#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৮
মিষ্টি ফোন রেখে হন্তদন্ত পায়ে ছুটে গেল। মাকে খুঁজে পেল রান্নাঘরে। মিষ্টির চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে মাকে বলল,
“তুমি আমার এতবড় সর্বনাশ কেন করলে, মা?”
অন্নপূর্ণা ভ্রু কুঁচকে মিষ্টির দিকে তাকাল। বলল,
“কী করেছি আমি?”
“এখন বুঝতে পারছ না, তাই না?”
অন্নপূর্ণা চোখে-মুখে বিরক্ত ফুটিয়ে বলল,
“আমার সাথে একদম হেয়ালি করবি না মিষ্টি। যা ঘরে যা..একটা কাজ তো করবেই না। উল্টো কাজের সময় বকবক করে মাথা ধরিয়ে দেবে।”
“ওনার কথা বাবাকে কেন বলেছ তুমি?”
অন্নপূর্ণা কড়াইয়ে তেল গরম করে মাছ ভাজতে দিয়েছে। মাছগুলো উল্টে দিয়ে কাপড়ের আঁচলে হাত মুছে মিষ্টির দিকে ঘুরে তাকাল। বলল,
“তোর বাবাকে তনুর ব্যাপারে আমি কিছুই বলিনি।”
“বললেই হলো নাকি! তুমি না বললে আর কে বলবে?”
অন্নপূর্ণা রাগী কণ্ঠে বলল,
“কেন তোরা আজকালকার ছেলে-মেয়েরা একদল বন্ধু-বান্ধব পালিস। তারাই সুযোগ বুঝে স্পাইয়ের কাজ করে।”
“মানে?”
“মানে-টানে কিছু না। তোর বাবার সাথে তনুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাসে দেখা হয়। সেখানেই ছেলেটা তোর বাবাকে চিনতে পেরে তনুর ব্যাপারে নিজে থেকে বলেছে। বাকিটা তোর বাবা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে।”
“বাবা নাকি বলেছে, আমাদের ছাড়াছাড়ি করিয়ে দেবে।”
“হ্যাঁ।”
মিষ্টি ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেল। চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। ভেজা কণ্ঠে বলল,
“আমি কিন্তু ওনাকে ছাড়ব না মা।”
“এই কথা তোর বাবাকে গিয়ে বল।”
মিষ্টি যেভাবে এসেছিল। সেইভাবেই ছুটে ঘরে চলে গেল। তনুকে ফোন দিয়ে বলল,
“আমি বা মা আপনার ব্যাপারে বাবাকে কিছু বলিনি। বাবা ঢাকা গিয়ে আপনার বন্ধুর কাছ থেকে আপনার সম্পর্কে জানতে পেরেছে।”
তনু চমকে উঠল। ভীতু কণ্ঠে বলল,
“এবার কী হবে মিষ্টি?”
“আমি জানি না।”
“আমি আবারও বলছি। যত যাই হয়ে যাক। আমি কিন্তু তোকে ছাড়ব না মিষ্টি।”
মিষ্টির পেটের ভেতর কী যেন কামড়ে ধরল। বুক দুরুদুরু করছে। মানুষটা খুব জেদি ও আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে কথাটা বলল। বলতে বাঁধা নেই। মানুষটার রাগ, জেদ মিষ্টির খুব ভালো লাগে। গোটা মানুষটাই তো মিষ্টির খুব প্রিয়, আপন। তনু গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“মিষ্টি…”
“হুঁ।”
“চলে আয় আমার ঘরে?”
“আপনি নিয়ে যান।”
“আমার মা গিয়েছিল। তোকে অনুষ্ঠান করে ঘরে তোলার প্রস্তাব রাখতে। তোর বাবা প্রত্যাখান করে দিয়েছে।”
“আমি বাবার সাথে কথা বলব।”
“যদি রাজি না হয়?”
“নাহলে কী করবেন?”
“তোকে নিয়ে পালিয়ে যাব মিষ্টি।”
“কোথায় যাবেন?”
“যে দেশে কেউ আমাদের চিনবে না, জানবে না।”
“আমরা থাকব কোথায়? খাব কী? পালিয়ে পালিয়ে কতদিন বেড়াব? মিষ্টি কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। তনু নিঃশব্দে হেসে দিল। মেয়েটা সত্যিই খুব বোকা। তনু বলল,
“যতদিন তোর বাপ আমাদের মেনে না নেয়।”
“আমি সিনেমায় দেখেছি।”
“কী দেখেছিস মিষ্টি?”
“বলতে খুব লজ্জা করছে।”
“আরেহ্.. বল না আমরা আমরাই তো!”
এত এত মন খারাপের মাঝেও মিষ্টির সাথে কথা বলতে তনুর খুব ভালো লাগছে। মিষ্টি নত মস্তিষ্কে, লজ্জিত কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“একটা বাচ্চা নিয়ে নিলেই পরিবার মেনে নেয়।”
তনু শব্দ করে হেসে দিল। সেকি দম ফাটা হাসি। মিষ্টির রাগ হয়ে গেল। রীতিমতো রাগে গা জ্বলছে।
তনু হাসি থামিয়ে বলল,
“এখুনি বাচ্চা নিবি মিষ্টি? তুই নিজেই তো একটা বাচ্চা।”
“এতই যখন আমাকে বাচ্চা মনে করেন। তাহলে বিয়ে করেছেন কেন?”
“বাচ্চা বউকে আদর করতে।”
“ধ্যুৎ।”
“মিষ্টি?”
“হুঁ।”
“চলে আয় প্লিজ?”
“বাবা খুব মন খারাপ করবে।”
“তোর বাবার কথা ভাবছিস। অথচ আমার কথা একবারও ভাবছিস না?”
“ভাবছি তো।”
“কী ভাবছিস শুনি?”
“এখন বলতে ইচ্ছে করছে না।”
“কতদিন তোকে কাছে পাই না, আদর করি না, ভালোবাসি না। তোর কী আমার জন্য একটুও মন পুড়ে না মিষ্টি?”
মিষ্টি মনে মনে বলল,
“আমার মনে আগুন লেগেছে। সেই উত্তপ্ত আগুনের তাপে প্রতিনিয়ত জ্বলেপুড়ে মরছি।” তবে মুখে কিছু বলল না। তনু বলল,
“আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। অনুষ্ঠানের নাম করে আমাদের দুজনকে আলাদা রেখে তোর বাপ কিন্তু খুব অন্যায় করছে মিষ্টি।”
“আপনি কেন নিজের দোষ স্বীকার করেন না?”
“আর কীভাবে স্বীকার করব? তোর বাপের পা ধরতে হবে?”
“আমি কী তাই বলেছি?”
“দ্যাখ এমনিতেই আমার মাথা গরম হয়ে আছে। তুই আর উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার মাথা বিগড়ে দিস না।”
অন্নপূর্ণা চেঁচিয়ে বলল,
“মিষ্টি একবার বসার ঘরে আয় তো? তোর বাবা ডাকছে।”
মিষ্টি শুকনো ঢোক চিপে বলল,
“আসছি মা।”
তনু ফোনের ওপাশে বলল,
“কে ডাকছে মিষ্টি?”
“বাবা ডাকছে।”
“তোর বাবা আমার ব্যাপারে তোকে হয়তো অনেককিছুই বলবে। যদিও আগে থেকেই সব জানিস তুই। কাকা যদি আমাদের ছাড়াছাড়ির ব্যাপারে কথা বলে। তুই তখন কী বলবি?”
“আমি আপনাকে ছাড়ব না।”
“গুড। এই কথাটা তোর বাবাকে বলতে পারবি?”
“মাকে বলব।”
“তোর বাবা যদি জানতে চায়?”
“তখন দেখা যাবে। এখন ফোন রাখুন।”
“এককাজ কর মিষ্টি। আমি লাইনেই থাকি। তুই ফোন হাতে নিয়ে যা। কাকা কী বলে আমারও তো শোনা দরকার।”
“বাবার সামনে আমি ফোন নিয়ে কখনো যাই না।”
“আজ যা।”
“না। আপনি এখন ফোনটা রাখুন। আমি পরে আপনাকে সব জানাব।”
মিষ্টি গুটিগুটি পায়ে বসার ঘরে গিয়ে বাবার সামনে দাঁড়াল। ভদ্রলোক মেয়েকে পাশে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“শোন মা, আমি সব কাগজপত্র গুছিয়ে ফেলেছি। তুই শুধু সময় মতো একটা সাইন করে দিবি।”
“কিসের কাগজপত্র বাবা?”
“তোকে এতকিছু জানতে হবে না। সবসময় মনে রাখবি আমি, আমরা সবসময় তোর ভালো চাই।”
মিষ্টি মায়ের দিকে কড়া চোখে তাকাল। অন্নপূর্ণা বলল,
“এতকিছু জানতে হবে না মানে কী? মেয়ের ব্যাপারে এতবড় সিদ্ধান্ত তুমি একা একা নিয়ে ফেলেছ। অথচ মেয়েকেই জানাতে চাইছ না। এটা কেমন কথা?”
ভদ্রলোক বলল,
“তুমি আমার থেকে বেশি বুঝো নাকি?”
অন্নপূর্ণা আজ আর চুপ করে থাকতে পারল না। এই মানুষটা সবসময় নিজের সিদ্ধান্তেই অটুট থাকে। ভুল-ঠিক যাই হোক। সবসময় সবার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তার-ও যে ভুল হয়। এটা কখনোই সে স্বীকার করতে চায় না। নিজেই মিষ্টিকে তনুর সাথে খুব আগ্রহ করে বিয়ে দিল। অন্নপূর্ণা কতবার বলেছে। অন্তত একটু খোঁজ-খবর নাও। সে নিল না। উল্টো অন্নপূর্ণাকে কতকথা শোনাল। এখন যখন শুনেছে, তনু চরিত্রহীন। মেয়ে আদৌও তনুর সংসার করবে কিনা। মেয়েকে না জানিয়েই ডিভোর্স পেপার রেডি করে ফেলেছে। এবং তনু যদি মিষ্টিকে ডিভোর্স দিতে না চায়। বেশি বাড়াবাড়ি করে। তাহলে কেস দেওয়ার ভয় দেখাবে। কারণ মিষ্টির এখনো আঠারো পূর্ণ হতে বেশকিছুদিন বাকি আছে। কেস দিতে নাকি সুবিধা হবে। মেয়ে যে তনু সাথেই সংসার করতে চায়। এটা তাকে কে বোঝাবে? অন্নপূর্ণা বলল,
“মিষ্টি তুই কী তনুর সাথে সংসার করতে চাস?”
ভদ্রলোক স্ত্রীকে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স ওর এখনো হয়েছে নাকি?”
“মেয়ে যখন এতই ছোট। বিয়ে দিয়েছ কেন?”
“মূর্খ মহিলা।”
“তোমার মতের অমিল হলেই তো আমি মূর্খ হয়ে যাই।”
ভদ্রলোক মিষ্টিকে বলল,
“মা তুই ঘরে যা। আমরা এই ব্যাপারে পরে কথা বলব।”
মিষ্টি ধীর পায়ে চলে গেল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল, তনু ইতিমধ্যে পাঁচবার ফোন দিয়ে ফেলেছে। আবারও ফোন দিল তনু। মিষ্টি ফোন রিসিভ করতেই বলল,
“কাকা কী বলল?”
“বলল সব কাগজপত্র প্রায় রেডি করে ফেলেছে। আমি যেন সময়মতো সাইন করে দেই।”
তনুর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“তুই কী বললি?”
“আমি কিছু বলিনি।”
“কেন বলিসনি মিষ্টি?”
“বাবার মুখে মুখে কথা বলার অভ্যাস নেই। খুব ছোটবেলা থেকে বাবা আমার, আমাদের সবার সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। বাবা-মা কখনো আমাদের খারাপ চায় না।”
“তোর এখনো মনে হচ্ছে। কাকা তোর ভালো চাচ্ছে?”
“আমি জানি না।”
“তোকে জানতে হবে। তুই কী চাস মিষ্টি?”
(চলবে)