মিষ্টির তনুদা পর্ব-০৫

0
2

#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৫

মিষ্টির ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মিষ্টি খাটের মধ্যিখানে বউ সেজে চুপটি করে বসে আছে। মিষ্টিকে ঘিরে তনুর সব কাজিনরা গোল হয়ে বসল। সবার মুখে হাসি লেগে আছে। সবাই গল্প আড্ডায় মসগুল হয়ে রইল। রিতু মিষ্টির কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
-”আমি কিন্তু এখন মেয়েপক্ষ। কারণ মিষ্টি আমার বেস্টফ্রেন্ড।

তনু-মিষ্টির বিয়ের মণ্ডপ ছাদের একপাশে করা হয়েছে। অন্যপাশে খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে।

তনু জুতা জোড়া পায়ে নিয়েই স্টেজে উঠে বসেছে।
মিষ্টির ভাই তমাল অনেকক্ষণ ধরেই তনুর জুতা লুকানোর জন্য খুঁজছিল। হঠাৎ তনুর পায়ে জুতা জোড়া দেখে চিল্লিয়ে উঠল। বলল,
-‘একি একি.. আপনি জুতা পায়ে খাটে উঠছেন কেন?
তনু ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে জুতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখিয়ে বলল,
-‘নতুন জুতা। আজই কিনেছি। একটুও ময়লা লাগেনি। বিশ্বাস কর?
-‘তাই বলে জুতা পায়ে পরে বসবেন?
-‘তো কী করব? তোরা একেকটা যে চোর। শেষে দেখা যাবে। আমি আছি আমার জুতা নেই। ছোটোবেলা থেকেই আমার জুতার প্রতি অসম্ভব দুর্বলতা। তোরা তো জানিস। তাই জুতা নিয়ে আমি কোনো রিস্ক নিতে পারব না। তনু ঢঙ করে কথাগুলো বলল।
তমাল চোখ বড় বড় করে তাকাল। বলল,
-‘আপনি কী রসিকতাও বুঝেন না?
-‘রসিকতা করতে ভালো লাগে। কিন্তু তোরা আমার জুতা চুরি করে আমার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিবি৷ এটা আমার একটুও ভালো লাগবে না।
রিতু ভেঙচি কেটে বলল,
-‘তুমি অনেক কিপ্টে দাদা।
-‘যা ভাগ? একে তো চুরি করবে। আবার বলে আমি নাকি কিপ্টা। কোথাও শুনেছিস? চোরকে দয়া দেখিয়ে নিজের জিনিস কেউ দিয়ে দেয়। এ্যাঁই..অনিক? তোরা কিছু বলছিস না কেন?
অনিক অন্যদিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। প্রতিবেশী বিয়ে দেখতে ওর বেশ লাগছে।

মিষ্টি যেভাবে বিয়ের আগে তিড়িংতিড়িং করে বিয়েটা ভাঙার জন্য মরিয়া হয়েছিল। তনু একটু ভয়েই ছিল বৈকি। মিষ্টি বিয়ের সময় না আবার ক্যাচাল করে। শেষে দেখা গেল। মিষ্টি বিয়ের সময় কোনোরকম টু শব্দও করল না। চাবি দেওয়া পুতুলের মতো সবার সবকথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল।
অবশেষে তনু-মিষ্টির সাজুবিয়ে ভালোভাবেই সম্পূর্ণ হলো।

রাতে তনু-মিষ্টি সহ তনুর সব কাজিনরা একসাথে খেতে বসল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তনু নিজেদের বাসায় চলে যেতে চাইল। সবগুলো কাজিন হৈ হৈ করে উঠল৷ অনিক বলল,
-‘এ-কী? আজ তুই যাবি কেন?
মিষ্টি মনে মনে আঁতকে উঠল। তনুদা আজ রাতে এই বাড়িতে থাকলে নিশ্চিত মিষ্টির ঘরে থাকবে। এই গণ্ডারটার সাথে একঘরে থাকার একটুও ইচ্ছে নেই মিষ্টির। হাজার হোক নতুন বউ। মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না মিষ্টি। তবে মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে। তনু মিষ্টির মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘বেশ তোরা যখন এত করে বলছিস। তাহলে আজ রাতটা থেকেই যাই বরং। কিন্তু আমি ঘুমাব কোথায়? রিতু চট করে বলল,
-‘কেন.. মিতুর ঘরের ফ্লোরে।
রিতুর কথাশুনে সবাই হেসে ফেলল।
তনুর বিশাল কাজিনগ্রুপ। তনুর দুই মাসি। চার মামা। মেসোতো ভাই-বোন পাঁচজন এসেছে। মামাতো ভাই-বোন ছয়জন উপস্থিত আছে। তনুর কাকাতো-জেঠাতো ভাই-বোন দিয়ে মোট কুড়ি জন এখানে উপস্থিত আছে। তনু-মিষ্টির বিয়ে উপলক্ষে আজ সবাই এসেছে। সবাই একসাথে রাত দুটো পর্যন্ত মিষ্টির ঘরে বসে আড্ডা দিল। গল্প, গানে সময় কেটে গেল। তারপর যে যার মতো শুতে চলে গেল।
তনু মিষ্টির ঘরের বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। বলল,
-‘তোর ঘরে এত গরম কেন রে মিষ্টি?
-‘আপনি আবার থেকে গেলেন কেন?
-‘কী করব বল? সবাই এত কষ্ট করে ঘরটা সাজিয়েছে। আমি আজ এই ঘরে থেকে না গেলে ওরা সবাই মন খারাপ করতো। ওদের বড়দাদা হিসাবে ওদের মন খারাপ দেখা তো আমার দায়িত্ব। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আয় মিষ্টি? মাথাটা দপদপ করছে। একটু টিপে দে?
রাগে মিষ্টির শরীর জ্বলে গেল। গণ্ডারটার কতবড় সাহস। একে তো পুরো বিছানা দখল করে শুয়ে আছে। আবার বলছে, মাথা টিপে দিতে হবে। মিষ্টি চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘আপনি এখুনি চলে যান তনুদা। আর ঘরটা মোটেও আপনার জন্য সাজানো হয়নি। আমি বউ সেজে ঘরে বসেছিলাম। ভিডিও করার জন্য ঘরটা সাজানো হয়েছে।
তনু দায়সারা ভাবে বলল,
“আমি যেতে চাইলেও তোর বাবা-মা যেতে দেবে না।
“কেন যেতে দেবে না? অবশ্যই যেতে দেবে। আপনার বাড়ি তো আর পাঁচ মাইল দূরে না।
“বাড়ি দূরে নাহলেও আজ রাতে বর-বউকে একসাথে থাকতে হয়। এটা নিয়ম।
“এই নিয়ম মানি না আমি। আপনি এখুনি চলে যাবেন।
তনু একলাফে উঠে দাঁড়াল। চট করে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়ে, মিষ্টির মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়াল। ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
-‘কোথায় যাব আমি?
মিষ্টি শুকনো ঢোক চিপল। তবে দমে গেল না। অকপটে বলল,
-‘আপনার ঘরে।
-‘মাঝরাতে আমার লোক হাসানোর কোনো ইচ্ছে নেই। তোর সমস্যা হলে তুই চলে যা।
-‘কোথায় যাব আমি? আজব তো!
তনু তেজি কণ্ঠে বলল,
-‘কী ভাবিস তুই নিজেকে, রানী ভিক্টোরিয়া? তোর সাথে শোবার জন্য আমি মরে যাচ্ছি না মিষ্টি। তুই কী জানিস, আমার সাথে শোবার জন্য কত মেয়েরা পাগল।
-‘ছিঃ..
-‘এখন ছিঃ ছিঃ করছিস কেন? বেশ.. তুই যখন চাস আমি তোর সাথে না থাকি। ওকে থাকব না আমি। তবে এখন আমি সোজা বাড়ি চলে যাব। কেউ যদি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে। আমি বলব, আমার বউয়ের প্রেমিকের সাথে ফোনে কথা বলতে ডিস্টার্ব হচ্ছে। এই নিয়ে আমার সাথে তুমুল ঝগড়া করেছে দেখে, আমি বাড়ি চলে এসেছি।
কথাগুলো বলেই তনু গটগট করে চলে যেতে নিল। মিষ্টি ভয়ে আঁতকে উঠল। পেছন থেকে তনুর পাঞ্জাবির কোণা শক্ত হাতে টেনে ধরল। তনু অন্যদিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে একটুখানি হাসল। মিষ্টি নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘আপনি কোথাও যাবেন না তনুদা।
-‘এখনো বোকার মতো দাদা..দাদা করছিস কেন মিষ্টি? একটু আগেই না দাদা থেকে ‘বর’ হয়ে গেলাম?
মিষ্টি বিস্ময় খেল। সেই ছোট্টবেলা থেকে তনুকে দাদা ডেকে অভ্যস্ত মিষ্টি। এখন নতুন করে কী নামে ডাকবে। বুঝতে পারছে না মিষ্টি। তনু মিষ্টিকে আবারও বলল,
-‘এত সেজেছিস কেন? যা শিগগিরই মেকাপ তুলে আয়।
মিষ্টি বাথরুমে চলে গেল। তনুও ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে একটা হাফপ্যান্ট আর হাতাকাটা ফুলতোলা সফট্ গেঞ্জি পরল। ভাগ্যিস পোশাকটা অনিককে দিয়ে আগেই আনিয়ে রেখেছিল তনু। আজ যে গরম পড়েছে। তনু ব্যালকনিতে চলে গেল। মাথায় একশো একটা চিন্তা৷ হাতে জলন্ত সিগারেট একটু একটু করে পুড়ছে। কখনোবা সিগারেটে লম্বা টান দিচ্ছে তনু।
অনেকক্ষণ পর মিষ্টি বাথরুম থেকে বের হলো।
মিষ্টির কোমল স্নিগ্ধ জলে ভেজা মুখে জলের ছোট ছোট কণা ঝরে পড়ছে। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। মুখে কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই। গায়ে পাটভাঙা সুতি শাড়ি। দেখতে খুব স্নিগ্ধ লাগছে মিষ্টিকে। মিষ্টিকে তো আগে হাজারবার দেখেছে তনু৷ কখনো তো এমন অস্থির লাগেনি? তবে আজ এমন লাগছে কেন তনুর? তনু অর্ধখাওয়া সিগারেটটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে, একপায়ে দুপায়ে মিষ্টির দিকে এগিয়ে এলো। মিষ্টির কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ভেজা চুলগুলো একহাত দিয়ে কানের পিঠে গুঁজে দিল৷ মিষ্টি হতবিহ্বল হয়ে এক জায়গায় মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ভেতর ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। মনটা খুব অশান্ত। তনুর অবাধ্য হাতদুটো থেমে নেই। চুল ছেড়ে মিষ্টির ঘাড়ে হাত রাখতেই মিষ্টির ঘোর কেটে গেল। ছিটকে দূরে সরে গেল। তনু থতমত খেল৷ খুব দ্রুত নিজেকে সামনে নিয়ে বলল,
-‘চিংড়ি মাছের মতো লাফাচ্ছিস কেন মিষ্টি? তোর ঘাড়ে একটা বিছে পোকা ছিল। হাত দিয়ে ফেলে দিলাম। এইজন্যই বলে, বিনা পয়সায় লোকের সেবা করতে নেই। শিগগিরই দরজা খুলে দিয়ে আয়। তোর বাড়ির লোক আবার উল্টাপাল্টা কিছু ভাববে। আর ফ্লোরের বিছানাটা ভালো করে ঝেড়ে দে। আমি ঘুমাব।

তনুদা ফ্লোরে শুতে শুতে চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“এসব বালের নিয়ম কে বানায় কে জানে! বিয়ের দিন নাকি ফ্লোরে ঘুমাতে হয়। যতসব ঢঙের কাণ্ডকারখানা।

চলবে