মিলি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
211

#মিলি (৪-৩)

শেষাংশ

‘ভালোবাসায় শরীর থেকে মনের প্রাধান্য থাকতে হয়৷ ঘুমিয়ে যাবার পর ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে তুলে সঙ্গম করার থেকে ঘুমের ভেতর মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে পাশে ঘুমিয়ে যাবার নাম ভালোবাসা। শরীর ভালোবাসায় প্রকট একট শব্দ, তবে অবশ্যম্ভাবী নয়। এক বয়সে শরীর মূখ্য, প্রেম মানেই সেক্স’।

মিলি চায়ের কাপ নামিয়ে রাখে। সায়েমের গাড়িতে বসতে হলো। নাটক শেষ হয়েছে সাড়ে ছ’টায়। অঝোরে বৃষ্টি শুরু হলো তারপর। হাতঘড়িতে সময় রাত আটটা। মিলির বাড়ি ফেরা খুব জরুরী। ও না ফিরলে তনু -টুনু খাবে না। সেদিন মায়ের রুটি সেঁকা হবে না। অনিন্দ্য বের হয়ে আসার পর একবারো ফোন করেনি। হয়ত, সেও না খেয়ে থাকবে। মিলি হতাশ হয়ে পরে। একটা মানুষের একবেলার নাটক দেখবার ইচ্ছের ওপর অন্যদের খাদ্যসুখ নির্ভরশীল। কেন? ওরা কি একবেলা নিজেরা খেয়ে নিতে পারবে না। অনিন্দ্য বাচ্চাদের খাইয়ে নিজে খেয়ে নিতে পারে। মা চলৎশক্তিহীন নন। নিজের রুটিটুকু ভেজে নিয়ে ঔষধ খেতে পারে৷ ওরা সবাই মিলির ওপর নিজেদের ভার ছেড়ে কি দারুণ করে নিশ্চিন্ত থাকে।

‘নাটকের নায়কের মৃত্যু হলো শেষে বুঝি এই দোলাচলে।‘
‘হুম, নায়িকা একেরপর এক পুরুষের কাছে ভালোবাসার নামে শরীরের সুখ হাতড়ে বেড়ায়। অথচ, ভালোবাসা তার পাশে থমকে আছে, মেয়েটা বুঝতে পারেনি।‘
‘আপনি কখনো গোটা রাত কারো পাশে জেগে ছিলেন?’
‘না, সেই সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য হয়নি।‘

মিলির চা খাওয়া শেষ। সায়েম তেলে ভাজা এগিয়ে দেয়। অনিন্দ্য ঠিক এমন করে বৃষ্টি দিনে পেঁয়াজু-বেগুনি কিনে আনে। প্রকৃত পুরুষ মাত্রই নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল। অনিন্দ্যকে এবার নিজ থেকে ফোন করে মিলি। একবার-দুইবার-তিনবার। রিং হয়ে বেজে বন্ধ হয়ে গেলে মিলি দুশ্চিন্তায় পরে। তনু-টুনুর কিছু হয়নি তো। মায়ের মন সুস্থির থাকতে পারে না। মিলি পাশের বাসায় ফোন দেয়। একবার ওর ঘরে দুয়ার ঠুকে জেনে নিক সন্তানের খবর। ও বাসার ভাবী জানালো, দরজায় তালা দেয়া৷ মিলি কাঁচ ভেদ করে তাকিয়ে থাকে। এমন তুমুল ঝড় বাদলে মেয়েদের নিয়ে অনির বের হওয়া একদম ঠিক হয়নি। পরক্ষনেই নিজের কথা মনে হয় ওর। মিলি এখনো বাহিরে। তাহলে ওদের নিয়ে এমন কথা ভাবা অর্থহীন।

‘আমরা হৃদয়ের ভেতর থেকে কাউকে গভীর ভাবে অনুভব করলে তাকে ভালোবাসা বলি। আপনি এখন ভালোবাসেন, সন্তানদের, তাদের বাবাকে, আপনার মাকে। নিজেকে ভালোবাসতে ভুলে গেছেন।‘
‘স্বামী-স্ত্রী একটা সময় পরে একে অপরের অভ্যাস হয়ে ওঠে। প্রিয় বালিশ বাদে যেমন আমরা ঘুমোতে পারি না, ভারী খাবার পর পান খাই তেমন আমরা একে অপরের অনুষঙ্গ হয়ে উঠি। ভালোবাসার বদল হয়ে অবাস্তব মোহ কাজ করে। যার মৃত্যু হয় না। ভালোবাসি সন্তানদের। মায়ের কথা বললেন তো। ওটা দায়িত্ব, কর্তব্য।মাকেও মাঝে মাঝে বড্ড ঝামেলা মনে হয়। মিথ্যে বলব না। আমি ক্লান্ত’।

সায়েমের ইচ্ছে করে মিলির হাত ধরে স্বান্তনা জানাতে। পরনারীকে চাইলেই স্পর্শ করা যায় না। স্পর্শ ভীষণ বড় একটি মুহূর্ত। সে চাইলে গড়তে পারে, পারে ভেঙে চুরমার করে দিতে দীর্ঘ অনুভব। মিলি সায়েমের দিকে হাত বাড়ায়।

‘আপনি আমার বন্ধু হবেন? নিখাদ বন্ধুত্ব। আমাদের ভেতর কোন চাওয়া বা পাওয়ার হিসেব থাকবে না৷ মন খুলে এক দন্ড কথা বলা যাবে। ‘

সায়েম সায়েম সময় চুপ থাকে। মিলি তার বন্ধু হতে চাইছে। বাস্তবিক ভাবে সে মিলির প্রতি দূর্বল। মিলি বিবাহিতা, দুই সন্তানের জননী। সায়েম জানে, মিলি কখনই সংসার ভেঙে তার কাছে আসবে না। সায়েমের কামনায় এই পাপ কখনো জাগেনি। তবু, কথা শেষ হয়ে এলেও কিছু কথা থাকে। তেমনি, ভালো লাগার মানুষ সব কিছু বিচারের আওতায় পরে না। বিপরীতমুখীতে মিলি অত্যন্ত ভদ্র। ঐ যে বুকের আঁচল গুছিয়ে বসা, চোখ নামিয়ে কথা বলা, হাসলেও ঠোঁটের কোনে টেনে রাখা সীমাতে অনিন্দ্যর নাম আঁকা, সায়েম এই মিলিকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। যাকে শ্রদ্ধা করা যায়, তাকে ভালোবাসা হয় খুব। প্রকাশ করা যায় না।

‘আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। এই ঝড়ের রাতে আপনাকে একা যেতে দেয়া অভব্যতা। ‘
‘আমাদের গন্তব্য শহরের এ মাথা এবং ও মাথা। এই ভদ্রতা না করলেও চলবে। আপনি যে নাটক দেখতে এসেছেন, আমি এতেই খুশি।‘

সায়েম প্লে লিস্ট থেকে গান বাছাই করে। খুব মেঘ ডাকলে, ‘মন মের মেঘের সঙ্গী শোনা হয়। ঘণঘোর বর্ষণে আঁধার ঘণিয়ে এলে, হৃদয়ের গোপন কথা বলতে ইচ্ছে করে না। অনুভবে বুঝে নিয়ে কান পাততে হয় বৃষ্টির সুরে। সায়েম আপনাতে যে গানটি ছেড়ে গাড়ি ঘোরায়, মিলি অবাক বিস্ময়ে তা মুগ্ধ হয়ে শোনে। এতক্ষণ মনে মনে এই গানটি কি গভীরতা নিয়ে সে গুনগুন করে গেয়ে চলেছিল।

‘ব্যকুল বেগে আজি বহে বায়
বিজুলি থেকে থেকে চমকায়
যে কথা এ জীবনে
রহিয়া গেলো মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘণ ঘোর বরিষায়
এমন দিনে তারে বলা যায়।‘
***

দু’টো মোরগ পোলাও নিয়ে জম্পেশ করে খেয়েদেয়ে অনিন্দ্য মিলির জন্য প্যাক করে নিলো। বৃষ্টির তোড় কমেছে। পকেটের ফোন বের করে মিলির মিসকল দেখলো সে। মিলি কেমন ঝড়ের বেগে চলে গেলো তখন। কিছুটি বললো না, শুনলো না। করুণ করে বাচ্চারা ডাকলো, ও পিছু ফিরলো না৷ শুধু বললো, খুব নাটক দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। অনিন্দ্যর যাবার দরকার নেই। এক বন্ধু আসবে, তার সাথে দেখে নেবে। অনি দ্বিতীয় প্রশ্ন করেনি৷ রুমার সাথে মিলির হুট করে ঠিক করা কাজ কারবার নিয়ে ও একটু বিরক।ত হলেও মিলিকে কিছু বলতে যায় না। অতটুকু ঝক্কি করা যেন মিলির একটু খানি স্বাধীনতার স্বাদ।
অনি জানে, মিলি ওদের কতটা ভালোবাসে। ঘরের দূয়ার থেকে জানালার শিকে মিলি তার যত্নের আবেশ দিয়ে রাখে। ব্যালকনি ছাওয়া রঙীণ গার আড়াল থেকে ঝোলে কাল শিংনাথ বেগুন। সবটাতেই মিলি আর মিলি। মিলিকে ছারা ওদের বাকি তিনটি মানুষের জীবনের প্রতিটি সময় অসম্পূর্ণ। তাই তো, বাচ্চাদের নিয়ে কি করবে ভেবে না পেয়ে অনি বাহিরে এলো৷

অনিন্দ্য ড্রাইভ করতে করতে তনুকে গল্প বলতে বলে। রুপাঞ্জেলের গল্প বলে তনু। কি করে দুঃখী রাজকন্যেকে ডাইনী বুড়ির ঘর থেকে নিয়ে যায় সাহসী রাজকুমার। বোকা রাজকন্যে জানতই না সে বন্দিনী।
টুনু মুখ বাঁকিয়ে নিজে নিজে পুতুল দিয়ে খেলে। মা তাকে টুকরো কাপড় দিয়ে ছোট ছোট পুতুল গড়ে দিয়েছে। তনুর গল্পের মাঝে অনির মনে ওরে মিলির বলা কথামালা। মিলিকে ঘিরে ওর সুখ, দুঃখ। হেঁড়ে গলার গান, বলতে চাওয়া কবিতা, সব কিছু মিলির জন্যে। সকালের সূর্যোদয় দেখা মিলির সাথে গোধূলী লগণ কাটে মিলির বাহুতে শুয়ে। আজ অনেকটা দিন পর মিলি এত চঞ্চল হয়ে উঠলো কেন। কেন শোকগাথা গাইতে শুরু করলো এত যতনে গড়ে তোলা সংসার নিয়ে। মাতৃত্ব নিয়ে মিলি গর্ব করে। বাচ্চাদের যতটা যত্ন নিয়ে সময় দিয়ে মিলি গড়ে তুলছে, তা নিঃস্বার্থ। অনিন্দ্যর বোন চাকরী করে, মিলি তার থেকে কম মেধাবী নয়৷ জগতের পিছুটান থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে মিলি একপ্রকার নিজের সাথে যুদ্ধ করেছে। অনি ওকে যতই সন্তানের প্রতি কর্তব্য বা দায়িত্বের কথা বলে বোঝায় না কেন, মিলির মনের ভেতর জেগে ওঠা এই ভয় একেবারে ফেলে দেয়া যায় না।
মিলি চাইলেই স্বার্থপর হতে পারত। নিজের পরিচয় তৈরী করে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে সমাজে নাম কামাতে পারত। মিলি তার সব পায়ে দলে সন্তানের মাঝে সুখ খুঁজেছে। কিন্তু, তার ভেতর ওকে আটকে রাখার এই যে ছল, মায়া নামের কারাগারে আটকে যাওয়া, তাতে মিলি হয়ত হাঁপিয়ে যায়। অনিন্দ্যর খারাপ লাগে। বাড়ি ফিরে মিলির সাথে আলোচনা করে নেবে ও৷ অনিন্দ্য মহাপুরুষ নয়। তার নিজস্ব চাহিদারা পূরণ হয়ে তবে মিলির আনন্দ, এই সে ভাবতে চায়। সহজ, সরল স্ত্রী কামনা করা প্রতিটি পুরুষের অধিকার, অনিন্দ্য না হয় আরেকটু উদারমনা। তনু-টুনুর কলকাকলীতে অনির ভাবনায় ছেদ পরে। গাড়ির কাছে একটি বাচ্চা ছেলে বেলী ফুলের মালা নিয়ে ঠকঠক করছে। অনিন্দ্য দ্রুত কয়েক জোড়া কিনে নেয়। মিলির পছন্দ বেলীফুলের মালা।

সিগন্যাল ছেড়ে একটু সামনে আগায় অনিন্দ্য। এখানটায় বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার জ্যাম লেগেছে। ডাম বামের গাড়ির হর্ণে বাচ্চারা কান চাপে। অনি অধৈর্য হয়ে আশেপাশে তাকায়। ওর চোখ হঠাৎ ভুল দেখে। ঐ গাড়ির সামনের সিটে বসে থাকা মিলির পাশের ভদ্রলোকটির পরিচয় অনি জানে না৷ হাসতে হাসতে মিলির হাতে ভদ্রলোক তুলে দিলেন সদ্য কেনা ভেজা বেলীর মালা। মিলি খোঁপায় জড়ায়। অনিন্দ্য গাড়ি নিয়ে তার পিছু পিছু এগোয়। ওদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামলে অনিও খানিক দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে এসে দরজা খুলে দিলে মিলি নামে। মিলিকে অনিন্দ্যর কাছে সেই গল্পের রাজকন্যা রুপাঞ্জেল লাগে।

অনিন্দ্যর চোখ ভরে আসে নোনা জলে। মিলির এই উচ্ছল হাসিমুখ দেখে ওর এত কষ্ট হচ্ছে। সুপুরুষ ভদ্রলোকের পাশে নিজ স্ত্রীকে দেখে অনির সন্দেহ জাগার বদলে ভয় হয়। চির পরিচিত ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলার ভয়।

#মিলি (৪_৪)

শেষাংশ

‘মা হলে সেই মানুষটিকে পৃথিরবীর সকল স্বত্তা বিসর্জন দিয়ে কেবল মা হয়ে উঠতে হয়। একটা বেতন বিহীন সাত দিন চব্বিশ ঘন্টার অলিখিত চুক্তিনামায় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে নিজের কাছে নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রতিশ্রুত রেখে যাবার নাম -মা। ‘

অনিন্দ্য নতুন করে কিছু বলতে পারে না। মিলি খেতে বসেছে। অনি এসে ওর খোঁপার ফুল সরিয়ে নিজের আনা ফুল জড়িয়ে দিলো। মিলি খাবার মুখে তুলতে গিয়ে থমকে গেছে। অনিন্দ্য চুপচাপ মিলির সামনে বসলো। তনু-টুনু বাসায় ঢুকে ঘুমিয়ে গেছে। মিলি মায়ের খবর নিয়ে শাড়ি খুলে বাসার ম্যাক্সি গায়ে চাপিয়ে টুকটাক কাজ সেরেছে। অনি এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। মিলির পেছন পেছন বাসায় ঢুকেছে অনিন্দ্য। গাড়িটা ইচ্ছে করে সায়েমের গাড়ি ঘোরানোর মুখে রেখে এসেছিল। সায়েম মিলিকে ফোন করলে মিলি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অনির দিকে চাইলো কেবল। অনি হাসলো, এবং গাড়ি সরিয়ে নেমে দাঁড়ালো। সায়েম অবিবেচক বোকা পুরুষ নয়। যথেষ্ট ব্যক্তিত্ববান বোধের বিকাশ তার রয়েছে। অনিন্দ্যকে দেখে সেও নেমে এলো গাড়ি থেকে। মিলি জানালা থেকে দুজনকে করমর্দন করতে দেখে পর্দা টেনে জানালা আটকে নিল। ওদের ভেতর কি কথা হলো, তা জানার প্রয়োজন নেই। একজন ভদ্রলোক ভক্তের সাথে একবেলা নাটক দেখে আসায় এমন কোন পাপ হয়নি। যেখানে, অনি কোনদিন তার সাথে নাটক দেখতে যাবার জন্যে রাজী হয় না৷ অনির কথা, ‘তুমি দেখে এসো। আমার এসব ভালো লাগে না।‘

অনি জানে, মিলি বাচ্চাদের রেখে একা যাবে না৷ বা যদি যায়, রুমাকে নিয়ে যাবে। যে সব মানুষ শুধু সঙ্গী বা বন্ধুকে নারী ও পুরুষের ফারাক দিয়ে বিচার করে, মিলি তাদের দলে নয়৷ বন্ধুত্ব একটি বিশাল শব্দ। যার কোন লিঙ্গ বা আয়তন নেই৷ অনির কাছে রুমার বদলে সায়েমকে নিয়ে নাটক দেখতে যাওয়া নিয়ে মিলি প্রাথমিকভাবে কুন্ঠিত হলেও এখন ওর খারাপ লাগছে না।

‘ভদ্রলোকের সাথে তোমার পরিচয় কেমন করে, মিলি।‘
‘রেস্তোরায়। রুমা সহ চা খেতে গেলাম। তোমাকে বলেছি, এক ভক্ত খাবার প্যাক করে দিলেন।‘
‘তিনি পুরুষ, তা বলোনি।‘
‘ভক্ত নারী বা পুরুষ তাই দিয়ে কিছু যায় আসে না, অনি।‘
‘তুমি নাটক দেখতে যাবে, আমাকে বলেছো। রুমা আপাকে সাথে নিয়ে যাও সবসময়। তাই চিন্তা করিনি। একটা অপরিচিত লোকের সাথে যাবে ফিরবে, তা একবারো বলোনি মিলি। আমি এটা এলাউ করতাম না৷ চারদিকে এত বিপদ হয়, তুমি কি ভুলে গেছো, আমাদের দুটো মেয়ে সন্তান আছে। তুমি একজন মা।’

মিলি খাওয়া থামিয়ে অনিকে দেখে নিল। মিলির চাওয়া পাওয়া কি অনির ওপর নির্ভর হয়ে পরছে দিন শেষে। আজ মিলি চাকরী করলে, ওকে যদি কোন কলিগ নামাতে আসতো, অনি কি এই প্রশ্ন তুলতো। সায়েমের দেয়া ফুল অনি সরিয়ে নিজের ফুল পরালো। মিলির কাছে অনির ফুলের দাম লক্ষগুণ বেশী। তাই বলে, একজন ভক্তের দেয়া ফুল খোঁপায় পরে নেয়ার অর্থ স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে না কেন এই সমাজ ও তার মানুষেরা।

‘বুঝলাম, তুমি একজন মানুষ। মা হয়ে উঠতে গিয়ে তোমাকে নিজস্ব অনেক স্বত্তার সাথে কম্প্রোমাইজ করতে হয়। মিলি, ইউ চুজ দিস অকোপেশন। মা হওয়া, গৃহিনী হওয়া তুমি বেছে নিয়েছো। আমি তোমাকে ফোর্স করিনি৷ তুমি এতদিন হ্যাপিলি এটা করে এসেছো৷ আজকে দুটো আর্ণিং হলো, আগামীকাল ভক্তেরা তোমার সাথে দেখা করতে চাইলো, তার মানে কি এই, তুমি সবাইকে তোমার লাইফে এলাউ করবে?’
‘শুধু একবেলা একজন নারী বন্ধুর বদলে পুরুষ বন্ধুর সাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া নিয়ে এতদূর কথা হবে, আমি আশা করিনি অনি। তোমার মেয়ে কলিগ রয়েছে৷ তারা যখন তোমার সাথে গল্প করে, আড্ডা দেয় আমাকে কখনো ইনসিকিউর ফিল করতে দেখেছো? তুমি অফিশিয়াল ট্যুরে যাও, মাসব্যাপী ট্রেনিং চলে৷ সেখানে কার সাথে থাকছো,খাচ্ছো আমি কোনদিন জানতে চাইনি অনি৷’
‘তুমি জানো, ছেলে মেয়ে আলাদা থাকে। আমি তোমাকে সন্দেহ করছি না, মিলি। ভদ্রলোকের পরিচয় জানতে চেয়েছি। আজ বিকেলে তুমি কি ওনার মেসেজ পড়ছিলে?’

মিলি খাবার নাড়ে। উত্তর দেয় না। অনির চোখ এড়ায়নি তাহলে৷ কি জবাব দেবে সে? সায়েমের সাথে মেসেজে তেমন কোন আলাপন হয় না। আবার অন্য একটি পুরুষ তাকে গান পাঠায়, কবিতা শেয়ার করে এটা ঠিক দেখতে বা শুনতে ভালো লাগে না। মিলি তা জানে৷ অনির সাথে এই এক ঘটনা ঘটলে মিলিও প্রশ্ন তুলতো। এবার মিলি সহজ হয়। যা সত্য তা অকপটে স্বীকার করা মানবোচিত কর্ম।

‘আমাদের পছন্দ খুব মেলে অনি৷ উনি ধরো, আমাকে রুদ্রের একটা কবিতা পাঠালো। বা শিমুলদার করা আবৃত্তির লিংক। বললো, এটা আমার কন্ঠে ভালে মানাবে। হয়ত, রবিদার কোন লেখা, যা জীবন ঘনিষ্ঠ। বাস, এই তো। কখনো, মনের ভাবনা শেয়ার করলেন। রেস্তোরার কোন চেঞ্জ, ডেকোরেশন রিলেটেড বা এম্প্লয়ি ম্যানেজমেন্ট। রুমার সাথেও কিন্তু আমার এরকম আলাপ হয়। আমি ওটা কখনো মোছার তাগিদ অনুভব করিনি৷ অথচ, সায়েমের দেয়া মেসেজ মুছে দিয়েছি৷ তোমার চোখে পরলে, তুমি কি মনে করো ভেবে। তাহলে, দেখা যায়, আমি যতই বন্ধুত্বের ভেতর নারী বা পুরুষের ব্যারিয়ার মানি না, বলি না কেন, আসলে অবচেতনে আমি নিজেও তা নিয়ে ভয় পাই ‘
‘আমিও ঠিক ঐ ভয়ে তোমাকে প্রশ্ন করেছি মিলি। তুমি কি কোন কিছুতে আমার ওপর মন খারাপ করেছো। আমরা কথা বলে ঠিক করে নিতে পারি।‘
‘তুমি আমাকে আবৃত্তির ক্লাসটাও বন্ধ করে দিতে বলছো, অনি। অথচ, ওটুকু ঘিরে আমার বেঁচে থাকা।‘
‘তুমি সিরিয়াসলি নিয়েছো। আমি দেখছি, সব সামলে নিতে তোমার কতটা কষ্ট হয়। তোমাকে আঘাত দিতে, বা ছোট করতে আমি কিছু বলিনি। ‘
‘তোমরা কি আমাকে সাহায্য করতে পারো না, অনি? সায়েম কি বলে জানো?’

মিলি কথাটুকু বলে বুঝতে পারে, অনির সামনে এভাবে বলা হয়ত ঠিক হলো না। অনির খুব খারাপ লাগে। অন্য একজন পুরুষের সাথে মিলি স্বামীর তুলনা ধরছে৷ ওর মুখের রঙ বদলে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। চোখে ক্রোধ জমলেও তা নিমিষে উধাও করে দেয় অনি৷ মিলিকে আগলে নিতে হবে। কণিকা সমান অবহেলা, অনুকম্পন এই মুহূর্তে অনেক বড় কিছুর সৃষ্টি হতে পারে। অনি অপর একটি মানুষকে সেই সুযোগের ব্যবহার করতে দেবে না।

‘তুমি ভুল বুঝো না। রাগ করো না।‘
‘করিনি, তোমার কাছে শুনতে চাইছি। বলো, মিলি আমি কি করতে পারি ‘।
‘তুমি যথেষ্ট কেয়ারিং অনি৷ তবুও, তনু-টুনুর সব কাজ একলা আমায় করতে হয়। আমি মানছি, এই জীবন আমার বেছে নেয়া। আমি মানছি, মা হয়ে আমি ওদের সব নিজের হাতে করতে ভালোবাসি। তবে, কখনো আমারও ছুটি লাগে। প্রতিটা দিন আমি এই একই কাজ একটানা করে যেতে হাঁপিয়ে উঠি। ঠিক ঐ দিনটায় আমার ছুটি চাই।‘
‘ব্যাস এতটুকু?’
‘এটা ঠিক এতটুকু না, অনি৷ তোমার মনে আছে? থিসিসের জন্য তোমাকে একদিন ছুটি নিতে বলেছিলাম।‘
‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তোমাকে সরিও বলেছি।‘
‘একটা কথা জানো কি, অনি৷ রিভলবারের গুলি থেকে মুখের কথা প্রচন্ড শক্তিশালী। গুলি তোমাকে একবারে মেরে ফেলে, আর মুখ থেকে ছুটে আসা কথার বাণে মানুষ প্রতিক্ষণে জর্জরিত হয়৷ তোমার বলা ঐ কথাদের আমি ভুলতে পারিনি।‘
‘আমাকে কি করতে হবে, মিলি। স্বামী হিসেবে তোমার সাথে আমার চমৎকার একটা বোঝাপড়া আছে, জানি।‘
‘আছে বলেই আজকে আমরা মন খুলে কথা বলতে পারছি। তুমি কি কখনো খেয়াল করেছো, আমি একটা সময় বিষন্নতার চাদরে নিজেকে ঢেকে নেই। তোমরা কেউ আমার ঐ চাদরখানি সরিয়ে আমার ভেতরটা দেখার চেষ্টা করো না। তখন হয়ত বাচ্চাদের নিয়ে তুমি কার্টুন দেখো। মা চুপচাপ থাকে। কিন্তু ঐ অতটুকুনই। কখনো আমার জন্যে কি ভালো হবে, তা তোমাদের ভাবতে দেখি না। অথচ, আমাকে দেখো। আমি সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত তোমাদের মন কেমন করে ভালো থাকবে তাই ভেবে মরি।‘
‘সায়েমের কাছে কি তুমি এর কোন সলিউশন পেয়োছো। ঐ লোকটা আমাদের মাঝে এলো কেনো।‘
‘তুমি কেন ভাবলে সায়েম আমাদের মাঝে এসেছে। ও পুরুষ বলে? দেখো, রুমাকে আমি যতটা চিনি ও যেমন করে ঘুরে বেড়ায়, আমি কখনো তা সাপোর্ট করি না। ঐ যে বলেছি, রুমা চাকরী করে বলে কলিগের সাথে গাড়ি চড়লে, লিফট নিলে, বা এক সাথে কোথাও খেতে গেলে সমাজের চোখে লাগে না। একজন গৃহিনী এই একই কাজ করলে, তোমরা পাড়া শুদ্ধ লোক কনসার্ণ হয়ে যাও। এই বুঝি ঘরের মেয়েটি কারো খপ্পরে পরে গেলো। সে যেহেতু চাকরী করে না, তাই তার বুদ্ধি কম। তাকে সহজে বিপদে ফেলা যায়। সে ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা রাখে না। বলো, অনি? তুমিও কি তাই ভাবো না? কিছুটা হলেও ভাবো। আমি জানি। সব খুলে বলার প্রয়োজন হয় না। ‘

মিলির খাওয়া শেষ। ও উঠে পরে। আগামীকালের জন্য কিচেন গুছিয়ে এসে বাচ্চাদের রুমের ফ্যান এডজাস্ট করে দেয়। বৃষ্টি থামেনি৷ ঝিরিঝিরি ঝড়ছে এখনো। অনিন্দ্য রাত পাজামা গলিয়ে মশারী খাটায়। মিলি চুল আঁচড়ে শুতে এসে অনির গায়ে হাত রাখতে চেয়েও সরে আসে। অনিন্দ্য মিলিকে চুমু খায়। মিলি অনির বুকে মাথা রাখে। কিছু সময় পর মিলি ঘুমিয়ে পরলেও অনির চোখে ঘুম নামেনি। একটি নিদ্রাহীন রাত হাজারো প্রশ্ন এবং উত্তরের হিসেবনিকেশে কেটে যায় অনির। মাতৃত্বের দায় ঠেকাতে গিয়ে কি মিলি নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিয়ে চলেছে অনির সমুখে?

অনি পাশ ফেরে। সকাল হয়ে গেলে উঠে দেখে ,রাতভর বৃষ্টিতে পথঘাট ভিজে আছে। অনি মিলির গায়ে কাঁথা টানে৷ মিলি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অনি ভাবে। মিলির শরীর খারাপের খবর শেষ কবে ও খতিয়ে দেখেছে। জ্বর, শরীর ব্যাথায় নাপা ব্যাস। মিলি সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবার চলতে শুরু করে। নিজের তীব্র জ্বরে ঔষধ খেয়ে তনুকে নিয়ে ডক্টরের কাছে দৌড়েছে মিলি। অনি আসতে পারেনি। অফিসে মিটিং চলছিলো৷ এত বছর এই একই নিয়ম ঘটে এসেছে। মিলি কখনো প্রশ্ন তোলেনি। অথচ, পিতা হিসেবে অনিরও সন্তানের সাথে হাসপাতালে যাবার কথা ছিল। মিলি তার কাছে ঠিক কি চায় এখন?

অনিন্দ্য অনেক ভেবে নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না। মিলির ভাবনাকে ফেলে দিতে চেয়েও পারে না। মিলি কি তবে স্বার্থপর? নিজের সন্তাদের দায় নিতে অপারগতা প্রকাশ করে ফেলল এত সহজে। অনির বদলে সায়েমের সাথে ঘুরতে গেলো। অনিকে লুকলো, অনিকে… না না না। মিলি কোথাও কোন ভুল করেছে কি না অনি ভাবনায় ডুবে যায়।

মিলির তবে দোষ কোথায় হলো। মিলি নিজের জন্যে ভাবতে চেয়েছে। একটা দিন মিলি ছুটি চেয়েছে। যে কোন একটা দিন। যে দিনটায় মিলির কাজ করতে মন চাইবে না। সাত সকালের নিত্য প্রয়োজন মেটাতে ইচ্ছে করবে না। মিলি অমন একটা দিন ছুটি চায়। নিজের জন্যে চাওয়া অন্যায় নয়৷ অনিন্দ্যর এবার ভীষণ খারাপ লাগে৷ মিলিও মানুষ। একজন আলাদা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে চাওয়া মানুষ। সে গৃহিনী হোক, চাকুরীজীবি হোক। সে মানুষ৷ তার নিজেকে নিয়ে দুদন্ড সময় কাটাতে চাওয়া কঠিন পাপ নয়৷

অনিন্দ্য ঘড়ি দেখে। তনু-টুনুর স্কুলের সময় হয়ে গেছে। মিলিকে ডাকতে গিয়ে থেমে যায় অনি। ঘুম ঘুম চোখে টেনে তুলে ওদের তৈরী করে নেয়। ফুড পান্ডা থেকে সকালের নাস্তা এনে টেবিলে সাজায় অনি। আজ শাশুড়ী নেই ভাগ্য ভালো। নয়ত, ওনার সাথে জবাবদিহি করতে করতে অনির জান যেতো। বাচ্চারা মায়ের কাছে বিদায় নিতে গেলে অনি মানা করে। মিলিকে চুমু খাওয়া হয়না অনির। দরজা আটকে ও নেমে যায়। যাবার আগে একটা ছোট্ট কাজ করে অনি। ও কাজটা তোলা থাকুক।

বেলা করে ঘুম ভাঙলো মিলির। চোখ কচলে দেয়ালঘড়িতে সময় দেখে আঁতকে ওঠে মিলি। দৌড়ে বিছানা ছেড়ে নেমে বাচ্চাদের রুমে গিয়ে ওদের কোথাও না পেয়ে অনিকে ফোন করতে গিয়ে ফ্রিজে আটকানো স্টিকি নোট পড়ে, অনি ওদের স্কুলে দেবে এবং সন্ধ্যায় বাসায় নিয়ে আসবে৷ টেবিলে নাস্তা রাখা আছে। মিলি যেন সময় করে খেয়ে নেয়।

নোট হাতে মিলি চেয়ার টেনে বসে পরে৷ অনিকে কি বললো না বললো তাই বলে অনি বাচ্চাদের স্কুলের জন্য ওকে জাগালো না। এতটা রাগ অনির? এত খারাপ ঠেকেছে মিলির আত্মপ্রকাশ!

আবৃত্তির ক্লাসে আজ গুম হয়ে থাকে মিলি। আব্বাস পড়া করেননি৷ মিলি আজ একটুও হাসলো না। উল্টো রাগ করলো। এমন করলে, পড়ার দরকার নেই বলে নিজেই লজ্জিত হলো। বয়স্ক লোকটির দোষ নেই। মিলির মন খারাপের ভার অন্য কারো ওপর দেয়া ঠিক নয়। রুমাকে মেসেজ করে মিলি। আজ রুমার মেইড ছুটি নিয়েছে। রুমার আক্ষেপ দেখে মিলির হাসি পায়।

‘বুয়াগোরো ছুটি আছে, বুঝলি রে। আমার ছুটি নাই। আশরাফ সোজা কাজে চলে গেলো। সিংকের ওপর বাসন, পোলাপান কেও-বেও করছে। আমার আজকে শাড়ি পরে অফিসে যাওয়ার কথা। সবাই কৃষ্ণচূড়া উৎসবে অফিস শেষে যাবে। আর আমি মনে হয় আজকে অফিসেই যেতে পারব না। ‘
‘বুয়া আসলেই বা কি। ওকে কাজ না দেখালে সে নিজের থেকে কোন কাজটা ঠিক মতো করবে? মাথা খাটাতে হয়, কম বেশি। ‘
‘মেয়েটা ওটস খাবে না। এদিকে পরোটা শেষ। এখন ফাঁকিবাজি গোলা রুটি বানিয়ে দিলাম।‘
‘অনি আজ আমাকে ডাকেনি। নিজে নিজে বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে গেছে।‘
‘ঝগড়া করেছিস?’
‘নাহ! আমার ভালো মন্দের হিসেব গুলো শুধু জানিয়ে ছিলাম মাত্র। ‘
‘এই তো, হারামী। তোকে মানা করিনি?’
‘কেনো রুমা? আমি কি খুব খারাপ কিছু চেয়েছি।‘
‘নাহ, আম্মা। তুমি ভালো করেছো। গতকাল যে নাটক দেখতে গেলি, ওখান থেকে এত কিছু?’
‘সায়েমের সাথে অনি দেখেছে আমাকে।‘
‘কস কি মমিন। হায় আল্লাহ। ভাইয়া রাগ করেছে অনেক?’
‘রাগ করলে বেঁচে যেতাম। সাইলেন্ট ট্রিটমেন্ট দিচ্ছে হয়ত’।
‘রাগ ভাঙাতে সুন্দর করে রান্না কর। শাড়ি টারি পরে থাক। ভাইয়া আসলে খাওয়ার পর পোলাপানকে একটা রুমে দিয়ে নিজেদের মত সময় কাটা। বুঝেছিস গাধী, কি করতে বলেছি?’
‘সেক্স ইজ নট দা আলটিমেট সলিউশন, রুমা। ওতে অনি হয়ত ভাবতে পারে সব ঠিক হয়ে গেছে। আমার কিন্তু ভেতরে সেই মনটা মরে রইল। আমি মুক্ত হলাম না।‘
‘সায়েমের কি খবর। ও কিছু বলেনি?’
‘হুম বলেছে। ব্লাকের নেক্সট যে কনসার্ট হবে তার টিকিট পেয়েছে বললো। আমি গেলে সেও যাবে। তুই যাবি?’
‘যেতে পারি। তবে আশরাফকে ম্যানেজ করে যেতে হবে। ‘
‘বিয়ের পর মেয়েদের বন্ধু থাকা অন্যায়, নারে?’
‘খাইসে রে। তুই দেখি ওমেন চ্যাপ্টার টাইপ বানী দেয়া শুরু করলি। থাম। শোন, বিকেলে ভাইয়া ফিরলে আসলেই কোথাও সবাই মিলে যা।‘
‘আজ আমি কোথাও যাবো না
আজ আমার ছুটি।
আজ আমি বড্ড ক্লান্ত
শ্রান্ত, ভগ্ন মনোরথে,
ভাবব আমায় নিয়ে
একলা অবিরত।‘
‘দোস্ত, তুই কবিতা আবৃত্তি কর। আমি গেলাম। বুয়া আসলো মনে হয়। না আসলে ওদের আম্মার বাসায় দিয়ে যাবো। বাই দা ওয়ে, আন্টি আসবে কবে।‘
‘আম্মাকে নিয়েও ভাবতে হবে। অন্য সন্তানেরা তাদের দায়িত্ব আমার কাঁধে দিয়ে শান্তিতে আছে। তাদেরকে ডাকব।‘
‘আমার মনে হয়, তুই এবার সরাসরি ওনাদের বল, আন্টির কিছু কাজ ভাগ করে নিতে। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো হয়ে লাভ নেই।‘
‘সন্তান হিসেবে আম্মাকে তো না দেখব বলি না। ঐ জুতো সেলাই টু চন্ডী পাঠটা একা আর করতে চাইছি না। জানি রে, এতেও চক্ষুশূল হতে হবে।‘

মিলি ফোন রেখে জানালার গ্রীল ধরে বাইরে দেখে। সায়েম টুকটাক মেসেজ পাঠিয়ে চলেছে৷ এতটুকু বিরতি পরলে রিপ্লাইয়ে সায়েম অস্থির হয় না। শান্ত হয়ে অপেক্ষা করে। সন্ধ্যার আবৃত্তি ক্লাস শেষ করে মিলি অনিকে ফোন করে। বাচ্চাদের নিয়ে ও কতদূর জানতে চায়। একটা দিন বাচ্চাদের না পেয়ে মিলির অস্থির লাগে। যেন বুকের খাঁচা থেকে জীবন কোথায় হারিয়ে গেলো। তবু, সান্তনা অনিন্দ্য ওদের সাথে আছে।

তনু-টুনু নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরলো। ওদের দারুণ পিকনিক হয়েছে। বাবার অফিসের আঙ্কেলরা চিপস, চকলেট দিয়ে ওদের ব্যাগ বোঝাই করে দিলো। টুনুকে বোরিং কোচিং করতে হয়নি। মিলি তনুর কাছে জানতে চায় ওরা বাবার অফিসে কি করলো,
‘তুমি যা যা করতে দাও না। বাবা তাই করতে দিয়েছে। আমরা গেম খেলেছি। আইসক্রিম খেয়েছি। আমরা একটুও মারামারি করিনি।‘
‘জানো আম্মু, বাবার অফিসটা এত বড়। এত এত বড়। ‘

টুনু দুই হাত প্রসারিত করে দেখায়। অনিন্দ্য ফেরার পথে চাইনিজ নিয়ে এসেছে। তাই খুলে সাজিয়ে রাখে টেবিলে।

‘কেমন কাটলো তোমার দিন। নিজের কাজ করতে পারলে?’
‘খোঁচা দিচ্ছো? আমি শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবি তাই তো।‘
‘নাহ। আমি সত্যি জানতে চাইলাম তোমার দিন কেমন কাটলো।‘
‘ভালো না। ওদের ছাড়া এভাবে থাকিনি কখনো।‘
‘অভ্যাস করো। চলো খেয়ে নেই। তোমার সাথে কথা আছে।‘

মিলি ধুকপুক বুকে খেতে যায়। অনিন্দ্য ফ্রেশ হয়ে এক ফাঁকে মিলির ফোন দেখে। সায়েমের ম্যাসেজ আজ মুছে দেয়নি মিলি। পুরো কনভারশেসন পড়ে না অনিন্দ্য। এতে মিলিকে অবিশ্বাস করা হয়। সায়েমের সাথে মিলির বন্ধুত্বটা নির্মল। অনিন্দ্য এই বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাবে না ঠিক করেছে। সম্পর্ক ভেতর থেকে মজবুত করে নেয়া জরুরী। বাহ্যিক খড়কুটো যেন ওখানে বাসা বাঁধতে না পারে।

মিলি শুতে এলে অনিন্দ্য ওর হাতে একটা খাম দিল। মিলি ওটা না দেখে শুয়ে পরতে নিলে অনিন্দ্য তাকে ভেতরে দেখতে বলে।
‘কাল দেখব। আজকে ঘুমাই। প্রতিদিন তো আর তুমি সকালে উঠে ওদের নিয়ে বেরোবে না।‘
‘তুমি খুলে দেখো, আগে। ‘

খাম খুলে মিলি বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠে। অনেক দিনের স্বপ্ন সাজেক দেখবে মিলি। ওখানের একটা কটেজে দুই দিন তিন রাত বুকিং দিয়েছে অনি।
‘আমরা কবে যাচ্ছি?’
‘আগামীকাল। এবং আমরা নয় তুমি যাচ্ছো। এখনি ব্যাগ গোছাও। একটা উইমেন গ্রুপের সাথে বুকিং দিলাম। একলাও থাকতে হবে না। এবং, বাচ্চাদের নিয়ে ভেবো না। আমি পুরো একটা উইক ছুটি নিয়েছি। ঘর সামলানো তোমার মত হয়ত পারব না। তবে, যা পারি তাই নিয়ে তোমাকে হ্যাপি থাকতে হবে। ফিরে এসে এলোমেলো দেখলে আমার ওপর চোটপাট করতে পারবে না।‘
‘তনু-টুনু? ওরা একা থাকবে কেমন করে?’
‘তোমার কাছে একা থাকে, তেমন করে থাকবে৷ আমি তোমার মত একুরেট করতে পারব না। ওরা মানিয়ে নেবে। নিজের কিছু কাজ নিজেরা করবে। ‘

অনিন্দ্য মিলির কাঁধ ধরে ওকে নিজের দিকে ঘোরায়। মিলি ঘাবড়ে গেছে। চোখে মুখে আনন্দ ও সংশয় দোলাচল জাগে। অনিন্দ্যর দেয়া উপহার ওর বিশ্বাস হয় না৷ আবার একে ফেলে পুনরায় সংসারে ডুবে যেতেও মন সায় দেয় না।
‘ঘুরে আসো মিলি। একদম নিজের মত করে কয়েকটা দিন কাটিয়ে সব শংকা, মন খারাপ, কষ্ট, হাহাকার পাহাড়ের বুকে জমা রেখে আসো। তুমি ফিরে আসলে সামনের ছুটিতে আমরা সমুদ্র দেখতে যাবো। ‘

মিলি অনিন্দ্যের বুকে কান পাতে। ওখানে সমুদ্র সফেন ঠেউয়ে ভালোবাসার পদাবলি শোনা যায়। দূরত্ব থেকেও কাছে আসা যায়, আসতে জানতে হয়। বৃত্তাকার পৃথিবী পথ হেঁটে বিশ্বজয় করার চাইতে কঠিন কাজ আপনজনের মন জয় করে নেয়া। ভালোবাসতে জানলে তাও হয় সহজ, সুন্দর। মিলির চোখ জলে চিকচিক করে। সায়েম আবারো জানতে চায়, ব্লাকের কনসার্টে মিলি যাবে কি না। মিলি অনির বুকে মাথা রেখেই ম্যাসেজ করে, ‘আগামীর কয়েকটা দিন আমি পাহাড়ে কাটাব। কোথাও যাওয়া হবে না। তারপর সমুদ্র, বন্ধু। ফিরে আসি। কথা হবে।‘

অনিন্দ্য আজ সারাদিন ধরে সাদাত হোসেনের কবিতা পড়েছে। ভয়ে ভয়ে মিলির কপোল চুমে চোখ বন্ধ করে তাই পড়ার চেষ্টা চালায়। মিলি শক্ত হাতে অনিকে জড়িয়ে ধরে কবিতা শোনে। ওর মন খারাপেরা কর্পূর হয়ে উড়ে চলেছে পাহাড় চুড়োয়। কাল তাকে সাদা মেঘের ভেলায় চড়িয়ে এক ফুঁৎকারে শূন্যে বুনোফুলের গন্ধ মেখে ভাসিয়ে দিতে মিলি আসছে, পাহাড়ের কাছে।

শোনো
কাজল চোখের মেয়ে
আমার দিবস কাটে, বিবশ হয়ে
তোমার চোখে চেয়ে।

দহনের দিনে কিছু মেঘ কিনে
যদি ভাসে মধ্য দুপুর
তবু মেয়ে জানে তার চোখ মানে
কারো বুক পদ্মপুকুর।

এই যে মেয়ে কাজল চোখ
তোমার বুকে আমায় চেয়ে
তীব্র দাবির মিছিল হোক
তাকাস কেন? আঁকাস কেন
বুকের ভেতর আকাশ?
কাজল চোখের মেয়ে
তুই তাকালে থমকে থাকে
আমার বুকের বাঁ পাশ।(সাদাত হোসেন)

(সমাপ্ত)