#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৬
তনু বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। মন কেমন করা কণ্ঠে বলল,
“মাকে ভুল বুঝিস না মিষ্টি।”
মিষ্টির অসহ্য লাগছে। কোনো এক অদৃশ্য জাদুবলে তনুকে জোর গলায় কিছু বলতে পারে না মিষ্টি। অথচ বলা প্রয়োজন। ভীষণ প্রয়োজন। এখন মানুষটা যতই অজুহাত দিক। নিত্যি-নতুন যুক্তি দাঁড় করাক। মিষ্টি তো জানে! কতটা বাজে ভাবে তনুর কাছে ঠকে গেছে মিষ্টি। দ্বিতীয়বারও যে তনুকে বিশ্বাস করে ঠকবে না। তার কী গ্যারান্টি? এই মানুষটাকে মিষ্টি পাগলের মতো ভালোবেসেছে। অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছে।
বিনিময়ে কী পেল, মিষ্টি? বিশ্বাসঘাতকতা। ভালোবাসার মানুষের সবকিছু সহ্য করা যায়। কিন্তু ছলনা? মিষ্টির মাথা চক্কর দিয়ে উঠল৷ দুর্বলতা থেকে এতবেশি খারাপ লাগছে বোধহয়। কড়া কণ্ঠে বলল,
“আপনি এখন চলে যান। এই বিষয়ে আমরা পরে কথা বলব।”
মিষ্টির কণ্ঠে কী ছিল তনু জানে না। তবে ও আর একমুহূর্ত বসে থাকতে পারল না। ধীর পায়ে চলে গেল। তনু চলে যেতেই মিষ্টির মা অন্নপূর্ণা ঘরে এলো। মিষ্টির মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে, কথার মারপ্যাঁচে মেয়েকে চেপে ধরল। মায়ের আদুরে কণ্ঠস্বর পেয়ে মিষ্টি আর নীরব থাকতে পারল না। ঝরঝর করে কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে, তনুর ব্যাপারে সবকিছু মাকে বলে দিল মিষ্টি। মেয়ের মুখে সবশুনে অন্নপূর্ণা হতভম্ব হয়ে গেল। মাথা ঝিমঝিম করছে। এত ভালো ছেলেটার কুৎসিত রূপ অন্নপূর্ণা মানতেই পারছে না। বেশি খারাপ লাগছে। তনুর মা জেনেশুনে মিষ্টির জীবনটা কেন নষ্ট করল? এই ভেবে। কত ভালো সম্পূর্ণ ছিল তনুর মায়ের সাথে অন্নপূর্ণার। তাছাড়া মিষ্টির বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তনুর বাবা।
বেঈমানটা কী চরম ভাবেই না মিষ্টিকে ঠকাল। অন্নপূর্ণা আর ভাবতে পারে না। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই বুকটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে।
এই কথাগুলো যদি ভুল করেও মিষ্টির বাবার কানে যায়। নিশ্চিত তনুর বাবা-মায়ের সাথে বিশাল গ্যাঞ্জাম লাগিয়ে দেবে। যে রগচটা মানুষ। হয়ত মিষ্টিকেও আর ওই বাড়িতে যেতে দেবে না। অন্নপূর্ণা এখন কী করবে, বুঝতে পারছে না। আগে কী মিষ্টির বাবাকে বলবে? নাকি তনুর মায়ের সাথে একবার গোপনে কথা বলে নেবে?
অন্নপূর্ণা শাড়ির আঁচল দিয়ে পরম যত্নে মিষ্টির চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে, মিষ্টিকে বুকে টেনে নিল। বলল,
“মনের বিরুদ্ধে যাওয়ার দরকার নেই। মন যা বলে তাই করবি। আমি সব সময় তোর পাশে আছি।”
এত এত মন খারাপের মাঝেও মায়ের আদর মাখা স্পর্শটুকু মিষ্টির মনে প্রশান্তির ছোঁয়া দিল। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল মিষ্টি।
তনুর পরীক্ষা চলছে। মিষ্টিকে রেখে একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও যেতে হলো। মিষ্টিটাও চোখের পলকেই কেমন পাল্টে গেছে। আগে সারাক্ষণ তনুর আশেপাশে ঘুরঘুর করত। তনুর কাছে একটু আদর পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যেত। একটু কথার বলার জন্য অস্থির হয়ে থাকত। অথচ এখন! তনু নিজে থেকে মিষ্টিকে ফোন দিলেও ফোন রিসিভ করে না। ব্যালকনির দরজা সবসময় বন্ধ করে রাখে। তনু দশটা কথা বলতে একটা কথার দায়সারা উত্তর দেয় মিষ্টি। মিষ্টির পাল্টে যাওয়া তনু মেনে নিতে পারে না। ওর খুব কষ্ট হয়। সম্পর্কটা আবারও আগের মতো সহজ-স্বাভাবিক হয়ে যাক। মনেপ্রাণে চায় তনু। অথচ মিষ্টির দিক থেকে কোনো আগ্রহই নেই।
মিষ্টির দিনগুলো গৎবাঁধা নিয়মেই চলছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠে কোচিং-এ যাওয়া, প্রাইভেট পড়ে দুপুর বারোটার দিকে বাড়ি ফেরা। স্নান করে, খেয়ে-দেয়ে লম্বা একটা ভাতঘুম দেওয়া। সন্ধ্যায় উঠে পড়তে বসা। তারপর টিভিতে কার্টুন দেখে ঘুমিয়ে যাওয়া। তনু মিষ্টিকে ফোন দিলে ইচ্ছে হলে মাঝে মাঝে কথা বলে। না হলে নেই। তবে এখন আর বেহায়ার মতো নিজে থেকে ফোন দেয় না মিষ্টি তনুকে। তনুর সাথে যে মিষ্টির কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ঠিক তা নয়। খুব ইচ্ছে করে। মনের ভেতরে প্রচুর অভিমান জমে আছে। সারাক্ষণ তনুকে নিয়ে ভাবে মিষ্টি। অথচ ফোন দিলে আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মিষ্টির জীবনটা আগেই ভালো ছিল। দিন যাচ্ছে আর কেমন যেন জটিল হয়ে যাচ্ছে।
আজ অনেকদিন পর ছাদে গেল মিষ্টি। স্বচ্ছ নীল আকাশ। একঝাঁক পাখি ডানা মেলে আকাশে উড়ে যাচ্ছে। যেন প্রতিযোগিতায় লেগেছে। কার আগে কে আপন নীড়ে ফিরে যেতে পারে।
“মন খারাপ?”
পাখি দেখায় এতটাই ব্যস্ত ছিল মিষ্টি। গৌরব কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ঠিক পায়নি মিষ্টি। বিরস মুখে বলল,
“না।”
মিষ্টির কাটা হাতের দাগগুলো অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। গৌরব মিষ্টির হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হাত কেটেছিলে কেন মিষ্টি?”
“এমনিই।”
“এমনি এমনি কেউ হাত কাটে বুঝি?” গৌরবের মুখে হাসি খেলে গেল। মিষ্টি চোখ রাঙিয়ে বলল,
“জানেনই যখন। শুধু শুধু প্রশ্ন করছেন কেন?”
“আমি সত্যিই কিছু জানি না। আমি তো এখানে ছিলাম না। আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আজকে এসেছি। এসেই শুনলাম তোমার কথা।”
“ওহ।”
“তনুর সাথে সবকিছু ঠিকঠাক তো মিষ্টি?”
মিষ্টি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“হ্যাঁ। কেন?”
“না.. মানে.. গুঞ্জন চলছে তোমার আর তনুর বিয়েটা নাকি ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
মিষ্টির চোখ কপালে উঠল। গৌরব সাহস করে মিষ্টির হাতের উপরে একহাত রাখল। বলল,
“আমি কী তাহলে সেকেন্ড চান্স পাব মিষ্টি?”
“কিসের সেকেন্ড চান্স গৌরব?” তনু সাহেবি স্টাইলে হেঁটে এসে মিষ্টির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, মিষ্টির কাঁধে একহাত রেখে কথাটা বলল। গৌরব থতমত খেল। মিষ্টির হাতটা আস্তে করে ছেড়ে দিল। দৃশ্যটা দেখে, তনুর সারা শরীর জ্বলে গেল। তনু বলল,
“তুই একা একা ছাদে কী করছিস মিষ্টি? আমি তোকে সারা বাড়ি খুঁজে অস্থির। চল তোর সাথে আমার খুব জরুরি কথা আছে।”
গৌরবের সামনে সিনক্রিয়েট করতে ইচ্ছে হলো না। মিষ্টি বিনাবাক্যব্যয়ে তনুর পিছু পিছু চলে গেল। ছাদ থেকে নেমে মিষ্টি বাসায় যেতে লাগল। তনু আচমকা মিষ্টির একহাত চেপে ধরল। চাপা কণ্ঠে বলল,
“এই বাড়ি না। আমার বাড়িতে চল?”
“আমার হাতটা ছাড়ুন? আমি কোথাও যাব না।”
“আমি ধরলেই তোর হাতে ফোস্কা পরে। আর ওই গৌরবের বাচ্চা ধরলে, নেশা নেশা ফিল আসে?”
“ছিঃ..”
“এখন ছি..ছি..করছিস কেন? গৌরব কোন সাহসে তোর হাত ধরার সাহস পায়?”
“একশোবার ধরবে। তাতে আপনার কী?”
“আমার অগোচরে আর কী কী করেছিস তুই গৌরবের সাথে?”
মিষ্টি ঠাস করে তনুর গালে থাপ্পড় লাগিয়ে দিল। তনু হতভম্ব হয়ে গেল। মিষ্টি ফুঁপিয়ে উঠল। চাপা কণ্ঠে গর্জে উঠে বলল,
“সবাইকে আপনার মতো নষ্ট ভাবেন নাকি?”
তনু অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে বলল,
“তুই আমার গায়ে হাত তুললি মিষ্টি?”
তারপর মিষ্টি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তনু জোর করে মিষ্টিকে নিজের বাসায় নিয়ে গেল।
মিষ্টিকে তনুর ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। তারপর ঠাস করে ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে মিষ্টির পাশে এসে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল তনু। মিষ্টির ডান হাতটা টেনে নিয়ে নিজের গালে রাখল। কোমল কণ্ঠে বলল,
“যতখুশি মার আমাকে? মেরে মেরে রক্তাক্ত করে দে..তবুও তুই আর দূরে দূরে থাকিস না। তুই দূরে সরে থাকলে আমার সহ্য হয় না মিষ্টি। আমি..আমি..
গৌরব মিষ্টির যে হাতটা তখন ধরেছিল। মিষ্টির সেই হাতটা মুচড়ে ধরল তনু। মিষ্টি ব্যথায় কুঁকড়ে গেল। চোখদুটো ছলছল করছে। তনু রাগী কণ্ঠে বলল,
“এই হাত গৌরব কেন ধরবে? তুই আমার বউ।
তোর উপরে একমাত্র আমার অধিকার। আমি তোকে স্পর্শ করব, আদর করব। যা খুশি তাই করব। তোর শরীরে অন্য পুরুষের স্পর্শ কেন লাগবে?”
কণ্ঠে তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে মিষ্টি বলল,
“সামান্য স্পর্শতেই এমন পাগলামি করছেন আপনি? আর যদি আপনার মতো আমার ঘৃণ্য অতীত থাকত! তখন কী করতেন?”
“তুই কাকিমাকে আমার ব্যাপারে কেন বলেছিস মিষ্টি? প্লিজ তোর মা যেন তোর বাবাকে আমার ব্যাপারে কিছু না জানায়। কাকা জানলে, জীবনেও আমাকে তোর জামাই হিসাবে মেনে নেবে না। আমাদের বিয়েটাও ভেঙে দেবে। আমি সহ্য করতে পারব না। তোকে হারালে ঠিকই একটা না একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলব।”
“আমার এমনিতেও আপনার মতো চরিত্রহীনের সংসার করার শখ নেই।”
“মন থেকে বলছিস মিষ্টি?”
“কোনো সন্দেহ আছে?”
“তুই আগেই ভালো ছিলি।”
“উচিৎ কথা শুনতে কারো ভালো লাগে না।”
“তুই কী চাস মিষ্টি?”
“আমি আপনার কাছ থেকে মুক্তি চাই।”
তনু মিষ্টির চোখে চোখ রেখে গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“আমি মুক্তি দিলে, সহ্য করতে পারবি তো?”
মিষ্টি দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“পারব।”
তনু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে কী যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবল। তারপর ধীর কণ্ঠে বলল,
“ওকে। আমি তোর কথা মেনে নেব। তার আগে ছয়মাস আমার সাথে সংসার করবি তুই। এই ছয়মাসে একবারও আমার অতীত টেনে আমার সাথে ঝগড়া করতে পারবি না। তুই আগের আহ্লাদী মিষ্টি হয়ে যাবি। তোর পরীক্ষা হয়ে গেলেই আমরা একসাথে থাকব।”
মিষ্টি “না” বলতে গিয়েও কী মনে করে তনুর কথা মেনে নিল। বলল,
“আচ্ছা।”
তনু মিষ্টির বুকের ভাঁজে মুখ গুঁজল। বিড়বিড় করে বলল,
“কতদিন তোকে মন ভরে আদর করি না মিষ্টি।”
মিষ্টি বাঁধা দিতে চাইল। তনুর অতিরিক্ত ভালোবাসার কাছে একসময় হার মেনে নিল মিষ্টি। সারা দিল তনুর মোহাচ্ছন্ন গভীর ভালোবাসার ডাকে। দুটি সত্তার মিলন হলো ঠিকই। তবে মনের মিলন আদৌও হয়েছিল কী?
(চলবে)