#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৫০
রাত এগারোটা। শিশির সদ্য ফিরে গোসলে ঢুকেছে। অধরা নিচে গিয়ে খাবার গরম করে বেড়ে ফেলল। সে নিজেও খায়নি। শিশির ফিরলে একসাথে খায় দু’জন। পুরো দিনে এই একটা সময়ে তাদের টুকটাক কথাবার্তা হয়।
অধরা আজ শাড়ি পরেছে। সবুজ শাড়ির সঙ্গে লাল রঙের কাচের চুড়ি পরেছে। সবার সামনে পরতে একটু লজ্জা লাগে বলে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর পরেছে। সাজগোজ শেষ হওয়ামাত্র শিশির ঢুকেছে। তাকে দেখে কয়েক সেকেন্ড থমকে তাকিয়ে হেসে বলেছে, “উফ! তোমাকে দেখে প্রেমে পড়ে যেতে ইচ্ছে করছে।”
“ওমা! কোনোদিন প্রেমে পড়োনি নাকি?”
“পড়েছি তো। বারবার পড়ে পড়ে কোমর ব্যথা হয়ে গেছে। আজ একটু টিপে দিও তো!”
“ব্যাড জোক! যাও গোসল করো, খাবার বাড়ছি আমি।”
শিশির খেতে নেমে দেখল মেন্যুতেও ভালো ভালো জিনিস রান্না হয়েছে। আজ কি বিশেষ কোনো দিন নাকি? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল সে অধরার দিকে। অধরা কিছু বলল না।
খেতে খেতে শিশির জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “আজকে কী বলোতো?”
অধরা মুখ টিপে হেসে বলল, “নাথিং! তোমার এটেনশন ক্রিয়েটের চেষ্টা। ইদানীং তো আমাকে চেনোই না। তাই মনে করিয়ে দিতে চাইলাম তোমার একটা বউ আছে।”
“তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে ভুলে গেছি?”
“তা তো গেছোই।”
“আমার মাথায় সবসময় তুমিই থাকো ম্যাডাম।”
“তাই নাকি? প্রমাণ দাও।”
“কী প্রমাণ?”
“আগামীকাল আমাকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে। আমরা একসাথে কিছু কেনাকাটা করব, বাইরে লাঞ্চ করব, বিকেলে ঘুরতে যাব।”
শিশির অপরাধীর মতো মুখ করে বলল, “কাল আমার অনেক কাজ অধরা…”
অধরার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। সে বলল, “ওকে!”
“স্যরি?”
“ইটস ওকে।”
খাওয়াদাওয়া শেষে শিশির ওপরে চলে গেল। অধরা সব গুছিয়ে নিয়ে ওপরে উঠল। বেশিরভাগ দিনই এমন হয়, সে খাওয়া শেষে গোছগাছ করে ওপরে গিয়ে দেখে শিশির ঘুমিয়ে পড়েছে। সে অনেক পরিশ্রম করে এটা ঠিক, এক কাত হয়ে লম্বা ঘুম দেয়, এক ঘুমে রাত কাবার। তবুও অধরার কষ্ট হয়। এটা কেমন জীবন?
ভিড়িয়ে রাখা দরজাটা খুলে দেখল শিশির বসে আছে বিছানার মাঝখানে। ওর হাতে বাগানবিলাস ফুল তোড়ার মতো করে বানানো।
সে ফুলটা অধরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ডিয়ার ওয়াইফ, প্লিজ একসেপ্ট মাই হার্ট।”
অধরা সেটা না নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেল। তার চোখে পানি জমে গেছে।
শিশির বারান্দায় গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল অধরাকে।
আকাশে গোল একটা চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নায় ভাসছে চারপাশ। বাতাসে হাস্নাহেনার ঘ্রাণ। শিশির অধরার ঘাড়ে চুমু খেয়ে বলল, “বিশ্বাস করো, আমি সত্যি বলেছিলাম। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন তোমাকে আমার সারাক্ষণই মনে পড়ে।”
অধরার এবারও মনে হলো শিশির ফ্লার্ট করছে, কিন্তু সে তবুও গলে গেল ঠিক মোমের মতো।
পরদিন দুপুরের দিকে শিশির অধরার অফিসে হানা দিল। তাকে ধরে নিয়ে গেল লাঞ্চ করতে। তারপর শপিং, ঘোরাঘুরি শেষে ফিরে এলো মায়াঞ্জরীতে।
অধরার মনে হলো, বহুদিন পর সে সত্যিকারের একটা দিন কাটালো।
**********
প্রথমে সবটা যেন অন্ধকার হয়ে গেল বলে মনে হলো। তারপর চোখের সামনে রঙটা পরিষ্কার হয়ে এলো। সবুজ! ওল্টানো প্রত্যেকটা কার্ডের রঙ সবুজ! ডেভিডের মনে হলো বুকের ভেতর থেকে বড় একটা বোঝা সরে গেল।
স্ক্রিনের কার্ডগুলো সরে গেল দ্রুত। আরেকটা নতুন গেম আসবে। ডেভিডের মনে হচ্ছে প্রতিটা সেকেন্ড একেকটা বছরের মতো। বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা হচ্ছে। মাথা ছিঁড়ে আসছে ব্যথায়। আতঙ্ক এক পলকের জন্য কমে আবার এক নতুন রূপে হাজির হলো তার সামনে। আরেকটা চ্যালেঞ্জ।
স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে একটা ঘর। ঘরের মাঝখানে চারটা বাক্স রাখা।
ঘরের এক দেয়ালে ঝুলছে একটা মুখোশ। মুখোশের নিচে লেখা-
“I speak one truth and three lies.
But only the truth is silent.”
প্রতিটি বাক্সের সামনে লেখা চারটি লাইন:
Box A: “আমি মিথ্যা বলছি।”
Box B: “Box C সত্য বলছে।”
Box C: “Box D মিথ্যে বলছে।”
Box D: “Box B মিথ্যে বলছে।”
তিনটা বাক্স ভুল বলছে, একটা সত্য বলছে। সত্য বাক্স কোনটা সেটা বের করতে হবে।
এবার টাইমার না, একটা ঘড়ি চলছে। এক মিনিট সময়। ঘড়িটা ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। কতক্ষণ সময় এটা বুঝতে গিয়েই তিন সেকেন্ড চলে গেল। প্রতিটা সেকেন্ডের ভগ্নাংশও মূল্যবান। দ্রুত প্রশ্নের দিকে মনোযোগ দিল সে। মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ধাঁধাটা নিঃসন্দেহে সহজ। কিন্তু এত অল্প সময়ে সেটা সমাধান করা ভীষণ কঠিন। মাথা স্থির রেখে প্রতিটা যুক্তি মাথায় ঢোকানোর চেষ্টা করল সে।
Box A বলছে সে মিথ্যে বলছে। সে যদি সত্য হয়, মানে তার স্টেটমেন্ট সত্য হয়, তার মানে এটা মেনে নিতে হবে যে সে মিথ্যে বলছে। এটা একটা সত্য- মিথ্যার প্যারাডক্স তৈরি হয়। তাই A কে বাদ দেয়া যায়।
Box B বলছে C সত্য বলছে। B কে সত্য ধরে নিলে C ও সত্য। কিন্তু এখানে সত্য একটাই। তাই Box B ও বাদ।
Box C বলছে যে D মিথ্যে বলছে। আবার D বলছে B মিথ্যে বলছে। যেহেতু B ইতিমধ্যে মিথ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে, তার মানে D সঠিক বলছে। আর D সত্য বললে C মিথ্যে বলছে।
এক মিনিট শেষ হয়ে গেল। ঠিক ৬০ তম সেকেন্ডের কাটা নড়ার সাথে সাথে Box D এর বাটনে চাপ দিল ডেভিড। ওর হৃদপিন্ড থেমে গেল যেন। দেরি হয়ে গেল না তো?
এবার উত্তর দিতেও যেন বহু দেরি হলো। স্ক্রিনটা এত আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে কেন? নাকি তার কাছে সময় ধীর মনে হচ্ছে? চোখের সামনে লাল সবুজ হলুদের একটা কোলাজ তৈরি হয়ে গেল। ডেভিডের মনে হলো সে কিছু দেখছে না, সব অন্ধকার হয়ে গেছে।
কিসের একটা শব্দে আস্তে আস্তে তার চোখের ঘোলাটে ভাব দূর হয়ে সামনেটা পরিষ্কার হয়ে গেল। কোথায় স্ক্রিন? সামনে নিরেট দেয়াল। তাহলে কি সে হেরে গেল? বন্দি হয়ে গেল চিরতরে?
রিমোটটা ছুঁড়ে ফেলে মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠল সে। ইভা… ইভাকেও কি সে মেরে ফেলল?
ইভা! ইভা! ইভা! বিড়বিড় করতে থাকল ডেভিড।
আবার একটা শব্দ হলো। মসৃন কোনো শব্দ। সে পাগলের মতো চারদিকে তাকাল। একদিকের দেয়ালে দরজার মতো অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। রকম্যান যে দরজা দিয়ে বেরিয়েছে সেটা না, উল্টোদিকের দরজা।
মসৃন গতিতে দরজাটা স্লাইড করে সরে গেল। পেছনে আলোকোজ্জ্বল একটা ঘর দেখা যাচ্ছে।
উঠে দাঁড়াল ডেভিড। পুরো শরীর ব্যথা। ভীষণ মেরেছিল লোকগুলো। কিন্তু ব্যথাটা তার মনে জায়গা করে নিতে পারল না। প্রচন্ড কৌতুহলে সে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল দরজার দিকে। ওপাশের ঘরটা অত্যন্ত সুসজ্জিত। ভেতরে ঢুকে যেন ডেভিডের পুরো শরীর স্বস্তিতে ডুবে গেল। সাদা ধবধবে বিছানায় ঘুমিয়ে আছে ইভা। স্নো হোয়াইটের মতো লাগছে তাকে!
সে ইভার দেখা পেয়েছে। তার মানে তার শেষ উত্তরটাও সঠিকই ছিল!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৫১
ভোরবেলা দুঃসংবাদটা শুনল অধরা। সে মাত্র নামাজ পড়ে বারান্দায় এসে বসেছে। শিশির চলে গেছে হাঁটতে। পূর্ব আকাশে সদ্য লাল আভার ছোঁয়া নতুন একটা দিনের সূচনা করছে। প্রকৃতি দেখায় মগ্ন অধরা হঠাৎ চমকে উঠল শিশিরের ফোনের কর্কশ শব্দে। শিশির ফোন রেখে যায় এই সময়ে। অধরা গেল ফোন ধরতে। এত ভোরে কার কল এলো? অসময়ে কল এলে ভয় ভয় লাগে। মনে হয় না জানি কে কোন অঘটনের খবর জানাতে বসেছে!
ভয়টা সত্যি হলো অধরার। শাওন ফোন করেছে। তাকে খুব অস্থির বলে মনে হচ্ছে। কাঁপা গলায় সে শুধু বলতে পারল, “শাওলী হসপিটালে। ওর অবস্থা ভালো না।”
হসপিটালের নাম জেনে নিল অধরা। ভয়ে তার বুক কাঁপছে। শাওলী সন্তান সম্ভবা ছিল। ওর কী হলো হঠাৎ করে? শিশিরও নেই, খবরটা কেমন করে সবাইকে দেবে? প্রেগ্ন্যাসির প্রথমদিকে শাওলী বেশ কিছুদিন এখানে থেকে গেছে। শরীর খারাপ হয়ে যাওয়াতে চলে গিয়েছিল। এরপর থেকে সে বাপের বাড়িতেই থাকে। শাওনও দেখা যায় বউ বাচ্চার টানে এখন প্রায়ই শ্বশুরবাড়িতে রাত কাটায়। সব তো ঠিকই ছিল, হঠাৎ কেমন করে কী হয়ে গেল?
পায়ে পায়ে নিচতলায় নামল অধরা। মা বাবার ঘরে আলো জ্বলছে। দু’জনেই জেগেছেন। অধরা একবার উঁকি দিল ঘরে। গল্প করছে দুজনে হাসিমুখে। সে চাইলেও কিছু বলতে পারল না।
শিশির ফিরল আধঘন্টা পর। ফেরামাত্র তাকে কথাটা জানাল অধরা। শিশির বলল, “মা বাবাকে না জানিয়ে ভালো হয়েছে। এতদূর ওদের নেয়াও যাবে না, এখানে বসে টেনশনে আরো শরীর খারাপ হয়ে যাবে। আমরা গিয়ে দেখি। অবস্থা বুঝে জানানো যাবে তাদের। এখন রেডি হও, অফিসের কথা বলে বেরিয়ে পড়ি।”
*
হাসপাতালের করিডোরে শাওনকে পাওয়া গেল। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখ লাল হয়ে আছে। অদূরে শাওলীর মা বাবা আর ভাইকে দেখা গেল বসে আছ। শাওলী কেবিনে। মিসক্যারেজ হয়ে গেছে ওর। ডি এন্ড সি করানো হয়েছে, এখনো জ্ঞান ফেরেনি।
শাওন কাঁপা গলায় বলল, “সব ঠিক ছিল, এমনিতেই ওর প্রেগন্যান্সিতে কিছু জটিলতা ছিল। বেড রেস্টে ছিল। নিয়মিত চেকআপ হচ্ছিল। কিন্তু কী হলো বুঝলাম না। মাঝরাতে ওর চিৎকার শুনে আমার ঘুম ভাঙে। দেখি বাথরুমের সামনে পড়ে আছে।”
শিশির শাওনের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়াল। শাওনের গা অল্প অল্প কাঁপছে। নিজের সন্তান হারানের বেদনা কী ভয়ানক হতে পারে তার কিছুটা ঝলক বুঝি পেল সে। বাবার অসুস্থতার সময় শাওন খুব ঠান্ডা মাথায় সবকিছু হ্যান্ডেল করেছিল। নিজে শক্ত থেকে সবাইকে সামলেছিল। আর আজ তার অনাগত সন্তানের জন্য এতটা ভেঙে পড়েছে! শিশির জড়িয়ে ধরল ভাইকে।
ওরা দুপুর পর্যন্ত সেখানেই রইল। শাওলীর শরীর এখন মোটামুটি সুস্থ। দেখা করতে গেল ওরা। নিঃশব্দে কাঁদছে শাওলী। চোখ বসে গেছে। বহু যত্নের চেহারা ভেঙে গেছে। অধরার ভীষণ মন খারাপ হয়ে রইল।
বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরল ওরা। মা বাবাকে ধীরেসুস্থে খবরটা জানাল। শুনে তারা পাথেরর মতো বসে রইলেন।
অনেকদিন পর তাদের বাড়িতে একটা সুখবর এসেছিল। সেটাও মাঝপথে হারিয়ে গেল।
সন্ধ্যার দিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অধরার মনে হলো মায়ামঞ্জরী আস্ত অন্ধকারের একটা স্তুপের ভেতর ঢুকে গেছে। ভুতুড়ে লাগছে সবকিছু।
********
ইভার কাছে ছুটে গেল ডেভিড। ওকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল। কিন্তু ইভার কোনো সাড়া নেই। কী হলো ওর? আচমকা ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল ডেভিডের শরীর বেয়ে। সে ইভার পালস চেক করল। পাওয়া যাচ্ছে না। পাগলের মতো পালস খুঁজতে লাগল ডেভিড।
অবশেষে পেল। চলছে!
চোখে পানি চলে এলো ওর। ইভাকে ঝাঁকুনি দিতে লাগল সে। “কী হলো ইভা তোমার? ওঠো প্লিজ! ইভা! প্লিজ!”
ঝাঁকুনির চোটে চোখদুটো সামান্য মেলল ইভা। ঘোলাটে চোখ। মনে হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ঠোঁট সামান্য নড়ল ইভার। কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। আশেপাশে খুঁজল ডেভিড। পানি জাতীয় কিছু নেই।
এমন সময় একটা দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকল একটা মেয়ে। ডেভিড যেমন মেয়েটাকে দেখে চমকালো, তেমনই মনে হলো মেয়েটাও ডেভিডকে দেখে একইরকমভাবে চমকে গেছে।
আগে না দেখে থাকলেও এক পলকেই ওকে চিনে ফেলল ডেভিড। বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণ চোখ, ভীষণ আবেদনময়ী শরীর। এটা জেন না হয়ে যায় না। এই মেয়েই ওই গোলমেলে ধাঁধাগুলো তৈরি করেছিল!
জেন চমকে গেলেও উপস্থিত বুদ্ধি হারালো না। মুহূর্তের মধ্যে কোমর থেকে পিস্তল বের করে তাক করল ডেভিডের দিকে। সে বুঝতে পারছে না এই ছেলেটা বের হলো কী করে! সে তো কেবল মজা করার জন্য প্রোগ্রামটা বানিয়েছিল। ডেভিডের মানসিক অবস্থা খারাপ করে দেবার পর এই গোলমেলে ধাঁধাগুলোর উত্তর এত অল্প সময়ে বের করা মোটেও সহজ ছিল না ওর জন্য। জেন চেয়েছিল যাতে ওদের শিকার ধরার পদ্ধতিটা একটু অভিনব হয়। কিন্তু নিজেরাই যে ফাঁদে পড়ে যাবে সেই ধারণা তার ছিল না। ডেভিড বেরিয়ে এসেছে, তার মানে রকম্যান সেখানেই বন্দি হয়ে আছে! গলা শুকিয়ে আসছে জেনের।
তার এক হাতে পিস্তল, আরেক হাতে দরজার নব ধরা ছিল। পিস্তল তাক করে রেখেই সে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বাইরে থেকে লক করে দ্রুত কম্পিউটারের সামনে বসে গেল। রকম্যান যে ঘরে আটকে আছে সেই ঘরের কোড নাম্বার দিয়ে ঘরটা আনলক করে ফেলল। তারপর যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে পড়ল ফ্ল্যাট থেকে। লিফট সৌভাগ্যক্রমে এই তলাতেই ছিল। তাতে চড়ে নিচে নেমে গেল দ্রুত। রকম্যানের বের হবার কথা পেছনের ফায়ার এক্সিট দিয়ে। পার্কিং থেকে গাড়ি নিয়ে বাড়ির পেছনের দিকে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল রকম্যানের বের হবার।
এদিকে জেন দরজা বন্ধ করতেই ডেভিড বুঝে গেল আবারও আটকা পড়েছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝল এটা একটা বহুতল ভবন। এত ওপর থেকে না বের হওয়া যাবে, না কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে। সে ঘরেই এমন কিছু খুঁজতে লাগল যেটা দিয়ে বাইরে যোগাযোগ করা যাবে। কিছুই দেখল না সেরকম।
ইভা ততক্ষণে একটু ভালোমতো চোখ খুলে চেয়েছে। কিন্তু হাত পা নাড়ার শক্তি পাচ্ছে না। কথা বলছে এলোমেলোভাবে।
ডেভিড ওর মুখটা দুই হাতে তুলে জোর দিয়ে বলল, “ইভা! প্লিজ কথা বলার চেষ্টা করো। তুমি এখানে কিভাবে এসেছ? তুমি কি এই জায়গার ঠিকানা জানো?”
ইভা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ডেভিড ওর মুখের কাছে মুখ এনে বলল, “প্লিজ ঠিকানাটা বলো ইভা। ফর গড সেক, প্লিজ! আমি জানি ওরা তোমাকে ড্রাগ করেছে, কিন্তু তবুও প্লিজ আমার জন্য একটু চেষ্টা করো মনে করার।”
ইভা কিছুতেই কিছু মনে করতে পারল না। হয়তো সে এটাও বুঝতে পারেনি যে সে কোথায় আছে বা কী হচ্ছে।
ইভার অবস্থা দেখে ডেভিডের মাথা আরো বেশি গরম হতে লাগল। রকম্যান আর জেনের ওপর রাগে পুরো শরীর কাঁপতে লাগল। একটা ঘুষি দিল সে বেডসাইড টেবিলে। হঠাৎ জিনিসটা চোখে পড়ল তার। ইভার হ্যান্ডব্যাগ। বিছানা আর বেডসাইড টেবিলের মাঝখানে পড়ে আছে। ওটা তুলে নিল সে। ভেতর থেকে ইভার মোবাইল বের হলো।
মোবাইলের পাসওয়ার্ড জানা ছিল ডেভিডের। আনলক করে সে দ্রুত কল করল বন্ধু মাইককে। সে যেন দ্রুত ফোর্স নিয়ে চলে আসে। জায়গাটার লোকেশন সে পাঠিয়ে দিল মাইকের কাছে।
এবার দরজার দিকে নজর দিল। যে দরজা দিয়ে সে ঘরে ঢুকেছিল সেটা এর মধ্যে দেয়ালে মিশে গেছে। ওখানে কোনো দরজা আছে সেটা বোঝার উপায় নেই। আর যে দরজা দিয়ে জেন ঢুকেছিল সেটা পরীক্ষা করে দেখা গেল ভারী কাঠের দরজা। নবের ওপরে একটা ছোট্ট ডিভাইস আছে যাতে জিরো থেকে নাইন পর্যন্ত বাটন বসানো। তার মানে দরজাটা কোড দিয়ে খুলতে হবে।
কিন্তু কোডটা কী? ভাবতে ভাবতেই দরজার পাশের ছবিটাতে নজর গেল তার। দেয়ালে টানানো একটা পেইন্টিং। তাতে নগ্ন এক নারী পানিতে শরীর ডুবিয়ে রেখেছে। ওর শরীরটা আবছা দেখা যাচ্ছে। মেয়েটার চেহারার সাথে জেনের মিল আছে। হতে পারে এটা জেনেরই আরও ইয়াং এজের ছবি, কিংবা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে তৈরি। কারন ছবিটা পুরোপুরি বাস্তব মনে হচ্ছে না।
সে ছবিটা খুঁটিয়ে দেখল। কিছু পেল না। এবার সে একটু পিছিয়ে গেল। খানিক দূর থেকে চোখ আধবোজা করে ছবিটার দিকে তাকাল। এবার ছয়টা নাম্বার ফুটে উঠল ছবির ওপর। টু নাইন ফোর থ্রি সিক্স জিরো।
নাম্বারটা এন্ট্রি করল সে দরজায়। ক্লিক করে দরজা খুলে গেল।
বেরিয়ে ডেভিড দেখল অফিসের মতো করে সাজানো ফ্ল্যাটে একটা কাকপক্ষীও নেই। সবাই পালিয়েছে।
মূল দরজাটার কাছে গিয়ে দেখল ওটাও লক করা। তবে এটা সহজেই খুলতে পারল ডেভিড। এই দরজার পাশেও একটা এবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং ঝোলানো, যেটা সামান্য দূর থেকে চোখ সরু করে দেখলে নাম্বার ভেসে ওঠে।
সবগুলো দরজা খোলার পর সে ছুটে বেরিয়ে গেল ফ্ল্যাট থেকে। যাবার আগে দরজা লক করে যেতে ভুলল না। ভেতরে ইভা রয়েছে। সে বের হবার আগে দেখেছে ইভা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। হয়তো খুব কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে ওকে।
ডেভিড লিফটের দিকে গেল। লিফট নিচে। ওটা ওপরে উঠতে অনেক সময় লাগবে। সে সিঁড়ির দিকে গেল। শরীরের প্রচন্ড ব্যথা উপেক্ষা করে প্রায় উড়ে চলল সে। কোথা থেকে এই মনোবল এসেছে সে জানে না। শুধু চাইছে নিজের শেষ শক্তিটুকু কাজে লাগাতে।
বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে চারপাশে তাকাল সে। জেন বা রকম্যান কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এতক্ষণে কোথায় পালিয়েছে কে জানে!
সে ছুটে পেছনের দিকে চলে গেল। তার মন বলছ রকম্যান ছাড়া পেলে ফায়ার এক্সিট দিয়ে বের হবে বা ইতিমধ্যে বের হয়ে গেছে।
সেদিকে গিয়েও রকম্যানের দেখা পাওয়া গেল না। পুলিশ ফোর্স পৌঁছে গেছে ততক্ষণে। ঘেরাও করে ফেলেছে বাড়িটা। তাদের সাথে খোঁজা শুরু করল ডেভিড। আশেপাশের এলাকা চষে ফেলতে লাগল।
*
রকম্যান একটা কফিশপের ভেতরে ঢুকে বসেছিল। জেন গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল ওর জন্য। কিন্তু গাড়ি পর্যন্ত যেতে পারেনি সে। তার আগেই পুলিশ চলে আসায় চট করে সে ঢুকে পড়েছে কফিশপে। আর জেন গাড়ি হাঁকিয়ে পালিয়ে গেছে। ভালোই হয়েছে।
জুবুথুবু হয়ে বসে রইল সে। কাচঘেরা জায়গাটা বাইরে থেকে ঠিকই দেখা যায়। তাকেও দেখে ফেলার সম্ভাবনা আছে। একবার মনে হলো ছুটে ভেতরে কিচেনের দিকে চলে যেতে। কিন্তু সন্দেহজনক আচরণ করলেই ধরা পড়ে যাবে তৎক্ষনাৎ। চারদিকে পুলিশি টহল এমনিতেই সবার মনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একটা কফি অর্ডার দিল সে। যথাসম্ভব কাচের দিক থেকে চেহারা সরিয়ে রাখল।
ডেভিডের চোখেই প্রথম পড়ে গেল সে। কারন এই জামাটা পরে সে ডেভিডের সামনেই গিয়েছিল একটু আগে।
ডেভিড চট করে ধরে ফেলল তাকে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে কলার ধরে টেনে তুলল তাকে। বের করে নিয়ে এলো টেনে হিঁচড়ে।
রকম্যান প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিল। খানিক ভীতও হয়েছিল। কিন্তু বেরিয়ে দেখল আশেপাশে কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো অন্যদিকে গেছে। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চট করে রিভলবারটা বের করে ডেভিডের কপালের সামনে ধরল। সেই মুহূর্তে ওর ভেতরে একটা পৈশাচিক আত্মতৃপ্তি খেলে গেল। সে নিজে ধরা পড়বে ঠিকই, কিন্তু তার আগে তার অতি ধুরন্ধর এই সহকর্মীকেও শেষ করে দিয়ে যাবে।
ঠোঁটের কোণটা হাসিতে বেঁকে গেল তার। ডেভিডের চোখে চোখ রেখে ট্রিগার টানল সে।
পরক্ষণেই পরিস্থিতি বদলে গেল। একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল রকম্যানের মেরুদণ্ড বেয়ে। কোনো গুলি নেই রিভলবারে! তখন ঘরটাতে আটকা পড়ে অস্থির হয়ে পাগলের মতো দরজা লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে চেম্বার খালি করে ফেলেছিল সে। আর রিলোড করার সময় পায়নি।
বিষয়টা বোঝার সাথে সাথে ডেভিড ওর হাতটা ধরে বাঁকিয়ে ওকে জাপটে ধরল পেছন থেকে। তবে প্রচন্ড শক্তিধর রকম্যানের সাথে পেরে উঠল না। সহজেই তাকে ঝেড়ে ফেলে ঘুষি বাগাল তার থুঁতনি বরাবর। প্রবল ব্যথায় কয়েক সেকেন্ড চোখে অন্ধকার দেখল ডেভিড। তারপর প্রচন্ড আক্রোশে আবার ছুটে গেল রকম্যানের দিকে। দুজনের হাতাহাতি লড়াই শুরু হলো। ডেভিডই বেশি আহত হলো।
এই পুরো ঘটনা চলল এক মিনিটেরও কম সময় ধরে। ততক্ষণে পুলিশেরা পৌঁছে গেল সেখানে। দু’জনকে ছাড়িয়ে ফেলল দ্রুত। রকম্যানকে এরেস্ট করে ধরে নিয়ে গেল তাদের সাথে।
ডেভিডকে শক্ত করে ধরে রাখল মাইক। ডেভিড রকম্যানের চলে যাওয়া পর্যন্ত দেখতে পারল। তারপরেই জ্ঞান হারাল। তার সব শক্তি এতক্ষণে ফুরিয়েছে৷
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামাঞ্জরী
পর্ব-৫২
জানালা খুলতেই মিষ্টি বাতাস ছুঁয়ে গেল অধরাকে। বাইরে তাকাল সে। সদ্য ভোরের আলো ফোটা সকালটা কত সুন্দর! মায়ামঞ্জরীর ঝোপালো গাছপালা, শখের বাগান, গাছে গাছে দৌড়াদৌড়ি করা কাঠবিড়ালি আর ভেসে আসা নদীর ঘ্রাণ৷ অনেকদিন হয়ে গেল এই বাড়িটায় আসবার। অধরার এখানে এত শান্তি লাগে যে মনে হয় কোথাও আর এই শান্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না৷
শিশির ভোর হতে হতেই বেরিয়ে গেছে। সে এখন আরো বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে মানুষটা। অধরার এত ব্যস্ততা ভালো লাগে না। ব্যবসাটা সুন্দরমতো শুরু হয়েছিল, তাদের সংসার চমৎকার চলছিল, তাতেই কী হতো না? কিন্তু শিশিরের আরো চাই। বাবার মতো পজিশনে যেতে হবে তার। ততটা বড় না হতে পারলে নাকি সে মনে শান্তিই পাবে না। সবার মনের শান্তির সংগা কত ভিন্ন রকমের!
কিছুদিন আগে গাড়ি কিনেছে শিশির। আগে যে ব্র্যান্ডের গাড়ি ব্যবহার করত সেটাই, একই রঙ। অদ্ভুত রকমের আনন্দ কাজ করছিল ওর ভেতর। ওকে অনেকটা আগের মতো লাগে এখন৷ যেমনটা সেই শুরুর দিকে লাগত তেমন। তৃপ্তি নিয়ে হাসতে পারত না শিশির। সেই তৃপ্তিটা ফিরে আসছে ওর মাঝে।
এখন সে অধরাকে অফিসে ছেড়ে দিয়ে তারপর নিজের অফিসে যায়। এটুকু সময় তাদের কী দারুণ কাটে! শুধু এটুকুই যেন ওদের নিজের সময়। গাড়ি কেনার আগে সেটা হতো না। দুজনের রাস্তা কিছুদূর গিয়েই ভিন্ন হয়ে যেত। তাই আলাদা আলাদাভাবেই যেত ওরা। এখন একটু দেরি হলেও শিশির ওকে ড্রপ করে দিয়ে যায়। আর এই সময়টুকুর জন্যই শিশিরের গাড়িটা ভীষণ আদুরে লাগে অধরার কাছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এটাকে জড়িয়ে ধরে রাখছে। তবে আজ জরুরি কাজে শিশির আগেই বেরিয়ে গেছে।
অধরা চায়ের সাথে সকালের নাস্তা গুছিয়ে ফেলল সবার জন্য। এরপর রেডি হয়ে রওনা দিল অফিসে। অনেকদিন পর পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ওঠার কারনে কি না কে জানে, অধরার ভীষণ গা গুলিয়ে উঠতে লাগল। কোনোরকম বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বমি করে ফেলল সে। অফিসে যেতে এখন রিকশা ধরতে হবে। অধরার শক্তিই হলো না রিকশা ডাকার। সে ফুটপাতে বসে পড়ল। শরীরটা হঠাৎ এমন লাগছে কেন? মনে হচ্ছে পৃথিবীটা বনবন করে ঘুরছে!
*********
ইভা চোখ মেলে তাকাল। সাদা একটা ছাদ দেখতে পেল চোখের সামনে। সে মনে করার চেষ্টা করল কোথায় আছে। চট করে মনে পড়ল না৷ একটু সময় লাগল। আস্তে আস্তে পুরো শরীরের চেতনা ফিরতে শুরু করেছে। আর স্নায়ু সাড়া দেবার সাথে সাথেই সে বুঝতে পারল তার হাতে কারো হাত ধরা।
এতক্ষণ ছাদের দিকেই চেয়েছিল ইভা। এখন পাশে চাইল। ডেভিড! বুকের রক্ত ছলকে উঠল ইভার। ডেভিড কোথা থেকে এলো? চারধারে ভালোমতো চেয়ে ইভা বুঝল এতা একটা হসপিটাল। ডেভিড তার পাশে বসে তার হাতে হাত রেখে ঘুমিয়ে আছে। প্রচন্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে। চোখের কোল বসে গেছে। মুখচোখ শুকনো। ডেভিড কি অসুস্থ?
ইভা নড়েচড়ে বসতেই ডেভিডও উঠে পড়ল। ওকে জেগে উঠতে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেল ডেভিড। ভীষণ খুশিতে ছলছল করে উঠল চোখ। নিজের আনন্দ আর আবেগ সামলাতে না পেরেই যেন ইভার খুব কাছাকাছি চলে এলো সে। আলতো করে ওর ঠোঁটে চুমু খেল। এই প্রথমবার। ইভার মনে হলো শত বছরের তৃষ্ণা জমে ছিল ওর বুকে। ইচ্ছে হলো ডেভিডকে বলতে, আর একটু… কিন্তু ডেভিড সরে গেল। ইভাও কিছু বলতে পারল না।
ডেভিড জানাল সে আর ইভা একই হাসপাতালে ভর্তি। মাঝরাতে তার অস্থির লাগছিল বলে চুপিসারে নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে তার কাছে চলে এসেছে সে।
ইভা কান্নাভেজা স্বরে বলল, “তুমি ঠিক আছো তো ডেভিড?”
“হ্যাঁ। একদম ঠিক আছি।”
“আমরা এখানে কিভাবে এসেছি?”
“সেটা অনেক লম্বা গল্প ইভা। পরে শোনাব।”
“ওকে! তাহলে এখন লক্ষী ছেলের মতো নিজের কেবিনে গিয়ে ঘুমাও। খুব অসুস্থ দেখাচ্ছে তোমাকে।”
ডেভিড হেসে বেরিয়ে গেল। ইভারও চোখে ঘুম জুড়ে এলো। সাথে চমৎকার একটা স্বপ্ন।
*********
শিশির কাজে ব্যস্ত ছিল। ছোটোখাটো একটা অফিস নিয়েছিল সে শুরুর দিকে। সেটাই এখনো চলছে। তবে কর্মী বাড়ছ, বড় অফিস খুঁজতে শুরু করেছে সে। অতি দ্রুত শিফট হতে হবে। ব্যবসায়ে যে দারুণ অগ্রগতি হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিজনেস ডিলগুলো ছোটো থেকে বড় হচ্ছে। বড় বড় প্রজেক্ট হাতে পাচ্ছে সে। এগুলোর পেছনে খাটতে হচ্ছে দিনরাত। নিজের কথা ভুলে যাচ্ছে সে। ভুলে যাচ্ছে সব ছোটোখাটো বিষয়গুলো। তবে নিজের পরিবারকে সে ভোলে না কখনোই। ওর পরিবারের লোকজন ভাবে ও সবাইকে ভুলে কাজে ডুবে গেছে। কিন্তু কথাটা তো সত্য নয়। বিজনেস মিটিংয়ের সময় তার মাথায় সবসময় থাকে বাবা। নিজের এগিয়ে যাওয়ার সময়টুকুতে মনে পড়ে মায়ের কথা, যে ছোটোবেলায় বাবার একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়ার গল্প শোনাতো তাদের। সেই গল্পের মতোই যেন বেড়ে উঠছে শিশির।
সবচেয়ে বেশি অভিযোগ অধরার। তার ধারণা শিশির তাকে অসম্ভব রকমের ইগনোর করে। অথচ শিশির তার অফিসে অনেকগুলো ইনডোর প্ল্যান্ট লাগিয়ে মায়ামঞ্জরীর একটা আবহ আনার চেষ্টা করেছে যাতে তার মনে হয় অধরা সবসময় তার সাথে আছে। কথাটা অধরা জানে না। কেন যেন শিশিরের জানাতে ইচ্ছে করে না। কাজের জন্য যেতে না পারলেও রোজ অধরার অফিস ছুটির সময় তার মন ওখানেই পড়ে থাকে। ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে অধরাকে সারপ্রাইজ দিতে। দেয়া হয়ে ওঠে না। রোজ ভাবে একটু সময় আজ বের করবে। কিন্তু ব্যস্ততায় হয়ে ওঠে না। হাজারটা কাজ চারদিকে। যেন কাজের সমূদ্রে ডুবে গেছে সে। তবে এই কাজগুলোকেই সে বুক পেতে আপন করে নিয়েছে।
শুধু বাবা মা আর অধরাই না, সেই দুর্ঘটনার ওর শাওনের সাথেও তার রোজ যোগাযোগ হয়। দুই ভাইয়ের মধ্যে বয়স আর ব্যক্তিত্বের ব্যবধানের জন্য যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল সেটা একটু একটু করে কমে যেন বন্ধুত্বে রূপ নিচ্ছে। শাওনের সাথে রোজ কথা হয় ওর। ফেরার সময় রাস্তায় লম্বা জ্যাম পড়লে শাওনকে কল করে সে। দু’জন দু’জনার সাথে শেয়ার করে রোজকার কথাগুলো, সেসব কথা যেগুলো বাবা মা বা স্ত্রীর সাথেও ঠিক শেয়ার করা যায় না। হয়তো সব সম্পর্কের আলাদা আলাদা কথা থাকে।
কাজের ফাঁকেই ফোনটা এলো। অধরার কল। এই সময়ে অধরার অফিসে ঢোকার কথা। এখন কেন ফোন করছে? সে ধরল কলটা। অধরা না, অন্য একটা গলা বলল, “আপনার ওয়াইফ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে প্লিজ নিয়ে যান।”
শিশির ছুটল ঝড়ের বেগে। অধরা বসেছিল এক মহিলার কাঁধে মাথা রেখে। সেই মহিলাই ফোন করেছিল শিশিরকে। এখন অধরাকে মোটামুটি সুস্থ দেখাচ্ছে। তখন ফোনে কথাও বলতে পারছিল না।
শিশির ওকে নিয়ে হাসপাতালে চলল। অধরা বারবার বলল, তার কিছু হয়নি। শুধু শরীরটা একটু দুর্বল আর মাথা ঘুরে গিয়েছিল। কিন্তু শিশির ওর কথা শুনল না। সোজা হাসপাতালের দিকে গেল।
*******
ইভা আর ডেভিড দু’জনেই রিলিজ পেয়ে একই দিনে বাড়ি ফিরল। বাড়ির অবস্থা খারাপ। ধুলোবালিতে একাকার হয়ে আছে। কয়েকদিনেই চেহারা এমন হয়ে গেছে দেখে ইভার মাথায় হাত পড়ল।
ওরা দু’জন মিলে একটু একটু করে ঘরের সাথে সাথে নিজেদের মানসিক ক্লান্তিও মুছে ফেলতে শুরু করল। ওরা একসাথে কাজ করে, খুনসুটি করে, রান্নাবান্না করে, খায়, একে অপরের ঔষধের কথা মনে করিয়ে দেয়, আর রোজ রাতে ঘুমাবার আগে একটু বাইরে থেকে হাঁটাহাঁটি করে আসে রিফ্রেশমেন্টের জন্য। দু’জনেরই মনে হয় জীবনটা এভাবে কেটে গেলে মন্দ হতো না। ওদের মানসিক যে ধকল গেছে তারপর এই সময়টা যেন খুব জরুরি ছিল সেরে ওঠার জন্য।
ওদের বাড়ি ঝকঝকে চকচকে বাসযোগ্য হওয়ার সাথে সাথে ইভার মনে নতুন স্বপ্ন জাগে। সে একটু একটু করে নিজের স্বপ্নটাকে একটা বাস্তব রূপ দেবার চেষ্টা করতে থাকে ডেভিডের অগোচরে।
ওদের সম্পর্কটা এখনো যেনা একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। সেটা শারীরিক অসুস্থতা নাকি মানসিক ভঙ্গুর অবস্থার কারনে দুজনেই সেটা নিয়ে কনফিউজড। তবে কেউ খোলাখুলি কিছু বলছে না। ডেভিডের কী প্ল্যান জানে না ইভা, তবে তার প্ল্যানটা সিম্পল এন্ড গর্জিয়াস!
********
শিশির অধরা মায়ামঞ্জরীতে পৌঁছুল সন্ধ্যা মেলবার সময়। পাখিরা তখন কিচিরমিচির করে মাথা ধরিয়ে ফেলার তাল করছে। কত কত চড়ুই যে বাস করছে এই পুরানো বাড়ির ঘুলঘুলিতে তার ইয়ত্তা নেই। রোজ সন্ধ্যা মেলবার পর বাড়ি ফেরে বলে অধরার এসব শোনার ভাগ্য হয় কেবল ছুটির দিন। আজ এই পাখিদের কিচিরমিচির যেন আরো দ্বিগুণ ভালো লাগতে লাগল তার।
অধরাকে ওপরে উঠিয়ে দিয়ে শিশির আবার নিচে চলে গেছে। বোধহয় দোকানে গেছে মিষ্টি কিনতে।
অধরা ফিসফিস করে গাছগুলোকে বলল, “তোমরা কি জানো, মায়ামঞ্জরীতে নতুন অতিথি আসছে?”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু