#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৯
শিশির সারাদিন অধরার মেসেজের অপেক্ষা করেছে। তার সাথে আরও কী কী বলবে সেসব মনে মনে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে। অধরা যদি আজও ফেক আইডি দিয়ে গৃহবধূ সেজে কথা বলতে চাইত তাহলে খুব মজা হতো সন্দেহ নেই। তবে সেটা হয়নি বলে যে তার মন হয়েছে খারাপ তা নয়, বরং অদ্ভূত এক প্রশান্তি প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নিল। বৃষ্টি থেমে গেছে। রয়ে গেছে তার রেশ। ভেজা মাটির ঘ্রাণ, ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা আর সতেজ সুখ সুখ অনুভূতি৷ এত ভালোলাগার মধ্যেও কোথাও যেন একটুখানি বিষাদ লুকোচুরি খেলছে। মনের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অধরার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ভনিতা বা মজা করে নয়, সত্যিকারের গল্প করতে ইচ্ছে করছে। ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ করেই কেন তার মন পরিবর্তন হয়ে গেল। মজা করতে করতে কেন সে দুম করে বলে বসল সে আসলে অধরা!
স্কুল কলেজে শিশিরের অনেক বন্ধু ছিল। বন্ধু এখনো আছে, তবে সবাই নিজ নিজ জীবনে ব্যস্ত। মাসে-দু’মাসে একবার হয়তো দেখা হয়। ব্যস্ততম দিনগুলো থেকে সবাই মিলে একটা সময় বের করার মতো কঠিন কাজ হয়তো ওরা করে ফেলে কখনো কখনো। কিন্তু সেটা লম্বা রেসের ফাঁকে একটুখানি জিরিয়ে নেয়া মাত্র। দু’ঘন্টার আড্ডায় না বলা কত কথা থেকে যায়! স্কুলে যে বন্ধুকে নিজের গোপনতম দীর্ঘশ্বাসের কথাটাও বলা হতো তার সাথে সপ্তাহে একদিন কথা হয় বড়জোর! বয়স বাড়লে বন্ধুদের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে একটু একটু করে৷ একসময় দেখা যায় কথা জমতে জমতে কথার পাহাড় তৈরি হয়েছে৷ এই পাহাড় কেটে কাছাকাছি আসা আর হয়ে ওঠে না৷ না সময় সেটা করতে দেয়, না জীবন। ইউনিভার্সিটি ছেড়ে আসার পর কথাটা আরো ভালোভাবে বুঝতে পারছে শিশির।
এখন একজন সঙ্গীর জন্য মন কেমন করাটা বেড়ে যাচ্ছে। তার বিয়ের কথা হচ্ছে বাড়িতে। মেয়ে দেখাদেখি হচ্ছে। তার আগ্রহ হলেও কেন যেন ভেতরে ভেতরে এক অতৃপ্তি দানা বেঁধে উঠছে। সে কোনোদিন মেয়েদের তেমন পাত্তা দেয়নি। নারীজাতির কাছে ঘেঁষাঘেঁষি তার অসহ্য বোধ হতো বরাবরই। মনে হতো তাতে ব্যক্তিত্বের জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে যায়। কাউকে মন থেকে কোনোদিন ভালো লাগাতে পারেনি সে। ঠিক এই কারনেই তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে আসা মেয়েদের সে বারে বারে ফিরিয়ে দিয়েছে। সে সবসময় ভাবত একসময় একজন আসবে, যে তার মনের খালি জায়গাটায় একেবারে খাপে খাপে বসে যাবে। সেই মানুষটা কি অধরা?
শিশির দুই হাত বুকে ভাজ করে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ভাবছে। অধরার বিশেষত্ব কী? কোনো বিশেষত্ব কি আদৌ আছে? এমন মেয়ে কি সে আগে দেখেনি? অনেক দেখেছে। তার ক্লাসের কিছু মেয়ে ওর মতো সাদামাটা হয়ে থাকত, নার্ভাস থাকত কিংবা সহজেই ভয় পেয়ে যেত৷ অধরা কিছুটা সেরকমই। ওর লাইফস্টাইলে আকর্ষণ করার মতো কিছুই নেই। তাহলে কী এমন আছে তার মধ্যে যা তাকে প্রথমদিন থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে? এত আগ্রহ সে কোনো মেয়ের প্রতি অনুভব করতে পারে তা এই প্রথমবার দেখল। নিজের আচরণে সে নিজেই অবাক হচ্ছে দিন দিন।
এখন, এই মুহূর্তে অধরার সাথে গল্প করার ইচ্ছেটা কি স্বাভাবিক? মেয়েটা গল্প করতে জানে কি না সেটাও একটা প্রশ্ন! এই কি তাহলে নিয়তি? নিয়তিই কি তাদের এক সুতোয় বেঁধে ফেলতে চাইছে? আর তারা পরষ্পরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেই অদেখা নিয়তির টানে?
যদিও আজ অধরার সততা তার পছন্দ হয়েছে। মেয়েটা জল গড়াতে দেয়নি৷ একটুখানি ঢেলে ফেলেছিল মাত্র৷ সময় থাকতে মুছেও ফেলেছে। শিশির ক্লান্ত চোখ মেলল আকাশের দিকে। অধরার চিন্তা মাথা থেকে দূর করা প্রয়োজন।
.
অধরা বিছানায় গড়াগড়ি খেল গভীর রাত পর্যন্ত। তার অস্থির লাগছে৷ এই অস্থিরতা বলে বোঝানোর মতো নয়। প্রথমত ভীষণ লজ্জা তাকে জেঁকে ধরেছে, তার ওপর পরের সপ্তাহে শিশিরদের বাড়িতে যাবার ব্যাপারটা! উফ! এ কোন বিপদে পড়া গেল? না, বিপদে সে পড়েনি, নিজে নিজে ঝাঁপ দিয়েছে!
***********
দেখতে দেখতে শিশিরদের বাড়িতে যাবার দিন চলে এলো। অদিতি এতদিন বেশ ভালো প্রস্তুতি নিয়েছে। কিভাবে কেক সাজাবে সেসব ঠিক করে ফেলেছে। বড় কেক বানাবার অজস্র ভিডিও দেখেছে কদিনে। জমা করেছে অনেক টিপস। তার মোবাইলের নোটপ্যাডে লিখে রেখেছে সব৷ কোনটা কখন কাজে লেগে যায়!
এসব করতে করতে এদিকে পড়াশোনা লাটে উঠছে দেখে মা বকাঝকা শুরু করে দিয়েছিলেন। এটাও বলেছিলেন, অর্ডার ক্যান্সেল করে দিতে। কিন্তু অদিতির ডেডিকেশনের সামনে মায়ের বকুনি তেমন টিকতে পারেনি।
শিশির বলেছিল সে সকালবেলা এসে অদিতি আর অধরাকে নিয়ে যাবে। কথামতো সে হাজির হলো অধরাদের বাড়িতে। অধরা-অদিতি তৈরিই ছিল৷ অদিতি গুছিয়ে রাখা কেক তৈরির সরঞ্জামের ব্যাগটা সযত্নে তুলে নিয়ে মাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পেছন পেছন অধরাও গেল। অধরা শিশিরের সাথে কোনো কথা বলল না৷ শিশিরও একবার ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞেস করে আর তার দিকে মনোযোগ দিল না।
গাড়িতে অদিতিকে শিশির পাশে বসতে বললে সে বলল, “ভাইয়া আমি পেছনে বসি প্লিজ?”
শিশির বুঝল অদিতি তার পাশে বসতে কমফোর্টেবল না। সে বলল, “ওকে। তাহলে অধরা…”
অধরা তাড়াতাড়ি বলল, “আমি অদিতির সাথেই বসব।”
শিশির কোমরে হাত দিয়ে বলল, “আচ্ছা! তো আমি কি আপনাদের দুজনের ড্রাইভার?”
অধরা বলল, “ড্রাইভ করে নিয়ে যেতে এসেছেন, সেই হিসেবে তো ড্রাইভারই।”
শিশির কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগে অদিতি বলল, “আপু প্লিজ যাও না সামনে। প্লিজ! কথা বাড়িও না। আমার ভালো লাগছে না।”
অধরা বুঝল অদিতি বের উত্তেজিত এবং চিন্তিত অবস্থায় আছে। তাকে আর প্রেশার দেয়াটা উচিত হবে না। সে সামনের সিটে বসে পড়ল চুপচাপ।
শিশির গাড়িতে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে অধরাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “সিটবেল্ট বেঁধে নিন।”
অধরা সিটবেল্টটা প্রথমে খুঁজেই পাচ্ছিল না৷ গাড়িতে চড়ার অভ্যাস না থাকলে এই হয়! একটু লজ্জাও লাগছিল তার। শিশির দেখিয়ে দিল। বলল, “এরপর প্লিজ বলবেন না আটকে দিতে। আপনার খুব কাছাকাছি চলে যেতে হবে। আমি ভদ্রমহিলাদের সম্মান করতে পছন্দ করি।”
অধরা শেষ পর্যন্ত সিটবেল্ট বাঁধতে সক্ষম হলো। শিশিরের কথায় তার কান লাল হয়ে গেছে৷ লুকিং গ্লাসে একবার দেখে নিল অদিতি শুনছে কি না। কিন্তু মনে হলো না তার এদিকে কোনো মনোযোগ আছে। সে বলল, “আমি কি সেরকম কিছু বলেছি?”
“না, তবে কাজটা করতেই হতো আপনি নিজে না পারলে। আফটার অল আমি সেফ ড্রাইভিং পছন্দ করি৷ আবার সেটা করলে রিস্ক হয়ে যেত। সিনেমা দেখেননি, এভাবেই নায়ক নায়িকার প্রেম হয়ে যায়।”
অধরা চোখ মটকে বলল, “আপনি নিজেকে নায়ক ভাবেন?”
“আপনি যদি নিজেকে নায়িকা ভাবতে পারেন তাহলে আমার নায়ক হতে দোষ কী বলুন?”
“তাই নাকি? তাহলে থিয়েটার করুন, বিজনেস করতে চাচ্ছেন কেন?”
“অফার পেয়েছিলাম৷ তবে দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে গন্ডা গন্ডা নায়িকার সাথে প্রেম আমার পোষাবে না৷ বাস্তবে একজনকে চাই।”
“জুটিয়ে নিলেই পারেন।”
“পেলে তো! আমার কপালে শুধু জোটে নিঃসঙ্গ গৃহবধূ, যাদের স্বামী সময় দেয় না।”
জায়গামতো খোঁচা দিতে পেরে শিশির দারুণ মজা পেল। আঁড়চোখে অধরার দিকে চাইল। লাল হয়ে গেছে চেহারা। অধরা কোনো কথা খুঁজে পেল না। চলন্ত গাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাবার মন্ত্র থাকলে সে এখুনি পড়ে অদৃশ্য হয়ে যেত। কিন্তু এখন বসেই থাকতে হবে এই অসহ্য ছেলেটার পাশে! সে উশখুশ করতে শুরু করল।
শিশির কিছুক্ষণ চুপচাপ অধরার মুখের রঙ বদল খেয়াল করল। তারপর একসময় কথা ঘুরিয়ে বলল, “আপনার শখ শুনেছি গাছ লাগানো। এত গাছ দেখে সেদিন আমার মাথাই ঘুরে গিয়েছিল। শুনেছি সবার হাতে লাগানো গাছে ফুল ফোটে না। যার হাতে ফোটে তার নিশ্চয়ই সেরকম গুণ আছে।”
অধরা একটু স্বস্তি পেল কথার মোড় ঘুরে যাওয়ায়। সে বলল, “গুণ কিছু না, গাছের ভাষা বুঝতে পারলে ফুল ফোটানোও সহজ।”
“সেটা কেমন?”
“সেটা বলে বোঝানো যাবে না।”
“আচ্ছা আচ্ছা বোঝা জরুরিও না। গাছপালার শখ আমার নেই।”
“কিসের শখ আছে?”
“হালকা পাতলা রান্নাবান্নার শখ আছে, তবে সেটা বন্ধুদের সামনে বললে হাসাহাসি করে বলে বলা হয় না।”
“আমাকে বললেন যে?”
“বললাম কারন জানি যে শৌখিন সে অন্যদের শখ নিয়ে মজা করে না।”
“ভালো বলেছেন। রান্নাবান্না খারাপ কিছু না। বরং কঠিন কাজ।”
“আপনি রাঁধতে পারেন?”
“মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় মেয়েদের রান্না শিখতেই হয়।”
“এটা ভুল কথা। আমার এমন কয়েকটা মেয়ে ফ্রেন্ড আছে মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির বড় মেয়ে যারা রান্নার ‘র’ ও জানত না!”
“এখন জানে না, একসময় জেনে যাবে।”
“তা জেনেই গেছে বিয়ের পর।”
“আপনার বুঝি অনেক মেয়ে বন্ধু?”
“মেয়ে বন্ধু আর বিশেষ মেয়ে বন্ধুর মধ্যে পার্থক্য আছে মিস অধরা।”
“আমি কি বিশেষ মেয়ে বন্ধুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছি?”
শিশির হেসে বলল, “করেননি, আমি নিজেই বললাম।”
ততক্ষণে তারা শিশিরদের বাড়িতে চলে এসেছে। বড় গেটটা দিয়ে গাড়ি ঢুকতেই অধরা কৌতুহল নিয়ে চারদিকে তাকাল। সবুজ ঘাসে ছাওয়া লন, দুইধারে বড় বড় পাম গাছের মতো গাছ লাগানো যার মাঝের রাস্তা দিয়ে গাড়িটা সোজা গিয়ে উঠল গাড়িবারান্দায়। ওদের বাড়িটা দোতলা। দোতলায় অনেকগুলো ঝুল বারান্দা। বেশ দেখবার মতো বাড়ির চেহারা। অধরাকে মনোযোগ দিয়ে চারদিকে তাকাতে দেখে শিশির বলল, “আগে ভেতরে চলুন, অদিতিকে কাজ বুঝিয়ে দেবার পর বাড়িটা ঘুরে দেখাচ্ছি আপনাকে।”
অদিতি বাড়ির দিকে ফিরেও তাকাল না। সে মোহগ্রস্ত হয়ে আছে যেন। ভেতরে ঢুকলে হাসিমুখে শিশিরের মা তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। বসার ঘরে সোফার নরম গদিতে বসে শিশিরের মায়ের হাতের ঠান্ডা লাচ্ছি খেল ওরা। তারপর আন্টি ওদের নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে। আজ রান্নাঘর অদিতির দখলে থাকবে। এখানে কেক বানানো হবে বলে তিনি দুপুরের রান্না সকালেই করে ফেলেছেন। আর রাতে পার্টির খাবার বাইরে থেকে আসবে বলে চিন্তা নেই। অদিতি সব দেখেশুনে নিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে সাজিয়ে রাখল। এরপর শুরু করে দিল কাজ। তার সহকারী হিসেবে কাজের মেয়ে নাসিমাকে দিয়ে আন্টি বেরিয়ে পড়লেন অধরাকে নিয়ে।
অধরা খেয়াল করল শিশিরের মা বেশ আদুরে আর মিষ্টি স্বভাবের। হেসে হেসে কথা বলেন, দেখতে ভালো লাগে। তবে অধরাও এটাও খুব দ্রুত বুঝে গেল যে ভদ্রমহিলা একটু বেশিই সহজ সরল৷ এত সরল মানুষকে সহজেই কথার জালে জড়িয়ে ফেলা যায়৷
ফের বসার ঘরে বসতেই একটা মেয়ে এলো। বেশ স্মার্ট দেখতে মেয়েটা। পরনের কাপড়টা তার রুচিশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। চেহারা সুন্দর, চোখে চশমা থাকায় একটা জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব আছে চেহারায়। মেয়েটা এসেই আন্টিকে বলল, “মা, নাসিমা কোথায়?”
“ও তো কেক বানাতে সাহায্য করছে।”
মেয়েটা যেন একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “শিশিরকে বললাম রেডিমেড কেক অর্ডার দিতে। তা না তার হোম বেকার ডেকে এনে বাসায় কেক বানাতে হবে, অদ্ভূত ছেলে!”
“আচ্ছা তুমি ঘরে যাও আমি নাসিমাকে বলি কফি বানাতে। ও না পারলে আমিই বানিয়ে দিচ্ছি।”
“না মা, থাক। আমি পারকোলেটরে বানিয়ে নেব।”
এতক্ষণে তার চোখ পড়ল অধরার দিকে। আগ্রহ করে ওর দিকে চেয়ে মেয়েটা বলল, “আরে আপনাকে তো খেয়ালই করিনি।”
আন্টি পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ও হচ্ছে অদিতি, মানে যে মেয়েটা কেক বানাচ্ছে ওর বড় বোন অধরা। আর এটা হলো আমার বড় ছেলের বউ শাওলী।”
শাওলী একটু হেসে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আন্টি বললেন, “ও ডাক্তার তো, অনেক পড়তে হয়। সারাদিন ব্যস্ত থাকে পড়া নিয়ে।”
আন্টি আর বসতে পারলেন না৷ আজ বাড়িতে পার্টি বলে একগাদা কাজ। ডেকোরেশনের লোকজন চলে এসেছে। সেদিকে ছুটলেন তিনি। অধরা বসে রইল। অবশ্য বেশিক্ষণ একা বসতে হলো না তাকে। শিশির কোথা থেকে যেন উদয় হয়ে বলল, “চলুন বাড়িটা ঘুরে দেখাই।”
শিশিরের দিকে চেয়ে অধরার ভেতরে কেমন একটা অচেনা মুগ্ধতা তৈরি হয়ে গেল। শিশির এর মধ্যে গোসল করে এসেছে। ঘরের টিশার্ট, ট্রাউজার পরনে। খুব ফ্রেশ দেখতে লাগছে ওকে। ওর অ্যাথলেটিক শরীরের গঠন এতদিন সে খেয়াল করেনি। আজ বেশ চোখে পড়ল ফুলে থাকা মাসল। সব ছাপিয়ে শিশিরের উজ্জ্বল চোখের দ্যুতি যেন অন্তর ভেদ করে ফেলবে তার। অধরা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। এসব ঠিক হচ্ছে না।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-১০
ডেভিড যে সত্যিই এত ভালো রান্না করবে তা আগে বুঝতে পারেনি ইভা। ডিনারটা জমল ভালো। খালার সাথে ডেভিডের আলাপ বেশ জমে উঠেছে। ডেভিড ক্রাইম রিলেটেড বিভিন্ন অপারেশনের কথা হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে বলছে, খালা হাসতে হাসতে চোখের পানি বের করে ফেলছেন। ইভারও ভালোই লাগছে। সন্ধ্যেটা উপভোগ করছে সে৷ এমনিতে সন্ধ্যেগুলো হয় নিরানন্দ। সে আর খালা যার যার মতো চুপচাপ খেয়ে উঠে যায়। তাতে অবশ্য এক ধরনের শান্তি থাকে। ইভা সবসময় ভাবত কোনো তৃতীয় ব্যক্তি এ সময় তাদের সাথে ঢুকে পড়লে তার খুবই বিরক্ত লাগবে। কিন্তু সে ডেভিডের সঙ্গ উপভোগ করছে বলে নিজেরই অবাক লাগতে লাগল।
ডিনার শেষে থালাবাসন ধুয়ে রাখতেও সাহায্য করল ডেভিড। ইভার সাথে টুকটাক কথা বলতে চাইলেও ইভা ততটা পাত্তা দিল না।
যাবার আগে ডেভিড ইভা আর খালা দু’জনকে দুটো উপহার দিয়ে গেল। সে চলে যাবার পর প্যাকেট খোলা হলো। খালার প্যাকেটে ছিল একটা খুব সুন্দর সিল্কের স্কার্ফ। আর ইভার প্যাকেট থেকে বের হলো একটা ডায়েরি৷ ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠা ফাঁকা। শুধু মাঝখান থেকে একটা চিরকুট বের হলো, তাতে লেখা, “Make me your best friend”.
ইভা একটু কনফিউজড হয়ে রইল। কাকে বেস্টফ্রেন্ড বানাতে বলল ডেভিড? তাকে নাকি ডায়েরিটাকে?
*******
অধরাকে নিয়ে শিশির প্রথমেই চলে গেল ওদের লনটা ঘুরে দেখতে৷ এখানে বিশেষ কিছু দেখার নেই। একটা অর্ধসমাপ্ত ফোয়ারা আছে, যেটা দিয়ে পানি ঝরছে ঠিকই, কিন্তু কেমন যেন অসংলগ্ন দেখাচ্ছে। শিশির বলল, “বাড়িটা করার সময় এটাও করা হচ্ছিল। ডিজাইন ছিল এক অর্ধনগ্ন নারীমূর্তির। মা বাড়ি দেখতে এসে সেটা দেখে তো রেগে আগুন। বাবার ওপর তুমুল চিৎকার চেঁচামেচি, এই জিনিস তার বাড়িতে রাখা যাবে না বলে আল্টিমেটাম দিয়ে বসল। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বাবা এটার কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এজন্য এই অবস্থা। জিনিসটা অদ্ভূত দেখতে হলেও কেউ কেন যেন এটা ভেঙে ফেলার কথাও বলে না।”
অধরা একটুখানি পানি ছুঁয়ে দেখল। এত সুন্দর জায়গা, অথচ গাছপালা নেই, স্রেফ ঘাসজমি। অধরার মনে হতে লাগল তার এত বড় জায়গা থাকলে সে এটাকে বাগানবাড়ি বানিয়ে ছাড়ত৷
বাড়ির পশ্চিমদিকে বেশ জঙ্গলমতো হয়ে আছে একসাথে বড় বড় কয়েকটা গাছের জটলা থাকায়। সবগুলোই সেগুন গাছ। শিশির বলল, “এগুলো মায়ের হাতের লাগানো। মা বাগান করায় তেমন এক্সপার্ট না। কী মনে করে গাছগুলো এভাবে লাগিয়েছিল নিজেও বোধহয় জানে না। এগুলো আবার বড় হয়েছে, মরে যায়নি।”
ওপরদিকে তাকাল অধরা। বড় বড় গোল গোল পাতার ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা ইতিউতি করে উঁকি দিচ্ছে।
এরপরেই ওরা চলে গেল বাস্কেটবল কোর্ট দেখতে। এটা খুব পছন্দ হলো অধরার। কেন পছন্দ হলো বলতে পারবে না। তবে জায়গাটা ছিমছাম। ইদানীং বৃষ্টি হচ্ছে বলে সতেজ একটা আবহাওয়া বিরাজ করছে। বাড়ি আর গাছপালার ছায়া পড়ায় জায়গাটা বেশ ঠান্ডা। সে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কে খেলে?”
“আমি।”
“আপনি!” অবাক হয়ে বলল অধরা।
“কেন খেলতে পারি না?”
“পারেন। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”
“এটা আমি নিজের জন্যই বানিয়েছি।”
“বাহ!”
“আপনি খেলতে পারেন?”
“বাস্কেটবল?”
“হু?”
“নাহ!”
“কী খেলতে পারেন?”
“কিছুই না। তবে খেলা দেখতে ভালো লাগে।”
“এরপর যেদিন খেলব সেদিন আগে থেকে বলে রাখব আপনাকে। এসে দেখে যাবেন নাহয়।”
অধরা মৃদু হাসল।
বাড়ির পেছনদিককার দেয়ালে খানিকটা শেওলা পড়েছে। সেখানেই জন্মেছে নয়নতারা ফুলের গাছ। গোলাপী ফুল ফুটিয়ে আলো করে আছে জায়গাটা। সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল অধরা।
“আপনার গাছপালা খুব পছন্দ তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“চলুন ভেতরে যাই। আপনার বোনের কাজের অগ্রগতি দেখে আসি।”
ওরা ভেতরে গিয়ে দেখল কেকের ব্যাটার বানানো হয়ে গেছে। অদিতি বড় ওভেনে তিনটা বোল একসাথে ঢুকিয়েছে বেক হবার জন্য। এর মধ্যে সে ক্রিম তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে।
অধরা জিজ্ঞেস করল, “কিছু লাগবে রে?”
অদিতি বলল, “নাহ। পারব। কিছু লাগলে নাসিমা আপুই করে দেবে। তোমাকে লাগবে না।”
অদিতি সাধারণত নিজের কাজে অন্যের সাহায্য পছন্দ করে না। তাই অধরা তাকে আর বিরক্ত করল না।
শিশিরের ডাক পড়ল ডেকোরেশনের কাজের ওদিকে। সে চলে গেলে অধরা বসার ঘরে গিয়ে বসল। দেয়ালের সাথে এটাচড বুকশেলফ আছে একটা৷ বেশ ভালো কিছু বইয়ের কালেকশন আছে। তবে মনে হয় না কেউ ওগুলো পড়ে। অধরা বেছে বেছে চিকন দেখে একটা বই নিল যেটা সে যাবার আগে হয়তো শেষ করতে পারবে। পুরো বই পড়তে না পারলে পরে উসখুস লাগতে থাকবে। বইটা হুমায়ূন আহমেদের লেখা, ‘আজ চিত্রার বিয়ে’।
অধরা বইতে ডুবে গেল। এই সময় একটা ব্যাপার ঘটল। বইতে একটা রবীন্দ্রসংগীতের লাইন লেখা। গানটা খুবই পছন্দ অধরার। গুনগুন করে কয়েক লাইন গেয়ে উঠল সে,
“বঁধু, কোন আলো লাগল চোখে!
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে…
ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,
ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে,
জন্ম-জনম গেল বিরহশোকে….”
গাইতে গাইতেই হঠাৎ সামনে চোখ চলে গেল। শিশির দাঁড়িয়ে আছে। মনোযোগ দিয়ে তার গান শুনছে। চোখে চোখ পড়তেই অধরার ভেতরটা কেঁপে উঠল। এমন হচ্ছে কেন তার সাথে? এই ডাকাত ছেলেটা এভাবে চেয়ে থাকে কেন? যেন এক্ষুনি হামলে পড়ে তার সব অনুভূতি জমা কাচের জারটা খপ করে তুলে নেবে নিজের হাতে!
“শিশির, এদিকে দেখে যা তো…” বলতে বলতে বসার ঘরে ঢুকল একজন। দু’জনেরই ঘোর ভাঙল। তারা কণ্ঠধারীর দিকে চাইল। অধরা একটু চমকাল। প্রায় শিশিরের মতোই দেখতে। ওর থেকে আরেকটু লম্বা, একটু মোটা, চেহারায় খুব সামান্য পার্থক্য। খুঁটিয়ে দেখে বিচার করলে এনার চেহারাই শিশিরের থেকে বেশি ভালো বলা যায়। সে যে শিশিরের বড় ভাই তা জানার জন্য প্রশ্ন করা নিষ্প্রয়োজন। শিশির আলাপ করিয়ে দিল তাদের।
ওরা কথা বলতে বলতে চলে গেলে আবার বইয়ের দিকে মন দিল অধরা। অর্ধেকের বেশি যখন পড়ে ফেলেছে, তখন দুপুরের খাবারের জন্য ডাক পড়ল। অদিতি ততক্ষণে গুছিয়ে এনেছে কাজ। কেক বেক করা শেষ। এখন আইসিং করবে।
খেতে বসে দেখা গেল শিশিরের বাবা বাদে বাড়ির লোকজন সবাই উপস্থিত। শিশিরের বড় ভাইয়ের নাম জানা গেল, শাওন। শাওনের বউ শাওলী, অদ্ভূত মিল। ভাবল অধরা।
খেতে বসে ওদের তেমন অস্বস্তি বোধ হলো না। শিশিরের মা যত্ন করে এটা ওটা বেড়ে খাওয়ালেন। সবার খাবার এক, শুধু শাওলীর খাবার আলাদা। সে স্ট্রং ডায়েট করে। তার বড় প্লেটটা ভর্তি সবজিতে। এক কোণে পড়ে আছে কম মসলায় সেদ্ধ এক টুকরো মাছ আর এক টুকরো মুরগি। সাথে একটা বাটিতে টকদই।
অধরার দিকে কেউ তেমন মনোযোগ দিল না। অদিতিকেই টুকটাক প্রশ্ন করে গেল সবাই। অদিতি সুন্দর করে উত্তর দিয়ে গেল, খেলও ভালো করে, তবুও অধরার মনে হলো অদিতি ওর মধ্যে নেই। তার আসল মনটা রান্নাঘরেই ফেলে এসেছে। সে খেতে খেতে ভাবল, এত অ্যামবিশিয়াস সে কেন হতে পারল না! একই মায়ের পেটেই তো জন্ম!
খাওয়া শেষে সবাই কাজে লেগে পড়ল। বসার ঘরে প্রচুর লোকজন চলে এসেছে। মূল অনুষ্ঠান হবে লনে। সেখানে লাইটিং করে সাজানো শেষ। তবে কিছু গেস্ট ভেতরেও বসবেন বলে এখনেও সাজানো হবে। অধরা কী করবে বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ অদিতির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একসময় বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ল। ঘুরতে ঘুরতে বাস্কেটবল কোর্টের কাছে এসে পড়ল। এখানে কেউ নেই।
সে চুপচাপ কতক্ষণ বসেছিল জানে না, কোথা থেকে যেন হঠাৎ উদয় হলো শিশির। বলল, “ছাদে যাবেন? এখন রোদ পড়ে গেছে। ছাদটা আপনার পছন্দ হবে।”
নিঃসঙ্গতা কেটে যাওয়ায় স্বস্তি পেল অধরা। সে সানন্দে রাজি হয়ে গেল।
ছাদের দরজা খুলে ভেতরে ঢুলে অধরা এত মুগ্ধ হলো যে প্রায় চিৎকার করে ফেলছিল আরেকটু হলে।
বিশাল ছাদ। পুরোটা সাদা ঝকঝকে টাইলসে মোড়া। ছাদটা পুরো ফাঁকা। অদ্ভূত রকমের সুন্দর। সে ঘুরে ঘুরে চারদিকটা দেখে বলল, “দারুণ তো!”
“ভালো লেগেছে আপনার?”
“হুম।”
“এদিকে আসুন।” বলে শিশির ছাদের সবচেয়ে পশ্চিম কোণটাতে নিয়ে গেল ওকে। সেখান থেকে শেষ বিকেলের লালচে সূর্যটা দেখা যাচ্ছে। সেগুন গাছগুলোর মাথা পেরিয়ে দূরে কোনো এক মসজিদের মিনার দেখা যাচ্ছে। অধরার ভীষণ ভালো লাগল। শিশির মৃদু স্বরে বলল, “আপনাকে একটা কথা বলব?”
“বলুন?”
শিশির কিছুক্ষণ চুপ করে দেখে বলল, “আমাকে বিয়ে করবেন?”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু