#মাশুল (নবম পর্ব)।
“তুমি আয়ারল্যান্ডে আছো, ডিপার্টমেন্ট থেকেই শুনেছিলাম, মাস্টার্স শুরু করার সময়টাতেই। জেনে ভালোও লেগেছিল। তুমি মেধাবী বিদেশে কাজের স্বীকৃতি খুব সহজে পাবে, এটা ভেবেই তোমার জন্য শুভকামনায়। সত্যি বলতে কি, তোমার সাথে আমার একটা সময় সম্পর্ক ছিল এটা বিয়ের পর আর কখনো মনে হয়নি। আরেকটু গুছিয়ে বললে মনে করার প্রয়োজন হয়নি। এটার পুরো কৃতিত্ব অবশ্য শিহাবের, ওর দেওয়া নিঁখাদ ভালোবাসা আমার অতীতকে আড়াল করে ফেলেছে। আর এর সাথে আরিয়ানার জন্ম ও বেড়ে উঠার ব্যস্ততাটাতো ছিলই। সবকিছু মিলে সময়ই তোমাকে পুরোপুরি ভুলিয়ে দেয়।” শিলার দেওয়া স্মিত হাসিটাতে সহজ হওয়ার চেষ্টা করলাম, কষ্টবোধ নিয়েই!
“এই ফেসবুকটা আসাতেই জীবনে কত স্মৃতি আবার ফিরে আসতে লাগলো। আমাদের এই ফেসবুক গ্রুপটাতেই তোমাকে অনেক বছর পর দেখলাম। তোমার প্রোফাইলে একটা পিকচারই পেয়েছিলাম। সম্ভবত ছবিটা আয়ারল্যান্ডে তোলা, খুব সুন্দর একটা ঝরনার সামনে! মিথ্যে বলছি না, অনেকদিন পর তোমাকে দেখে খুব ভালো লেগেছিল। তবে ঐ যে শুধুই অনুভূতি শূন্য এক ভালোলাগা, এর বাইরে কিছু না।
কি সব বড় বড় প্রোফাইল এখন তোমার? মাশাল্লাহ্! প্রফেসরও হয়ে গেছো এই অল্প বয়সে, তাই না? তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক গর্ব হয়।” শিলা বেশ মজা করেই আমাকে প্রশংসায় ভাসালো।
আমি প্রফেসর না সদ্যই এসোসিয়েট প্রফেসর হয়েছি, শুধরে দিলাম। গত দশ বছর ধরে ওর কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসাটা লালন করাতেই যে এ সাফল্য, এ কথাটা বলার আর সাহস পেলাম না। শিলাকে না পাওয়ার কাছে আপাত পাওয়া আমার সাফল্যগুলো যে কিছুই না, একবার বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। চুপ করে রইলাম।
“বিয়ে শাদী করোনি কেন? শুধু পড়াশোনা আর ডিগ্রী নিয়ে থাকলেই হবে?” শিলার অভিভাবকদের মতো খানিকটা ধমকের স্বরে জিজ্ঞেসটায় সম্বিৎ ফিরলো।
এখন শিলাকেই বিয়ে করতে চাই, তবে আজ ওর বলা এ লম্বা গল্পটায় সেই ইচ্ছার মৃত্যুটা চাপা পড়ে গেছে, সম্ভবত সারাজীবনের জন্যই।
“জানো নেহাল, শিহাবের মৃত্যুর পর আজই প্রথম কারো সাথে মন খুলে বুকের মধ্যে জমে থাকা কষ্টের কথাগুলো বলতে পারলাম। অনেকদিন ধরেই ভাবছি কথাগুলো কাউকে বলা দরকার। আজ তোমাকে প্রথম দেখায় মনে হল আমার এক বিশ্বস্ত বন্ধুকে পেয়েছি। যার সাথে কথাগুলো শেয়ার করা যায়। অনেক ধন্যবাদ মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনেছ বলে। নিজেকে খুব হালকা বলে মনে হচ্ছে।” শিলা এখন বেশ ফর্মাল। সম্ভবত গল্পটার ইতি টানতে চায় বলেই।
আমার মুখেও কোনো কথা নেই! বুকের মধ্যে ঝরে যাওয়া রক্তক্ষরন অনুভব করলাম তীব্রভাবে। আমার সম্পর্কে শিলাকে নতুন করে বলার আর কিছুই নেই। ল্যাব, ক্লাস আর পাবলিকেশন, এসব নিয়েই যে আমার চলমান যান্ত্রিক জীবন, শিলা বুঝে নিল! আমার প্রতি ওর দুঃখবোধ স্পষ্ট। শিলারও সম্ভবত আমার সম্পর্কে আর খুব বেশি জানার আগ্রহ নেই।
এরপর টিএসসির এই বসার জায়গাটা শেষবারের মতো তাকিয়ে, নীরবে হাটতে লাগলাম বন্ধুদের সাথে মূল অনুষ্ঠানে যোগ দিব বলে। অল্পক্ষন পরেই শিলা চলে যায়, বিকালে ওর মেয়ের গানের স্কুল আছে বলে। আমার সাথে ওর বিদায় নেওয়াটাও ছিল বেশ স্বাভাবিক, অন্যদের সাথে একই রকমভাবে।
শিলার সাথে আজকের কথোপকথন, আমার নতুন করে দেখা স্বপ্নটাকে ভেঙ্গে চুড়মার করে দিল। আমার ধারণা ছিল শিলা আমাকে ক্ষমা করে দিবে। আমি ওর মেয়ের দ্বায়িত্ব নিতেও প্রস্তুত। কিন্তু শিলার ভাবনায় যে আমি একেবারেই নেই, এই ধাক্কাটা আর নিতে পারলাম না। কথোপকথনের ব্যস্ততায় সারাদিন এক কাপ কফি ছাড়া এক দানাও পেটে পরেনি। আমি প্রচন্ড বিধ্বস্ত, শরীর খুব খারাপ লাগছিল।
বন্ধুদের প্রত্যেকেই এরই মাঝে বুঝে যায়, আমার গোপন ইচ্ছা আজ প্রত্যাখাত হয়েছে। অনেকের চোখেই সমবেদনা, কারো কারো চোখে বিদ্রূপ! সবকিছু মিলিয়েই প্রচন্ড অপমানবোধে এই আমি অস্বস্তিতে!
দশ বছর আগে করা একটা ভুলের মাশুল এতটা নিষ্ঠুর ভাবে দিয়ে যেতে হবে, চিন্তা করতেই বুকটা কেঁপে উঠলো। শূন্য হয়ে আসতে থাকলো পৃথিবীটা। এরপরই বিড়বিড় করে “শিলা”, “শিলা” বলতে বলতে মূর্ছা গেলাম, অনুষ্ঠানের মাঝে ভরা মজলিশে!
জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে আবিষ্কার করি ক্যাফেটেরিয়ার টিচার্স লাউঞ্জে শোয়া অবস্থায়! ডাক্তার সম্ভবত প্রেশার মাপাটা মাত্রই শেষ করেছে। চোখ মেলতেই দেখি চারপাশে বন্ধুদের উৎকণ্ঠা আর উৎসুক দৃষ্টি। শরীরে প্রচন্ড দুর্বলতা অনুভব করলাম, আর সেটা মানসিক ধকল আর অভুক্ত থাকার কারণেই।
উপস্থিত সবাই সাধ্যমতো শুশ্রূষা করে যাচ্ছে। একটু সুস্হ বোধ করতেই, আশফাকই ব্যাচেলর ডর্মিটরিতে আমার থাকার রুমটায় নিয়ে এলো। আমার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত, তিনদিন পরই আয়ারল্যান্ডে রিটার্ন করবো। কথাটা শুনেই আশফাক একেবারে চুপ করে রইলো! ও খুব ভাল ভাবেই আমার সদ্য স্বপ্নভঙ্গের বেদনাটাকে উপলব্ধি করলো। সম্ভবত আমার শরীরের কথা চিন্তা করে তাৎক্ষণিক কোন মন্তব্য করলো না।
আয়ারল্যান্ডে চলে যাওয়ার আগে আমার প্ল্যানটা এখন অনেকটা এরকম। পরদিন সকালে এয়ারলাইন্সের সাথে রিটার্ন টিকেট কনফার্ম করে চাঁদপুর চলে যাব। বাবা মায়ের কবর জিয়ারত আর কাছের আত্মীয়স্বজনদের সাথে সম্ভবত শেষবারের মতো দেখা করবো। এক রাত চাঁদপুর থেকে ক্যাম্পাসে এসে লিমেরিকে ফিরে যাওয়ার শেষ প্রস্ততি নিব।
আশফাককে আগে ভাগেই পরিকল্পনাটা জানিয়ে রাখলাম। সত্যি বলতে কি, এ ট্যুরটাতে আশফাকই আমার হোস্ট, সবকিছুর দেখভাল করেছে নিজে থেকে। সারাদিনে যাওয়া ধকলটাতে বেশ টায়ার্ড ছিলাম, শুয়ে পড়লাম একটু আগে ভাগে। সকালে ঘুম থেকে উঠেও অনুভব করলাম সদ্য আশাহত হওয়ার ব্যথাটাকে!
চাঁদপুর গাড়িতে করেই যেতে পারতাম, যাইনি। আজন্ম স্মৃতিজড়িত নৌযানে করেই গেলাম, সদরঘাট থেকে। নদী পথের ভ্রমণে বিষন্নতা কিছুটা কমতে পারে, এ চিন্তা থেকে। ভীষণ আপ্লুত হলাম পরিচিত বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার সৌন্দর্য দেখে।
একেকটা নদী পারি দিচ্ছি, আর জীবনের একেকটা সময়ের চিন্তা আসছে। কেন জানি শিলার সাথে কাটানো ভার্সিটির সময়টাতে এসেই সব চিন্তাগুলো থামছে। বুঝলাম, আমার জীবনের সত্যিকারের সুখের সময় আসলে ওটুকুই!
চাঁদপুরের বাড়িতে এসেই দেখি এলাহি কান্ড! পুরো এলাকার লোকজন ভেঙ্গে পড়েছে, আমাকে এক নজর দেখার জন্য। আমার দেশে আসার খবরে, ডজন খানেকের মতো বিয়ের প্রস্তাবও এসেছে, পাত্রী পক্ষের আগ্রহে!
বড় ভাবী সন্ধ্যায় তার পছন্দের এক পাত্রী দেখাবেন বলে জানিয়েও গেলেন। হঠাৎ শুরু হওয়া উটকো এ অত্যাচারে বেশ বিরক্ত হলাম। বড় ভাইকে একান্তে ডেকে এসব বন্ধ করার অনুরোধ করলাম। বিয়ে যে আর এ জীবনে করছি না, সে সিদ্ধান্তটা ততোক্ষণে আমার পাকাপাকিই!
পরদিন ঢাকায় ফেরার সময়টা ছিল সত্যিই হৃদয় বিদারক। ভাইবোনেরা কেউই আমাকে যেতে দিবে না। অনেক অনুনয় করলো আরো কিছুদিন থেকে যেতে, আন্তরিকতার সাথেই। ক্ষমাও চাইলো, বিয়ের পাত্রী দেখানোর মতো বিষয় নিয়ে বিরক্ত করায়!
সদ্য ঘটে যাওয়া, শিলা বিষয়ক কষ্টের কথা পরিবারের কাউকে বলিনি। রক্তের বন্ধন, ভাইবোনেরা ঠিকই ধারনা করে নিল, আমার জীবনে খুব সম্প্রতিই বড় কিছু একটা ঘটে গেছে! অবশ্য কারণ জানার আগ্রহ দেখানোর সাহস কেউই করেনি।
সকালে আশফাক একবার ফোন দিয়ে ঢাকা ফেরার সম্ভাব্য সময়টা জানতে চাইলো। আমি তখন বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। এই কয় দিনেই আশফাকের প্রতি আমার একটা সীমাহীন কৃতজ্ঞতাবোধ তৈরী হয়েছে, ওর কেয়ারিং ক্যারেক্টারটার জন্য।
চাঁদপুর থেকে ফেরার পথটায় শুধুই পরিবারের কথা ভাবলাম। আমার সহজ সরল মায়ের নিখাদ ভালোবাসা, শিক্ষক বাবার কড়া শাসন! ভাইবোনদের খুনসুটি। সহপাঠী বন্ধুদের সাথে নির্মল আনন্দ! কতো শত সেই সব স্মৃতি।
অল্পসময়ের জন্য চাঁদপুর এসে অনেক জনকে নতুন করে আবারো দেখলাম। কত ভুলো স্মৃতি আবারো মনে পড়লো। বেশ ভালো অনুভূতি নিয়ে ফিরছি। অনেকদিন পর আপনজনের সাথে সময় কাটিয়ে আসাতে বিষন্ন ভাবটা অনেকটাই কমে এলো। জলদিই লিমেরিকে নিজস্ব জগতে ফেরত যাব, মাথায় তখন এ ভাবনাটাই ঘুরছে!
জাবি ক্যাম্পাসে আমার জন্য আজ এত বড় একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল, চিন্তাও করতে পারিনি। আমার থাকার রুমটাতে ঢুকতেই অবাক হলাম, সবকিছু আজ খুব সুন্দর করে গুছানো। আমাকে দেখেই শিলার এক ভুবনমোহনী হাসি, ছুঁয়ে গেল! আশফাক ওর বউ সহ বসে আছে সোফায়, কিছুই জানেনা এমন একটা ভাব করে!
শিলার পাশেই বসা ফুটফুটে সুন্দর একটা মেয়ে বাচ্চা। বুঝতে সমস্যা হলো না, এটাই আরিয়ানা! মেয়েটা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিঃশব্দে আরিয়ানার পাশে গিয়ে বসলাম। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠলাম, সত্যই আমরা সবাই যে দূর্ভাগা!
মুহূর্তেই পুরো পরিবেশ ভারি হয়ে উঠলো। আরিয়ানাও কাঁদলো, সম্ভবত ভয় পেয়ে। জীবনের জটিল মারপ্যাচে মেয়েটা যে অল্প বয়সেই পিতৃহারা, বিষয়টি ফিল করলাম। দুঃখী এই মেয়েটার জন্য প্রানভরে দোয়াও করলাম।
“তুমি কাল আয়ারল্যান্ড যাচ্ছো না! আশফাক এয়ারলাইন্সকে এখুনি জানিয়ে দিবে।” শিলার কথাটা অনেক জোরালো, রেন স্পষ্ট অধিকার নিয়ে বলা।
“তোমার প্ল্যান মতো আসা পুরো একমাসই আমাদের সাথে দেশে থাকবে। আমরা সবাই তোমার সাথে অনেক আনন্দ করবো।” শিলার কথাতে এবার সত্যই অবাক হলাম।
“নীলু, আমারও কিছুদিন ভালো সময় কাটানোর লোভ হচ্ছে। শিহাবের মৃত্যুর পর থেকে মন খারাপ আর বিষন্নতা নিয়ে আছি। কবে যে শেষ একটা দিন শুধুই আনন্দে কেটেছে, ঠিক মনে করতে পারি না। অন্ততপক্ষে বন্ধু হিসেবে চলো সবাই মিলে কয়টা দিন ভালো সময় কাটাই!” শিলার খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলা কথাতে আমি দ্বিধায়।
সাথে সাথেই আশফাকের দিকে তাকালাম। ওর চোখে মুখে দুষ্টুমির হাসি দেখে বুঝলাম সব কিছু তাহলে ওর প্ল্যানমাফিকই হচ্ছে। এই একদিনেই আশফাক সবাইকে ম্যানেজ করে ফেলেছে! আমার প্রতি বন্ধুর ভালোবাসা দেখে অবাক হলাম।
আমার উত্তরের অপেক্ষায় তখন সবাই চুপচাপ। পুরো রুমটায় পিনপন নীরবতা।
শিলার দিকে ফিরে তাকাতেই ওর কাতর চাহনী আমাকে আপ্লুত করলো। আরিয়ানাও কিছু না বুঝে আমার হাত ধরে বসে আছে, হয়তো আমি ওদের আপন কেউ এটা ভেবেই! আশফাক হাতজোড় করে আমার দিকে তাকিয়ে। ভাবীর চোখও ছলছল, সম্ভবত কোন সিনেমা বা সিরিয়ালের কাহিনীর সাথে পুরো ঘটনার মিল পাচ্ছে বলে। উপস্হিত সবার প্রত্যাশাগুলোকে খুব জেনুইন বলে মনে হল। খানিকক্ষণ চিন্তা করে নিজের সাথে পরাজিত হয়েই বলা
“আচ্ছা ঠিক আছে, এখন তাহলে লিমেরিকে যাচ্ছি না!”
(চলবে)