#মায়া_মহল (১২) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
মায়ার মা রূপী নারীটিকে দেখে পরশ স্তব্দ হয়ে গেলো। এতো তার চেনা শিশু মায়ার মা নয়। এই মায়া যদি আঠারো বছর আগের সেই মায়া হয়,তাহলে এর কাছে কিভাবে এলো? আর যদি এই মায়া সেই মায়া না হয়,তাহলে কে এই মায়া? নাকি এই মেয়ে মায়ার অশরীরী আত্মা?
তফুরাকে পরশ নিজের পরিচয় দিয়ে, একটি রিকশা ডেকে নিলো। তার কাপড়চোপড়ের বড় সাইডব্যাগটি নিজের দুই হাঁটুর ভাঁজের উপর রাখলো।
যেতে যেতে পরশ কৌশল করে তার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,
আপা আপনার মেয়ে মাশাল্লাহ! লাখে একখান। আদব কায়দায়,জ্ঞানে,মেধায় চালু আছে। মায়ার চেহারার আদল মনে হয় তার বাবার মতো হয়েছে? নাহ?
তফুরা না শোনার ভান করে পথঘাট দেখছে। পরশ তাকে শুনিয়ে আবারও বলল,
আপনার সাথে মায়ার কোন মিল খুঁজে পাইলাম না আমি।
এই ব্যাটা গোয়েন্দার মত এত কথা কয় ক্যান? বিরক্তি নিয়ে মনে মনে বলল তফুরা।
পরশ আর বিশেষ ঘাটালো না তফুরাকে।বাড়ি পৌঁছে গেলো। তফুরার পরিচয় মায়া মহলে একজন আশ্রিতার মা। তাই বিশেষ করে কারো সাথে পরিচয় করার আবশ্যক নেই। নেই তারজন্য বাড়তি খাতির। পরশ কুমকুমকে ডেকে বলল,
কুমকুম উনি মায়ার আম্মা। ঢাকা থেকে এসেছে। জানইতো। উনাকে খাবার দিও হাতমুখ ধুয়ে এলে। পরশ তফুরার ব্যাগ ঘরের সিঁড়িতে রেখে অন্যকাজে চলে গেলো। মর্জিনা তফুরাকে পুকুর ঘাট দেখিয়ে দিলো।
তফুরা জিজ্ঞেস করলো, আমার মেয়ে কই?
আছে। শুনলেন না উনি অসুস্থ?
হ্যাঁ, ফোনে শুনছি।
আপনে খাইয়া লন। নিয়া যামু মায়া আপার কাছে।
তফুরা হাতমুখ ধুয়ে উঠে পুকুর পাড়ে দাঁড়ালো। তাজ্জব চোখে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বাড়ির চারপাশ দেখলো। তার মায়া এত রাজকীয় সাজের বাড়িতে থাকে? কি রাজ কপাল নিয়ে এই মেয়ে দুনিয়াতে এসেছে?
ভাত খাইবেন না? আসেন এদিকে।
মর্জিনার ডাকে হুঁশ ফিরে তফুরার। তাকে হেঁশেলের বড় চৌকিতে সুস্বাদু পঞ্চপদ দিয়ে ভাত খেতে দিলো মর্জিনা। খাওয়ার পরে তফুরা নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে আস্ত একটা রেডি করা পানের খিলি মুখে পুরে দিলো। অস্থির হয়ে উঠলো মেয়ের মুখ দর্শনের জন্য। মর্জিনা গিয়ে পরশকে বলল। পরশ ছোট বাবুর থেকে চাবি নিয়ে নিলো। সে তফুরাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল মায়ার বন্ধী থাকা কক্ষের সামনে।
কপাট খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো দুজন। পরশ ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। মায়া মেঝেতে পাতা আধপুরোনো বিছানার উপরে কাত হয়ে পড়ে আছে। পরশ কোঁচা থেকে মায়ার মোবাইলটা তাকে দিয়ে দিলো।এবং জিজ্ঞেস করলো,
দুপুরে ভাত খাইছ?
মায়া মাথা ঝুঁকিয়ে বলল খাবার দিয়েছে ও খেয়েছে সে।
তফুরা এক বিধ্বস্ত,বিপর্যস্ত, বিপন্ন মায়াকে আবিষ্কার করলো। মায়া অবিকল বহুদিনের পুরোনো কোন ভগ্নস্তূপের মতো হয়ে আছে। সে আল্লাগো! ওমাগো! বলে মায়াকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
আমার মেয়ের এই হাল ক্যান? মা কি হইছে তোর? তোরে এরা আটকায়া রাখছে ক্যান? কি বড় অপরাধ করছত তুই মা? তোর না অসুখ হইছে? কি অসুখ?
হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জানতে চাইলো তফুরা।
মায়া কিছুই বলছে না। কেবল ফ্যালফ্যাল চাহনিতে মায়ের দিকে চেয়ে রইলো।
তফুরা মায়ার সারাগালে হাত বুলাতে বুলাতে আরো বলল,
তোর সুরত এমন হইছে ক্যান? এরা তোরে মারছে ক্যান? কথা কসনা ক্যান? ল এখনই চইলা যামু এই জানোয়ারগো বাড়ি থেইকা। তার আগে এগো নামে থানায় মামলা দিমু।মানুষরে আশ্রয় দেওয়ার নাম কইরা জুলুম করে।অত্যাচার করে এরা।
পরশ তফুরাকে থামালো এবার। বলল,
চলে যাবেন ভালো কথা। তার আগে কারণগুলা শুনা দরকার না আপনার? কেন মায়ার এই বন্ধীদশা হলো?
জ্বি ভাই। কন না। হুনতে চাই হগল কিছু।
কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল তফুরা।
আগে বলেন মায়া কি আপনার গর্ভজাত কন্যা?
তফুরা অবাক হলো শুনে। বলল,
হ আমার পেটের সন্তান মায়া। কি হইছে?
মায়াও নির্বাক চাহনি ফেলল পরশের উপরে।
পরশ বলল,
মনে হয় আপনি মিথ্যা বলছেন। শুনেন তাহলে বলে,পরশ মায়া আসার পর কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করলো। এবং তিনদিন আগে এই বাড়ির বড় ছেলে জুবায়ের মারা গেলো,তাও বলল তফুরাকে।
তফুরা কেঁপে উঠলো। বলল,
তো তাদের মরণের লগে আমার মাইয়ার দোষ কি?
জুবায়ের মারা যাওয়ার আগে বলে গেলো তার মরণের জন্য মায়াই দায়ী। এটা শুনেই বেগম সাহেবা তাকে এখানে বন্ধী করলো। নয়তো যদি তার সান্নিধ্যে আবার কেউ মইরা যায়। উনি নিজের হাতে এরে প্রচন্ড মারলো। রুস্তমকে দিয়েও প্রহার করলো। এবার বুঝছেন কাহিনী। খাওয়া দেয় সারাদিনে দুইবেলা। নয়তো সবকিছু ঠিকঠাকই ছিলো।
তফুরা মায়াকে জিজ্ঞেস করলো,
উনার বলা সত্য মা?
হ্যাঁ আম্মা সত্যি। কিন্তু আম্মা তারা কিভাবে মারা গেলো আমি কিছুই জানি না। বেগম সাহেবা বলে, আমি নাকি সবাইকে মারছি।
তফুরা কিছুক্ষন চুপ হয়ে রইলো। প্রগাঢ় নিরবতা তাকে ঘিরে। তার দুচোখের কোন বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। তার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে গ্রীষ্মের মাঠের মতন।
পরশ বলল,
আমার মনে হয় মায়াকে আপনি কোথাও কুড়িয়ে পেয়েছেন? আপনি সত্য স্বীকার না করলে মায়ার আরো বড় বিপদ হবে।এমনকি মায়াকে জীবন্ত মেরে ফেলার প্ল্যান করতেছে বেগম সাহেবা।
তফুরা ও মায়া একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠলো। অশীতিপর বৃদ্ধার মত তারা মা মেয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে শরৎকালেও।
মায়া কাঁপা স্বরে বলল,
চাচা আপনি কিভাবে জানেন এটা? আর আপনি আমাদেরকে বলেই বা দিলেন কেন? আপনি না এই মহলের সবচেয়ে পুরাতন ও বিস্বস্ত একজন?
পরশের মুখে অফুরন্ত বেদনার ছাপ ফুটে উঠলো। শীতল গলায় বলল তফুরার দিকে চেয়ে,
দেখলেন আপা, কইলাম না আপনার মেয়ে বুদ্ধীমতি। তার প্রশ্নগুলা শুনছেন? এইজন্য আমারও অনেক দরদ এই মেয়েটার জন্য। আর আমার ইতিহাস? তা পরেই বলি তোমারে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে গভীর পরিতাপের সুরে বলল পরশ।
দরজার বাইরে কারো পদধ্বনি শোনা গেলো। পরশ ফিসফিসিয়ে মায়া ও তফুরাকে সাবধান বাণী শোনাল,
এতক্ষণ আলাপের কিছুই বুঝতে দিবেন না ছোটবাবুকে। কাকপক্ষীও যেন জানতে না পারে। নয়তো মা মেয়ের একলগে গর্দান যাবে। মনে রাইখেন এখানে আমি ছাড়া সবাই আপনাদের পর।
মায়া ও তফুরা স্তব্ধ হয়ে গেলো। মুখে কুলুপ এঁটে রইলো মা মেয়ে। পরশ কপাট খুলে মেলে দিলো। শাহের ভিতরে ঢুকে সালাম দিলো তফুরাকে। মায়া ও তফুরা বোবা চাহনিতে চেয়ে রইলো শাহেরের দিকে। শাহের পরশকে আদেশ দিলো চলে যেতে। পরশ চলে গেলো ভারাক্রান্ত হৃদয়ে।
শাহের তফুরাকে বলল,
আপনি এখানেই মায়ার সঙ্গে ঘুমাবেন। অসুবিধা হবে কোন?
না বাবাজি অসুবিধা হবে না। মায়ার মুখেতো সব শুনলাম। মায়া নির্দোষ বাবা। আমরা আর থাকুম না। মায়াকে নিয়া আমি কাইল ভোরের চইলা যামু।
নাহ এখন যাবেন না। কোন সমস্যা হবে না আর। যা হওয়ার তা হয়েই গেলো। আপনাদের কাজ আছে। সময় হলে আমিই বলব আপনাদের চলে যেতে।
আইচ্ছা বাবা।
মায়ার কোমরে একটা তাবিজ আছে এটা কিসের? জিজ্ঞেস করলো শাহের তফুরাকে।
তফুরা ও মায়া চমকে উঠলো। তফুরা বলল,
তুমি কিভাবে জানলে বাবা?
আমি কিভাবে জানি সেটা বড় কথা নয়। ইম্পরট্যান্ট হলো কিসের তাবিজ সেটা?
বাবা এই তাবিজ হইলো মায়াকে সকল বালা মুসিবত থেকে রক্ষা করার তাবিজ।
শাহের গোপনে আশ্চর্য হলো শুনে। রুম থেকে যেতে যেতে বিস্ময়ের সাথে ভাবল,
একটা তাবিজের এত ক্ষমতা? কেউ মায়াকে ছুঁতে চাইলেই মরে যাবে? তাহলে কি মরে যাওয়া সবাই মায়াকে স্পর্শ করতে চেয়েছে? যদি তাই হয় আমি স্পর্শ করার পরেও আমার কোন সমস্যা হয়নি কেন? নাকি মায়া বিশেষ কোন ক্ষমতার অধিকারী? কে এই মায়া? মায়া কি সত্যি এই সহজ সাধারণ নারীর মেয়ে?
শত প্রশ্ন শাহেরকে জীর্ণশীর্ণ করে ফেলছে। সে নিজের রুমে গিয়ে ইজি চেয়ারে বসে দুলতে লাগলো। কল্পনার বেড়াজালে আটকে যাচ্ছে মাকড়সার মতন।
কিছুক্ষণ পরে পরশ চুপিচুপি আবারো মায়ার রুমে গেলো। তফুরাকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
আপনি এখন শুধু এটা স্বীকার করেন,
মায়া আপনার ঔরসজাত সন্তান কিনা?
তফুরা হতবিহ্বল চোখে একবার পরশের দিকে একবার মায়ার দিকে চাইলো। তারপর ঘাবড়ানো কন্ঠে বলল,
আপনার ধারণা সত্যি ভাইজান।
মায়ার কলিজা মোচড় খেয়ে উঠলো কলার মোচার মতন। উদভ্রান্তের ন্যায় আম্মা বলে অবিশ্বাস্য চাহনি নিক্ষেপ করলো তফুরার মুখপানে।
পরশ মায়ার পিঠে মমতার ছোঁয়া দিয়ে বলল,
তোমার আম্মার বলা ও আমার ধারণাগুলো যদি সত্যি সত্যি মিলে যায়,
তাহলে এই মায়া মহলের একচ্ছত্র মালিক তুমি। দ্বিতীয় কেউই নয়। আর আমি কোন ভৃত্য নই।
চলবে…
#মায়া_মহল (১৩) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
পরশ মায়ার পিঠে মমতার ছোঁয়া দিয়ে বলল,
তোমার আম্মার বলা ও আমার ধারণাগুলো যদি সত্যি সত্যি মিলে যায়,
তাহলে এই মায়া মহলের একচ্ছত্র মালিক তুমি। দ্বিতীয় কেউই নয়। আর আমি কোন চাকর নই। তুমি যেমন ভাগ্যের শেকলে বন্ধী হয়ে নিজের বাড়িতে আশ্রিতা। ঠিক তেমনি আমিও তোমার মতো নিজের বাড়িতে আশ্রিতা রূপী চাকর।
নিজের বাড়িতে চাকর পরিচয়ে বাস? কি কষ্ট! কি আত্মগ্লানি! ভেবেই ক্রোধে মায়ার দু’কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো উত্তপ্ত সীসার মতো। তিরতির করে কাঁপা সরু অধরযুগল নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
কিহ? কিই..বলছেন চাচা? কি বলছেন এসব? আমি যে কিছুই বুঝতেছি না।সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
তফুরার অক্ষিদ্বয় কোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে বাজ পড়া পাখির মতো স্থির হয়ে আছে। গোটা দুনিয়া তারকাছে ওলট পালট লাগছে। পরশ মায়াকে বলল,
সব জানতে পারবে মা। আমি বহুত আগেই তোমারে চিনবার পারছি। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তোমারে সরাসরি কিছু জানাইতে পারিনাই। তবে চোখে চোখে রাখছি তোমারে। তারপর তফুরাকে বলল পরশ,
আপনি মায়ারে কোথায়,কিভাবে পাইছেন,সবকিছু সত্য সত্য আমারে কন। লুকাইলে আমার নয়,আপনাদের বিপদ হইবো।
তফুরা কন্ঠকে খাদে নামিয়ে মিনমিন স্বরে বলল,
ভাইজান,আপনি হইলেন এই মহলের খেটে খাওয়া সামান্য একজন মানুষ। আপনারে জানায়া কি লাভ? আমগো মুক্তি মিলব? আমগো মা মাইয়ারে সবাইর সামনে নিয়া যান,আমি সব কমু মায়ার ঘটনা।
মায়া তফুরার দু’গাল দু’হাত দিয়ে চেপে ধরলো। কাঁদোকাঁদো গলায় একাধিক প্রশ্ন ছুঁড়ে মারল তীরের ন্যায়,
আম্মা! তারমানে সত্যিই আমি তোমার পেটের মেয়ে নই? আমি কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে তোমার? কই কখনো তো শুনিনি এমন কিছু? টেরওতো পাইনি তোমার আচার আচরণে? স্কুলেওতো অভিভাবকের স্থানে তোমার নাম ছিলো, তোমার ঠিকানাই আমার ঠিকানা লিখা ছিলো। বলো সব মিথ্যা আম্মা! বলো সব মিথ্যা !
ক্যান টের পাইবি? ক্যান বুঝতে পারবি মা? আমি যে তোরে নিজের পেটের মাইয়ার চাইতেও বেশী আদর করি। যত্ন করি। মাথায় থুইনাই উকুনের ডরে। মাটিতে থুইনাই পিঁপড়ার ডরে। রাখছি তোরে মায় কোলে কোলে। বড় করছি আদব কায়দায়। যাগো কাছে এতটা বছর ছিলাম। হেরাও জানে তুই আমার পেটের মাইয়া।
তকদ্বীরের চাকায় ঘুইরা আইজ যে এই নিষ্ঠুর সত্য দিনের আলোর মতন হগলের সামনে আইবো, তাতো স্বপ্নেও কল্পনাই করতে পারিনাইরে মা।
তফুরা ও মায়া গলাগলি করে পাগলের মতো কাঁদছে। উম্মাদের মতো আহাজারি করছে। পরশ কেবল চেয়ে চেয়ে দেখলো তাদের মা মেয়েকে। পৃথিবীর এক অপূর্ব সুন্দর করুণ দৃশ্য তার সামনে ঘটে গেলো। সে না কাউকে বলতে পারছে, না এদের ক্রন্দন রোধ করানোর মিছে চেষ্টা করছে। এমন পবিত্র মধুর আলিঙ্গনের বেদনাবিধুর দৃশ্য সে এর আগে কবে কখন অবলোকন করেছে, তা মনেও করতে পারছে না।
তাদের ক্রন্দনের সুর স্তিমিত হয়ে এলো। পরশ থিতু গলায় তফুরাকে বলল,
ভুলেও এইকাজ করতে যাবেন না। আপনার মাথায় ঘিলু নাই? যেখানে এতবড় বড় কাহিনি ঘইটা গেলো, সেখানে তারা একজনও যদি মায়ার ও আপনার পরিচয় জানতে পারে,চাপাতি দিয়া দুইকোপে দুইজনের দম বন্ধ কইরা দিবো। বাঁচতে হইলে আমার পরামর্শ মতে চলতে হইবো। এবার কন মায়ারে পাওয়ার ঘটনা?
আম্মা, চাচা অনেক ভালো মনের মানুষ। উনার কথা শুনে বুঝতে পারনাই? সব রহস্য খুলতে হবে। তুমি বললে পরে চাচা কি বলে শুনি আমরা। দমে থাকলে হবে না আম্মা। বলো চাচারে সব। আল্লাহ ভরসা।
তফুরা পরনের সুতী কাপড়ের আঁচল দিয়ে আঁখিকোণ মুছে নিলো। বলতে শুরু করলো,
সময়টা ছিলো বারিষকাল। আবার তখন আমি ছিলাম বিধবা। কোন সন্তানাদি ছিল না আমার। দুইটা মাইয়া ছিলো। মইরা গ্যাছে। আমি ছিলাম খুব অভাবি। গরীব। কয়দিন থাকতে গেলাম আমার খালার বাড়ি। সেইটাও চরের মইধ্যেই। খালাগো বাড়ির শ্যাষ মাথায় একটা পুষ্করিণী ছিলো। তার পাড়ের দিকে কয়টা তালগাছ ছিলো। রাইতে সেই গাছ থেইকা তাল পড়ে ধপাস ধপাস কইরা। ভোর না হইতেই সেই বাড়ির অন্য গরিবরা আইসা সেই তাল নিয়া কাড়াকাড়ি করে। তাল গাছ যাদের, তারা থাহে শহরে। এসবের খবর রাহে না তারা। সেই বাড়ির আশপাশে তেমন কোন বাড়ি ছিল না। চাইরপাশ নিরব। ঘন জংলায় ভইরা থাইকতো। তো যেহেতু খালার বাড়ি ছোডকাল থেইকাই যাই। তাই তালের এই বিষয়টা আমি জানি। খালাও আমারে তাল চুরি কইরা আনতে কইতো। তাল আমার ম্যালা প্রিয়। তাই লোভও সামলাইতে পারি না। যাইতাম আর কয়টা তাল নিয়া লুকায়া নিয়া আসতাম।
সেদিন রাইতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হইতেছিলো।শ্যাষ রাইতে মনে হইলো,সকাল হইলেই তাল ভাগে পামু না। ঘোর অমাবশ্যা তহন।সাদারেও তহন কালা দেহা যাইবো।
ভাবলাম আন্ধারকালেই যাই। তাল নিয়া আসি। তাল, গুড় দিয়া রাইন্ধা চাইল ভাজা দিয়া মিলায়া খামুনি। আমার লগে আমার এক খালাতো বইন ছিলো। সে ছোড একটা টচ লাইট হাতে নিয়া আমার লগে গেছিলো। এদিক সেদিক তাল খুঁজতাছি দুই বইন,
আচম্বিতে আমার বইন আমারে খামছি মাইরা ধইরলো। আমার পা থাইমা গেইলো। হে কইলো,
বুবু তাল লাইগব না। বাড়ি ল। ভূত আছে এইহানে।জংলার ভিতরে কে জানি গোঙ্গানি দিতাছে।
আমিও ডরাই গেছি। কান পাইতা রইছি। ওমা! হাঁচাইতো। মহিলা ভূতের গলা দেহি। রাইতের কাল। তাই নিরবে অল্প আওয়াজও আমরা স্পষ্ট হুনলাম। আমরা পা এগিয়ে চইলা আইতে লাগলাম। তহন সে আওয়াজ জোরে হইলো। কইলো,
আল্লার দোহাই লাগে বাঁচান। একটু এদিকে আসেন বোন। আপনাদের পায়ে পড়ি। আমি ভূত না। মানুষ। ভয়ের কিছুই নেই।
আমার নরম দিল সেই করুণ স্বর শুইনা গইলা গ্যালো। দুই বইন তার সামনে গেলাম পা টিপে টিপে। লাইট মাইরলাম। ওহ খোদা! এ দেহি আগাগোড়া আমার মতন এক বেডি। পরনে সুন্দর একখান কাপড়। গাছের সাথে পিছমোড়া করে তার দুইহাত বান্ধা। টিভির বেডিগো মতন কি মিঠা কইরা কথা কয়। বয়সও আমার মতন হইবো। কোলে কি সুন্দর চান্দের লাহান ফুটফুটে এক মাইয়া শিশু।
সে আউলা ঝাউলা গলায় কাঁদতে কাঁদতে কইলো,
বোন আমাকে চিনবেন না। আমাকে আমার স্বশুর বাড়ির লোকজন মেরে ফেলার জন্য এই চরে এনে বেঁধে রেখে গিয়েছে দুই ঘন্টা আগে। আমি একটু পরে মরে যাব। শেয়াল কুকুরে খাবে আমার লা*শ। এটা আমার কলিজার টুকরার মেয়ে। ওর বয়স এখন ছয়মাস। আপনি ফেরেশতা হয়ে এলেন ওর জন্য। ওকে বাঁচান বোন। ওকে নিয়ে যান। আল্লাহ আপনাকে পরকালে শান্তিতে রাখবে।
আমার খালাতো বইন শিশুটারে কোলে তুইলা নিলো। তারকথা হুইনা আমার হাত পায়ের পশম খাড়ায়া গেলো। আল্লাগো কয় কি। কইলাম,
আমি ওরে নিমু। আপনারেও বাঁচামু। লন আমার লগে। আপনার স্বামী কই?
হে ঝরঝর কইরা কাইন্দা দিলো আবারো।কইলো,
আমার স্বামীকেও তারা জীবন্ত মেরে ফেলল গতকাল। আর আপনি আমাকে চাইলেই বাঁচাতে পারবেন না বোন। ওরা সবাই জোর করে ধরে আমার শরীরে মরণ বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে ইনজেকশনের মাধ্যমে। নিদিষ্ট সময় শেষ হলে আমি মারা পড়বো। তাদের বিশ্বাস ছিলো আমি মরে গেলে শেয়াল, কুকুর কামড়ে ছিঁড়ে আমার এই নিষ্পাপ কচি মেয়েটাকেও জংগলে খেয়ে ফেলবে।
আমি আবারও অবাক হইয়া জিগাইলাম,
বুঝলাম বইন। কিন্তুক কারণডা কি আপনাগো সক্কলরে স্বামীর বাড়ির লোকেরা মাইরা ফালানোর?
কইলো,
সম্পত্তির জন্য। ক্ষমতার জন্য। দূর্নীতি করার জন্য। অসৎ উপায়ে বিত্তশালী হওয়ার জন্য। তারা প্রচুর লোভী!
আমি ফের জিগাইলাম,
তাতে আপনাগোরে মাইরবো ক্যান বইন?
কইলো,
কারণ এসব কিছুর একমাত্র বাধা আমি,আমার স্বামী, আমার এই মেয়ে।
বাচ্চার নাম কি বইন?
মায়া ওর নাম। ওর আব্বু রাখছে। খুউব শখ কইরা। বোন ওর গলায় যে তাবিজটা আছে, বড় হইলে কোমরে দিয়া দিয়েন। ওরে সতর্ক করে দিবেন যেন ভুলেও এই তাবিজ না খুলে। সারাজীবন এই তাবিজ যেন সে সাথে রাখে। তাহলে কেউ চাইলেও অসৎভাবে আমার মেয়েটার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
আমি কইলাম,
আইচ্ছা বইন। এই ভুল হইব না। মাথায় রাখলাম। আপনার স্বশুর বাড়ির ঠিকানা কন আমারে। দেহি কিছু করতে পারি কিনা? আর যারা আপনারে এই গহীন জংগলে রাইখা বাইন্ধা গ্যালো,হ্যারা কই এহন?
সে শরীরের যন্ত্রণায় কোঁকাতে কোঁকাতে কইলো দাঁত কিড়মিড় কইরা,
তারা তিনজন আসলো। তখনই চলে গেলো তারা। আর তাদের বাড়ি মানে মায়াদের বাড়ি হলো…
হে মানে এই মায়ার আম্মা আর কিছু কইতে পারেনাই ভাইজান। চটপটাইতে চটপটাইতে মইরা গ্যালো। আমরা হায় হুতাশ করতে করতে বাড়িত গিয়া সবাইরে জানাইলাম। সবাই তারে সেই চরেই আমার খালার বাড়িতে দাফন করে দিলো। এখন তো মনে হয় এটাই সেই বাড়ি মায়াদের।
তফুরার গলা ধরে এলো। মাটির জগ থেকে পানি নিয়ে খেলো গড়গড় আওয়াজে।
মায়ার সমস্ত অনুভূতি অবশ হয়ে আছে। প্রাণহীন মানুষের মতন অচল শরীরে কাত হয়ে আছে বিছানায়।
আর এই জঘন্যতম! ঘৃণিত! অভিশপ্ত কাজটি করলাম আমিই নিজহাতে। আমিও সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী!
দুইহাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল পরশ।
চলবে…