মিষ্টির তনুদা পর্ব-০৮

0
4

#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৮

-‘যাক্.. আমায় চিনতে পেরেছ তাহলে! কেমন আছ তনু?
-‘আছি ভালো। প্লিজ ঘরে এসে বসো।
গৌরব ঘরে গিয়ে মিষ্টিকে দেখে বেশ চমকাল। মিষ্টি তনুর সাথে বন্ধ ঘরে একাকী কী করছিল? ঠিক বুঝতে পারল না গৌরব। তবে ওর একটুও ভালো লাগল না।
-‘সরি। অসময়ে বোধহয় তোমাদের ডিস্টার্ব করলাম। আসলে পিসি-ই বলল তুমি ঘরে আছো। গৌরব মিষ্টির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল। তনু হেসে ফেলল। গাল চুলকে বলল,
– আরেহ না…তেমন কিছু না।
তনু চেয়ার টেনে গৌরবকে বসতে দিল। গৌরব বসল। টেবিলে একটা বই ফ্যানের বাতাসে এলোমেলো উড়ছে। গৌরব বইটা টেনে নিল। কলেজের ইংরেজি বই। বলল,
-‘এই বই দিয়ে কী করছিলে তনু?
তনু মিথ্যে করে বলল,
-‘মিষ্টিকে পড়া দেখিয়ে দিচ্ছিলাম।
গৌরব হাফ ছেড়ে বাঁচল। মিষ্টি তাহলে পড়তেই এসেছে। অথচ গৌরব কি-না কী ভাবছিল। তবে দরজা-জানালা বন্ধ করে পড়তে হবে কেন? থাক এত ভেবে কাজ নেই। তনু এমন কিছু করবে না। যা-তে মিষ্টির অসম্মান হয়।
মিষ্টির খুব বিরক্ত লাগছে। কিছুতেই দুজনের কাঠখোট্টা কথার মাঝখানে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। ইশ..মানুষটা আর একটু হলেই মিষ্টির মাঝে ডুবে যেত। গৌরবের কথার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে, সহজে যাবে না। অগত্যা মিষ্টি উঠে দাঁড়াল। বলল,
-‘আমি এখন আসি।
তনু বলল,
-‘আচ্ছা যা..
মিষ্টির দেখাদেখি গৌরবও উঠে দাঁড়াল। আসলে এই সময়ে ইচ্ছে করেই গৌরব তনুর সাথে দেখা করতে এসেছে। গৌরব একটু আগে জানালা দিয়ে দেখেছে, মিষ্টিকে এই বাড়িতে আসতে। অনিককে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, তনু দাদা এসেছে। চট করেই একটা অজুহাত পেয়ে গেল গৌরব।

গৌরব বলল,
-‘আমিও যাব মিষ্টি। চলো একসাথে যাই।
মিষ্টির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে তনুর মুখের দিকে তাকাল। তনু এমন ভাবে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। মিষ্টি যদি ভুলেও রাজি হয়। তাহলে আজ চোখ দিয়েই গিলে ফেলবে তনু মিষ্টিকে। মিষ্টি বার কয়েক শুকনো ঢোক চিপল। বলল,
-‘আপনি গল্প করুন। আমার একটু তাড়া আছে।
-‘আরেহ.. সমস্যা নেই। আবার পরে আসব। তুমি চলো তো..
তনু মুখে বলল,
-‘কিরে.. নিয়ে যা গৌরবকে।
কিন্তু চোখ দিয়ে ইশারায় মানা করল। বোকা মিষ্টি তনুর ইশারা বুঝতে পারল না। সরল মনে গৌরবকে বলল,
-‘আচ্ছা তাহলে চলুন।
তনু ভেতরে ভেতরে জ্বলে গেল। অতিরিক্ত রাগে সর্বশরীর কাঁপছে। ভুল হয়েছে। বড্ড ভুল হয়েছে। মিষ্টি যে তনুর বউ এই কথাটা গৌরবকে সরাসরি বলে দেওয়া ভালো ছিল। গৌরবটাও গাধা নাকি। কিছুদিন যাবৎ এই বাড়িতে আছে। অথচ এখনো জানে না। মিষ্টি বিবাহিত। নাকি জানে! জেনেও এমন করছে।

দুজন পাশাপাশি দূরত্বে হাঁটছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গৌরব বলল,
-‘চলো একটু ঘুরে আসি।
মিষ্টি বলল,
-‘আমি এখন কোথাও যাব না। দুদিন পর আমার পরীক্ষা। পড়তে হবে।
-‘আরেহ.. চলো তো। কিছুই হবে না।
কথাটা বলেই আলতো করে মিষ্টির একহাত ধরে ফেলল গৌরব। মিষ্টি ভড়কে গেল। একটু পেছন ঘুরে উপরের দিকে তাকাল। হায়..মানুষটা জানালার কার্ণিশে দাঁড়িয়ে ওদেরকেই দেখছে। ভয়ে মিষ্টির পেটের ভেতর কাঁপন ধরে গেল। মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেল। গৌরব কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ গৌরববের হাত থেকে জোর করে নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে বাসায় চলে গেল মিষ্টি।

সারাদিন আজ ভ্যাপসা গরম ছিল। রাতে আকাশ কাঁপিয়ে মুষলধারে ঝুমবৃষ্টি নামছে। মিষ্টি সেই দুপুর থেকে তনুকে ফোন দিচ্ছে। জেদি, একগুঁয়ে, রগচটা মানুষটা কিছুতেই মিষ্টির ফোন ধরছে না। রাগারাগি করুক, বকুক। যা খুশি করুক। তবুও ফোনটা তো ধরুক। আগে হলে, এক দৌড়ে ওই বাড়িতে কোনো একটা বাহানায় চলে যাওয়া যেত। এখন খুব লজ্জা লাগে। সবাই আবার কি-না কী ভাববে। মিষ্টির অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। এদিকে তনুকে জানালা দিয়েও দেখা যাচ্ছে না। মানুষটা জানালা বন্ধ করে বসে আছে। মিষ্টি আর থাকতে না পেরে তনুর ছোটবোন তনুশ্রীকে ফোন দিল। বলল,
-‘ফোনটা একটু তোর দাদাকে দে না প্লিজ?
-‘কেন দাদার ফোন কী হয়েছে?
মিষ্টি অভিমান করে বলল,
-‘জানি না।
-‘আচ্ছা একটু ওয়েট করো.. দিচ্ছি।

-‘মিষ্টিদি থুক্কু বউদি ফোন দিয়েছে। তোর সাথে কথা বলবে।
তনুশ্রীর হাতে ধরে রাখা ফোনটা তনুর দিকে বাড়িয়ে দিতেই তনু ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বোনের সামনে সিনক্রিয়েট করতে ইচ্ছে করল না। তনু ফোন কানে চেপে ধরে মিষ্টিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,
-‘আমার ফোনে ফোন দে। আমি রিসিভ করছি।
কথাটা বলেই ফোনের লাইন কেটে দিয়ে ফোনটা তনুশ্রীর হাতে দিয়ে দিল তনু। তনুশ্রী চলে যেতেই ফোন রিসিভ করে তনু রাগী কণ্ঠে বলল,
-‘তুই এত বেহায়া কেন রে মিষ্টি? যেহেতু দেখছিস ফোন ধরছি না। এতবার ফোন দেওয়ার কী আছে?
-‘আপনি আসুন প্লিজ।
-‘কোথায় যাব?
-‘আমার ঘরে।
-‘কেন?
-‘আমার ভালো লাগছে না।
-‘আমি কী ভালোলাগার ঔষধ?
-‘হুঁ..
তনু রহস্য করে বলল,
-‘গৌরব তো আছেই। ওকে ডেকে নে। বৃষ্টির রাত। খুব জমবে কিন্তু।
রাগে মিষ্টির নাকের পাটা ফুলে উঠল। চোখ দিয়ে অঝরে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। ভেজা কণ্ঠে বলল,
-‘সত্যি সত্যিই ডেকে নেব কিন্তু?
-‘নে..তোর কতবড় কলিজা আমিও দেখি।
-‘দেখতে চান আমার কতবড় কলিজা?
-‘দেখা…
-‘ওকে লাইনেই থাকুন। আমি যাচ্ছি।
-‘যা..
ফোন রেখে মুখে ওড়না গুঁজে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল মিষ্টি। তনুর সাথে জেদ করে সত্যি সত্যিই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাসার বাইরে গিয়ে রাস্তা পার হয়ে তনুদের বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি ভেঙে দু’কদম হাঁটতেই তনু কোথা থেকে যেন ছুটে এলো। একহাত দিয়ে মিষ্টির মুখ চেপে ধরে, মিষ্টিকে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে গেল। বাইরে তখনো মুষলধারে বৃষ্টি। ওরা ছাদে গিয়ে দাঁড়াতেই দুজনই বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে গেল। তখন গৌরব মিষ্টির যে হাতটা ধরেছিল। তনু শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে মিষ্টির সেই হাতটা মুচড়ে ধরল। চোখ রাঙিয়ে বলল,
-‘আমাকে ছুঁয়ে কথা দেওয়ার পরও তুই কেন গৌরবের সাথে গেলি?
মিষ্টি ব্যথায় কুঁকড়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল,
-‘আপনিই তো বলেছিলেন।
-‘আমি বলেছি?
মিষ্টি চোখ তুলে তাকাল। তনুর রক্তলাল চোখদুটো দেখে ভয়ে চুপসে গেল মিষ্টি। মানুষটার ভেজা টি-শার্ট গায়ের সাথে লেগে গেছে। ভেঁজা চুলগুলো দিয়ে বৃষ্টির জল ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে। দেখতে অন্যরকম সুন্দর লাগছে।
মিষ্টি একটা লং হাতার বাটিকের থ্রি-পিস পরা ছিল। জর্জেটের ওড়নাটা গলায় পেঁচানো। জামা গায়ের সাথে এঁটে-সেটে লেগে আছে। ভেজা শরীরের প্রত্যেকটা বাঁক স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ল্যাম্বপোস্টের মৃদু আলোতে মিষ্টিকে অপার্থিক রূপে দেখে তনুর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। বুকের ভেতর অনাবিল সুখ সুখ নিষিদ্ধ অনুভূতি। তনু শুকনো ঢোক গিলল। খুব সাবধানে মিষ্টিকে নিজের কাছে টেনে নিল। দূরে কোথাও বিকট শব্দে বজ্রপাত হলো। প্রকাণ্ড কম্পিত শব্দ জমিনের বুকে ধেয়ে আসতেই মিষ্টি ভয় পেয়ে তনুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। দুজনের রাগ, জেদ, অভিমান, অনুরাগ, বৃষ্টির জলের সাথে ধুয়ে-মুছে বিলীন হয়ে গেল। বুকে কামনার সুর বেজে উঠল। তনুর হুঁশ ফিরতেই নিজেকে সামলে নিল। মিষ্টির কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল। মিষ্টি ছাড়ল না। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরল তনুকে। তনু কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-‘ছাড় মিষ্টি? সামনে তোর পরীক্ষা। এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে।
-‘আসুক।
-‘জেদ করিস না। চল?
-‘না।
তনু মিষ্টিকে চট করে কোলে তুলে নিল। মিষ্টিকে উপেক্ষা করার সাহস বা শক্তি আজ তনুরও নেই। মনটা খুব নাজুক হয়ে আছে। তনু মিষ্টিকে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে গেল। ভেতর থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। মিষ্টি তখনো তনুর গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে আছে।
তনু মিষ্টিকে আস্তে করে খাটে বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসল। মিষ্টির ভেজা গালে তর্জুনী দিয়ে স্পর্শ করতেই আবেশে কেঁপে কেঁপে উঠল মিষ্টি। মিষ্টির গালে লম্বা রেখা টেনে গলা পর্যন্ত স্পর্শ করতেই আবেশে চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল মিষ্টি। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা শব্দ হচ্ছে। নিঃশ্বাস খুব দ্রুত ওঠা-নামা করছে। তনু মিষ্টির কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘আমাদের জীবনের বিশেষ একটা রাত এত সাদামাটা ভাবে শুরু হতে পারে না। আর কিছুদিন..
তনু কথাটা শেষ করতে পারল না। মিষ্টি তনুর শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে উন্মুক্ত বুকে মুখ গুঁজলো। আদরে আদরে তনুকে বেসামাল করে দিল। মিষ্টির মেয়েলি স্পর্শে তনুর ভেতরের পুরুষসত্তা জাগ্রত হয়ে উঠল। মিষ্টির মুখখানি আঁজলায় তুলে ধরে, মিষ্টির ভেজা চোখের পাতায় গাঢ় চুমু এঁকে দিল। মিষ্টির উন্মুক্ত কোমরে হাত রাখতেই মিষ্টি ছটফটিয়ে উঠল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। ঠিক তখনই তনুর সবগুলো কাজিন হৈ হৈ করে ছাদে ওঠে এলো। সবাই একসাথে সেই ছোট্টবেলার মতো বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। রিতু চিলেকোঠার ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
-‘এ্যাঁই.. মিষ্টি? কাকিমা বলল তুই নাকি ছাদে আছিস। এখানে কী করছিস? চলে আয়? আমরা সবাই বৃষ্টিতে ভিজছি।
মিষ্টির ঘোর কেটে গেল। একরাশ লজ্জা ওর চোখ-মুখ ছুঁয়ে গেল। মুখজুড়ে লাজ্জেরাঙা রক্তিম আভা ফুটে উঠল। তনু হেসে ফেলল। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে গেল।
তারপর রিতুকে নিচু কণ্ঠে কিছু বলতেই রিতু দৌড়ে নিচে নেমে গেল। একটা ভারি বড় ওড়না এনে তনুর হাতে দিতেই তনু মিষ্টিকে ওড়নাটা দিয়ে বলল,
-‘এটা দিয়ে ভালো করে শরীর ডেকে বাইরে আয়।
মিষ্টি বাধ্য মেয়ের মতো তনুর কথামতো ওড়না শরীরে পেঁচিয়ে নিল। ওরা দুজন ছাদে আসতেই অনিক সিটি বাজাল। এখন কেন যেন মিষ্টির খুব লজ্জা লাগছে। এভাবে যে ওদের কাছে ধরা পরে যাবে। মিষ্টি বুঝতেই পারেনি। ততক্ষণে গৌরবও ছাতা হাতে ছাদে চলে এসেছে।
অনিক আবদার করে তনুকে বলল,
-‘দাদা একটা গান ধরো না?

(চলবে)