মায়ার বাঁধন পর্ব-৩১

0
301

#মায়ার_বাঁধন🍂
৩১.
————————
উত্তরের জানালায় ঠেস দিয়ে উদাস ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে নীরা। মনে জাগছে সহস্র প্রশ্ন। তুরান কীভাবে জানতে পারল এই জায়গার সন্ধান? কেন এলো সে? এতক্ষণ নিশ্চয়ই চলে গেছে? সে ক্ষণে ভেসে আসে প্রগাঢ় কন্ঠস্বর,

“নীড়পাখি।”

নীরার সর্বাঙ্গ দুলে ওঠে। জানালার উন্মুক্ত কপাটি গলে ধেয়ে আসে হিম শীতল সমীর। শৈথিল্য আনে নীরার অন্তঃপুরে। নীরার স্তব্ধ, বিমূঢ় রূপে সেই আকুলতা প্রবল হয়। ভেসে আস পুনরায়।

“নীড়পাখি।”

নীরা আনমনেই ওড়নার খোট খামচে ধরে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। ক্ষীণ পরেই অনুভব করে তার কোমল হস্তের ভাঁজে খসখসে, শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শ। নীরার দেহে মৃদু কম্পন সুস্পষ্ট। তুরান মুগ্ধতা মিশ্রিত দৃষ্টে চেয়ে। ধরে যেন এতক্ষণে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তুরান আর একটু নিকটস্থ হয়৷ দুজনের মধ্যে দূরত্ব কিঞ্চিৎ। পিনপতন নীরবতা বিস্তৃত কক্ষে শুধু দুটো মানুষের নিঃশ্বাসের ওঠানামার ভারি সংকেত। পুরোপুরি দূরত্ব ঘুচিয়ে তুরান পেছন থেকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় নীরাকে। নীরা এবার থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। ঝটকা মে’রে সরে যেতে চাইলে অসম্ভব হয় তুরানের জন্য। তুরানের হস্ত বন্ধন দ্বিগুণ তীব্র হয়। সে বন্ধন থেকে ছাড়া পাওয়া নীরার পক্ষে কঠিনসাধ্য। নীরা এখন অব্দি বিন্দুমাত্র সাড়াশব্দ করে নি। শুধু তুরানের থেকে ছাড়া পেতে মোচড়ামুচড়ি করছে। তখনই এক নেশাক্ত কন্ঠের আকুতিধ্বনি তার কর্ণে এসে আঘাত হানে।
উলটপালট করে তোলে তার অন্তঃপুর।

“আ’ম সরি বউ। এ যাবত আমার সকল অন্যায়ের জন্য তোমার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। যাচাই বাছাই না করেই যে দুর্ব্যবহার আমি তোমার সঙ্গে করেছি জানি তার ক্ষমা হয় না। তবুও আমি ক্ষমা চাইছি। তোমার অনুমতি বিহীন তোমাকে স্পর্শ করার জন্য ক্ষমা চাইছি। খুব করে তোমার মুখের মিষ্টি হাসি দেখতে চাই। দেখতে চাই সেই লাজুকতা মিশ্রিত কোমল মুখশ্রী। প্লিজ একটি বার! শুধু একটিবার সুযোগ দেবে কী আমায়? কথা দিচ্ছি শেষ নিশ্বাস অব্দি আমার ভালবাসায় বন্দিনী করে রাখব তোমায়। অনন্ত সুখে ভরিয়ে দেব তোমার অন্তঃপুর। কখনো কোনো অভিযোগ আনতে দিব না। একবার বিশ্বাস করেই দেখো।”

তুরান একটু থামে। নীরার দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে পুনরায় কন্ঠে স্মিত আওয়াজ তোলে,

“ববববউউ”

নীরা বলতে চায় অনেক কিছু কিন্তু পেরে ওঠে না। আমরা আমাদের দূর্বল সময়ে কারো সান্নিধ্য পেলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। আর যদি হয় সে প্রিয়জন তাহলে তো কথাই নেই। যে আঘাত দেয় তার বুকেই আবার শান্তির আশ্রয় খুঁজে নেই। নীরার ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে। তুরানের এই সহজ স্বীকারোক্তিগুলো যেন তার কর্ণে মধুর মতো গলে পড়েছে। সে আর স্থির থাকতে পারে না। পেছনে দিকে ঘুরেই হামলে পড়ে তুরানের বক্ষে। ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। তুরান পরম সুখে জড়িয়ে নেয় তার প্রাণেশ্বরীকে। অধর কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে বলে,

“ভালবাসি বউ। তোমার শূন্যতা আমাকে পুড়িয়েছে প্রতিনিয়ত। বুঝিয়ে দিয়েছে তুমি আমার ঠিক কতটা জুড়ে আছো। সারাজীবন এভাবেই তোমায় আমার বক্ষপিঞ্জরায় আবদ্ধ করে রাখতে চাই।”

নীরার হাতের বন্ধন সুদৃঢ় হয়। কান্নার মাত্রা কমে এসেছে। থেকে থেকে শুধু ফোপাঁনোর আওয়াজ আসছে। তুরানের অধরে নিরবে তৃপ্তিপূর্ণ হাসি ফুটে।

———

জাহানারা চৌধুরীর কোলে মাথা রেখে পরম শান্তিতে চোখ বুজে আছে নীরা। হৃদয় জুড়ে তার আজ অনন্ত প্রশান্তি বিরাজমান। নীরাকে ফিরে পেয়ে জাহানারা চৌধুরী ভীষণ বকাঝকা করেছেন এভাবে চলে যাওয়ার জন্য। আলহাম চৌধুরী তো গাল ফুলিয়ে বসে ছিলেন। নীরা অনেক আকুতি মিনতি করে তার মান ভাঙিয়েছে। জাহানারা চৌধুরীর কাছে তুরানের সকল পাগলামির কথা শুনে নীরা ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। সেই সঙ্গে মনে মনে ভীষণ খুশিও হয়েছে। এটাই তো সে এতদিন ধরে চেয়ে আসছে। তুরান একটু বাহিরে গেছে। কী যেন কী দরকারে। নীরা এসে থেকেই শ্বাশুড়ির কোলে ঘাপটি মে’রে পড়ে আছে। তখনই দরজায় টোকা পড়ে। শ্বাশুড়ি মা অনুমতি দিলে নত মস্তকে ভেতরে প্রবেশ করে রিনা। তাকেই দেখতেই জাহানারা চৌধুরী তেঁতে উঠেন। ধমকে বলেন,

“তুমি এ ঘরে কেন? এতকিছু করেও কী শান্তি হয়নি? এতদিন তোমার কার্যকলাপ মুখ বুজে সহ্য করে গেছি কিন্তু আর নয়। এবার তরিকের কাছে তোমার বিষয়টি তুলে ধরতেই হচ্ছে। ভেবেছিলাম শুধরে যাবে কিন্তু না যে হয় সে নয়তেই হয় নিরানব্বই এর প্রয়োজন পড়ে না।”

রিনা অসহায় নেত্রে তাকিয়ে রইল জাহানারা চৌধুরীর মুখপানে। তার মুখশ্রীতে স্পষ্ট অনুশোচনার রেশ। জাহানারা চৌধুরীর কথায় সে কোনোরকম দিরুক্তি পোশন ছাড়াই নীরার নিকট এগিয়ে এলো। নীরার হাত দুটো চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। অপরাধী কন্ঠে বলল,

“পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও বোন। তোমাকে শুরু থেকেই আমি নানাভাবে কষ্ট দিয়ে এসেছি। হিংসে হতো খুব। কিন্তু তোমার অনুপস্থিতি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে তুমি ঠিক কতটা খাঁটি। হালিমা খালা আমাকে বলেছে অগোচরে তুমি আমার ঠিক কতটা খেয়াল রাখতে। আমার সবকিছুর দেখভাল করতে। আর সেই আমিই কী না! ছিহ।
যাই হোক পারলে ক্ষমা করে দিও আমাকে।”

রিনা অশ্রুসিক্ত আঁখি মুছে উঠে দাড়ায়। জাহানারা চৌধুরীর পানে তাকিয়ে পুনরায় বলে,

“আম্মা পারলে আপনিও আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আপনার সুখের সংসারে আমার জন্য অশান্তির আগুন জ্বলেছে। আমার জন্যই আপনার শরীরের এই হাল। পারলে ক্ষমা করবেন আমায়।”

রিনা আর এক মুহূর্ত দাড়ায় না। জোর কদমে হেঁটে প্রস্থান নেয়। জাহানারা চৌধুরী ও নীরা একে অপরের দিক চেয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।

———–

রাতের খাবার শেষ করে ঘরে চলে এসেছে নীরা। তুরান এখন অব্দি ফেরেনি। নীরার মনটা উশখুশ করছে। শুয়ে, বসে কিছুতেই স্বস্তি মিলছে না। বার কয়েক ফোন হাতে নিয়েছে তুরানের নম্বরে ডায়াল করবে কিন্তু শেষমেশ ব্যর্থ হয়ে ফোন বিছানায় ফেলে রেখেছে। নীরা ধীর গতিতে এগিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশ বেজায় মোহনীয়। ক্ষণে ক্ষণে হিম শীতল পবন শরীরে মৃদু কম্পন তুলছে। অকস্মাৎ উদরে শীতল স্পর্শে কেঁপে ওঠে নীরা। চমকে পেছন ফিরে তাকায়। তুরান দাড়িয়ে। অধর কোণে ক্রুর হাসি। নীরা আমতা আমতা করছে। দৃষ্টি চঞ্চল। কী বলবে বুঝতে পারছে না। নীরার হাবভাব বুঝে তুরানই আগে মুখ খোলে। কন্ঠে কৌতুক মিশিয়ে বলে,

“আমিই তো এতো ঘাবড়ানোর কী আছে? অন্য কেউ ভেবেছিলে বুঝি?”

“আশ্চর্য! অন্য কেউ কেন ভাবতে যাব?”

“তাহলে এমন করলে কেন?”

“আ আসলে হঠাৎ করে তো একটু চমকে গেলাম তাই।”

তুরান আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো নীরার সঙ্গে। নীরার কর্ণধারে অধর স্পর্শ মিলিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“শুধু চমকে গেলে কেউ এভাবে কাঁপে?”

নীরা পুনরায় কেঁপে ওঠে। তুরানের প্রতিটি কথা, স্পর্শে তার ভেতরকার শক্তি দূর্বল হয়ে পড়ছে। উত্তেজনায় কন্ঠনালী রোধ হয়ে আসছে। নীরা প্রতুত্তরে চুপ থাকে। তুরান নিঃশব্দে হাসে। হুট করেই কোলে তুলে নেয় নীরাকে। হতভম্ব নীরা আঁকড়ে ধরে তুরানের শার্টের কলার। আরেক হাতে গলা জড়িয়ে নেয়। দৃষ্টি তার বদ্ধ। তুরান ঘরের ভেতরে এগিয়ে যেতে থাকে। আর মৃদু আওয়াজে বলতে থাকে,

“সেদিন না হয় অচেতন ছিলাম। আজ সচেতন হয়েই কিছু করি। নয়তো বউ আবার ভাবতে পারে তার বর তাকে আদর দিতে কিপ্টেমি করে। মান সম্মান থাকতে তখন আমার?”

নীরার কান গরম হয়ে উঠেছে। শার্টের কলার ছেড়ে তুরানের বুকে আলতো এক কিল বসিয়ে পুনরায় শার্ট আঁকড়ে ধরে নিয়েছে। সামনে কী হতে যাচ্ছে ভেবেই অস্থিরতা প্রকট থেকে প্রকট হচ্ছে তার।

———
চলবে,
®অহমিকা মুনতাহাজ নিশি