#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৭
ইভার যা সন্দেহ ছিল তাই হয়েছে। সে এত করে বলার পরেও লোকটা পিছু ছাড়েনি৷ এখন তার বাড়ির আশেপাশেও একে মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছে। সমস্যাটা কী? লোকটা চাইছে কী? লোকটা কি নেহায়েতই ফালতু নাকি কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে? হুট করে উদয় হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়াটা ইভার মোটেও হজম হচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটায় কোথাও একটা ঘাপলা আছে৷ কিন্তু কোথায়?
আজ রবিবার৷ ছুটির দিনে অলস সময়ে ইভার প্রিয় কাজ হলো আয়েশ করে জানালার পাশে বসে কফি পান করা৷ এ সময় সে মৃদু লয়ের গান শোনে, হাতে একটা বইও থাকে, যেটা বেশিরভাগ সময় পড়া হয় না৷ সময় কেটে যায় জানালার বাইরের মেপল গাছের দিকে চেয়ে চেয়ে৷ কাপ খালি হয়ে গেলে সে গিয়ে আরেক কাপ বানিয়ে আনে৷ এভাবে একটা ঘন্টা কাটালে ও পুরো সপ্তাহ রিচার্জড থাকে৷ কিছুটা নিঃসঙ্গ সময় তাকে অনেকটা শক্তি দেয়।
সে শুনেছে তার মায়েরও একই স্বভাব ছিল। মাকে সে দেখেনি৷ খালার কাছে মানুষ হওয়া ইভার মায়ের সম্পর্কে যা জানা তার পুরোটাই খালার কাছ থেকে। খালা যেমন তাকে ভীষণ ভালোবাসেন সেও তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে৷ খালা বিয়ে করেননি, সেও করেনি। তারা দু’জনেই যেন মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে দু’জনকে নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। মুখে বলাবলি অবশ্য হয়নি।
তার এই একাকী সময়টুকুতে খালা বিরক্ত করেন না৷ দোতলায় নিজের বেডরুমে বসে সিনেমা দেখেন কিংবা বই পড়েন।
প্রায় ঠান্ডা হয়ে আসা কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বাইরে তাকাল ইভা। এ সময় নানা কথা মাথায় খেলে যায় তার৷ সবচেয়ে বেশি যেই প্রশ্নটা মাথায় আসে সেটা হলো, পৃথিবীতে আমরা ঠিক কেন এসেছি? এইযে বেঁচে আছি, এর উপযোগিতা কী? পৃথিবী আমার কাছ থেকে ঠিক কী চায়?
এমন সময় তার চোখ গেল সাদার বরফের মাঝে কালো কোট পরা লোকটার দিকে। গেটের সামনে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। ইভা বিড়বিড় করে বলল, “অসহ্য!”
ওপর থেকে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামার শব্দ হলো। খালা নামছেন। চোখমুখে উপচে পড়ছে হাসি। ওকে সামনে পেয়ে বললেন, “আমার একজন গেস্ট এসেছে।”
ইভা বুঝল লোকটা এই সুযোগে তার খালাকে পটিয়ে ফেলেছে। নাহ, লোকটা খুবই চতুর৷ সে খালাকে জিজ্ঞেস করল, “কে এটা?”
ততক্ষণে খালা গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। লোকটা ঢুকলে তাকে নিয়ে বসালেন লিভিংরুমে৷ সে এগিয়ে গেলে পরিচয় করিয়ে দিলেন খালা, “ইনি মিস্টার ডেভিড স্পাইক, আর ও আমার বোনের মেয়ে ইভা। ইভা পার্কার।”
ডেভিড বলল, “হ্যালো!”
ইভা কিছুই বলল না। খালা বললেন, “উনি আমার ভীষণ উপকার করেছেন সেদিন। আমি সুপারমার্কেটে গিয়ে জিনিসপত্র কিনে দাম দিতে গিয়ে দেখি পার্সে কোনো টাকা নেই। টাকা নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। ইনি সেখানে ছিলোন। সব টাকা দিয়ে দিলেন, আমার জিনিসপত্রও পৌঁছে দিলেন৷ আজ তাই ওনাকে আমাদের সাথে ডিনারের আমন্ত্রণ জানিয়েছি।”
পরিচয়পর্ব শুনে ইভা মোটেও অবাক হলো না। এরকম কোনো ছুতোয় লোকটা খালাকে হাত করেছে এটা বোঝাই যাচ্ছিল। সে অবাক হলো ডিনারের কথা শুনে। ডিনারের এখনো ঢের দেরি৷ এদিকে কাউকে নিমন্ত্রণ করে খালা কিছুই রান্না করেননি। এটা কেমন কথা?
তার মনে ঘুরতে থাকা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বিষ্ময়ের স্ফুলিঙ্গটাকে আরেকটু উষ্কে দিল ডেভিড।
“আমি ভালো রান্না করতে পারি। তাই দু’জন লেডির সৌজন্যে আজকের ডিনার আমি বানাতে চাচ্ছি। আপনার কোনো আপত্তি নেই তো মিস পার্কার?”
ইভা যন্ত্রের মতো বলল, “নো।”
“থ্যাংস।”
ডেভিড সুন্দর করে হেসে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। ইভা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হচ্ছেটা কী?
******
অধরা যা ভয় পেয়েছিল তেমন কিছু হলো না৷ ছেলেটা উল্টোপাল্টা কথা বলল না। বরং মজার মজার কথা বলে তাকে হাসিয়ে চলল। একসময় অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় দু’জনেই একে অপরকে বিদায় জানিয়ে শুতে গেল। অধতা তো বিদায় জানাবার সময় ভুলে লিখে ফেলেছিল, “কাল ক্লাস আছে ভোরে। এখন শুতে হবে।”
ভাগ্যিস মেসেজটা শিশির দেখার আগেই সে ডিলিট করে দিতে পেরেছে!
অধরা এক অদ্ভূত আনন্দ নিয়ে শুতে গেল সেই রাতে। জানালা গলে আসা নরম জ্যোৎস্না তাকে ভিজিয়ে দিতে থাকল একটু একটু করে। সেই সাথে একটা নতুন স্বপ্নে সে ডুবে যেতে থাকল অবচেতন মনের সাথে৷
শিশির শুয়ে পড়েও অনেকক্ষণ মোবাইল স্ক্রল করে গেল। ভালো লাগছে না। আরো কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে অধরার সাথে। মেয়েটার সেন্স অফ হিউমার ভালো। কথা বলতেও আরাম লাগে। তবে মেয়েটা একটু বোকা। না, অনেকটাই বোকা। ক্লাসের কথা লিখে ফেলেছিল! যদিও ডিলিট করে দিয়েছে মেসেজ, তবে তার নোটিফিকেশনে রয়ে যাওয়ায় মেসেজটা সে ঠিকই দেখতে পেরেছে। পরে অধরা লিখেছে, “আমার স্বামী সন্দেহ করবে, গেলাম।”
কথাটা ভেবে আবারও হাসি পেয়ে গেল শিশিরের। অধরার কাল্পনিক স্বামী যাতে তার ওপর রাগ না করে সেজন্য সে তাড়াতাড়ি কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছে৷ এখন ওর কাল্পনিক স্বামী কী করছে? ওকে আদর করছে? ভেবে কেমন যেন একটু ঈর্ষা বোধ হলো শিশিরের। কিন্তু ঈর্ষাটা কার প্রতি? অনুভূতিরাও কেমন অদ্ভুতুড়ে!
এলোমেলো ভাবতে ভাবতে শিশিরের চোখ লেগে এলো। স্বপ্নে দেখল সে অধরার স্বামী। অফিস থেকে ফিরে দেখতে পেল অধরা মোবাইলে কার সাথে যেন চ্যাটিং করছে আর হাসছে। সে হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে দেখল অধরা একজনকে লিখেছে, “আপনি আমার স্বামীর চেয়েও বেশি সুন্দর।”
স্বপ্নটা ভেঙে গেল অধরার মোবাইলটা আয়না বরাবর ছুঁড়ে দেয়ার সাথে সাথে। উঠে বসল সে। আয়নার দিকে তাকাল। এই আয়নাতেই স্বপ্নে সে মোবাইল ছুঁড়েছিল৷ উঠে গিয়ে আলো জ্বেলে আয়নার সামনে দাঁড়াল সে। চেহারাটা ভালো করে দেখল। চেহার তো তার খারাপ না। তবুও সন্দেহ রয়েই যায়, বিয়ের পর তার বউ অন্য কাউকে সুন্দর বলবে না তো?
*******
পরদিন অধরার ইউনিভার্সিটিতে যাবার সময় পার হবার পর শিশির সোজা বেরিয়ে পড়ল গাড়ি নিয়ে। অদিতির সাথে সকালে কথা বলে নিয়েছে সে, সেদিনকার ব্যাপারটা যাতে পুরোপুরি মিটে যায় আর অদিতির টাকাও দিয়ে আসা হয় তাই সে সকালে তাদের বাড়িতে যাবে।
কথামতো অধরাদের বাড়িতে চলে গেল সে। আজও গেট বন্ধ। সীমানা প্রাচীরের বাইরে ঝুলছে চমৎকার লাল গোলাপী ছোটো ছোটো ফুলের গুচ্ছ। সে দরজা নক করে ফুলগুলো দেখতে থাকল।
হঠাৎ কানের কাছে কে যেন বলে উঠল, “ওগুলো মধুমঞ্জরী।”
শিশির অবাক হয়ে চেয়ে দেখল অদিতি দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা মোটেও তার বড় বোনের মতো নয়, তবে খুব মিষ্টি।
অদিতি হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন?”
অদিতির মিষ্টি হাসির দিকে চেয়ে শিশির স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যেন উত্তর দিল, “ভালো। তুমি তো দেখি বাচ্চা মেয়ে। কোন ক্লাসে পড়ো?”
অদিতি বেনী দুলিয়ে বলল, “ক্লাস টেন।”
“কোন গ্রুপ?”
“কমার্স।”
“বড় হয়ে কী হবে?”
“বিজনেসম্যান।”
“সেটা তো তুমি অলরেডি!”
“হুম কিন্তু আরো বড় বিজনেস হবে।”
“কেকের?”
“শুধু কেক না, আরও অনেক কিছু থাকবে।”
“ভবিষ্যত সফল বিজনেস উইমেনের সাথে কথা বলতে পেরে গর্ব বোধ করছি।”
তার কথা শুনে অদিতি আনন্দে ঝলমল করতে করতে বলল, “থ্যাংস! আসুন ভেতরে।”
শিশির ভেতরে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেল। ছোটো একটা বাগানে এত ফুল থাকতে পারে সে কোনোদিন ভাবতেও পারেনি।
(চলবে)
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৮
অল্প একটু জায়গার ওপর ছোট্ট একতলা বাড়ি। তার সানে একচিলতে বাগান। সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে বড় বড় গাছ। ডানদিকে গোলাপের বাগান। অনেক রঙের গোলাপ একসাথে ফুটে আছে। একসারি বেলী, একটা ঝোপালো গাছে কামিনী উপচে পড়ছে, হাস্নাহেনা গাছের নিচে ছড়িয়ে আছে অজস্র ফুল, ফুলের ভারে নুয়ে আছে ডালগুলো৷ ঘরে ঢোকার মুখে একপাশে হাসছে গোলাপী আর হলুদ রেইন লিলি। বাড়ির পেছনদিকে কৃষ্ণচূড়া গাছটা অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। লাল টকটকে ফুল ফুটে আছে তাতে। প্রকৃতি এদের বাড়িটা সাজিয়ে দিতে কোনো কার্পন্য করেনি। শিশিরের মুখ দিয়ে আপনার বের হয়ে গেল, “দারুণ!”
অদিতি বলল, “এগুলো মা আর আপুর করা। দু’জন সময় পেলেই বাগান করতে লেগে যায়।”
“তোমরা তো খুব শৌখিন ফ্যামিলি।”
অদিতি হেসে বলল, “বলতে পারেন।”
শিশির চারপাশ ভালো করে দেখে ভেতরে ঢুকল। বসার ঘরটা ছিমছাম সুন্দর। এখানেও গাছপালা। সব মিলিয়ে কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগে। অদিতির মা এলেন পরিচিত হতে।
শিশির সালাম দিলে তিনি প্রত্যুত্তর দিয়ে বললেন, “সেদিন তোমার সাথে যা হলো, একদম ঠিক হয়নি৷ আমার বড় মেয়েটা একটু পাগলাটে ধরনের।”
“তাই?”
“এমনিতে ভালো, খুবই গোছানো মেয়ে, কিন্তু মাঝেমধ্যে খুব অস্থির হয়ে যায়। উল্টোপাল্টা কাজ করে ফেলে। তুমি কিছু মনে করো না বাবা।”
“আরে না আন্টি, আমি কী মনে করব?”
মা উঠে নাস্তা আনতে চলে গেলে অদিতি জিজ্ঞেস করল, “কেক ভালো লেগেছিল?”
“ভীষণ!”
শিশির কেকেট টাকাটা অদিতিকে দিয়ে বলল, “আজ কিন্তু আরেকটা কেক অর্ডার দিতে এসেছি।”
“আচ্ছা।”
“বড় কেক। দশ পাউন্ডের। বানাতে পারবে?”
অদিতি হা হয়ে গেল। এত বড় কেক কেমন করে বানাব?”
“কেন ট্রাই করো, পারবে আমি জানি।”
অদিতি ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু এত বড় কেক আমি জীবনে বানাইনি, বানানো কথা ভাবিওনি।”
“বিজনেস করত গেলে বড় বড় ডীল কিভাবে হ্যান্ডেল করবে তাহলে?”
“সেটা তো অন্য কথা…”
মা নাস্তা নিয়ে এসে টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, “কিসের জন্য এত বড় কেক লাগবে?”
“আমাদের বাড়িতে একটা পার্টি রাখা হবে। বাবার জন্মদিন আর আমার বিজনেস জয়েন করার খবরটা সবাইকে জানানোর উপলক্ষে।”
“তাহলে তো অনেক বড় বড় মেহমান আসবে। তুমি নাহয় নামীদামী কোনো দোকান থেকেই নাও। ও তো ছোটো, পরে বানাতে না পারলে?”
“না পারলে নাই। ব্যাপার না৷ ওর কেকটা ভালো লেগেছে বলে ছোটো বোন মনে করে ওকে সুযোগটা দিতে চাইছি৷ কেকটা ভালো হয়ে গেলে ওর নামই কিন্তু ছড়াবে।”
“তা ঠিক।”
অদিতি কিছুক্ষণ ভেবে ব্যাপারটা চ্যালেঞ্জের মতো নিয়ে নিল। “ঠিক আছে বানাব। কিন্তু এত বড় কেক তো আমাদের গেট দিয়েও বের হবে না।”
“তুমি আমাদের বাড়িতে গিয়ে বানাতে পারো।”
মা বললেন, “না না, সেটা আবার কেমন হয়…”
শিশির অভয় দিয়ে বলল, “আপনিও নাহয় যাবেন৷ এটা ওর প্রোফেশন। আর এই প্রফেশনে এরকম চলে। এটা মোটেও কোনো অসম্মানের কাজ না আন্টি। বরং অদিতি ওর কাজটাতে এগিয়ে যাবে, বয়সে এত ছোটো উদ্যেক্তা হিসেবে এপ্রেসিয়েশন পাবে, তাছাড়া পরিচিতও হবে।”
অদিতি আর মা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল৷ শিশির বলল, “রাতে জানালেও হবে। পার্টি নেক্সট উইকে।”
“আচ্ছা।”
শিশির ততক্ষণে চা বিস্কুট খেতে শুরু করেছে। ঘরে তৈরি তালের পিঠা সে খুব মজা করে খেল। আর পুরো সময়টা গল্প করে গেল অদিতি আর তার মায়ের সাথে। গল্পের ঝুড়ি তার ভর্তি৷ একেকটা বের করে শুরু করে দিচ্ছে আড্ডা৷
“আন্টি, আপনি গ্রামের বাড়িতে থেকেছেন কখনো? কেমন লাগে থাকতে?”
“বিয়ের পর আমি গ্রামেই তো থাকতাম। কষ্ট আছে, আবার ভালো দিকও আছে।”
“সবচেয়ে বেশি ভালো দিক কোনটা?”
“সবচেয়ে বেশি ভালো দিক হলো তাজা মাছ, শাকসবজি পাওয়া যায়৷ এখানে সেসব কোথায়?”
“আন্টি গ্রামের বাড়িতে বিয়ে করলে কেমন হবে?”
“ভালোই হবে।”
অদিতি মাঝখান থেকে বলে, “কী যে বলো মা! উনার সাথে গ্রামের মেয়ের মেন্টালিটি ম্যাচ করবে?”
শিশির কেক চিবুতে চিবুতে বলে, “কেন করবে না? আমার এক খালা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসেন। সে এলে সারাদিন ড্রইংরুমে চলে সিরিয়াল। সেসব সিরিয়ালের মেইন কাহিনী হলো গ্রামের মেয়ে আর শহরের ছেলের প্রেমকাহিনী। আমি খেয়াল করে দেখেছি শহরের মেয়েদের থেকে গ্রামের মেয়েদের পার্সোনালিটি স্ট্রং হয়।”
“সিরিয়াল দেখে এটা খেয়াল করেছেন?”
“হুম।”
মা বললেন, “ধুর! ওসব নাটক সিনেমা দেখে জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়া যায় নাকি?”
শিশির হাসতে হাসতে বলে, “আন্টি আমি মজা করছিলাম৷ তবে গল্পের বই পড়ে শখ হয়েছে বর্ষায় গ্রামে গিয়ে জানালার পাশে বসে ডোবা থেকে ভেসে আসা ব্যাঙের ডাক শোনার।”
অদিতি হেসে বলল, “ওটা আমাদের বাসায়ই পাবেন। আমাদের উল্টোদিকের কম্পাউন্ডটা ফাঁকা। মাঝখানে গর্ত করে রেখে দিয়েছে। ঝোপঝাড়ে ভর্তি হয়ে গেছে পুরোটা। বর্ষায় সেই গর্তে পানি জমে আর কোথা থেকে যেন একঝাঁক ব্যাঙ এসে কনসার্ট শুরু করে দেয়! আপুর রুম থেকে সবচেয়ে ভালো শোনা যায়।”
“আরে বাহ! তাহলে তো একদিন তোমাদের বাসায় থাকতে হয়।”
অদিতি কী যেন বলতে চাচ্ছিল, মা কথা ঘুরিয়ে শিশিরকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মা কী করেন বাবা?”
“রান্নাবান্না, ঘর গোছানো আর টেনশন।”
সবাই হেসে ফেলল।
শিশির চলে যাবার পরেও অনেকক্ষণ তাকে নিয়ে কথা হলো। মায়ের ভালো লেগে গেছে ছেলেটাকে। অদিতিরও খুব ভালো লেগেছে৷ মনে মনে ভাবছে, ওনার সাথে সম্পর্কটা দীর্ঘস্থায়ী হলে ভালো হতো।
অধরা আর বাবা ফেরার পর রাতে তাদের সাথে পরামর্শ করতে বসা হলো অদিতি কেক বানাতে যাবে কি না তা নিয়ে৷ বাবা অদিতিকে জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে তুই কি যেতে চাস?”
“বুঝতে পারছি না বাবা।”
“বুঝতে না পারলে তো হবে না৷ ভালোমতো ভেবে বল, ইচ্ছে আছে?”
“তা আছে।”
“কনফিডেন্স?”
“আছে।”
“তাহলে যা।”
“সাহস হচ্ছে না। যদি গড়বড় হয়ে যায়?”
“নিজের উপর বিশ্বাস থাকলে কিছুই হবে না।”
“তাহলে যাব।”
মা বললেন, “অধরাও যাবে তোর সাথে।”
অধরা মনে মনে প্রমাদ গুনল। এতক্ষণ এই ভয়টাই পাচ্ছিল সে৷ ওই ছেলের বাড়িতে যেতে হবে শেষ পর্যন্ত? ধুর! সে তো পুরোপুরো জড়িয়ে যাচ্ছে জালে। ছেলেটা যেন পিছু ছাড়ছেই না। অবশ্য সে নিজেই ফেক আইডির কান্ডটা ঘটিয়েছে। আজ সারাদিনে অনেকবার নক করেছে শিশির। সে ক্লাস, টিউশনির ফাঁকে ফাঁকে উত্তর দিয়েছে, “বাসায় মেহমান এসেছে, বেশি কথা বলা সম্ভব না।”
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বৃষ্টি নামল ঝেঁপে। মোবাইলে টুং করে নোটিফিকেশন এলো। শিশির লিখেছে, “এখন ফ্রি?”
অধরা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরের ঝমঝম বৃষ্টি আর শীতল বাতাসের ঝাপটা হঠাৎ তার মনটা অন্যরকম করে দিল। নিজের ডিপার্টমেন্টে অধরার অন্যতম প্রিয় শিক্ষক হচ্ছেন জুনায়েদ স্যার৷ স্যারের ক্লাসটা বরাবরই ভীষণ উপভোগ্য হয়। আবার তিনি আদর্শ মানুষ হিসেবেও সুপরিচিত। কিন্তু তিনি আজ ক্লাস নিতে পারছিলেন না। জ্বর ঠান্ডা বেশ কাবু করে ফেলেছে তাকে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর কাশতে কাশতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। সবাই বলছিল ক্লাস না নিয়ে আজকের মতো বিশ্রাম নিতে। স্যার বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত না পেরে ক্ষান্ত দিয়েছিলেন৷ যাবার আগে থেমে থেমে বলেছিলেন, “আমি কেন কষ্ট করে ক্লাস নিতে চাইছিলাম জানো? এইযে তোমরা সবাই নিজেদের মূল্যবান সময় খরচ করে এসেছ। এই আশায় বসে আছো যে আজ জুনায়েদ স্যার নতুন কিছু শেখাবেন। তোমাদের এই সময় বা আশার কি কোনো দাম নেই? আমাদের জীবনটা এত ছোটো যে পলক ফেলতে ফেলতেই শেষ হয়ে যায়। আমি চাই না মৃত্যুর পর কেউ আঙুল তুলে বলুক, জুনায়েদ স্যার তো কাজে ফাঁকি দিতেন। তোমাদের কাছে মনে হতে পারে একটা ক্লাস ফাঁকি দিলে কী হয় তাই না? কিন্তু আমার কাছে প্রতিটা ছোটো বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। আজ ক্লাস না নিয়ে চলে গেলে কী গ্যারেন্টি যে পরশু সামান্য সর্দিতে মনে হবে, না নেই ক্লাস। কী আর এমন হবে! এজন্য মন্দ অভ্যাসকে কখনো পাত্তা দিতে নেই। তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকা উচিত নিজের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে সৎ থাকার। অনেককে হয়তো দেখবে এসব জিনিস পাত্তা দিচ্ছে না। তোমারও মনে হবে আমিও একটু ওদের দলে ভিড়ি, সবাই যখন যখন এমন তাহলে আমি কেন হব না? মনে রাখবে, দিনশেষে তোমার হিসেবটা তোমাকেই দিতে হবে। তুমি সৃষ্টিকর্তার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে না, অমুক তমুক করেছে তাই আমিও করেছি।”
কথাগুলো মনে পড়তেই অধরার একটুও ইচ্ছে হলো না মিথ্যে কনভার্সেশন চালিয়ে যেতে। বরং নিজের কাজের জন্য নিজের ওপর ঘৃণা হতে লাগল। সে এই পর্যন্ত শিশিরের সাথে ঠিক কতগুলো মিথ্যে কথা বলেছে? আজও তো তাই করেছে৷ স্যারের কথাগুলো নিজের ক্ষেত্রে উপলব্ধি হতে সময় লেগে গেছে তার। তবে দেরি হয়ে যায়নি৷
অধরা বুক ভরে শীতল বাতাস টেনে নিয়ে মোবাইলে টাইপ করল, “জনাব শিশির, আমি অত্যন্ত দুঃখিত আপনার সাথে মিথ্যে কনভারসেশন চালিয়ে যাবার জন্য। আমি কোনো অতৃপ্ত গৃহিনী নই। আমি অধরা। চিনেছেন? অদিতির বোন। আজ আপনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন৷ আমি আমার কাজের জন্য লজ্জিত। আপনাকে ধোঁকা দেবার জন্য ক্ষমা চাইছি। আশা করি ব্যাপারটা বুঝবেন। আর আমার কাজের জন্য আমার বোনকে প্লিজ ভুল বুঝবেন না। তাকে যে সুযোগটা আপনি দিতে চাচ্ছেন তার জন্য ধন্যবাদ।”
মেসেজটা ডেলিভার হতেই সে চেপে রাখা শ্বাস ছেড়ে দিল। পাল্টা উত্তরের অপেক্ষা না করেই নেট কানেকশন বন্ধ করে দিল। বিছানা ভালো করে ঝেড়ে নিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়ল। তন্দ্রামতো আসতেই মনে হলো, শিশির এই ব্যাপারে যদি অদিতির সাথে কথা বলে তাহলে কেমন হবে? ছি!
ওপাশ থেকে কী উত্তর আসে জানা দরকার। নেট কানেক্ট করল অধরা৷ উত্তরটার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। শিশির লিখেছে, “আপনাকে আমি প্রথমেই চিনেছি মিস স্যরি। নিজের ফেক আইডি দিয়ে আসল আইডি ফলো করার মতো বোকামি না করলে আপনি এত তাড়াতাড়ি ধরা পড়তেন না। আপনি ক্ষমা চাইলে আমারও ক্ষমা চাওয়া উচিত। তবে আমাদের মধ্যে ক্ষমা চাওয়াচাওয়ি একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে বলে আপনার মনে হয় না?”
অধরা মোবাইল রেখে মুখ ভোঁতা করে বসে রইল। তার মানে ছেলেটা তাকে চিনতে পেরে গিয়েছিল! তার চটুল মেসেজগুলো দেখে নিশ্চয়ই হেসে খুন হয়েছে। কী ভীষণ লজ্জার বিষয়! অধরা দুটো বালিশ দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে রইল।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু