#মায়ায়_জড়ালে
#সূচনা_পর্ব
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
আমি কবুল বলার পর যখন আমার সাথে বিয়ে হওয়া লোকটি আমায় দেখেন,তিনি আমায় দেখামাত্রই তালাক দিয়ে দেন। আকস্মিক তালাকে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম।বিয়ে হবে হবে করেও এতোদিন হচ্ছিল না,আর যখন হলো তখন আমি ডিভোর্স পেয়ে গেলাম।এই বুঝি আমার কপাল!এই ভেবে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। আশেপাশের সবাই আমার জন্য আফসোস করতে থাকে। কিন্তু আমি নিয়তির উপর সব ছেড়ে দেই!ভাগ্যকে বিশ্বাস করে চুপ থাকি।
এতটুকু বলে থামলো প্রিয়ন্তি।
—“ তো উনি আপনাকে ডিভোর্স দিলো কেন?” প্রিয়ন্তির কথায় বিন্দুমাত্র অবাক না হয়ে বললো আওসাফ আবসার।
—“ আপনি অবাক হচ্ছেন না?”
—“ হচ্ছি, কিন্তু প্রকাশ করছি না।”
—“ আপনি স্পষ্টভাষী !”
—“ কিছু কিছু মানুষের জন্য!”
—“ সেইসমস্ত মানুষের মধ্যে আমায় ফেললেন!?”
—“কেন নয়!”
—“ আচ্ছা!”
—“ জি!এখন বলুন,উনি ডিভোর্স দিলো কেন?”
—“ উপহাস করছেন আপনি আমায়?”
—“ আশ্চর্য!উপহাস করবো কেন? শুধু জানতে চাইছি।”
—“ উনি আমায় দেখে আমায় তালাক দিয়েছেন ,এ কথাটির মানে বুঝেননি আওসাফ আবসার?”
—“ সত্যিই বুঝিনি।বুঝলে জিজ্ঞেস করতাম না।”
—“ আমার গায়ের রং,আমার গালে থাকা তিল উনার পছন্দ হয়নি,তাই ডিভোর্স দিয়েছিলো!” টেবিলের উপর রাখা দুই হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বললো প্রিয়ন্তি।
—“ বিয়ের আগে আপনাকে দেখেননি ওই লোক!”
—“ না।ছবিও দেখেছিলো শুধু।ওইখানে ফিল্টার করে আমায় সাদা করে দেয়া হয়েছিলো।আর তিলটাও ওড়নার ঘোমটার আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো।তাই খেয়াল করেননি।আর যখন খেয়াল করলেন,তখন সাথে সাথেই ডিভোর্স দিয়ে দিলেন।”
— আশ্চর্য!এই কারণে কেউ ডিভোর্স দিতে পারে?”
—“ পারে বলেই তো আমি ডিভোর্সী!” প্রিয়ন্তির চোখে পানি এসে গেল।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানিটুকু তৎক্ষণাৎ মুছে ফেললো সে।
—“ এই,আপনি কাঁদছেন কেন?এই সামান্য কারণে কেউ কাঁদে নাকি?বোকা!”
—“ ডিভোর্স কোনো সামান্য কারণ নয় মিস্টার আওসাফ আবসার।একটা মেয়ের জীবনে ডিভোর্স এমন একটা ক্ষতি যার মূল্য অপূরণীয়।কেউ সহজে তা পূরণ করতে পারে না।পরিণামে ডিভোর্সিরা ধুঁকে ধুঁকে মরে।”
—“ তাহলে তো দেখা যাচ্ছে আমায়ই ডিভোর্স নামক ক্ষতিটার মূল্য চুকানোর চেষ্টা করতে হবে!”
—“ মানে?” কান্না বন্ধ হয়ে গেল প্রিয়ন্তির।গোল গোল চোখ করে আওসাফের দিকে তাকালো সে!
—“ মানে,আমি আপনাকে বিয়ে করবো মিস শাহনুর প্রিয়ন্তি!”
—“ অনেক কথা সহজে বলা যায়, কিন্তু করা যায় না”
—“ আপনি কি আমায় বিশ্বাস করতে পারছেন না প্রিয়ন্তি?
—“ একদম না।হতে পারে আপনি আমার দুঃখ দেখে খানিকটা শান্তনার বাণী শোনাচ্ছেন।”
—“ একদম না”
—“ একদম হ্যাঁ, মিস্টার আওসাফ আবসার।আপনি সফ হার্টের বলেই এখনো বসে আমার কথা শুনছেন,এর আগে যতোজন আমার সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে,দেখা করতে এসেছে,ততজনই আমায় প্রত্যাখ্যান করে চলে গিয়েছে।”
—“ আপনি কি আমায় বিশ্বাস করছেন না প্রিয়ন্তি!”
—“ জানি না!” বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলো প্রিয়ন্তি!
—“ কেন জানেন না?” কথা বাড়ানোর চেষ্টা করছে আওসাফ এবং প্রিয়ন্তি তা বুঝে গিয়েছে।
—“ অযথা কথা বলে কেন মায়া বাড়াচ্ছেন আওসাফ?”
—“ তার মানে আপনি আমার মায়ায় পড়েছেন?”
—“ কখন বললাম?”
—“ এইযে বললেন,মায়া বাড়াচ্ছি কেন?মায়ায় না পড়লে কি মায়া বাড়ানো যেতো বলুন?”
—“ অতোশত জানি না।”
—“ কেন জানেন না!”
—“ কারণ আমি ডিভোর্সি!”
—“ এ কথা বলতে কি আপনার ভালো লাগে?”
—“ ভালো না লাগলেও বলতে হবে।”
—“ কেন?”
এবার আওসাফের চোখের দিকে তাকালো প্রিয়ন্তি।এক জোড়া নয়নে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললো,
—“ ধরুন,আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।”
—“ ধরবো কি করেই ফেলবো!” প্রিয়ন্তির মুখের কথাকে যেন হ্যাঁচকা টান দিলো আওসাফ।
—“ আরে,পুরো কথাটা তো শুনুন!”
—“ বলুন!”
—“ আপনার সাথে বা কারো সাথে যদি আমার বিয়ে হয়,তখন কয়েকদিন স্বাভাবিক মধুর নিয়মে কাটবে।বিয়ের পরবর্তী জীবনে তো অনেক কথা কাটাকাটি হয়,ঝগড়া হয় তখন কিছু হলেই আপনি আমায় আমার ডিভোর্সের খোটাটা নিশ্চয়ই দিবেন!”
—“ যদি না দেই!”
—“ কেন দিবেন না অবশ্যই দিবেন!”
—“ ধুর বোকা!শুনুন,আপনার সাথে ওই লোকটার জাস্ট কবুল বলাবলি হয়েছে।ওই লোক আপনাকে স্পর্শ করেছে কখনো?”
—“ না!যখন বরের সাথে কনের হাত একসাথে বাধা হয়,ওইসময় তিনি আমায় দেখে এক তালাক দুই তালাক তিন তালাক বলে ডিভোর্স দিয়ে দেন।”
—“ তাহলে?উনি যখন আপনাকে স্পর্শ করলোই না,তখন তো আপনি এখনো পিউর ই আছেন।আমি আপনাকে অযথা কথা শোনাবো কেন?এমন হতো যে ওই লোকের সাথে আপনার সম্পর্ক ছিল বা অন্য কিছু তবে একটা চান্স ছিলো। কিন্তু আপনি তো কোনো চান্সই রাখলেন না ম্যাম!”
—“ কিন্তু…
—“ উঁহু আর কিছু শুনবো না আমি।এখন একটু খাওয়া-দাওয়া করবো।তারপর বাড়ি গিয়ে আমার মতামত জানাবো।আমি নিজেই আপনার বাবা মাকে ফোন করে আমার মতামত জানিয়ে দিবো।এখন বলুন কি খাবেন?
—“ কিছু খাবো না”
—“ তা বললে কেমন হয়? দাঁড়ান ওয়েটারকে ডাকছি,মেন্যু দেখে বলবেন কি খাবেন!”
—“ আরে আমি কিচ্ছু খাবো না।”
—“ বুঝেছ ,আমার সামনে খেতে নিশ্চয়ই অস্বস্তি বোধ হবে।এক কাজ করি,প্যাক করে দেই।আপনি বাসায় নিয়ে যান।”
—“ দরকার নেই!”
—“ চুপ করে বসুন।”
শেষোক্ত কথাটুকু গম্ভীর গলায় বললো আওসাফ। প্রিয়ন্তিও বাধ্য মেয়ের মতো বসে গেলো।
প্রিয়ন্তি নামের মেয়েটা শ্যামবর্ণের!ডান গালে ছোট একটা তিল যেন তার শ্যামবর্ণের প্রতিনিধিত্ব করেএ।গায়ের রঙ,যেমনই হোক, প্রিয়ন্তি খুব মায়াবতী। প্রিয়ন্তি বয়স ২২।সে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে সাধারণত ১৮ বছর হলেই বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়।এরচেয়ে একটু দেরী হলেই লোকজন কথা শোনাতে ছাড়ে না। প্রিয়ন্তিও এর বাইরে নয়।
কিন্তু তার গায়ের রঙের জন্য প্রায় লোকেরাই ফিরে যেতো।আর যারা রাজি হতো,তারা মোটা অঙ্কের যৌতুক দাবি করতো। কিন্তু প্রিয়ন্তি যৌতুক দিয়ে বিয়ে বসতে আপত্তি জানাতো। তাছাড়া,তারা মধ্যবিত্ত!
যেসব লোকের জন্য তার সম্বন্ধ আসতো,বাড়ি থেকে প্রিয়ন্তিকে রেস্টুরেন্টে পাঠানো হতো সেই লোকদের সাথে দেখা করার জন্য। কেননা, প্রিয়ন্তীদের ঘরবাড়ির অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিল না।প্রিয়ন্তীর সবাই দেখে বাসায় ফিরে জানাতো তাকে পছন্দ হয়নি।
আজ থেকে ৪ মাস আগে প্রিয়ন্তীর জন্য একটা বড় ঘর থেকে সম্বন্ধ আসে।লোকটা বিদেশে থাকার কারণে সে প্রিয়ন্তীর সাথে দেখা করতে পারে না।ওই লোকের মায়ের প্রিয়ন্তীকে পছন্দ হওয়ার কারণে লোকটি মায়ের পছন্দের সাথে সম্মতি দেয়।ওই লোকের মা প্রিয়ন্তীর একটা ফিল্টার ব্যবহার করা ছবি নিজের ছেলের কাছে পাঠিয়ে দেয়।লোকটা প্রিয়ন্তীকে দেখে পছন্দ করে।
প্রিয়ন্তী ওই লোকটার সাথে ভিডিও কলে কথা বলে,নিজের আসল চেহারা দেখাতে চায়। কিন্তু তার বাসা থেকে নিষেধ করা হয়।বলা হয় ‘ এই প্রথম কেউ তাকে পছন্দ করেছে,বিয়ে করতে রাজী হয়েছে। অত্যন্ত এই বিয়েতে যেন সে কোনো সমস্যা না করে।’
পরিবারের চাপে প্রিয়ন্তি ওই লোকটির সাথে কথা বলে না।ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসে প্রিয়ন্তির বিয়ের দিন।যথাসময়ে বিয়েও হয়, কিন্তু যখনি পাত্র পাত্রীকে সামনে নিয়ে আসা হয়,লোকটি তখনি তার মাথায় পড়া শেরওয়ানি ছুড়ে ফেলে দিয়ে প্রিয়ন্তিকে তালাক দেয়।
যেহেতু ছেলের বিয়েতে মা উপস্থিত ছিল না,তাই ওই লোক সহজেই প্রিয়ন্তীকে তালাক দিয়ে দেয়।প্রিয়ন্তির পরিবারের আর কিছুই করার ছিল না।মেয়ের ক্ষতি তো হয়েই গিয়েছে।তাই তারা বিষয়টা মেনে নেয়।
এরপর গত চারমাস ধরে প্রিয়ন্তির জন্য যতগুলো বিয়ের প্রস্তাব এসেছে,সবগুলোই এসেছে বিবাহিত লোকের।হয়তো বউ মরা,নয়তো বউ পালিয়ে গিয়েছে কেউ কেউ তো সন্তানসহ ও এসেছে।কিন্তু প্রিয়ন্তি কোনোটাতেই মত দিতে ইচ্ছুক নয়।
দুদিন আগে প্রিয়ন্তির বাবার এক ছেলেবেলার বন্ধু আশকাফ সাহেব তাদের বাড়িতে আসেন,কথায় কথায় প্রিয়ন্তির প্রসঙ্গে্ উঠলে তার ব্যাপারে জেনে তিনি খুবই মর্মাহত হন। প্রিয়ন্তিকে তিনি যতদূর চিনেন,প্রিয়ন্তি খুবই ভালো ও ভদ্র মেয়ে। শুধু গায়ের রঙটাই তার প্রতিবন্ধতকতা। কিন্তু আশকাফ সাহেব গায়ের রঙকে প্রাধান্য দেন না।তাই প্রিয়ন্তির বিষয়টা শোনামাত্রই তিনি নিজের একমাত্র ছেলের জন্য প্রিয়ন্তিকে নিতে চান।তা শুনে প্রিয়ন্তির বাবা খুব খুশি হয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরেন।
কিন্তু এ খবর প্রিয়ন্তিকে জানালে সে বলে ছেলের মত আছে কী না জানতে।আশকাফ সাহেব ছেলেকে জানানো মাত্রই সে বিয়েতে রাজী হয়।আওসাফের বাবার উপর পূর্ণ বিশ্বাস ছিল। তাছাড়া সেও বাবার মতো মানুষের গায়ের রঙে বিশ্বাসী নয়।
ছেলে রাজী আছে শুনলেও প্রিয়ন্তি ছেলের সাথে মুখোমুখি হতে চায়।সে ছেলের সাথে দেখা করতে চায়।সে ভয় পায়!পাছে পূর্বের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়।তাই সে ভয়েই আজকে সে এসেছে আওসাফের সাথে দেখা করতে।এসে দেখে……
চলবে।