মায়ার বাঁধন পর্ব-১২+১৩

0
354

#মায়ার_বাঁধন🍂
১২.
খুব করে টিয়ার মাথাটা বারকয়েক ঠেসে দিল হিয়া। মেয়েটার জন্য তার একদন্ড শান্তি নেই। টিয়াকে প্রতি সে যতটা যত্নবান নিজের প্রতিও সে কখনোই ততটা নয়। বোনটার একটু কিছু হলেও প্রাণপাখি যেন উড়ে যায় তার। এই তো একটু আগেই যখন সে ফোনে অধৈর্য হয়ে পাশ ফিরে তাকালো টিয়া তখন দিব্বি এক হাতের সঙ্গে সঙ্গে এবার মাথাটাও জানালা থেকে বাহিরে বের করে দিয়েছে। মুহূর্তেই আ’ত্না কেঁপে ওঠে হিয়ার। চলন্ত গাড়ি। মাঝামাঝি যানবাহন সম্পন্ন রাস্তায় কেউ এমন করে? যদি কিছু অঘটন ঘটে যায় তখন? পরক্ষণেই আঁতকে উঠে টিয়াকে টেনে ভেতরে নিয়ে আসে হিয়া। টিয়ার মাথাটা দু-হাতে ধরে ইচ্ছে মতো কয়েকটা ঠাসা দেয়। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,

-“একটুও শান্তি দিবি না আমায়? এত বড় ধাড়ি মেয়ে হয়ে কিনা বাচ্চাদের মতো আচরণ করছিস। কবে আক্কেল হবে তোর?”

টিয়া ফুঁসে ওঠে। জোরালো কন্ঠে বলে,
-“কী করেছি আমি?”

হিয়া এবারে ছোট্ট করে এক চ’ড় বসিয়ে দেয় টিয়ার গালে। ক্রোধে কটকট করে বলে,
-“গাঁ’ধি কোথাকার। এখনো বুঝতে পারছিস না তুই কী করেছিস? জানালা দিয়ে ওভাবে ঝুলে ঝুলে স্বপ্নে ভেসে বেড়ালে কী কাজ হবে? যখন তখন যে কোনো বড় দূর্ঘটনা ঘটতে সময় নেবে না নাকি? সে খেয়াল কী আদৌ তোর মধ্যে আছে?”

টিয়া অসহায় ফেসে তাকিয়ে পড়ল। ঠোঁট উল্টে বলল, ‘সরি।’ পরক্ষনেই নীরার কথায় সে কিছুটা জেগে ওঠে।

-“থাক না হিয়া ছোট তে বুঝতে পারেনি। এভাবে বকাঝকা করো না।”

নীরার কথায় টিয়া আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
-“দেখেছ তো ছোট ভাবি মাত্র পাঁচ মিনিটের বড় হয়ে কীভাবে আমাকে বকাঝকা করে? এমন ভাব মনে হয় যেন ও আমার পাঁচ মিনিট নয় পাঁচ বছরের বড়।”

হিয়া চোখ গরম করে তাকালো। টিয়ার মাথাটা পুনরায় আরেক ঠাসা দিয়ে বলল,

-“পাঁচ মিনিট হোক বা পাঁচ বছর, বড় তো বড়-ই হয়। সত্যিটা মানতে শিখ।”

টিয়া মুখ ভেংচি কেটে পুনরায় বাহিরে দৃষ্টি দেয়। তবে এবারে আর হাত,মুখ বাহিরে দেয় না। চুপটি করে বসে আছে। নীরা এতক্ষণে পড়ে মৃদু আওয়াজে হেসে উঠল। হিয়াও হাসল ওর সঙ্গে। ফ্রন্ট সিটে বসা তুরানও এক পল লক্ষ্য করে নিয়েছে তার পিচ্চি বউয়ের প্রাণবন্ত হাসি।

—–
বাড়ি পৌঁছতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে যায়। গাড়ি থেকে নেমেই নীরা কেমন এক অন্য নীরা হয়ে উঠল যেন। সবকিছুই ঠিক ছিল কিন্তু তুরানের চরম বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়াল নীরার চোখের পানি। এসে থেকেই মা – চাচিদের সঙ্গে কান্না জুড়ে দিয়েছে। এদিকে যে জামাই দাড়িয়ে রয়েছে সে খেয়াল কী কারো আছে? তখনই তুরানের নিকট এগিয়ে এলেন নীরার বাবা হাশিম শিকদার। তুরানকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

-“এসো বাবা ভেতরে এসো। দেখ না তোমার শ্বাশুড়ি মেয়েকে পেয়ে কেমন বাচ্চা হয়ে গেছে। জামাই যে এখনো বাহিরে দাড়িয়ে সে খেয়াল কী তার আছে?”

তুরান মৃদু হেসে শুধু বলল, “ইট’স ওকে।”

পরপরই পেছন থেকে হাজির হলো হিয়া-টিয়া। হিয়া সূক্ষ্ম হেসে সালাম জানাল হাশিম শিকদারকে। কিন্তু টিয়া সে তার ননস্টপ বকরবকর চালু করে দিয়েছে। বলছে,

-“আরে আঙ্কেল শুধু ওদিকে দেখলে হবে? এদিকেও তো দেখুন। আমরাও তো এসেছি না। এসব বড় বড় ছেলেমেয়ে বাতিলের খাতায় ফেলে আমাদের মতো কচি বাচ্চাদের নিয়ে ভাবুন।”

হাশিম শিকদার শব্দ করে হেসে দিয়ে টিয়াকে কাছে টেনে নিলেন। বাধ্যতার সহিত মাথা নুয়িয়ে বললেন, “অবশ্যই, অবশ্যই।”

আড়াল হতে টিয়ার কথাগুলো শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেললো নয়ন। সে নীরার কাছেই আসছিল কিন্তু ওদের দেখে চেপে গেছে। হাজার হোক নীরার সম্মুখে পড়া মানে আবেগে কেঁদে দেওয়া শিওর কিন্তু টিয়ার সম্মুখে কাঁদা মানে নিজের পায়ে নিজেই কু’ড়া’ল মা’রা। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই প্রস্থান করল নয়ন। সুমন ঠিকই এলো। সে বেশ শক্তপোক্ত ছেলে। বোনকে কীভাবে সামলাতে হয় সে জানে সঙ্গে নিজেকেও। সুমন এগিয়ে গিয়ে তুরান সহ হিয়া-টিয়ার সঙ্গে সূক্ষ্ম আলাপ সেরে নিল। অগত্যা চলে গেল বাড়ির বাহিরে। হিয়া একপল পেছন ঘুরে দেখে নিল সদ্য যৌবনে পা রাখা কিশোর ছেলেটিকে। তার কিশোরী মন অবলীলায় নানান কথাই তখন ভাবতে মত্ত।

—–
কয়েকদিন পর নিজের চেনা পরিবেশে পা রেখে বড্ড অচেনা লাগছে নীরার সবকিছু। মনে হচ্ছে কত যুগ পর এলো এখানে। সবকিছু অন্য রকম লাগছে। ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল সে। নীরা বেড়তেই তুরান গিয়েছে ফ্রেশ হতে। তুরানের হলে একসঙ্গে দু’জনে নিচে যাবে। নীরার মা বারবার করে বলে দিয়েছে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে। নাস্তার ব্যবস্থা করা আছে। হিয়া-টিয়াকে গেস্ট রুম দেওয়া হয়েছে। ওরা ওখানেই ফ্রেশ হচ্ছে।

ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে তুরানের দৃষ্টি গেল নীরার দিকে। মেয়েটা সেই সকালের মতো উশখুশ করছে কেমন। তুরান ভেবে পেল না কিছুই। অগত্যা জিজ্ঞেস করেই ফেলল,

-“কী হয়েছে? এ্যানি প্রবলেম?”

নীরা নড়েচড়ে বসল। তুরানের মুখোমুখি চেয়ে বলল,

-“আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল।”

-“হুম বলো।”

-“আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা যেমনই থাক না কেন প্লিজ এখানে কোনো রকম সিনক্রিয়েট করবেন না প্লিজ। একটা দিনেরই তো ব্যাপার একটু মানিয়ে নিয়েন। আসলে বাবা-মা যদি এসব জানতে পারে খুব কষ্ট পাবে। আমার মা এমনিতেই হাই প্রেসারের রুগী।”

তুরান নীরার চিন্তান্বিত মুখশ্রীতে একপল তাকালো। নিষ্প্রভ কন্ঠে বলল, “হু,চেষ্টা করব।”

নীরা স্বস্থির নিশ্বাস ফেলল। সে ভেবেছিল হয়তো তুরান বেঁকে বসে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেবে।

—–
নানান রকম পিঠায় পুরো টেবিল সাজানো। সঙ্গে রয়েছে আরও নানা পদের মিষ্টান্ন খাবার। তুরান এক ঢোল গিলল। এত এত মিষ্টান্ন খাবার। সে এমনিতেই মিষ্টি তেমন একটা পছন্দ করে না। তার ওপর আবার এতো এতো খাবার সবেতেই মিষ্টি। তাও যা ভেবেছিল কোনো রকমে একটু মুখে তুলে ভেগে যাবে কিন্তু চারপাশ থেকে সকলে যে হারে হৈ হৈ করছে তাতে মনে হয় না পার পাবে। বউটাও তার হয়েছে এক। তাকে এমন অকূলপাথারে ছেড়ে দিয়ে সে দিব্বি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। তাও যে জোরজবরদস্তি উঠে চলে যাবে সে উপায়ও বন্ধ। একটু আগে নীরার কাছে যেই কথা সে দিয়েছে তার বরখেলাপ হয়ে যাবে না? নিরুপায় হয়ে নিজের তীব্র অপছন্দের জিনিসও গাণ্ডেপিণ্ডে গিলতে হচ্ছে তাকে। একেই বোধহয় বলে মাইকার চিপা।

এদিকে হিয়া-টিয়া বেশ ইনজয় করছে। এত এত আয়োজন। সবথেকে বড় কথা এত সাধের পিঠা তারা আগে কখনো খায়নি। এতো সব পিঠার নামও জানে না। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নীরার চাচির থেকে জেনে নিচ্ছে। তাদের জন্য এটা একটা গুড এক্সপ্রেরিয়েন্স। নাস্তার পাঠ চুকিয়ে সকলে চলে গেল বিশ্রাম নিতে। তুরান গিয়ে ধপাস করে বেডে শুয়ে পড়ল। সে নিজেকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছে। নাস্তায় যদি এতো আইটেম থাকে তাহলে লাঞ্চে কী থাকবে? লাঞ্চ রাখারা জায়গা হবে তার এই ছোট্ট পেটে? এরা বোধহয় তাকে খাইয়ে খাইয়েই মে’রে ফেলার পরিকল্পনায় আছে।

হিয়া জোর পায়ে আগেই ঢুকে গেছে রুমে। সকালে তাড়াতাড়ি উঠেছে এখন একটু বিশ্রাম আবশ্যক। কিন্তু চঞ্চল স্বভাবের টিয়া চলেছে ধীর গতিতে। হঠাৎ কী দেখে যেন তার পা থেমে যায়। চটজলদি পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয়। তার অধর কোণে ফুটে ওঠে এক অমায়িক, দুর্বোধ্য হাসি।

.
চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ নিশি

#মায়ার_বাঁধন🍂
১৩.
বিছানার ওপর আধশোয়া হয়ে বই পড়ুয়া নয়নকে দেখে দুর্বোধ্য হাসল টিয়া। মনে মনে বলল,

-“বেয়াই মশাই, টিয়া এসে গেছে। এবার বুঝবেন মজা। যাওয়া আগে ঠিক সেদিনের ঝগড়ার প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়ব।”

ক্রুর হেসে সেখান থেকে প্রস্থান নেয় টিয়া। রুমে গিয়ে ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। না চাইতেও তার অধর কোণে মিটমিটি হাসির রেখা ফুটে উঠছে। হিয়া সবেই একটু চোখ বন্ধ করেছিল। টিয়ার আগমনে ব্যঘাত ঘটে তার। পাশ ফিরে দেখতেই ভেসে ওঠে টিয়ার মিটিমিটি হাসি। হিয়া ভ্রু কুঁচকায়। সন্দিহান কন্ঠে বলে,

-“কী হয়েছে? এভাবে হাসছিস কেন? সত্যি করে আবার কী আকাম করেছিস?”

টিয়া হিয়ার কথা শুনে মনে মনে বলল,”এখনো কিছুই করিনি তবে শীঘ্রই করব।” তবে মুখে বলল,

-” তোর কী মনে হয় আমি কী শুধু আকামই করি?”

-“মনে হওয়ার কী আছে? যা চোখে দেখা যায় তা মনে করার দরকার পড়ে না।”

টিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে কিছু বলতে যায় কিন্তু থামিয়ে দেয় হিয়া। হাই তুলতে তুলতে বলে,

-“বাজে বকা বন্ধ করে রেস্ট কর আর আমাকেও রেস্ট নিতে দে।”

হিয়া উল্টোদিক ফিরে শুয়ে পড়ে। টিয়া মুখ ভেংচি কেটে অনত্র তাকায়।

—–
খেয়েদেয়ে শুয়ে বসে দিনটা বেশ ভালোই কেটে যায় তুরানের। তবে আজ বউটা তার বড্ড বেইনসাফি করছে তার সঙ্গে। একটু সময়ও তাকে দিচ্ছে না। এই যে এখন ঘুমানোর সময়। ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা বেজে দুই মিনিট চলছে অথচ এখনো তার ঘরে ফেরার নাম নেই। অজানা এক আতঙ্কে খচখচ করছে তুরানের অন্তরিক্ষ। তার ধারণা যদি সত্যি হয় তবে আজ রাতটা তার জন্য হারাম হয়ে যাবে হয়তো। বউ ছাড়া কী ঘুম নামবে চোখে? এই যে এই কয়েকটা দিন বউটা তার পাশেই গুটিশুটি মে’রে ঘুমিয়ে থাকে। ক্ষনে ক্ষণে সে একটু উঁকিঝুঁকি মে’রে দেখে নেয় তার ঘুমন্ত পরীটাকে। সেই সুযোগ বোধহয় আজ আর পাবে না। ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তুরান। একটা সিগারেট ধরিয়ে এগিয়ে যায় বেলকনির দিকে।

তুরানের সমস্ত উদ্ভট ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে কিছুক্ষণ বাদেই নীরা প্রবেশ করে ঘরে। আশেপাশে তাকিয়ে তুরানকে না দেখতে পেয়ে এগিয়ে যায় বেলকনিতে। তুরান টের পায় তবু ফেরে না। নীরা কিছুক্ষণ সেভাবেই দাড়িয়ে থেকে তুরানের এটেনশন পেতে চেষ্টা করে কিন্তু ফলাফল শূন্য। অবশেষে খুকখুক শব্দ করে ওঠে। তুরান তবুও ফিরে তাকায় না। সিগারেটে টান মে’রে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

-“কিছু বলবে?”

-“একটা কথা ছিল। রাখবেন?”

-“হুম, শুনছি বলো।”

-“ছাদে যাবেন?”

এ পর্যায়ে তুরান পেছনে ঘুরে। ভ্রু কুঁচকে তাকায় নীরার দিকে। নীরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আমতা আমতা করে বলে,

-“ন না মানে আসলে রাতের আকাশটা আজ বড্ড বেশিই সুন্দর। থালার মতো বিশালাকারের চাঁদ উঠেছে। খোলা আকাশের নিচে বসে চন্দ্রবিলাশ করলে মন্দ হতো না।”

তুরান রাজি হয়। একটু আগেই যার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য ছটফট করছিল এখন তার ডাকে সারা দেবে না তাই আবার হয় নাকি। তবে প্রকাশ্যে নিজেকে স্বাভাবিক রাখল সে কিন্তু ভেতরে ভেতরে উত্তেজনার ত্রুটি নেই। সিগারেটে শেষ টান মে’রে বেলকনি থেকে ফেলে দিতে দিতে বলল,

-“চলো তবে। মন্দ না হলে আমারও আপত্তি করার কিছু নেই।”

নীরার মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস উপচে পড়ছে। তুরান আড়চোখে উপভোগ করে নেয় সে দৃশ্য। আড়ালে নিজেও মুচকি হাসে।

—–
ভর জ্যোৎস্না রাত। এক জোড়া কপোত-কপোতী মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে উপভোগ করছে গোটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দুজনেই প্রকৃতিতে বিভোর। কারোও মুখে রা শব্দটুকু নেই। বিশালাকৃতির চন্দ্রের চতুর্দিকে বিস্তৃত ঝিকিমিকি তারকার ঝাক। জ্বলছে মিটিমিটি। মৃদু হাওয়ায় দুলছে গাছপালা। দুলছে কপোত-কপোতীর হৃদয়। অকস্মাৎ তুরান মুখ খোলে। আকাশের দিকে তাকিয়েই বলে ওঠে,

-“গাইতে পারো?”

নীরা চমকে উঠল। ছটফটে চাহনিতে তাকালো তুরানের পানে। বেশ দ্রুতই বলল, “নাহ, নাহ।”

তুরান কিঞ্চিৎ হাসল। নীরার আতঙ্কিত মুখপানে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,

-“জানি মিথ্যে বলছ। গেয়ে শোনাও ঝটপট।”

নীরা নড়েচড়ে বসল। পুনরায় আর্তনাদ করে বলল,
-“সত্যি বলছি পারি না।”

তুরান অভয় দিয়ে বলল,
-“ভয় কীসের?শুরুটা তুমি করো শেষটা না হয় আমিই করলাম।”

নীরা দ্বিগুণ চমকায়। সত্যি সত্যি তুরান গাইবে? তবে সে খুব করে চাইছে তুরানই আগে সুর তুলুক। সে না হয় শেষটুকু ধরবে। কিন্তু তার সেই ভাবনায় ভাটা পড়ে তুরানের মিহি কন্ঠের আকুতিভরা বাক্যে।

-“এই পূর্ণিমা তিথি। তারকা ঝিকিমিকি। মৃদু পবনে দুলছে হৃদয়। এমন পরিবেশে বহুরুপী সুন্দরীর নিকট ছোট্ট একটা আবদার তো করাই যায়। নিশ্চয়ই সে আশাহত করবে না?”

নীরা কী বলবে ভেবে পায় না। খানিকক্ষণ যাবৎ যু’দ্ধ চালায় নিজের মনের সঙ্গে। মানুষটাকে ফিরিয়ে দিতে মন সায় দিচ্ছে না। এমন আকুতি কী অবজ্ঞা করা যায়? তবুও
ওই যে ইতস্তততা। কিয়ৎক্ষণ চলল নিরবতা। পরপরই শোনা গেল ধীরুজ গতিসম্পন্ন মিহি কন্ঠের গান,

(((নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে
চুপিচুপি বাঁশি বাজে বাতাসে বাতাসে

নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে
চুপিচুপি বাঁশি বাজে বাতাসে বাতাসে

বাকিটুকু নিজ দ্বায়িত্বে শুনে নেবেন)))

কথা মতো ঠিকই তুরান শেষটায় সুর মিলিয়েছিল। নীরা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছে তার বরের মাধুর্যপূর্ণ কন্ঠস্বরে সঙ্গীত। আবেশে ছেয়ে গেছে হৃদয়। প্রশান্তি মিলেছে অন্তঃকোণে। কতবার যে দুজনের দৃষ্টি একত্রে হয়েছে তার কোনো হিসেবে নেই। প্রতিবারই নীরা লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে ফেলেছে কিন্তু তুরান এক চুলও নড়ে নি। বরং পুরোপুরি উপভোগ করেছে নীরার লজ্জারাঙা মুখশ্রী। অদ্ভুত শান্তি খুঁজে নিয়েছে সে মুখশ্রীতে। আলতো হাতে কতবার যে ছুয়ে দিতে চেয়েছে কিন্তু শেষমেশ হয়ে ওঠেনি। সময়, সম্পর্কের বেড়াজালে কঠিন ভাবে আটকে গেছে সে।
না পারছে গিলতে না পারছে ওগরাতে।

—–
রাত করে ঘুমোনোর ফলে সকালে ঘুম ভাঙতে বেশ দেড়ি হয় তুরান-নীরার ৷ ছাদ থেকে নেমে এসে দু’জনে ঘুমতেই পারছিল না। এক অদ্ভুত অনুভূতিতে শিউরে উঠছিল সর্বাঙ্গ। দু’জনের প্রতি দু’জনের তীব্র আকর্ষণ অনুভব করছিল। লজ্জা, সংকোচ জেঁকে বসছিল। আগের রাতগুলো তো এতোটা আকর্ষিত ছিল না তবে আজ কেন এমন লাগছে? ভাবনা চিন্তার মধ্যে দিয়েই একপ্রকার কখন জানি ঘুমিয়ে পড়ল তারা। ঘুম ভাঙল কারো বিকট চিৎকারে। নীরা ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠল। তুরানও উঠে বসেছে। একে অপরের চোখ চাওয়াচাইয়ি করে বলল,

-“এটা টিয়ার গলা না?”

.
চলবে,