#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৪
তনু হাঁটু মুড়ে বসে মিষ্টির পা’দুটো জড়িয়ে ধরল। মিষ্টি ছটফটিয়ে উঠল। সরে যেতে চাইল। তনুর হাতের বাঁধন ধীরে ধীরে শক্ত হলো। মিষ্টি প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্বেও তনুর কাছ থেকে একচুল পরিমাণ সরে যেতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে চোখের কাজল লেপ্টে গেছে, মুখের মেক-আপ গলে গলে পড়ছে। এলোমেলো চুলগুলো কপাল জুড়ে লুটিয়ে পড়েছে। মিষ্টির সেদিকে খেয়াল নেই। ওর এখন তনুর স্পর্শটুকু বিষাক্ত লাগছে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিছে পোকার মতো কিলবিল করে কামড়াচ্ছে। তনু বুকচিরে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলিণ কণ্ঠে বলল,
“আমার ভুল হয়ে গেছে মিষ্টি। ভুল না আমি অন্যায় করেছি, পাপ করেছি। আর জীবনেও করব না। এই তোকে ছুঁয়ে দিব্যি কাটছি। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে প্লিজ? আমাকে শেষ একবার সুযোগ দে না…”
মিষ্টি অধৈর্য হয়ে বলল,
“আমাকে ছাড়ুন?”
তনু জেদি কণ্ঠে বলল,
“না ছাড়ব না। তুই এমন করছিস কেন মিষ্টি? বিশ্বাস কর, আমি বিয়ের পরে কোনো পাপ করিনি। তুই যা শুনেছিস..সব বিয়ের আগের ঘটনা।”
“কেন আপনি চরিত্রহীন হলেন তনুদা?”
মিষ্টির গলা ভেঙে এলো। কথা বলতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন? থেমে থেমে বলল,
“জেঠীকে বললেই তো আপনাকে বিয়ে দিয়ে দিতো। আমি তো মানতেই পারছি না। আমার বরের চরিত্রে দোষ ছিল। গার্লফ্রেন্ডের সাথে রাত্রিযাপন করেছেন। কষ্ট হলেও মানা যায়। হয়তো ভালোবাসা থেকেই এতটা কাছে গিয়েছিলেন কিংবা ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। কিন্তু ওইসব খারাপ জায়গা কেন যাইতেন? বিধাতার ভয় নেই আপনার?”
“আমার ভুল হয়ে গেছে মিষ্টি। আর জীবনেও এমন ভুল করব না। ভগবানের কাছে পাপ স্বীকার করে নেব। তার আগে তুই আমাকে ক্ষমা করে দে।”
মিষ্টি ফুঁপিয়ে উঠল। চোখের জলে সবকিছু ঝাপসা দেখছে। এত প্রিয় মানুষটাকে কেমন অসহ্য লাগছে। মিষ্টি নিজের চুলগুলো নিজেই দুইহাতে টেনে ধরল। হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে পারলে বুকের জমাট বাঁধা কষ্ট বোধহয় একটুখানি কমতো। মিষ্টি চোখের জল মুছে নিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তনু মিষ্টিকে জাপ্টে ধরে বিছানায় নিয়ে গেল। তনু অতিরিক্ত আদরে আদরে মিষ্টির সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করল। মিষ্টির কষ্ট তো একটুও কমলো না। উল্টো তনুর উষ্ণ স্পর্শে শরীরে জ্বালা ধরে গেল। মনে হলো, মিষ্টিকে কেউ জলন্ত আগুনে ফেলে দিয়েছে। মিষ্টি প্রাণপনে তনুর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও পারল না। তনুকে আছড়ে, কামড়ে, নাজেহাল করে ফেলল। তবুও তনু মিষ্টিকে একমুহূর্তের জন্য ছাড়ল না। জাপ্টে ধরেই মিষ্টির চোখে-মুখে, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিল। মিষ্টি ফুঁসে উঠল। অতিরিক্ত রাগে বেসামাল হয়ে তনু হাতদুটো নিজের গলায় চেপে ধরে বলল,
“আমাকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মারার থেকে একবারে গলা টিপে মেরে ফেলুন। আপনার স্পর্শটুকু আমার শরীরে বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। আমি কোনো উষ্ণ অনুভূতি পাচ্ছি না। আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। নরকের কীট মনে হচ্ছে। কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই দুইহাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে দিল মিষ্টি।
তনু মিষ্টির বুকের ভাঁজে মুখ গুঁজে ভেজা কণ্ঠে বলল,
“তুই এমন করছিস কেন মিষ্টি? প্লিজ স্বাভাবিক হ?”
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমি তো সহ্য করতে পারছি না। এত কেন কষ্ট হচ্ছে আমার?”
“তোর সব দুঃখ-কষ্ট আমি আমার অতিরিক্ত ভালোবাসা-আদর দিয়ে ভুলিয়ে দেব মিষ্টি।”
“এই একই কথা ওই খারাপ জায়গার মেয়েগুলোকেও বলতেন তাই না? ওদের সাথে আমার কী তফাৎ রইল বলুন তো? ওরাও আপনাকে যেভাবে পেয়েছে। আমিও আপনাকে ঠিক একইভাবে পেয়েছি। ওদের তো আমার থেকেও সৌভাগ্য। ওরা আমার আগে আপনাকে একান্ত আপন করে পেয়েছে।”
“আমার ভুল হয়ে গেছে “বউ।”
“আমারও ভুল হয়েছে। আপনাকে বিয়ে করে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটাই করেছি আমি। আমি বোকা দেখে সবাই আমাকেই কেন ঠকিয়ে মজা পায় কে জানে!”
“এভাবে বলিস না মিষ্টি। মানুষ মাত্রই ভুল করে। আমিও করেছি। তাছাড়া আমার অতীত খারাপ ছিল। বর্তমান না। তুই আমাকে একটা সুযোগ দিয়েই দ্যাখ না? আমি কথা দিচ্ছি। পৃথিবীর বেস্ট বর হয়ে দেখাব।”
“যাদের চরিত্রের দোষ থাকে। তারা সহজে ভালো হয় না। দিনশেষে আপনি আবারও আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে ঠকাবেন।”
“না মিষ্টি না। তোর ধারণা ভুল। খারাপ মানুষও ভালো হয়। তবে হাজারে এক আধটা। আমিও ভালো হতে চাই মিষ্টি।”
“আমি বাড়ি যাব।”
“আমাকে ছুঁয়ে কথা দে মিষ্টি। বাড়ির কাউকে আমার অতীতের কথা বলবি না?”
মিষ্টি কণ্ঠে তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলল,
“ভয় পাচ্ছেন? আচ্ছা বলব না।”
“ভোরেই রওনা দেব আমরা।”
সারাটা রাত মিষ্টি জেগে রইল। জেগে রইল তনুও। মিষ্টিকে এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়তে ইচ্ছে করল না। আগ রাতে নিজেকে তনুর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য খুব ধস্তাধস্তি করেছে মিষ্টি। তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। তনু এক চুলও মিষ্টিকে ছাড়েনি। মিষ্টি ব্যর্থ হয়ে তনুর পাশে চোখদুটো বন্ধ করে ঘাপটি মেরে শুয়ে রইল। মনের ভেতর হাজারো খারাপ চিন্তা বাসা বেঁধেছে। আপন মানুষের কুৎসিত রূপ হঠাৎ বেরিয়ে এলে কেমন যে লাগে। তা শুধু ভুক্তভোগীরাই গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারে। মিষ্টির চোখের পাতায় কতগুলো নারী মুখ ভেসে উঠল। তারা তনুর সাথে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে এক চাদরের নিচে শুয়ে আছে। কারো গায়ে কাপড় নেই। উফ, আর কিছু ভাবতে পারে না মিষ্টি। মাথার নিউরন গুলো বোধহয় একটা একটা করে ছিঁড়ে যাচ্ছে। মাথা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলল মিষ্টি। খুব ভোরে ওরা দুজন কাউকে কিছু না বলেই চলে গেল। তনু রাস্তায় গিয়ে রবিকে ফোনে সংক্ষেপে আসল ঘটনা জানাল। রবি শুনে খুব দুঃখ প্রকাশ করল।
মিষ্টিদের বাড়ির সামনে এসে বাইক থামাতেই মিষ্টি লাফিয়ে নেমে গেল। তনু নিচু কণ্ঠে বলল,
“মিষ্টি আমার বাড়িতে চল?”
মিষ্টি শুনেও শুনল না। দ্রুত পা চালিয়ে নিজেদের বাড়িতে চলে গেল।
তনুর বুক দুরুদুরু করছে। মনটা খুব অশান্ত। মিষ্টি সেই যে ওদের বাড়িতে ঢুকে ব্যালকনির দরজা, জানালা বন্ধ করে রেখেছে। প্রায় দুইঘণ্টা মতো হয়ে গেল। এখনো দরজা খুলছে না। তনুর মা তনুর ঘরে হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এলো। ভীতু কণ্ঠে বলল,
“এ্যাঁই তনু, মিষ্টির সাথে তোর ঝগড়া হয়েছে নাকি রে? মেয়েটা প্রায় দুইঘণ্টা যাবৎ ঘরে দরজা দিয়ে বসে আছে। মিষ্টির মা মিষ্টিকে খাওয়ার জন্য এই যে ডাকছে। কিছুতেই দরজা খুলছে না। কথাও বলছে না।”
তনুর বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। মুখটা ভয়ে শুকিয়ে গেল। মাকে কিছু না বলে এক দৌড়ে মিষ্টিদের বাড়িতে চলে গেল। হৃদপিণ্ড খুব জোরে জোরে লাফাচ্ছে। তনু মিষ্টির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, জোরে জোরে শ্বাস নিল। দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
“এ্যাঁই মিষ্টি দরজা খুল?”
“(নিশ্চুপ।)”
“মিষ্টি কাকিমা খুব টেনশন করছে। দরজাটা খুল বলছি?”
“(নিশ্চুপ।)
” আমাকে ক্ষেপাস না মিষ্টি। দরজা..টা..খুল?”
মিষ্টির মা ভয়ে কেঁদে দিল। বলল,
“কী হয়েছে বাবা? সত্যি করে বলোতো? মিষ্টি তো কখনো এমন করে না।”
তনু মিথ্যে করে বলল,
“তেমন কিছু না কাকিমা। খুব সামান্য একটা বিষয় নিয়ে ওর সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে।”
“মেয়েটা আমার খুব অভিমানী।”
“আপনি চিন্তা করবেন না কাকিমা। ওর কিছুই হবে না। মিষ্টি দরজাটা খুল? আমাকে নিয়ে তোর অভিযোগ তো? বেশ..আমার সাথে ঝগড়া কর, আমাকে যা খুশি বল। তবুও দরজাটা খুল প্লিজ?”
“(নিশ্চুপ।)”
“এ্যাঁই মিষ্টি আমি কিন্তু এবার সত্যি সত্যিই দরজা ভেঙে ফেলব?”
“(নিশ্চুপ।)”
মিষ্টির মা ঘাবড়ে গেল। ভয় জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“তোমার কাকাকে আসতে বলব?”
“না কাকিমা। শুধু শুধু চিন্তা করবে। আচ্ছা এই ঘরের এক্সট্রা কোনো চাবি নেই?”
“আছে তো। কিন্তু কোথায় রাখছি সঠিক মনে করতে পারছি না।”
“প্লিজ খুঁজে দেখুন। পাওয়া যায় নাকি।”
“আমি..আমি..দেখছি।”
কাকিমা চলে যেতেই তনু নিচু কণ্ঠে বলল,
“মিষ্টি..? তুই কী চাস সবাই আমার গোপন কথাটা জেনে যাক? আর আমি একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলি?”
খানিক বাদে ঘরের দরজা খুলে গেল। তনু চট করে ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে আস্তে করে দরজাটা বন্ধ দিল। মিষ্টি সারাঘর অন্ধকার করে রেখেছে। তনু ঘরের লাইট জ্বেলে দিল। তারপর মিষ্টির একহাত চেপে ধরতেই মিষ্টি অতিরিক্ত ব্যথায় কুঁকড়ে গেল। তনুর হাতে তরল ভেজা কিছু অনুভব হতেই তনু মিষ্টির হাতখানা আস্তে করে ছেড়ে দিল। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল তনু। তনুর হাতটা টাটকা রক্তে ভিজে গেছে। তনু ভয়ার্ত চোখে মিষ্টির দিকে তাকাল। মিষ্টির শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখা হাতটা আলতো করে ধরে একটানে শাড়ির আঁচল হাতের উপর থেকে সরিয়ে ফেলতেই মিষ্টির কাটা হাত দেখে তনুর মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। ইশ, পুরো হাত ফালা ফালা করে কেটে জখম করে ফেলেছে বোকা মেয়েটা। লাল রঙা টাটকা রক্ত হাত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। তনু কী করবে, কী বলবে ভেবে পেল না। এত রক্ত দেখে রীতিমতো ওর গা কাঁপছে। মিষ্টির কাঁধ দুটো চেপে ধরে, অস্ফুট স্বরে বলল,
“এটা তুই কী করেছিস মিষ্টি?”
(চলবে)