মিষ্টির তনুদা পর্ব-০৯

0
4

#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৯

তনু মোহাচ্ছন্ন হয়ে একপলক মিষ্টির দিকে তাকাল। বৃষ্টির জল মিষ্টির চোখ-মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে। মিষ্টিকে দেখতে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। মায়া মায়া মুখটা একরাশ স্নিগ্ধতায় ঘেরা। তনু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল। কণ্ঠে সুর ঢেলে চিরচেনা গানটা গেয়ে উঠল।

আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
আমার দিনগুলো সব রং চিনেছে
তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
তুমি চোখ মেললেই, ফুল ফুটেছে
আমার ছাদে এসে।
ভোরের শিশির ঠোঁট ছুঁয়ে যায়
তোমায় ভালোবেসে।

আমার ক্লান্ত মন, ঘর খুঁজেছে যখন-
আমি চাইতাম, পেতে চাইতাম
শুধু তোমার টেলিফোন।
ঘর ভরা দুপুর, আমার একলা থাকার সুখ।
রোদ গাইতো, আমি ভাবতাম
তুমি কোথায়, কতদূর?

আমার বেসুরো গিটার সুর বেঁধেছে
তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
আমার একলা আকাশ চাঁদ চিনেছে
তোমার হাসি হেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।

তনুর গানের কণ্ঠ সুন্দর। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে মুগ্ধ হয়ে গান শুনছিল। তনু গান শেষ করতেই সবাই হাততালি দিল। মিষ্টি তনুর মুখোমুখি বসেছিল। তনু গানের পুরোটা সময় মিষ্টির চোখের দিকে তাকিয়ে গান গেয়েছে। একরাশ লজ্জা মিষ্টির চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে। মনের ভেতর রঙিন প্রজাপ্রজি উড়ছে। মিষ্টির মনে হলো তনু যেন গানের প্রতিটা কথা মিষ্টিকেই উৎসর্গ করেছে। এই সুন্দর রাত, আকাশে অর্ধ ডুবন্ত চাঁদ। রাতের গা বেয়ে মুষলধারে বৃষ্টি। পাশে প্রিয় মানুষ। প্রিয় মানুষের জাদুকরী কণ্ঠে পছন্দের গান। সুখী হওয়ার জন্য একজীবনে আর কী চাই? তবে এখন আশেপাশে এত কোলাহল, এত মানুষ আর ভালো লাগছে না। ইশ, এখন যদি শুধু মিষ্টি আর তনু থাকতে পারতো! তাহলে আজকের রাতটা ওদের জীবনে বসন্ত হয়ে ধরা দিতো৷ কেন সবাই চলে যাচ্ছে না? কেন মিষ্টির অবুঝ মনের ছটফটানি কেউ বুঝতে চাইছে না? এখন সবাইকেই অসহ্য লাগছে। মুখ ফুটে যে বলবে, তোমরা সবাই চলে যাও..তাও পারছে না। লজ্জা লাগছে খুব।
ওদের সবার মাঝখান থেকে গৌরব দুঃসাহসিক কাজ করে বসল। এতক্ষণ মিষ্টিতেই মগ্ন ছিল গৌরব। কিছু কিছু মানুষকে প্রথম দেখায়, প্রচন্ড ভালো লেগে যায়। গৌরবেরও মিষ্টিকে খুব ভালো লেগেছে। এই মেয়েটাকে বিয়ে করলে, সুখে-শান্তিতে দিব্যি একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে।
ছেলেরা প্রেমের বাজারে কলেজ, ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে খুঁজলেও বিয়ের বাজারে অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়ে পছন্দ করে। গৌরবও সেকেলে মনোভাবের উর্ধ্বে নয়। হঠাৎ মিষ্টির সামনে হাঁটু মুড়ে বসল গৌরব। একহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” উইল ইউ ম্যারি মি?”

সবাই চমকে উঠল। অনিক দাঁতে জিভ কাটলো। বড্ড ভুল হয়ে গেছে। গৌরবকে আগে বলা উচিৎ ছিল। তনুদাদার সাথে মিষ্টির বিয়ে হয়ে গেছে। বরের সামনে বসে বউকে বিয়ের প্রপোজ করার মতো ভয়ংকর কাণ্ড আর দুটো হয় না। তনু হতভম্ব হয়ে গেল। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠতেই মনটা তিতা বিষে ভরে গেল। ইচ্ছে করছে গৌরবকে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় মারতে। রাগে গা কাঁপছে। কপালের শিরা ফুলে উঠেছে।
ব্যাটার সাহস কত বড়। ওরই সামনে ওর বউকে প্রপোজ করছে। তনু একটানে মিষ্টিকে নিজের কোলের মাঝে বসিয়ে দিল। মিষ্টি লজ্জায় নুইয়ে গেল। গৌরব তনুর কাণ্ড দেখে হতবাক হয়ে গেল। তনু মিষ্টির ঘাড়ে নাক ঘঁষে রহস্য করে হাসল। মিষ্টির ঘাড়ে চিবুক রেখে গৌরবের চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“মিষ্টি আমার বউ।”

মিষ্টি কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর শিরশিরে অনুভূতি। ভালোলাগায় সুখ সুখ আবেশে মনটা পুলকিত হলো। বুকটা গর্বে ভরে গেল। উফ, মানুষটা বলিষ্ঠ কণ্ঠে কতটা দৃঢ় ভাবেই না বলল, “মিষ্টি আমার বউ।” কথাটা মনে মনে বার কয়েক আওড়াল মিষ্টি।
গৌরব চুপ হয়ে গেল। তনুর কথাটা বোধহয় মস্তিষ্ক সহজ ভাবে হজম করতে পারল না। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। মুখটা অপমানে থমথমে হয়ে গেল। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল গৌরব। একবার বোকার মতো মিষ্টির দিকে তাকাল তো আরেকবার তনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘আগে বলোনি তো?
তনু বলল,
-’আমি জানতাম না। যে তুমি জানো না।
গৌরব বিড়বিড় করে বলল,
“মিষ্টিকে দেখে বোঝার উপায় নেই। যে ও বিবাহিত।
মিষ্টি তখনই জামার হাতা গুটিয়ে ঝকঝকে সাদা শাঁখা বের করল। হাতের শাঁখাদুটো এমনভাবে বের করল যেন সরসরি গৌরবের চোখে পড়ে।
অনিক পরিবেশ স্বাভাবিক করতে গৌরবকে বলল,
-‘দাদা চলো তো। মামী বোধহয় ডাকছে তোমাকে।
গৌরবের পা চলে না। তবুও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। কোনো এক জাদুবলে যদি, মিষ্টির বিয়েটা মিথ্যা হয়ে যেত। তাহলে গৌরব ঠিকই মিষ্টিকে বিয়ে করে নিতো। এটা তো রূপকথার গল্প না। অতএব মিষ্টির বিয়ে মিথ্যা হওয়ার চান্স নেই। বুকের ভেতর এত কেন কষ্ট হচ্ছে? মিষ্টিকে তো খুব বেশিদিন ধরে চিনেও না গৌরব।
গৌরব চলে যেতেই ঘড়ি দেখে একে একে সবাই উঠে দাঁড়াল। অনেক রাত হয়েছে। যে যার ঘরে চলে গেল।
শুধু বসে রইল তনু আর মিষ্টি। বৃষ্টি ঝরে এসেছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। একপশলা বাতাস ওদের শরীর ছুঁয়ে যেতেই শীত শীত অনুভূতি হলো। মিষ্টি বলল,
-‘চলুন। আমরাও যাই।
-‘আমি এখন তোর সাথে তোর ঘরে যাব মিষ্টি।
মিষ্টি কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। বলল,
-‘কেন?
-‘তোর সাথে থাকব।
-‘না।
-‘তাহলে তুই আমার ঘরে চল?
-‘না। মা কী ভাববে? আমার খুব লজ্জা লাগছে।
-‘তাহলে আমাকে তোর বাসায় নিয়ে চল?
-‘আজ না প্লিজ..
-‘আজই।
মিষ্টি অসহায় বোধ করল। বলল,
-‘এত জেদ করছেন কেন তনুদা?
-‘নেক্সট টাইম আমাকে যেন আর দাদা না ডাকতে পারিস। তার ব্যবস্থা করব আজ আমি।
মিষ্টির মুখটা শুকিয়ে গেল। লুকিয়ে দেখা করা আর একঘরে থাকা। দুটো আলাদা ব্যাপার।
মিষ্টি নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘আপনার তো জামা-প্যান্ট ভেজা।
-‘তো কী হয়েছে? তোর বাবার লুঙ্গি পরব।
-‘ধ্যুৎ..আমি পারব না।
-‘কেন আমি কী তোর প্রেমিক লাগি? যে আমাকে তোর বাসায় নিয়ে যেতে এত লজ্জা পাচ্ছিস? তাছাড়া আমি আমার শ্বশুরবাড়ি যাব। তোর কী?
মিষ্টি লাজুক কণ্ঠে বলল,
-‘আচ্ছা চলুন তবে।

তনু মিষ্টিদের বাড়িতে গিয়ে মিষ্টির মাকে বলল,
-‘আমি কিন্তু আসতে চাইনি কাকিমা। মিষ্টিই আমাকে জোর করে নিয়ে এলো৷
মিষ্টি অতিরিক্ত লজ্জায় নুইয়ে গেল। ছিঃ..মানুষটা কত অকপটে মিথ্যা কথা বলল।
নতুন জামাই বিয়ের পর এই প্রথমবার এসেছে। মিষ্টির মা ব্যস্ত হয়ে গেলেন। বলল,
-’তুমি এসেছ আমি খুব খুশি হয়েছি। তুমি বরং ভেজা পোশাক পাল্টে নাও বাবা। এ্যাঁই.. মিষ্টি? ওভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শিগগিরই যা..তনুকে শুকানো জামা-প্যান্ট এনে দে। মাংস-খিচুড়ি করেছি। আমি বরং এই ফাঁকে তনুর জন্য একটু ইলিশ মাছ ভেজে আনি। ছেলেটা ইলিশ মাছ খেতে খুব পছন্দ করে। তনু মিষ্টির দিকে তাকিয়ে একচোখ টিপলো৷ ঠোঁটের কোণে চোরা হাসি ফুটিয়ে সাহেবী স্টাইলে হেঁটে মিষ্টির ঘরে চলে গেল।

(চলবে)