#মিঠুর_বাবা (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
পাখি বিছানায় ঘুমন্ত মিঠুর দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে। অতঃপর হাতে থাকা তার এবং পলাশের বিয়ের ছবিটা দেখে। হ্যাঁ পলাশ। যার সঙ্গে ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলো পাখি। তার সেই ঘর সুখেরই ছিলো। তবে হঠাৎ পলাশের মাঝে পরিবর্তন দেখতে পায় সে। তার মনে হচ্ছিলো পলাশ অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। পরবর্তীতে পাখি সেই মেয়ের খোঁজও পায়। যার সঙ্গে পলাশের সম্পর্ক ছিলো। পাখি ভেবেছিলো ঐ মেয়েটা তার গল্পে ভিলেন। তার স্বামীর বিবাহিত জীবনে পরকীয়ার বিঁষ নিয়ে এসেছে। কিন্তু তার ধারণা সত্যি ছিলো না। বরং সেই মেয়েটার জীবনে সে ছিলো আসল অপরাধী। কারণ সেই মেয়েটাই পলাশের প্রথম স্ত্রী ছিলো। তাকে গ্রামে রেখে শহরে এসে পলাশ পাখির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। যদিও পাখি জানতো না পলাশ বিবাহিত। তবুও দোষটা তারই। সে না চাইতেও একজন মেয়ের ঘর ভাঙতে চলেছিলো। এসব যখন পাখির সামনে আসে তখন তার কোলে ছয় মাসের মিঠু। তাকে বুকে নিয়েই মিঠু পলাশের ঘর ছাড়ে। পাখি কারো জীবনে ভিলেন হয়ে থাকতে চাইনি। তাই চলে এসেছে। পলাশ তাকে রাখতে চেয়েছিলো। কিন্তু থাকেনি পাখি। সে সতীনের ঘর করতে চায়নি। তবে সেদিন ঘর ছাড়ার আগে পাখি পলাশকে বলেছিলো,“তোমার এই অপরাধের শা স্তি তুমি ঠিক একদিন পাবে। অবশ্যই পাবে।”
এটা বলে পাখি মিঠুকে নিয়ে ঘর ছেড়েছে। এসে উঠেছিলো বাবা, মায়ের কাছে৷ এক বছরের মাথায় তাদের ঘরে সেও বোঝা হয়ে গেল। তার বিয়ের চেষ্টা শুরু করে তারা। তবে কোন পাত্রই মিঠুকে মেনে নিতে চায় না। নিজের সন্তানকে বুক ছাড়া করতে চায়নি বলে পাখি বাবা, মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যায়। সে তার যোগ্যতা অনুযায়ী ছোট এক চাকরি নিয়ে নতুন শহরে সন্তানকে নিয়ে নতুন এক জীবন শুরু করে।
পলাশের প্রতি ঘৃণায় তার সব স্মৃতি জীবন থেকে মুছে ফেললেও বিয়ের এই ছবিটি এতদিন কাছে রেখেছিলো পাখি। যেটা মিঠু দেখে নিয়েছে। তাই এই ব্যস্ত শহরে ভুল করে মিঠুর সঙ্গে তার বাবার দেখা হয়ে গিয়েছে। সবকিছুর জন্য পাখি এই ছবিটিকেই দ্বায়ী করে। অতঃপর এই ছবিটিকে আর স্মৃতি হিসাবে না রাখার সিদ্ধান্ত নেয় পাখি। সে একটি লাইটার দিয়ে ছবিটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। একটু একটু করে ছবিটি পুড়ে ছাই হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে পাখিরও মনে হয়, তার হৃদয়টা ধীরে ধীরে মুক্তো হচ্ছে৷ এত বছর ধরে একজন প্রতারকের স্মৃতি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলো সে। যেটা তার ভুল ছিলো। চরম ভুল। সেই ভুল আজ শুধরে নিলো।
___
সেই ঘটনার এক মাস কেটে যায়। পাখি ধীরে ধীরে মিঠুর স্মৃতি থেকে পলাশের মুখটা মুছে ফেলার চেষ্টা করে। তবে এসব করতে গিয়ে সে বুঝতে পারে মিঠু তাকে মা, বাবা দুটোই ভাবতে পারছে না। মিঠুর কাছে সে শুধুমাত্র একজন মা। যেখানে দাঁড়িয়ে মিঠুর হৃদয়ে বাবা নামক মানুষটির অভাব রয়েছে। তার স্কুলের বন্ধুরা যখন বাবাদের গল্প বলে, তাদের বাবাদের হাত ধরে তারা যখন স্কুলে আসে, ঘুরতে যাওয়ার বর্ননা করে তখন মিঠুর কষ্ট হয়। মিঠুর হৃদয়টা হাহাকার করে। যেজন্য সে বাবার অভাব বোধ করে। এই বিষয়টি বুঝতে পেরে পাখি একটি সিদ্ধান্ত নেয়। সে তার কলিগ মায়াকে ফোন দিয়ে বলে,“আপনি একজন পাত্রের কথা বলছিলেন না? আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
মায়া এই কথা শুনে খুশি হয়। পরবর্তী দিনে পাখির সঙ্গে শাওন নামে এক ভদ্রলোকের দেখা করেন। শাওনের প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে। সে এখন দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাচ্ছে। পাখি তার সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা সেড়ে নেয়। অতঃপর বলে,“আমাকে বিয়ে করতে হলে আমার সঙ্গে আমার বাচ্চাকেও মেনে নিতে হবে।”
“আমি রাজি।”
শাওনের মুখে এই কথা শুনে পাখি অদ্ভুত নজরে তার দিকে তাকায়। তবে কিছু বলে না। শুধু জানায় কয়েকদিন পর সে সিদ্ধান্ত জানাবে। এই ক’দিন শাওনও তাকে চিনে নিক। দেখুক, সে তাকে গ্রহণ করতে পারে কি-না। শাওন রাজি হয়। অতঃপর পাখি শাওনকে নিয়ে তার বাড়ি আসে। সে মিঠুর সঙ্গে শাওনের পরিচয় করিয়ে দেয়। মিঠু যখন বলে,“মা এই আংকেলটা কে?”
“তুমি তোমার বাবাকে চাও না?
এটা তোমার বাবা। তোমার সেই বাবা যে তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করবে।”
পাখির কথার ভাবার্থ প্রথমে মিঠু বুঝতে পারে না। তবে পাখি শান্তভাবে তাকে বোঝায়। তার জন্য সে দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মিঠুর বাবাকে তার জীবনে ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছে। মিঠু যখন জানতে পারে, এ তার বাবা হবে এবং তার বন্ধুদের বাবাদের মতো তার সব দায়িত্ব নিবে তখন সে ভীষণ খুশি হয়। পাখি শাওনকে মিঠুর সঙ্গে আজকে এখানে থাকতে বলে জানায়,“আমি এখন অফিসে যাচ্ছি। সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরবো। ততক্ষণ আপনারা বাবা, ছেলে গল্প করে নিন।”
“মানে আপনি থাকবেন না?”
শাওনের এই কথায় পাখি হেসে জবাব দেয়,“থাকবো তো। আপাতত থাকছি না।”
শাওন এই কথা শুনে নিজেও চলে যেতে চাচ্ছিলো তবে মিঠু তার হাতটা ধরায় সে থেমে যায়। পাখি মিঠুর সঙ্গে তাকে আজকের দিনটা কাটাতে বলে। এটা তার অনুরোধ। শাওন তাই থেকে যায়। পাখি মুচকি হাসি দিয়ে তাদের বিদায় জানিয়ে বের হয়।
রাস্তায় বেরিয়ে পাখি অফিসের উদ্দেশ্য না বের হয়ে বরং পাশের এক প্রতিবেশীর বাসায় যায়। সেখানে বসে সে নিজের বাড়ির দিকে নজর রাখে। শাওন পাখিকে অনেক আগেই দেখেছে এবং পছন্দ করেছে। মায়ার সঙ্গে শাওনের পরিচয় ছিলো তার মাধ্যমে সে এসব কথা জানিয়েছে। তবে পাখি এসব প্রস্তাবে আগাতে চায়নি। সে যে নিজের সন্তানের জন্য এগিয়ে যাচ্ছে না জেনে শাওন মায়ার মাধ্যমেই তাকে জানায় সে সন্তানসহই তাকে গ্রহণ করবে৷ তার নিজের সন্তানের মতো মিঠুকে লালন পালন করবে। অন্যদিকে এই মাস খানেকের মাঝে পাখি মিঠুর কাছে তার বাবাকে মৃ ত প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। যেহেতু সেদিনের এক পলকের দেখার পর মিঠু আর পলাশকে দেখেনি, তাছাড়া ছোট থেকেই জেনে আসছে সে মা রা গেছে। তাই মেনে নেয়। তবে মনের মধ্যে বাবা না থাকার আক্ষেপ সেই ছোট থেকে ছিলো। এসবের মাঝে প্রতিবেশীরা মাঝে সাজে পাখির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতো। সেখান থেকেই মিঠুর মাথায় আগে থেকেই ছিলো মা আবার বিয়ে করলে সে বাবা পাবে। পলাশকে দেখার আগেই পাখি মিঠুর কাছে এসব কথা শুনেছে। তার আক্ষেপ দেখেছে। তাই আজ পাখি কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিলো। তার সিদ্ধান্তের ফলাফল দেখার জন্যই সে প্রতিবেশীর বাসায় বসে রইলো।
দুই ঘন্টার মাঝে শাওন তার বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যায়। পাখি এটা দেখে সে দ্রুত বাড়িতে আসে। মিঠু পাখিকে দেখে জড়িয়ে ধরে। সে কান্না করে দেয়। কাঁদো গলায় বলে,“মা আমার বাবা চাই না। ঐ লোকটাকে আমার বাবা বানাইয়ো না। ওনি আমাকে পছন্দ করে না৷ মোটেই পছন্দ করে না।”
অতঃপর মিঠু কাঁদো কাঁদো গলায় পুরো ঘটনা বলে। শাওনকে সে বাবা ভেবেই অনেক কথা বলছিলো। তার বন্ধুদের বাবারা যা করে, সে সেরকম করবে কি-না। এমন অনেক কথা। এসব কথায় শাওন বিরক্ত হয়। মিঠু কথা বলার ফাঁকে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,“বন্ধুরা বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরলে অনেক ভালো একটা গন্ধ পাওয়া যায়। তোমাকে জড়িয়ে ধরে আমি সেটা পাই কি-না দেখি।”
এসবে বিরক্ত হয়ে শাওন মিঠুকে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। সে বিরক্তি নিয়ে বের হয়। কারণ তার উদ্দেশ্য ছিলো পাখিকে বিয়ে করা। তার সন্তানের দায়িত্ব তো তার কথা ভেবে নিবে বলেছে৷ তাই বলে তাকে সন্তানের মতো দেখতে হবে নাকি। এসবে প্রচন্ড বিরক্ত হয়েই শাওন চলে যায়। মিঠুকে শাওন এত জোরে ধমক দেয় যে মিঠু সেই কথা এখন পাখিকে বলতে গিয়ে শিউরে উঠে। এসব শুনে পাখি আট বছরের অবুঝ বাচ্চাটিকে ধীরে ধীরে বোঝায়। এই জগতে কেউ পরকে আপন করে না। পাখির কাছে এমন অনেক প্রস্তাব এসেছে যে তার সন্তানকেও সে নিজের মতো ভাববে। পালণ করবে। তবুও পাখি কখনো দ্বিতীয় বিয়েতে মত দেয়নি। কারণ সে জানে হয়তো বিয়ের পর কয়েক মাস তার স্বামী মিঠুকে দেখবে, তারপর নিজের সন্তানের আকাঙ্ক্ষা জাগবে। যেই সন্তানের আগমনের সঙ্গে দুই সন্তানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যাবে। মুখে যতই বলুক, কেউ চাইলেই অন্যের সন্তানকে নিজের ভাবতে পারে না। তাই এখানে মিঠুকে এটা মেনে নিতে হবে তার বাবা নেই। তার বাবা মা রা গেছে। হ্যাঁ পাখির জন্য তো পলাশ মৃতই। এটা মিঠুকেও মেনে নিতে হবে। সেই সঙ্গে এবার যদি মিঠু বাবা চায় তবে তাকে মাকেও হারাতে হবে। মা হয়তো স্বামী পেয়ে তার সঙ্গে চলে যাবে। চাইলেও সে হয়তো মিঠুকে তখন দেখতে পারবে না। কিন্তু পাখি এটা চায় না। তাই তো সে মিঠুর সব স্বপ্ন পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। শুধুমাত্র মিঠুর জন্য। যদিও মিঠু সব বুঝতে পারে না। তবে কিছুটা বুঝে। সে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,“মা আমার আর কারো গায়ের গন্ধ লাগবে না৷ তোমার গায়ের মিষ্টি এই মা মা গন্ধটাই অনেক সুন্দর। এটাই আমার খুব প্রিয়।”
এই কথা শুনে পাখি মুচকি হাসে। তার চোখের কোনে দু’ফোঁটা অশ্রু এসে জমা হয়। মিঠু আবার বলে,“মা আমি বাবা চাইলে সে যদি এই আংকেলের মতো হয় তবে আমার আর বাবা লাগবে না। তুমিই আমার বাবা হয়ে থাকো। তোমার গায়ে থাকা মা মা গন্ধটার মাঝে আমি বাবার গন্ধটা খুঁজে নিবো।”
এটা শুনে পাখি মিঠুর কপালে চুমু দেয়। সন্তানকে বুকে আগলে নিয়ে বলে,“আমিও এটাই চাই।”
★
পাখি মায়াকে ফোনে জানিয়ে দেয় সে শাওনকে বিয়ে করবে না৷ তার পছন্দ হয়নি৷ সবচেয়ে বড় কথা সে আর দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চায় না। বিয়ে করতে হবে এমন তো কোন নিয়ম নেই। তার বেঁচে থাকার জন্য বিয়েটা জরুরি নয়। মিঠু জরুরি। যেটা তার কাছে আছে। মিঠু আর সে তাদের ছোট দুনিয়া খুব সুন্দরভাবে কেটে যাবে। এসব বলে পাখি ফোন রাখে। অতঃপর রাতে ঘুমানোর সময় মিঠু পাখির গলা জড়িয়ে ধরে বলে,“তুমিই আমার সব মা।”
এটা শুনে পাখি হাসে। এবং মনেমনে বলে,“হ্যাঁ আমিই সব। তোমার বাবা হওয়ার জন্য যেসব করা লাগবে সেইসব আমি করবো। আমিই হবো তোমার বাবা এবং মা। তোমার হৃদয়ের সব আক্ষেপ আমি ভুলিয়ে দিবো।”
হয়তো মিঠু তার মায়ের মনের কথা বুঝতে কিংবা শাওনের ব্যবহারে সে বুঝেছে এখন তার জীবনে যে বাবা আসবে সে তাকে ভালোবাসবে না। তার প্রতি বিরক্ত হবে। তাকে ধমক দিবে। তাই মিঠু বলে উঠে,“তুমিই আমার বাবা। তুমিই আমার মা।”
(সমাপ্ত)