।
কিন্তু খালার সবচেয়ে বড় পিছুটান হলাম আমি। খালার কাছে আমি জন্ম থেকেই কৃতজ্ঞ। তাই তার খুশির পথে আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়ালাম না। শুরুতেই জানিয়ে দিলাম খালা চলে গেলে আমি একটুও অসন্তুষ্ট হব না, বরং ভীষণ খুশি হব।
খালা আর মি. টেলর প্রচুর জোরাজোরি করলেন আমাকে তাদের ওখানে গিয়ে থাকতে। কিন্তু আমার যেতে ইচ্ছে হয়নি। খালাও শেষ পর্যন্ত আমার তীব্র অনিচ্ছা বুঝে চুপ হয়ে গেছেন৷ কিছুদিনের মধ্যে তারা বিয়ে করছে। বিয়ের পর হানিমুনে যাচ্ছে আমাজনে। মজার না বিষয়টা?”
এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল ডেভিড৷ ইভার গল্প শেষ হতে হতে তারা ইভার বাড়িতে চলে এসেছে। তাকে এগিয়ে দিতে এসেছে ডেভিড। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ডেভিড বলল, “খালা তাহলে এখন বেশ সুখীই আছেন বলা যায়, তাই না?”
“দারুণ! তাকে দেখলে তুমি চিনবে না। চেহারাই অন্যরকম হয়ে গেছে।”
“তোমার চেহারাও অন্যরকম হয়ে গেছে ইভা। তুমি ভালো নেই।”
ইভা জোর নিয়ে বলল, “না, আমি ভালো আছি।”
ডেভিড বলল, “খালার প্রতি তোমার সত্যিই কোনো রাগ নেই?”
“না।”
“খালা সারাজীবন তোমাকে মানুষ করে শেষ মুহূর্তে নিজে ভালো থাকার জন্য তোমাকে একা ছেড়ে চলে গেলেন তাতে তোমার খারাপ লাগছে না?”
ইভা বিরক্ত হয়ে বলল, “ডেভিড, ডোন্ট বি মিন! খালা আমাকে ছেড়ে যেতে চাননি। আমিই তাকে এক অর্থে জোর করে পাঠিয়েছি। আর তাছাড়া আমি চাই না কেউ আমার জন্য তার নিজের সব সুখ সাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিক!”
“তা ঠিক, স্যরি। আসলে তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছে। একা একা থাকছ। কোনো বিপদ হলে?”
“কিচ্ছু হবে না আমার।”
“তবে আমার হবে..”
“কী হবে?”
“খুব খিদে পেয়ে গেছে। কিছু খেতে না পেলে মারা যাব।”
“স্যরি খাবার কিছুই নেই। কিছু রাঁধলে তবে খেতে পারবে। বসো। আমি ফ্রেশ হয়ে ডিনার রেডি করছি।”
ইভা নিজের ঘরে চলে গেলে ডেভিড রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ইভা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল রান্নাঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ আসছে। ডেভিড তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। মুচকি হাসল সে। গিয়ে যোগ দিল ডিনার তৈরিতে। দ্রুতই তৈরি হয়ে গেল অনেক কিছু। টেবিলে খাবার সার্ভ করা পর্যন্ত ডেভিড সাহায্য করল ইভাকে।
খালা চলে যাবার পর এতদিনে ইভা তার ডিনারটা এনজয় করল। নয়তো টিভি চালিয়ে কোনোরকম কিছু একটা মুখে গুঁজে শুয়ে পড়া রোজকার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। খালাকে যতই বলুক সে বেশ আছে, আসলে সে পুরোপুরি একা হয়ে পড়েছে৷ ভেতরে ভেতরে অনেক দুর্বল হয়ে গেছে আগের চেয়ে।
ডিনারে টুকটাক গল্প চলতে থাকল৷ ডেভিড প্রচুর চেষ্টা করে গেল ইভাকে হাসানোর, মজা করার। অনেকটা সফলও হলো।
ডিনার শেষে কফি বানাতে চলে গেল ইভা। ডেভিড গিয়ে বসল সোফায়। তার কাছে বাড়িটা ভুতুড়ে লাগছে৷ একটা মানুষের অনুপস্থিতি কেমন অনেকটা শূন্যস্থান তৈরি করতে পারে তা আজ এখানে না এলে উপলব্ধি করতে পারত না ডেভিড। সে বুঝতে পারছে ইভা এখানে বেশিদিন থাকলে মরেই যাবে। মেয়েটা মোটেও ভালো নেই। এতদিনের শক্তপোক্ত একটা পার্সোনালিটি, যেটা তৈরি হয়েছিল খালার ব্যাকআপে, খালা চলে যাওয়া সেই ব্যাকআপও চলে গেছে। বড় নড়বড়ে হয়ে গেছে মেয়েটা। তাই দ্রুতই ওর চোখে পানি আসছে, আগের মতো জোর গলায় কথা বলছে না।
কফি খেতে খেতে আরো কিছু এলোমেলো বিষয়ে কথা বলার পর ডেভিড একসময় প্রস্তাবটা দিয়েই ফেলল, “ইভা, আমার বাসায় শিফট হয়ে যাও।”
ইভা সবিস্ময়ে ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। “পাগল নাকি?”
“পাগলের প্রলাপ বকছি না। আমি সিরিয়াস।”
“আমি কোথাও যাচ্ছি না।”
“ইভা, তুমি কতটা খারাপ আছো তা আমি বুঝতে পারছি। তোমার ভেতরকার বিষন্নতা আমি উপলব্ধি করতে পারছি পুরোপুরি। তুমি একটুও ভালো নেই। একাকী বাড়িটা খাঁ খাঁ করে সারাক্ষণ। তোমাকে গিলতে আসে হা করে। তুমি না বললেও আমি জানি তুমি একা থাকতে অভ্যস্ত নও বলে একা থাকতে পারছও না। কেন অস্বীকার করছ? আমি তো তোমার বন্ধু। আমাকে বলো?”
কথাগুলো শুনে ইভার নিজেকে সামলানো মুশকিল হয়ে গেল। চোখে পানি চলে এলো প্রায়৷ সে নিজেকে বেশ কষ্টে সামলে নিয়ে ধরা গলায় বলল, “আমি ভালো আছি।” কিন্তু গলাটা জোরালো হলো না।
ডেভিড সোজা কাজের কথায় চলে এলো। “দেখো ইভা, আমি যে বাড়িতে থাকছি সেটা কোম্পানি থেকে প্রোভাইড করা হয়েছে। বিশাল বাড়ি। চারটা বেডরুম। তুমি তোমার মতো থাকবে। তবে একা অন্তত থাকবে না। আমরা একসাথে আজকের মতো ডিনার তৈরি করব, ডিনার করব, সকালে তুমি আমাকে ঘুম থেকে তুলে দেবে, একসাথে ব্রেকফাস্ট করব, উইকেন্ডে জমিয়ে আড্ডা দেব, ঘুরতে যাব। আর প্রমিজ, তোমাকে কোনোরকম ডিস্টার্ব করব না৷ তুমি পুরোপুরি তোমার মতো থাকবে। তোমার পার্সোনাল রুম বা পার্সোনাল স্পেসে ঢুকব না। চলবে?”
ইভার ইচ্ছে হলো সে তক্ষুনি ‘হ্যাঁ’ বলে দেয়। কিন্তু বলতে পারল না৷ ইগোর দেয়াল আটকে দিল তাকে। তার ভেতরে এই বাড়িতে থাকার ইচ্ছেটা সত্যিই নষ্ট হয়ে গেছে। মন চায় দূরে কোথাও চলে যেতে৷ বেরিয়ে যেতে যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে।
ডেভিড আবারও জিজ্ঞেস করল, “বলো রাজি?”
ইভা মাথা নিচু করে বলল, “ভেবে বলব।”
ডেভিড বলল, “ওকে। কিন্তু উত্তরটা দু’দিনের মধ্যেই চাই। এরপর নিজে থেকে রাজি না হলে কিডন্যাপড হয়ে যাবে। কিডন্যাপ করে এরপর তোমার সাথে কী কী করা হবে সেসব কিডন্যাপারের ইচ্ছে!” বলে চোখ টিপল ডেভিড।
ইভা অবাক হয়ে বলল, “তুমি তো বেশ দুষ্টু হয়ে গেছ।”
“ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে দুষ্টু গ্যাংয়ের সাথে মেশার ফল।”
“উফ!”
ইভার ঠোঁট গোল করে ‘উফ’ বলাটায় চোখ আটকে গেল ডেভিডের। এমনিতেই গতকাল সোফিয়াকে চুমু খেয়ে ব্যাপারটা বেশ আকর্ষণীয় বলেই মনে হচ্ছে তার। এখন ইভাকে আরো বেশি চমৎকার লাগছে। ইচ্ছে করছে কাছে চলে যেতে।
ইভা ওর চোখের দিকে চেয়ে উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “মি. স্পাইক, রাত অনেক হয়েছে। এখন আপনি আসতে পারেন।”
ডেভিড হাসতে হাসতে গুড নাইট জানিয়ে বেরিয়ে গেল।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৩৭
কিছুদিন পর ডেভিড একপ্রকার জোর করেই ইভাকে তার নিজের বাড়িতে শিফট করিয়ে নিল। ইভারও খুব বেশি অমত ছিল না৷ থাকলে কিছুতেই ওকে নেয়া যেত না৷ খালাও এই ঘটনায় খুব খুশি হলেন। ওরা দুজন এক সন্ধ্যায় খালা আর মি. টেলরের সঙ্গে ডিনার খেয়ে জম্পেশ গল্প করে এলো। তাদের বিয়ের ইনভিটেশনও পেয়ে গেল ডেভিড৷ মি. টেলরকে তার ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল। লোকটা বুদ্ধিমান এবং একই সাথে হৃদয়বান৷ খালা নিশ্চয়ই সুখী হবেন তার সাথে।
ডেভিড ইভা একসাথে গাড়িতে করে ফিরল। ডেভিডের গাড়ি থাকলেও নিরাপত্তা বা ছদ্মবেশের খাতিরে সে সচরাচর ব্যবহার করে না। ডিনারের রাতে গাড়িটা নিয়ে বের হয়েছিল। তাই ফেরার সময় একটু ঘুরপথে গাড়ি চালিয়ে নিল সে। ইভার সাথে সময় কাটাতে এত ভালো লাগে কেন এই প্রশ্নের উত্তর তার গোয়েন্দা মস্তিষ্ক বহু খুঁজেও পায়নি৷ কোনোদিন পাবে বলে মনেও হয় না৷
*********
শিশির রাগ করে ফোন তুলছে না। অধরার গতরাত থেকেই মন খারাপ হয়ে আছে। শিশির ঠিক কেন রাগ করল বুঝতে পারছে না সে৷ জানামতে সে এমন কিছু করেনি যাতে ওর রাগ হতে পারে। অধরা অতটা পাত্তা দিত না, যদি না রাগটা শিশির বাড়িতে যাবার আগে করত। বাড়িতে গিয়ে কেন হঠাৎ মেজাজ খারাপ দেখাল? বাড়িতে কি কিছু হয়েছে? মা কি কিছু বলেছেন? চিন্তায় চিন্তায় পরদিনও অধরার কিছুই পড়া হলো না। শেষে সে ঠিক করল কী হয়েছে আগে জানতে হবে। নইলে শান্তি লাগবে না।
সে শিশিরকে কল করতে থাকল, মেসেজ করতে থাকল একটার পর একটা। একবার কল দেয়, কল কেটে গেলে চার পাঁচটা উল্টোপাল্টা মেসেজ পাঠায়, আবার কল, আবার মেসেজ। কল তোলে না, কিন্তু মেসেজ ঠিকই সিন করে। অধরার এক পর্যায়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল৷ হঠাৎ নতুন একটা বুদ্ধি খেলে যাওয়াতে মেজাজ ঠান্ডা হয়ে মুখে হাসি ফুটল তার। মেসেজ অপশনে গিয়ে লিখল,
“প্রাণের স্বামী, আপনার বিরহে আমার এই মন কেঁদে কেঁদে ব্যকুল হয়ে আছে। আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কাঁদছে বিচ্ছেদের কণ্ঠক বিদ্ধ হয়ে। আপনারে না দেখে হৃদয় রক্তাক্ত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। হে স্বামী, আপনি যদি যোগাযোগ না করেন, ফোন না ধরেন, তবে এই দুঃখিনী স্ত্রীর প্রাণটি যে আর থাকে না।”
লেখার পর সেন্ড করতে গিয়ে অধরা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। পাঠাবে কি না ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত চোখ বুজে পাঠিয়েই দিল।
এই প্রথম মেসেজটা সিন হওয়ার সাথে আবার ওপাশ থেকে একটা ওয়াও রিয়েক্ট পড়ল। কিন্তু উত্তর এলো না।
অধরা একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার লিখল, “কেন এত নিষ্ঠুর হচ্ছেন স্বামী?”
এবার মেসেজের উত্তর এলো। সে লিখেছে, “পড়াশুনা করো।”
“প্রাণের স্বামী যখন অভিমানে অভিভূত হয়ে থাকে, তখন কী পড়া আর কী শুনা, আপনিই যে আমার সব। আমার আত্মা, জীবনের উদ্দেশ্য, প্রাণের তরঙ্গ, ঘড়ির কাটা, শিরার রক্ত, চোখের দৃষ্টি। আপনার রাগ না ভাঙলে আমি কেমন করে স্বাভাবিক থাকি?”
শিশিরের প্রচন্ড হাসি পেল। আশেপাশে কলিগরা আছে, সবাই কাজে ব্যস্ত। এর মধ্যে হাসাটাও বিপদ। সে ফোন হাতে ওয়াশরুমে চলে গিয়ে নিঃশব্দে বেশ কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে উত্তরে লিখল, “আচ্ছা আচ্ছা। আমার রাগ পড়ে গেছে। এখন পড়ো।”
“না, আপনার রাগ পড়েনি। রাগ পড়লে ভালোবাসা দেখাতেন।”
“মেসেজে ভালোবাসা কেমন করে দেখাব? বাড়িতে চলে এসো, তারপর দেখাই ভালোবাসা কত প্রকার, কী কী।”
“দেখব ক্ষণ! তার আগে পরীক্ষাটা তো দিতে হবে। নইলে যে মূর্খ স্ত্রী নিয়ে সারাজীবন সংসার করতে হবে। লোকে কী বলবে?”
“লোকে যা বলে বলুক। তোমার আর পরীক্ষা দিয়ে কাজ নেই। প্রাণের স্বামীর কাছে চলে এসো।”
“প্রাণের স্বামী, আপনি এমন নির্দয় হবেন না। আমায় পরীক্ষা দিতে দিন। সেই সাথে রাগ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে একটু ভালোবাসার কথা বলুন।”
শিশির হাসল। এই কথোপকথন দীর্ঘায়িত করা যাবে না৷ পরে সারাক্ষণই ইচ্ছে করবে কথা বলার। তারপর অধরার পড়ালেখার আক্ষরিকভাবেই বারোটা বাজবে। সে লিখল, “ঠিক আছে জানপাখি বউ। রাগ নেই আর। এখন পড়তে বসো।”
মেসেজটা দেখে অধরা আবার লজ্জায় আবারো লাল হয়ে গেল। ফোনটা উল্টে রেখে বইপত্র নিয়ে বসে পড়ল সে। সে নিজেই তো শুরু করেছে এসব৷ মেসেজে যতই লিখুক, সামনাসামনি এসব শিশিরকে বলার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু শিশিরকে দিয়ে কোনো বিশ্বাস নেই। দেখা যাবে বাড়ির সবার সামনেই জানপাখি ডেকে বসছে৷ উফ! দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল অধরা৷
এমন সময় মা চায়ের ট্রে নিয়ে ওর ঘরে ঢুকলেন। পিছু পিছু অদিতিও এলো। বহুদিন আড্ডা দিতে দিতে চা খাওয়া হয় না তাদের৷ অধরার তো মনে হয় এক বছর হয়ে গেছে শেষ তারা একসাথে বসে চা খেয়েছে। বড় আপা সকালে চলে গেছে। বাড়িটাও একটু নিরব হয়েছে৷ সেই শীত শীত বিকেলের শান্তির ওম যেন ঘিরে রেখেছে পুরো বাড়ি। অধরাকে পেয়ে ওর গাছগুলোও খুশি। খুশি জানালার পাশে টবে ঝোলানো মানিপ্ল্যান্ট, ওর বইপত্র আর ওর হাতে আঁকা পেইন্টিংগুলোও।
চায়ের আড্ডাটা জমল খুব। অধরার প্রচুর গল্প জমে আছে। সব মায়ামঞ্জরীর গল্প। সেই গল্প একবার শুরু করলে আর ফুরোয় না৷
মায়ের টনক নড়ল সবার আগে। অধরাকে পড়ার জন্য তাড়া দিয়ে উঠে পড়লেন তিনি৷ উঠল অদিতিও৷ কেক বানানোর চক্করে ওর নিজের পড়ালেখারও বারোটা বেজে আছে৷ পরীক্ষা এগিয়ে আসছে।
অধরা এবার সত্যিকার অর্থেই বইপত্র খুলে বসে কিছুক্ষণের মধ্যে ডুবে গেল পড়ার ভেতর। ফিরে গেল তার সেই আগের একাডেমিক জীবনে।
দু’ঘন্টা পড়ার ওর ব্রেক নিল সে। নভেম্বরেও তেমন ঠান্ডা পড়েনি। তাই ওড়নাটাই গায়ে জড়িয়ে বাগানে একটু হাঁটাহাঁটি করে এলো সে। কত কথা মনে হতে লাগল, মানুষের একটা জীবনে আসলে মিশে থাকে অনেকগুলো আলাদা আলাদা পৃথিবীর স্বাদ। বন্ধুদের সাথে ওর একটা আলাদা পৃথিবী আছে, আলাদা পৃথিবী আছে একাডেমিক বইয়ের পাতায়, বহু আলাদা আলাদা জগতের অনুভূতি আছে গল্পের বইয়ের পাতায় পাতায়, আবার আলাদা পৃথিবী শ্বশুরবাড়িতে। প্রতিটা সম্পর্কেরও আছে আলাদা আলাদা লেয়ার। সব মিলিয়ে আস্ত একটা মানবজীবন কত বিচিত্র! ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে গেল সে।
অদিতির ডাকে কল্পনার জগত থেকে ফিরে এলো অধরা। অদিতি ওর ফোন নিয়ে বাইরে এসেছে৷ বলল, “দুলাভাই ফোন করছে সেই কখন থেকে!”
অধরা খানিকটা শঙ্কা নিয়ে ফোন ধরল। আবার রাগ করবে না তো মশাই?
কিন্তু শিশিরের গলায় রাগের আভাস পাওয়া গেল না৷ স্বাভাবিক গলায়ই কথাবার্তা হলো তাদের। কথা শেষে আবার পড়তে চলে গেল অধরা৷ পড়ার ফ্লোটা আজ ভালোভাবে ধরে ফেলতে পারলে আর চালিয়ে যেতে কষ্ট হবে না।
*********
পরদিন সন্ধ্যায় শিশির এসে হাজির। তার চেহারা দেখেই অধরার মনে হলো বেচারা বুঝি আর থাকতে পারছিল না। এত দ্রুত বউপাগল হয়ে কেমন করে হবে? অবশ্য সে নিজেও স্বামীপাগল হয়নি তাই বা কেমন করে বলবে? বোধহয় নতুন বিয়েতে সবাই একটু আধটু পাগলাটে হয়ে যায়৷
সেরাতে খাওয়াদাওয়ার পর শুতে গেলে লোডশেডিং হয়ে গেল। পূর্ণিমার বিশাল চাঁদ উঠেছে। অধরা হঠাৎ বলল, “চলো ছাদে যাই। কৃষ্ণচূড়া পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়ে ছাদটা যে কী সুন্দর লাগে!”
“তোমার পড়াশুনা?”
“কাল ভোরে উঠে পড়ে পুষিয়ে নেব।”
“ওকে। চলো।”
ছাদে গিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিল শিশির, যেন দুম করে কেউ চলে এসে কাবাবে হাড্ডি না হয়ে যায়৷ অধরা জ্যোৎস্নার সৌন্দর্যে মুগ্ধ থাকায় ব্যাপারটা খেয়াল করল না৷
শিশির পেছন থেকে শক্ত করে যখন জড়িয়ে ধরল তাকে, অধরা যেন জ্যোৎস্নার মতোই তরল হয়ে গলে যেতে থাকল। মিহি গলায় সে বলল, “আমার কী হয়েছে বলতো?”
“কী হবে?”
“এত ভালো লাগে কেন?”
শিশির হাসল। উত্তর দিল না। সুন্দর সুন্দর স্মৃতিগুলো জমা হচ্ছে ঝুলিতে। আশঙ্কা হয় তার, এই চমৎকার সময়গুলো সহসাই ফুরিয়ে যাবে না তো?
সকালে শিশির চলে গেলে অধরার বেশ খানিকটা মন খারাপ হয়ে রইল। আজ আর সে আসবে না। আবার কবে আসবে কে জানে! আজ একটু বেশিই কষ্ট হলো থাকতে। শুরু হলো ওর আসার দিন গোনা। কিন্তু শিশির আর এমুখো হলো না বেশ কিছুদিন।
এক ছুটির দিনে দুপুরের দিকে শিশির অধরাকে ভিডিও কল করল। কল ধরে অধরা দেখল শিশির দাঁড়িয়ে আছে মায়ামঞ্জরীর একতলার বারান্দায়। পেছনে ওর গাছেগুলোর দু-একটা দেখা যাচ্ছে। অধরার হঠাৎ ইচ্ছে করল ছুটে চলে যেতে ওখানে। মায়ামঞ্জরীর ঘ্রাণ যেন আচ্ছন্ন করে ফেলল তাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য। এ কেমন দোটানা! ওখানে থাকাকালীন সময়ে এই বাড়িটাকে সে মিস করেছে প্রচন্ডভাবে। আর এখান মিস করছে মায়ামঞ্জরীকে।
শিশির বলল, “তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। আজ দেখাব।”
“কী কথা?”
“নিজেই দেখো।”
শিশির চুপিসারে রান্নাঘরের দরজার কাছে গিয়ে ক্যামেরাটা ওদিকে ঘুরিয়ে দিল। মা রান্না করছেন। কোমরে আঁচল গোঁজা, ঘামে লেপ্টে আছে চুল, খুন্তি নাড়ছেন মনোযোগ দিয়ে।
শিশির সরে গিয়ে বলল, “দেখলে? সেই যে তোমার কাচ্চি থেকে শুরু হয়েছে৷ এখন মা-ই রান্না করেন বেশিরভাগ সময়। রুনু খালার রান্না এখন আর পছন্দ হয় না। রান্নার সময়ে ঘরে শুয়ে থাকতে পারেন না।”
অধরা হাসল। মায়ের কথাটা শুনে খুব আনন্দ হচ্ছে তার।
শিশির বলল, “এটা কিন্তু তোমার ক্রেডিট। থ্যাংস!”
“ধুর! আমি আবার কী করলাম?”
“মায়ের সাথে কথা বলবে?”
“দাও।”
শিশির মোবাইল নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। শাশুড়ির সাথে এর মাঝে দু-চারবার কথা হয়ছে অধরার। তবে ভিডিও কলে এই প্রথম। সালাম দিল সে।
মা সালামের উত্তর দিলেন। তারপর হঠাৎই কেন যেন অধরাকে দেখে তার চোখে পানি চলে এলো। তিনি চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করে বললেন, “পড়াশুনা কেমন চলছে?”
“ভালোই চলছে। দোয়া করবেন মা৷ কী রান্না করছেন এখন?”
“কাতল মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট।”
পাশ থেকে শিশির বলল, “মায়ের মুড়িঘণ্টটা যা হয় না! একেবারে চেটেপুটে খেতে হয়।”
“আমিও খাব তাহলে।”
মা হেসে বললেন, “তুমি যেদিন আসবে সেদিন করব।”
“পরীক্ষা শেষ হলেই ছুটে চলে আসব।”
“হুম তাড়াতাড়ি এসো। রুনু বলছিল তোমার গাছে পানি দিতে দিতে নাকি ওর কোমর ব্যথা হয়ে গেছে।”
শিশির বলল, “আসার সময় রুনু খালার কোমর ব্যথার জন্য তেলপড়া নিয়ে আসতে ভুলো না যেন।”
রুনু খালা তখনই রান্নাঘরে ঢুকছিলেন৷ তিনি লজ্জা পেয়ে বললেন, “আমার নামে এইসব কী কইতাছো? আমি কবে কোমর ব্যথার কথা কইছি?”
সবাই হেসে ফেলল। ভিডিও কল দীর্ঘায়িত হলো। বাবা আর শাওনও এসে যোগ দিল একসময়। অধরার এত ভালো লাগল! মনে হলো দূরে গিয়েও সবার অনেকটা কাছে চলে এসেছে সে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৩৮
একই বাড়িতে থাকা শুরু করার পরেও ইভা কিংবা ডেভিডের নিজস্ব জীবনযাত্রার তেমন কোনো পার্থক্য হলো না। ডেভিড খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট রেডি করে, তারপর বসে যায় মেকআপ করতে৷ ছদ্মবেশ ধারণের পর তাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ মনে হয়। রোজ ব্রেকফাস্টের সময় ইভার মনে হয় সে একটা ক্লাউনের সাথে বসে নাস্তা খাচ্ছে। কিন্তু সেটা ডেভিডকে বলে না সে, পাছে বেচারা মন খারাপ করে ফেলে।
ইভার সকালটা শুরু হয় প্রচুর পাখির ডাকাডাকি দিয়ে৷ এই বাড়ির পেছনে এত গাছপালা আর পাখির ঝাঁক যে সকাল-সন্ধ্যা কান ঝালাপালা হয়ে যায়৷ ইভার অবশ্য এটা ভালোই লাগে, নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয় না।
আগে তার জন্য সকালের খাবার তৈরি করে দিত খালা, এখন দেয় ডেভিড। ডেভিডের সাথে সকালের খাবার খেতে খেতে হালকা কথাবার্তা হয়। এরপর আর সারাদিন ওর পাত্তা পাওয়া যায় না। ইভার আগেই ডেভিড বেরিয়ে যায়। ফেরে অনেক রাতে। ফিরেই ইভার ঘরের দরজায় একবার নক করে জিজ্ঞেস করে, “ইভা, তুমি ঠিক আছো?”
ইভা উত্তর দেয়, “আমি ঠিক আছি। তুমি?”
“একদম ঠিক। গুড নাইট হানি।” বলে চলে যায় নিজের ঘরে। ডেভিড যে সত্যিই তাকে একেবারেই বিরক্ত করবে না, নিজের মতো থাকতে দেবে এটা ইভা আশা করেনি। সে ভেবেছিল সে এখানে আসার ওর ডেভিডের পাগলামি বেড়ে যাবে। তা যে হয়নি সেজন্য ইভা শুধু স্বস্তি পায়নি, তার এখানে থাকার ইচ্ছেটাও বেড়ে গেছে।
তবে মাঝেমধ্যে ওর নিজেরই ইচ্ছে করে ডেভিডকে জ্বালাতন করতে, ওর সাথে আড্ডা দিতে। দু-একদিন সে গিয়েছিলও, কিন্তু বেচারা সারাদিন কাজ করে এত ক্লান্ত হয় যে ফিরেই দশ মিনিটের মাঝে ভোঁসভোঁস করে ঘুমোতে থাকে। ডেভিড নিজের ঘরের দরজা লক করে না৷ খোলা দরজা দিয়ে দেখা যায় সে হাত পা ছড়িয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে৷ ইভা কিছুক্ষণ ওর বাচ্চাদের মতো ঘুমানোর দৃশ্য দেখে ফিরে আসে। প্রতিবারই ওর প্রচন্ড হাসি পায়। তার এই নৈশ ভ্রমণের কথাও সে ডেভিডকে বলেনি। ভেবে রেখেছে একদিন সুযোগ পেলে সবটাই বলে ফেলবে।
খালা আর বর্তমান খালুর বিয়েতে তারা একসাথেই গেল। নির্বিঘ্নে বিয়ে সম্পন্ন হলো। ইভার এতদিন মনে হতো খালা পর হয়ে গেছে৷ কিন্তু বিয়ের সাদা ঝলমলে পোশাকে খুশিতে লাল হয়ে থাকা খালার দিকে চেয়ে ওর মনের সব গ্লানি উবে গেল কর্পুরের মতো। খালার তো এই সুখটুকু প্রাপ্য! ইভা তার পুরো জীবনের জন্য খালার কাছে ঋণী। খালাকে ভালো দেখতে তার নিজের মন আনন্দে ভরে যাচ্ছে যেন তার নিজের সাথেই চমৎকার কিছু হচ্ছে!
বিয়ে শেষে খালা ইভাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে মেকআপ নষ্ট করে ফেললেন। ইভার ভীষণ কান্না পেলেও সে কাঁদল না৷ খালাকে জড়িয়ে ধরে রাখল আর মাঝে মাঝে চেষ্টা করে গেল হাসানোর। শেষে কোনোরকম কান্না থামলে তাকে সুন্দর একটা উপহার দিয়ে তুলে দিয়ে এলো মি. টেলরের হাতে।
বিয়ে থেকে ফেরার সময় গাড়িতে বসে ইভার একটা কথাই বারবার মনে হতে লাগল, আজ, এই মুহূ্র্তে যদি ডেভিড সেই প্রথমদিককার মতো তাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করত, সে কোনোকিছু না ভেবে নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে যেত। আজ খালাকে কনের বেশে দেখে তার এত ইচ্ছে করছিল নিজেও বিয়ের কনে সাজার, তা সে কাকে বলবে?
কিন্তু ডেভিড প্রপোজ করল না। সে নানা কথা বলে গেল, কিন্তু নিজেদের ব্যাপারে একটা কথাও তুলল না। ইভা খানিকটা আশাহত হলো। অবশ্য বেচারাকে দোষ দিয়ে কী লাভ? সে অনেকবার তাকে পাবার চেষ্টা করে এখন চেষ্টা থামিয়ে দিয়েছে৷ আর এখন পুরো পৃথিবীতে ইভার সবচেয়ে আপনজন তো এই ডেভিডই। যদিও তার সাথে ইভার অফিশিয়ালি কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।
বিয়ের কিছুদিন পর খালা আর খালু চলে গেলেন আমাজন অভিযানে। ইভার নিজেরও ইচ্ছে হলো ডেভিডকে বলতে, চলো আমরাও ঘুরে আসি। কিন্তু বলা হলো না। এত বড় মিশন রেখে কি ডেভিড যাবে? নাকি যাওয়ার কথাটা তাকে বলা উচিত হবে?
******
ইভার ঘুম ভাঙল ছাড়া ছাড়া কোনো একটা দুঃস্বপ্ন দেখে। কী দেখেছিল সেটা ঘুম ভাঙার পর আর মনে করতে পারল না। কয়েক সেকেন্ড পর ধ্যানভঙ্গ হলো তার। উঠে বসল। সে টেবিলে রাখা একটা বইয়ের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সামনে টেবিল ল্যাম্পের হলদে আলো জ্বলছে। প্রথমেই মনে প্রশ্ন এলো, ক’টা বাজে? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল সে। দুটো পয়ত্রিশ। এত রাত!
ডেভিড ফেরার আগে ইভা সাধারণত ঘুমায় না। টেবিলে বসে বই পড়ে। ডেভিড ওকে গুড নাইট জানিয়ে যাওয়ার পর ঘুমাতে যায়৷ এটাই ওর রোজকার রুটিন। এভাবে কখনো সখনো সে ঘুমিয়েও পড়ে, তখন ঘুম ভাঙে ডেভিডের ডাকে। আজ ডেভিড ডাকল না কেন? তবে কি সে ফেরেনি? নাকি ডেকেছিল, সে শুনতে পায়নি?
ইভা দ্রুত উঠে পড়ল। দরজা খুলে বের হয়ে করিডোর ধরে হাঁটতে শুরু করল। ওর ঘরের পর একটা ফাঁকা ঘর, তারপরের ঘরে থাকে ডেভিড। ওদিকে যাবার সময় ইভার হৃৎস্পন্দন ক্রমাগত বাড়তেই লাগল। মনের ভেতরে বাজতে লাগল অশনি সংকেত। ডেভিডের ঘরে আলো জ্বলছে। দরজা হাট করে খোলা। সেদিকে তাকাতেই এক নজরে স্বস্তির আবেশ বয়ে গেল ওর শরীর জুড়ে। ডেভিড শুয়ে আছে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
আরেকটু কাছে গেল ইভা। তক্ষুনি তার স্বস্তিটা পরিণত হলো আতঙ্কে। ডেভিড স্বাভাবিক নেই৷ সবসময়ের মতো আরামে শুয়ে নেই সে। তার চেহারা বিকৃত হয়ে আছে। যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেছে মুখ। অপ্রকৃতিস্থ লাগছে তাকে। ইভা দৌড়ে গিয়ে ওকে সোজা করল।
“ডেভিড! ডেভিড! কী হয়েছে তোমার?”
ডেভিড চোখ মেলল কোনোমতে। ওর চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে আছে। হাত পা নাড়াতে পারছে না। শ্বাস অনিয়মিত। ইভা ভীষণ ভয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য অসাড় হয়ে গেল।
মস্তিষ্ক স্বাভাবিক হয়ে আসতেই সে ছুটে গেল ফোনের কাছে। এম্বুলেন্সে খবর দিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে এলো সেটা৷ ডেভিডকে নিয়ে ও রওনা দিল হাসপাতালে।
ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করা হলো ডেভিডকে। কী হয়েছে ডাক্তাররাও প্রাথমিকভাবে বলতে পারল না৷ ইভাকে শুধু বলা হলো অপেক্ষা করতে। ইভার হাত পা কাঁপতে লাগল। বসে বসে শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগল তার। কী হতে পারে ডেভিডের? কিচ্ছু মাথায় আসছে না। হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকও হয়নি। তাহলে কী হয়েছে?
একা একা আরো অসহায় লাগছে ইভার। খালা খালু নেই, ডেভিডের কোনো আত্মীয়কে সে চেনে না। সম্ভবত ওর কেউ নেইও৷ ইভারও কেউ নেই৷ এত একা ওর কোনোদিন লাগেনি। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীতেই ও একা। ডেভিডের কিছু হয়ে গেলে কী হবে? হাত জোড় করে প্রার্থনা করতে লাগল সে ডেভিডের জন্য।
হঠাৎ মনে পড়ল ডেভিড তাকে তার বাড়িতে ওঠার শুরুর দিকে একটা কথা বলেছিল। বলেছিল যদি তার কিছু হয় তবে যেন ইভা একজনকে একটা মেসেজে সব জানায়। যাকে জানাতে হবে তার নাম্বারটা সে তার মোবাইলে সেভ করে দিয়েছিল। সেটা খুঁজে বের করল ইভা। ‘কোজি’ নামে সেভ করা। সেই নাম্বারে মেসেজে সব জানাল ইভা। তবে ডেভিড তার নাম লিখতে বারন করেছিল বলে লিখল না। শুধু শুরুতে একটা কোড লিখতে বলেছিল, 976421. তাতেই কাজ হয়ে যাবে৷
মেসেজটা সেন্ড করার পরপরই ডাক্তারের কাছ থেকে ডাক এলো তার। জানতে পারল, কোনো একটা মারাত্মক ড্রাগ অতিমাত্রায় সেবন করার কারনে ডেভিডের এই অবস্থা হয়েছে৷ পরিস্থিতি আরো জটিল হতে পারে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু