মিলি পর্ব-০২

0
116

#মিলি (২)

অনিন্দ্যর আসবার সময় হয়ে গেলে মিলি ক্লাস গোটায়। সময়ানুযায়ী ক্লাস শেষ হয়েছে আরো ঘন্টা আধেক আগে। মিলি বসে বুড়ো-বুড়িদের গল্প শুনছিলো। নর্থ ক্যারোলিনা থেকে সত্তর বছর বয়সী এক বাংলাদেশী বৃদ্ধ আবৃত্তি শেখেন। ভদ্রলোক ঢাকা কলেজ থেকে পাশ করে বিদেশ গিয়ে ছিলেন। ওখানে এক বিদেশীনির প্রেমে পরে তার সাথে ঘর বাঁধা। তিরিশ বছরের সংসারে স্ত্রীর একটি কথাও বুঝতে পারেননি তিনি। স্ত্রী বাংলা শিখেছেন তার কাছে। কিন্তু, তিনি স্প্যানিশ শিখতে পারেননি। প্রথমদিন শুনে মিলি বললো,

‘তাহলে আপনি ওনাকে ভালোবাসতে পারেননি।’

আব্বাস নামের সেই ভদ্রলোক হো হো করে হাসলেন। বাঙালীরা যেমন করে ভালোবাসে, বিদেশে ভালোবাসার সঙ্গাটা অন্যরকম। এখানে, নারীরা স্বাধীন। মতের মিল না হলেই তারা আলাদা থাকা শুরু করে। আব্বাস সাহেব শ্যালিকে সত্যিই ভালোবেসেছেন। তাই, বিচ্ছেদ তাদের ঘটেনি। তবে, কোথায় যেন সেই হারিয়ে যাওয়া বাংলার চিরন্তন নারীরূপ তার হৃদয়ে গেঁথে আছে। এ বয়সে ঠিক আক্ষেপ করেন না। তবে, নীরবে সেই ভালোবাসা খুঁজে নেন, কবিতায়। মিলি তাই কখনো রাগ করে না। জীবন বড্ড বিচিত্র। আরো বিচিত্র এর রস ও আস্বাদ গ্রহণের চাহিদা।
অনিন্দ্য এসে পরলে মিলি গরম গরম আলুর পাকোড়া ভাজে। বাচ্চাদের সাথে সময় কাটায় অনিন্দ্য। টুনুকে সে কোচিং থেকে ফেরার পথে তুলে এনেছে। তনুর প্লেট থেকে টুনু চিজি মিটবল তুলে নিলে দু’ বোনের মাঝে ধুমধাম লেগে যায়৷ মিলি চিৎকার করে। ওরা তার কন্ঠস্বরের সাথে পাল্লা দিয়ে ঝগড়া করছে। রেগে মেগে দুটোর দিকে তেড়ে গেলে অনিন্দ্য তাকে শান্ত করে।

‘কি নিয়ে চাপে আছো, বলো দেখি।’
‘কিছু না। সামান্য বিষয় নিয়ে এরা এত সিনক্রিয়েট করে।’
‘ছোট মানুষ। একজন আরেকজনের সাথে সারাক্ষণ আছে।’
‘তুমি বোঝনি। দেখো, একটু শেয়ার করলে কি হয়। তনু না হয় ছোট। টুনু তো বড়। ও বুঝবে না?’
‘না। টুনু আর এমন কি বা বড়। তনু না থাকলে ওকে কি তুমি বড় বলতে?’

মিলি চুপ হয়ে যায়। সত্যি টুনুটাও ছোট। তনু হবার পর ওকে বড় বোন হয়ে যেতে হয়েছে৷ বয়সের দিক থেকে বিচার করলে টুনুর এখনো মিলি আর অনিন্দ্যর কোলে চড়ে ঘুরবার কথা। মিলি টুনুকে কাছে টেনে নেয়। তার এই মেয়েটি অভিমানী। মায়ের রাগ করার কারন বেশ বুঝতে পেরেছে।

‘আমার খাবার থেকেই ওকে সবসময় কেনো খেতে হবে, আম্মু। আমি জানি ও আমার আসার আগে নাস্তা খেয়েছে৷ তখন কি আমি ছিলাম বলো?’

মিলি মেয়ের চুলের বিনুনি খুলে দেয়। ভাদ্রের গরমে ঘণ কালো চুল ভেতর থেকে ঘেমে ওঠে। টুনু মায়ের আদরে আরাম পেয়ে বুকে মুখ গোঁজে। তনুই বা সইবে কেনো বড় বোনের এই আদর খাওয়া। সে দৌড়ে এসে মায়ের কোলে ঝাঁপায়। অনিন্দ্য ছো মেরে তনুকে কাঁধে তুলে গাইতে শুরু করে।

‘সোমবারে পাখিটির ডিম ছিল দুটি
মঙ্গলবারে দেখি গেছে তারা ফুটি
বুধবারে চেয়ে দেখি সেই দুটি ছানা
গজালো তাদের গায়ে কচি কচি ডানা
বৃহস্পতিবারে তারা ডানা দুটি মেলে
মা’র কাছে চেয়ে চেয়ে মিঠে ফল খেলে
শুক্রবারে তারা এ উহারে কয়
ভোর হলে দেখা যাবে আকাশেতে ভয়
শনিবারে গাছে গাছে ডালে ডালে উড়ে
রবিবারে পাখি দুটি কোথা গেল উড়ে!’

মিলির মা জামাইয়ের গান শুনে উঠে দরজা বন্ধ করে দেন। মাগরিবের আযানের সময় হয়েছে। এ যুগের ছেলেমেয়েরা বেয়াদব। আযানের ওয়াক্তে গান গেয়ে একটু পর ঝপাৎ ঝপাৎ অযু করে আবার লম্বা তাকবীর দিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যাবে। ঠিক যেন সাত খুন করে এসে হাত পা ধুয়ে মসজিদে গেলেই সব মাফ। যত্তসব আদিখ্যেতা। তার কপাল খারাপ। পাঁচ ছেলেমেয়ের একজনও তাকে রাখতে চায় না। মিলির সুবুদ্ধি বা দুর্বুদ্ধি যাই হোক, একটা কিছু আছে। মাকে এনে নিজের কাছে জায়গা দিয়েছে। নয়ত, এই বয়সে মিলির মাকে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে থাকতে হতো৷ অবশ্য তিনি ভালো করে জানেন, ওখানেও তার খটখটে দুর্মুখ স্বভাবের জন্য বেশি দিন জায়গা হতো না। তাকে লোকজন বিদেয় করে ছাড়তো। এখানে, মেয়ের কাছে আছেন। তিন বেলা খাবারের সাথে ডাক খোঁজ পান। নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন। বৃদ্ধ বয়সে এতটুকুই প্রয়োজন। আযান হয়ে আসলে, তিনি জায়নামাজে বসে হাত তোলেন,’ইয়া আল্লাহ, আমার সন্তান যেনো থাকে দুধে-ভাতে।’ গোধূলি আকাশ ছড়িয়ে যাওয়া আলোয় সৃষ্টিকর্তা চোখ মেলে থাকেন। তার দৃষ্টিতে ও শ্রবণে সুক্ষতম শব্দেরাও ধরা পরে। সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময় তিনি তার সৃষ্টির ডাক ফেরাতে চান না, পারেন না।

দিন কাটে রোদচশমায় ঢাকা প্রহর বেলায়। সুখেদের পাওয়া যায় তাৎক্ষণিক। দুঃখ গুলো জেঁকে বসে কেবল। মনের অতলে ওরা সাতার কেটে যায। মিলির বারেবারে খোঁজ হয় সময় গড়িয়ে চলেছে। ওর সব কাজ কেবলি বাকি পরে যায়। সংসারের অন্য সব কাজ হয়ে চলে আপন গতিতে। মিলিই ওদের বয়ে যায়। কেবল ওর কাজ গুলো সারবার সময় কারো অবসর হয় না৷ তার থিসিসের প্রথম পার্ট জমা দেবার তারিখ আগামী মাসের দুই তারিখ। সুপারভাইজারকে মেল দিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি সপরিবারে ইন্ডিয়ায় ছুটি কাটাতে গেছেন। মিলি তাকে মেইল দিয়ে রাখে। এই ভদ্রলোকের ভুলে যাবার স্বভাব রয়েছে। এবং ভুলে গিয়ে তিনি উল্টো অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ হয়ে যান। মিলির মাঝেমধ্যে মনে হয়, ইয়া বড় এক ছুরি নিয়ে ওনার পেছন দৌড়ায়। দৌড়াতে দৌড়াতে বলবে,
‘আর ভুলে যাবি কি না বল। আর যদি ভুল করে ভুলেও যাস, তাহলে তুই যে ভুলে গেছিস তা মনে রাখবি। নয়ত, এই বড় ছুরি দিয়ে তোর ভু ড়ি গা লি য়ে দেব।’

কিন্তু, মিলির আর দৌড়ানো হয় না। এবং, প্রতিবার মিলি সব দোষ মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে ফাইল ছুঁড়ে হাত পা মেলে কাঁদতে বসে। অনিন্দ্য তখন মিলিকে কাছে টেনে স্বান্তনা দেয়। মিলি বড় ভালো মেয়ে। স্বামীর স্নেহস্পর্শ, স্নেহসম্বোধন, স্নেহরসে সে সিক্ত হয়ে পুনরায় স্থিতি খুঁজে পায়। এই জীবনে এতটুকুই বা কম কিসে।

অনিন্দ্য মুখে যতই বলুক, মিলির থিসিস প্রেজেন্টেশনের দিন ও ছুটি নেবে। বাচ্চাদর সামলাবে। আদতে, ছুটির কথা বলতেই ভুলে গেছে অনিন্দ্য। সকাল সকাল মিলির তোড়জোড় দেখে ঘুমঘুম কন্ঠে অনিন যখন জানতে চাইলো, মিলি এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাবে। মিলি আকাশ থেকে পরল। গতকাল শুধু অনিন্দ্যকে আজকের প্রোগ্রাম মনে করায়নি৷ একটু রাগ করলো এবারে মিলি।

‘ সকালে রওয়ানা না দিলে হবে? স্যার সারাদিন বসিয়ে রেখে বিকেলে সময় দেয়। ‘
‘তুমি আজকে যাবে?’
‘হ্যাঁ। কেন গত এক সপ্তাহ ধরে তোমাকে বলেছি্’।
‘গতকাল একবার মনে করাবা না?’
‘প্রতিদিন মনে করাতে হবে? তোমার ট্যুর থাকলে কি তুমি আমাকে প্রতিদিন মনে করায় দাও?’
‘আমার ট্যুর আর তোমার পড়া এক?’

মিলি কাজল দেয়া থামিয়ে অনির দিকে তাকাল। তাই তো। অনিন্দ্য অফিস ট্যুরে না গেলে চাকরি নড়বড়ে হবে। তার পড়া থেমে গেলে কারো ক্ষতি হবে কি? টুনু -তনুর পড়াশোনা চলবে। বাড়িতে রান্না হবে। উনুন বন্ধ হলে পেট পুজো থাকবে না। সবাই কষ্ট পাবে। মিলির পড়া থামালে কি আর এমন হবে। বড়জোর মিলির মন খারাপ হতে পারে। মিলির একটা আজন্ম লালিত ইচ্ছের মৃত্যু ঘটবে। এই তো! খুব বেশি কিছু নয়।

কথাটা বলে অনিন্দ্য বুঝতে পারলো, ও ভুল করেছে। মিলি চোখ খুব করে ঘষে কাজল তুলতে শুরু করেছে। রেস্টরুমে গিয়ে ভালো করে মুখ ধুয়ে এসে বাসার কাপড় পরে নিল চট করে। এবারে এগিয়ে এলো অনিন্দ্য, বউকে সরি বলতে। মিলি যেন কিছু হয়নি এমন করে বললো,

‘আমার ভুল হয়েছে। তুমি অফিস যাও। ফেরার সময় থোড় নিয়ে আসবে। ছোট ছোট চিংড়ি মাছ এনো। বসে বসে বাছব। নারকেল আনতে ভুলো না। থোড়ের সাথে নারকেল বাটা দিলে খেতে স্বাদ বাড়বে। ‘

অনিন্দ্য থমকে গেলো। মিলির চোখে এক কণা জল নেই। কন্ঠে রাগ-দুঃখ-অভিমান নেই৷ অনিন্দ্য যেন খুব চাইলো মিলি রাগ করুক। অনিন্দ্য ওর রাগ ভাঙাবে। ক্ষমা চাইবে। দরকারে আজকের দিনটা ছুটি নেবে৷ মিলি প্রায় জোর করে একটু আগে ভাগে অফিসে পাঠাল অনিন্দ্যকে। মায়ের জন্য নামাজের কাপড় কিনতে গেলো। দরদাম করলো কষে। টুনুকে ডাক্তার দেখিয়ে আনল স্কুল শেষে। তনুকে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে হোমওয়ার্ক করিয়ে ফেলল। রাতে অনেক সময় ব্যয় করে বাচ্চাদের জন্য ফ্রাইড চিকেন সহ সাত আট পদ তৈরী শেষে চমৎকার একটা পারিবারিক ডিনারও হয়ে গেল। ঘুমোবার আগে অনিন্দ্য তাকে কাছে টানলে সাড়া দিল মিলি। একটু অবাক হলেও অনিন্দ্যর মন হালকা হলো। মিলি তবে রাগ করে বসে নেই।

মাঝরাতে চোখ মেলে বিছানায় শুয়ে রইল মিলি। ওর ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। যাদের ভীষণ করে ওকে বোঝার কথা ছিল, ওরা ঘুমে মত্ত। শতচেষ্টা করেও মিলি চোখ বন্ধ করতে পারল না। বুকের গভীরের দ্রিমদ্রিম শব্দেরা বাহিরে আসতে পারলে আজ পুরো পাড়া জেগে রইতো।

চলবে।