মায়ার বাঁধন পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0
724

#মায়ার_বাঁধন
৩২.(অন্তিম পর্ব)

সকালে তুরান, নীরা একসঙ্গেই ভার্সিটিতে যায়। আজ সকালটা ছিল অন্য রকম। সকলের সঙ্গে আজ ডাইনিংয়ে রিনাও উপস্থিত ছিল। শ্বাশুড়ির হাতে হাতে সব এগিয়ে দিয়েছে। সবাই বেজায় খুশি। একটা স্নিগ্ধ, সুন্দর দিনের শুরু।

ভার্সিটিতে প্রবেশ করে নীরা তুরানের থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ক্লাসের দিকে চলে যায়। কিন্তু যত গন্তব্যে এগোচ্ছে তার পায়ের চলন ততই ধীরুজ গতিসম্পন্ন হচ্ছে। অতশীর মুখখানা অক্ষিপটে ভেসে উঠছে বারংবার। একটা সময় স্থবির পায়ে এসে পৌঁছায় সে ক্লাসের দ্বার কক্ষে। চারিদিকে এক পলক নিশ্চল দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। সীমা, রুহিকে দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে অতশীও রয়েছে। নীরা ভেতরে প্রবেশ করে। কিছুটা এগিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। তার কী ওদের নিকট যাওয়া উচিত? নাকি অন্যত্র স্থান নেওয়া উচিত? নীরার ভাবনা ছেদ ঘটায় রুহি। সে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে নীরার কাঁধে হাত রাখে। চমকে ওঠে নীরা। নিজ ভাবনায় এতটাই মশগুল ছিল যে কখন রুহি এলো টেরই পাই না। রুহি তার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“এসেছিস। চল তাড়াতাড়ি। কথা আছে অনেক।”

নীরা রুহির সঙ্গে সীমা ও অতশীর নিকট উপস্থিত হয়৷ অতশী সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। নীরার কেমন জানি খটকা লাগে। সীমা কিছু বলে না। সে নির্বাক শ্রোতা৷ নীরা কিছুটা সাহস জুগিয়ে অতশীর কাঁধে হাত রাখে। অতশী ততক্ষণাৎ হাতটা ঝাড়া মে’রে সরিয়ে দেয়। নীরা হতভম্ব। বিস্মিত কন্ঠে শুধায়,

“কী হয়েছে? এনি প্রবলেম?”

অতশী সীমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“সীমা তাকে বলে দে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। সে থাকুক তার মতো। আমাদের তো তার দরকার নেই। এমন ফ্রেন্ডশিপ থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।”

সীমাও সায় দেয় অতশীর কথায়। বিরক্ত হয় রুহি। চোখ মুখ কুঁচকে তার বানী,

“আহ তোরা কী শুরু করলি? মেয়েটার সঙ্গে কথা তো বলতে দে আগে।”

রুহিবইটি নীরার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,

“আচ্ছা তুই যে তুরান ভাইয়ের বউ এটা আমাদের আগে বলিস নি কেন?”

নীরা ছোটখাটো একটা ধাক্কা খায় যেন। শুরুতেই তার দৃষ্টি যায় অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকা অতশীর পানে। ওরা এসব কীভাবে জানল কিছুতেই নীরার মাথায় ঢুকছে না৷ নীরার স্তব্ধতা দেখে রুহি ফের বলে,

“কী এটাই ভাবছিস তো আমরা কীভাবে জানলাম?”

নীরা দৃষ্টি ঘুরিয়ে রুহির দিকে আনে। রুহি তার দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পেরে বলে,

“তাহলে শোন।”

অতঃপর রুহি গতদিনের সমস্ত ঘটনা বিবৃতি করে শোনায়। সব শুনে নীরা যেন পাথর বনে যায়৷ তুরানের তার প্রতি সিরিয়াসনেস দেখে যতটা না ভালো লাগছে ঠিক ততটাই খারাপ লাগছে অতশীর মুখ পানে তাকিয়ে। নীরা কী বলবে না বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ক্ষীণ বাদে সে তার কম্পিত, স্থিতিশীল হস্ত জোড়া এগিয়ে দেয় অতশীর কাঁধে। অতশী ফেরে না ঝটকা মে’রে সরিয়ে দিতে নেয়। কিন্তু নীরার জোড়ালো বন্ধন থেকে মুক্ত হতে অক্ষম হয়। নীরা আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ওকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। অতশী আর শক্ত থাকতে পারে না। সে ও নীরাকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে। ভাঙা কন্ঠে আওড়াল,

“এমন টা কেন করলি বল? আমি অজান্তেই একটা ভুল রাস্তায় পা বাড়িয়েছিলাম। তোদের হালাল সম্পর্কের মধ্যে নিজের অজান্তেই আমি ঢুকে পড়েছিলাম। তুই সেদিন ওভাবে চলে না গিয়ে আমাকে সবটা বলতে পারতি। আমাকে কী তোর অতটাই খারাপ মনে হয় যে আমি সবটা জানার পরেও তোর সংসারে নজর দিতাম? বলেই দেখতি। অযথা কষ্ট পেলি নিজে।”

নীরার কথা আটকে আসছে। তবুও কোনোরকমে বলে,

“আমি কীভাবে তোর সামনে দাড়াব বুঝতে পারছিলাম না। মস্তিষ্ক শূন্য লাগছিল। কী করেছি না করেছি নিজেও জানি না।”

“হয়েছে, হয়েছে এবার তোরা থাম। পুরো ক্লাস তোদের মনোযোগে।”

নীরা, অতশী চোখ মুছে নেয়৷ সীমা, রুহি মুচকি হেসে ওদের দুটোকে জড়িয়ে নেয়। চার বান্ধবী একে অপরের জড়িয়ে প্রশান্তি অনুভব করে।

——–

নেহাল কেবলই তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ক্যাম্পাস ক্রস করছিল। পথিমধ্যে দেখা হয়ে যায় তুরানের সঙ্গে। তুরানের দিকে তাকিয়ে আগাগোড়া এক পলক মেপে নেয়। পরপরই এক দুর্বোধ্য হাসি টেনে চলে যেতে নেয়। দু কদম এগোতেই ডেকে ওঠে তুরান। নেহাল থামে পেছন ফেরে না। তুরান কন্ঠে গাম্ভীর্য টেনে বলে,

“পারলে ফিরে আয়। নতুন করে দু’জনে সবকিছু শুরু করব। একসঙ্গে লড়ব।”

নেহাল তাচ্ছিল্য হাসে। বলে,
“তুই ওদের চিনিস না। ওরা কখনোই ছাড়বে না আমাকে। সেই সঙ্গে তোরও ক্ষতি হবে।”

তুরান এবার ঘুরে দাড়ায়। নেহালের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“আমার কিচ্ছু হবে না। জানি লোকটা খারাপ। তুই ওই পথ থেকে সরে আয়৷ আমরা দু’জনে মোকাবিলা করব।”

নেহাল কিছু বলে না চুপ করে রয়। তুরান নেহালের কাঁধে হালকা চাপ প্রয়োগ করে। বলে,

“ভেবে দেখিস।”

অতঃপর দুজন চলে যায় দু’দিকে।

ক্লাস শেষে তুরান নীরাকে কল করে বলে দেয় গেটের কাছে ওয়েট করতে। আজ তারা একসঙ্গে ফিরবে। কথামতো নীরা তাই করে। একটু বাদেই তুরানের উপস্থিতি। সে তার বাইক ছুটিয়ে একেবারে নীরার সম্মুখে এসে দাড়িয়েছে। নীরা চমকে দু কদম পিছিয়ে যায়। তুরান অধর কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

“ভ’য় নেই বিবিসাহেবা আমিই তো। আপনার একান্ত অনুগত বর।”

নীরা মুখ ভেংচি কাটে। ব্যঙ্গ করে বলে,
“ইশ এলেন রে আমার একান্ত অনুগত বর। দুদিন হলো না দরদ দেখাতে এসেছে।”

তুরান শব্দ করে হেসে ওঠে। নীরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। পরপরই তুরান নিজের একহাত বাড়িয়ে দেয় নীরার পানে। উচ্ছসিত কন্ঠে বলে,

“উঠে এসো।”

নীরা লাজুক বদনে এগিয়ে যায়। তুরানের হাতের ওপর হাত রেখে উঠে বসে বাইকে। চলতে শুরু করে দু’জনে আপন গন্তব্যে।

———
পরিশিষ্টঃ🍂
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেটে গেছে পাঁচটি বছর। জীবন এগিয়ে চলেছে জীবনের দাঁড়িপাল্লায়। সুখ, দুঃখ পরিমেয়তায় ভরপুর সবকিছু। জাহানারা চৌধুরীর সংসারে এখন কেবল সুখ আর সুখ। বড় ছেলে তরিক ব্যবসায়িক কাজ সম্পন্ন করে ফিরে আসার বছর পরেই রিনার কোল আলো করে এসেছে এক পুত্র সন্তান। তার বছর খানেক পরেই একত্রে বিবাহ সম্পন্ন করা হয়েছে হিয়া,টিয়ার। বলাবাহুল্য হিয়া,টিয়ার বিয়ে শেষমেশ সুমন ও নয়নের সঙ্গেই হয়েছে। হিয়ার জুড়ি মিলেছে সুমনের সঙ্গে আর টিয়ার জুড়ি মিলেছে নয়নের সঙ্গে। সুমন- হিয়া ঠিক যতটা শান্তশিষ্ট দম্পতি নয়ন-টিয়া ঠিক তার উল্টো। সেই লেভেলের ঝগড়াটে কাপল। এখনো সেই শুরুর দিনের মতোই ঝগড়া করে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। নেহাৎই পরিবার থেকে বিয়েটা জোর করে দিয়েছে নয়তো কোনোদিনও দুটিতে এক হতো না। এই প্ল্যানটা অবশ্য নীরার ছিল ওদের ঝগড়া বন্ধ করার কৌশল হিসেবে। কিন্তু হলোটা কী?ঝগড়া কমার বদলে দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কিয়া মাঝেমধ্যেই সুযোগ পেলে স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে চলে আসে বাবার বাড়িতে। তার মেয়ে তিয়া এখন সাড়ে ছয় বছরের পাকনি বুড়ি একটা। অতশীর বিয়ে হয়েছে নেহালের সঙ্গে। এই বিয়ের সমস্ত ক্রেডিট কিন্তু তুরানের। নেহাল যখন তার বন্ধুক্তে সাড়া দিয়ে পুনরায় সৎ পথে ফিরে আসে। পরপরই তুরান লক্ষ্য করে নেহালের হাবভাব। তার অতশীকে চোখ দিয়ে গিলে খাওয়া নজর এড়ায়নি তুরানের। একসময় তুরান অতশীর কাছে নিজে প্রস্তাব রাখে। অতশী আর না করতে পারেনি। এক সময়ের প্রিয় মানুষের কথায় সায় দিয়ে গ্রহণ করে নেয় নেহালকে। সীমা,রুহিও নিজেদের মতো বিয়ে করে সেটেল। সবার জীবন বেশ সুখে পরিপূর্ণ। এখন কেবল অপেক্ষা নীরা-তুরানের ঘর আলো করে একটা রাজকুমারী আসার। যে #মায়ার_বাঁধনে তারা আটকা পড়েছে বেশিদিন হয়তো লাগবে না সেই শুভক্ষণ আসতে। ভালো থাক সকলে। #মায়ার_বাঁধনে জড়িয়ে কাটিয়ে দিক ইহকাল।

————-
সমাপ্ত

®অহমিকা মুনতাহাজ নিশি