মিষ্টির তনুদা পর্ব-১৯

0
4

#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব – ১৯

মিষ্টি বিড়বিড় করে বলল,
“আমি আপনাকে চাই।”
“মিষ্টি, জোরে বল?”
“কী বলব?”
তনু অধৈর্য হয়ে বলল,
“কী বলবি এখনো বুঝতে পারছিস না? আর কবে বুঝবি মিষ্টি? আমাদের ছাড়াছাড়ি হলে?”
মিষ্টির বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। এইমাত্র কী বলল মানুষটা? সত্যিই কী ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে? তনুকে ছাড়া মিষ্টি থাকতে পারবে না। যে-কোনো মূল্যে মিষ্টির তনুকে লাগবে। সারাজীবনের জন্য লাগবে।
এই মানুষটার গন্ধ গায়ে না মেখে কী করে থাকবে মিষ্টি? ওদের যদি সত্যি সত্যিই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তনু কী আবার বিয়ে করবে? সেই মেয়েটাকেও কী মিষ্টির মতো করে গভীর ভাবে আদর করবে, ভালোবাসবে? আরকিছু ভাবতে পারে না মিষ্টি। ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। চোখদুটো ভিজে উঠে। এই মানুষটার পাশে কোনো মেয়েকে ভাবলেই তো খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করে। পাগল পাগল লাগে। মস্তিষ্ক বিবশ অনুভূতিতে ছেয়ে যায়। তনু অস্থির কণ্ঠে বলল,
“তুই প্লিজ আমার কাছে চলে আয় মিষ্টি?”
“বাবা যেতে দেবে না।”
“রাতে পালিয়ে আয়। বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নেব।”
“অসম্ভব।”
“তাহলে কী সম্ভব? আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে তুই খুশি হবি?”
“না।”
“খবরদার.. তুই কিন্তু কোনো পেপারে ভুলেও সাইন করবি না মিষ্টি।”

তনুর মা আবারও এলো মিষ্টিদের বাড়িতে। তনুর মা তৃণা রানী মিষ্টির বাবা অমলচন্দ্রকে বলল,
“এইসব কী শুনছি দাদা?”
অমলচন্দ্র ধীর কণ্ঠে বলল,
“কী শুনেছেন?”
“আপনি নাকি তনু-মিষ্টির ছাড়াছাড়ি করিয়ে দিবেন?”
“আপনাকে কে বলল?”
“যেই বলুক। কথাটা সত্যি নাকি আগে তাই বলুন?”
“হ্যাঁ।”
“এতবড় সিদ্ধান্ত আপনি আমাদের না জানিয়েই নিয়ে ফেললেন?”
অমলচন্দ্র পাল্টা প্রশ্ন করল,
“আপনার ছেলের ব্যাপারে আপনারা আমাকে আগে জানিয়েছিলেন বউদি?”
মিষ্টি মা এগিয়ে এসে বলল,
“কোন কথার সাথে কোন কথা গুলিয়ে ফেলছ তুমি? তাছাড়া মিষ্টি যথেষ্ট বড় হয়েছে। ওর মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে তোমাকে।”
অমলচন্দ্র স্ত্রীকে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“তুমি চুপ করো।”
তৃণা রানী বলল,
“তনু আমার ছেলে। ওর সব ব্যাপারে সবাইকে সবকিছু বলে বেড়াব নাকি আড়াল রাখব। এটা সম্পূর্ণ আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু মিষ্টি এখন আমার তনুর বউ। মিষ্টির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই আমাদের জানাতে হবে। তাছাড়া তনু মিষ্টিকে ছাড়বে না। আপনি কোন সাহসে ওদের অগোচরে কাগজপত্র তৈরি করেছেন? সবকিছু মগের মুল্লুক নাকি!”
“আপনার চরিত্রহীন ছেলের সাথে জেনেশুনে আমার মেয়ে দেব কেন?”
“কারণ আমার তনু পাল্টে গেছে।”
“তার গ্যারান্টি কী?”
“আমি গ্যারান্টি দাদা।”
“আপনার কথা আমি আর বিশ্বাস করি না বউদি।”
“আমি মিষ্টিকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
“আমার মেয়েকে যেতে দেব না।”
“আপনি বললেই হবে নাকি?”
“গলা নামিয়ে কথা বলেন বউদি।”
তৃণা রানী মিষ্টির মাকে বলল,
“দিদি দাদাকে বোঝান।”
মিষ্টির মা কিছু বলতে গেলে ভদ্রলোক চুপ করিয়ে দিলেন। তৃণা রানী বলল,
“মিষ্টিকে ডাকেন দিদি? ওর মুখে শুনি। ও কী চায়।”
অমলচন্দ্র বলল,
“তার কোনো দরকার নেই। আমার কথাই শেষ কথা।”
“তা বললে তো হবে না দাদা। আমি মিষ্টির মুখ থেকেই শুনব।”
“বেশি বাড়াবাড়ি করে লাভ নেই বউদি। আমার ভালো রূপ দেখেছেন। খারাপ রূপ এখনো দেখেননি। আশা করি, এমন কিছু করতে বাধ্য করবেন না আমাকে। যেন আপনার ছেলের বাকি জীবন জেলে বসে কাটাতে হয়।”
“খবরদার দাদা। আমার তনুকে নিয়ে আজেবাজে চিন্তা মাথায়ও আনবেন না। তাহলে আমিও ভুলে যাব আপনি তনুর বাবার কাছের বন্ধু। আর তনু একা জেলে যাবে কেন? তনুকে জেলে যেতে হলে সাথে আপনিও যাবেন। নিজের মেয়েকে বাল্যবিবাহ দেওয়ার অপরাধে। সব প্রমাণ আমাদের কাছেও আছে কিন্তু।”
ভদ্রলোক চমকে উঠল। বিস্ময় চেপে বলল,
“আপনি আমায় জেলে দিবেন বউদি?”
“আমি তো একবারও বলিনি আপনাকে জেলে দেব। শুধু বলেছি তনু একা কেন জেলে যাবে। আর জেলের কথাটা প্রথমে আপনিই তুলেছেন।”
“আপনার ছেলের সাথে আমি কিছুতেই মেয়ে দেব না।”
“আপনার মেয়ে যদি আমার তনুর সংসার না করতে পারে। আমিও দেখে নেব ও আর কার সংসার করে।”
তৃণা রানী আর একমুহূর্ত দাঁড়াল না। হন্তদন্ত পায়ে চলে গেল।

তৃণা রানী বাড়িতে গিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। তনু এতক্ষণ মায়ের অপেক্ষায় ছটফট করছিল। মাকে দেখে জলের গ্লাস এগিয়ে দিল। তৃণা রানী এক ঢোকে জলটুকু খেল। কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে বলল,
“মিষ্টির বাবা তোর উপরে খুব ক্ষেপেছে। মনে হয় না, মিষ্টিকে আর সসম্মানে তোর হাতে তুলে দেবে।”
তনু ভীতু কণ্ঠে বলল,
“এখন কী করব মা?”
“কী আর করবি। হয় মিষ্টিকে ডিভোর্স দিবি।”
“অসম্ভব।” তনু দুইহাতে মুখ ঢেকে ফেলল। ওর খুব অস্থির লাগছে। তৃণা রানী তনুর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আর নাহলে মিষ্টিকে নিয়ে পালিয়ে যা।”
তনু বিড়বিড় করে বলল,
“পালিয়েই তো যেতে চাই। গাধিটাই তো রাজি হচ্ছে না।” শেষের কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলল তনু।
তৃণা রানী উঠে ঘরে যেতে যেতে বলল,
“তো রাজি করা তোর বউকে।”

তনু ঘরে গিয়ে মিষ্টিকে ফোন দিল। মিষ্টির ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। আশ্চর্য একটু আগেও না মিষ্টির সাথে কথা হলো। তনুর অস্থিরতা বেড়ে গেল। রিতুকে ফোন দিয়ে বলল,
“মিষ্টির ফোন বন্ধ কেন জানিস কিছু?”
“না তো।”
“আচ্ছা তোকে জানতে হবে না। তুই শুধু তোর ফোনটা মিষ্টির কাছে খুব সাবধানে রেখে আসবি। ভুলেও কেউ যেন না দেখে।”
“কী হয়েছে দাদা?” রিতু কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। তনু বলল,
“অনেককিছু হয়ে গেছে রে। আমাদের না হওয়া সংসারটা বোধহয় শুরু হওয়ার আগেই ভেঙে যাবে।”
রিতু বোধহয় কিছু আঁচ করতে পারল। তনুকে আর ঘাটাল না। বলল,
“বাটনফোন রেখে আসলে চলবে?”
“চলবে। তবে আগে আমাকে একবার মিসকল দে।”

রিতু তনুর বলা কথামতো খুব স্বাভাবিক ভাবেই মিষ্টিদের বাড়িতে গেল। মিষ্টির কাছে ঘটনা জানতে চাইলে মিষ্টি নিচু কণ্ঠে ফিসফিস করে সংক্ষেপে ঘটনা খুলে বলল। এ-ও বলল মিষ্টির কাছ থেকে খুব কৌশলে ফোন নিয়ে গেছে বাবা। মায়ের ফোনটাও খুঁজে পাচ্ছে না মিষ্টি। সব ফোন বাবার কাছে জিম্মি রাখা। তবে তনুর ব্যাপারে কিছুই বলল না মিষ্টি। খুব সাবধানে গোপন করে গেল। শুধু বলল,
“বাবা ঢাকা থেকে তোর দাদার নামে কার কাছে কি-না কী শুনে এসেছে। বাড়ি এসে আমাদের ছাড়াছাড়ি করানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে।”
রিতু জানে, মিষ্টির বাবা একটু বেশি বুঝদার, রগচটা স্বভাবের মানুষ। ওনি যা একবার বুঝে সেটাই ঠিক। আর দুনিয়া শুদ্ধ সবাই ভুল। রিতু কথা বলতে বলতে খুব সাবধানে সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে মিষ্টির হাতে ফোনটা তুলে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“দাদাকে ফোন দিস। তোর সাথে কথা বলবে। এখন আমি আসি। কেমন!” রিতু চলে যেতেই মিষ্টিও গুটিগুটি পায়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগল৷ মিষ্টির বাবা আচমকা পেছন থেকে ডাকল,
“কোথায় যাচ্ছিস মিষ্টি?”
মিষ্টি ধড়ফড়িয়ে উঠল। আর একটু হলেই হাত ফসকে ফোনটা পরে যেত। মিষ্টি চট করে ফোনটা ওড়নার তলায় লুকিয়ে ফেলল। শুকনো ঢোক চিপে বলল,
“ঘরে যাচ্ছি বাবা।”
“ওই ঘরে যাওয়ার দরকার নেই। তুই বরং তমালের ঘরে যা। তমাল আজ থেকে তোর ঘরে থাকবে।”
অন্নপূর্ণা বলল,
“কী শুরু করলে তুমি? মেয়েটা কী এখন নিজের ঘরেও যেতে পারবে না?”
“না পারবে না। আমি যা বলছি মিষ্টি তাই শোন।”
মিষ্টির খুব কান্না পেল। বাবা এমন করছে কেন আজ? প্রথমে মিষ্টির ফোন নিয়ে নিল। এখন ঘরেও যেতে দেবে না। জেঠীর রাগ বাবা এখন মিষ্টির উপরে ঝাড়ছে। মিষ্টি বেশ বুঝতে পারছে। বাবা কী সত্যি সত্যিই কখনো তনুকে মিষ্টির জামাই হিসাবে মেনে নেবে না? মানুষটাকে তো ক্ষমা চেয়ে নিজের ভুল শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। অথচ বাবা করছে উল্টোটা। বাবার মুখের উপর কখনো মিষ্টি কথা বলতে পারে না। আজও সাহস হলো না। মিষ্টি পা বাড়াল মিষ্টির ছোটভাই তমালের ঘরের দিকে। তমাল এবার ক্লাস এইটে পড়ে। তমাল রঙ তুলি দিয়ে একমনে আঁকিবুঁকি করছিল। দিদিকে দেখে হেসে দিল। বলল,
“কী ব্যাপার। তুই হঠাৎ এই ঘরে?”
তমাল প্রচন্ড নোংরা স্বভাবের। পুরো ঘর রং, তুলি, বই পেন্সিল, জামা- প্যান্ট দিয়ে এলোমেলো করে রেখেছে। মিষ্টি বলল,
“বাবার হুমুক। এখন এই ঘর থেকে বের হ। খবরদার আমার ঘর একদম এলোমেলো করবি না তমাল।”
তমাল মুখে ভেংচি কেটে বলল,
“ঢঙ।”
তমাল উঠে চলে গেল। মিষ্টি আস্তে করে ভেতর থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিল। কোনো রকমে ওড়না দিয়ে বিছানাটা ঝেড়ে পরিষ্কার করে, গড়িয়ে পড়ল। কতক্ষণ মুখে ওড়না গুঁজে কাঁদল মিষ্টি। তনু বার বার ফোন দিচ্ছে। একটুও ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না। ফোনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টির কান্নার স্রোত বেড়ে গেল। সহজ স্বাভাবিক সম্পর্কগুলো ওদের জন্যই আজ এত জটিল হয়ে গেল। জেঠী চলে যাওয়ার পর বাবা হুংকার দিয়ে বলেছে, মিষ্টি যেন খুব শীঘ্রই সাইন করে দেয়। যতক্ষণ না ওদের মুখের উপর কাগজটা ছুঁড়ে ফেলতে পারবে। ততক্ষণ বাবার শান্তি নেই।
জেঠীর এত সাহস কীভাবে হলো, বাবাকে পুলিশের ভয় দেখানোর। জেঠী কী জানে না, পুলিশ পকেটে নিয়ে ঘুরে বাবা। বাবার এই কথাগুলো নাহলেও বিশ-পঁচিশ বার বলা হয়ে গেছে।
অনেকক্ষণ কান্না করার ফলে এখন একটু হালকা লাগছে। মিষ্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রিসিভ করল। তনু অস্থির হয়ে বলল,
“এতক্ষণ ফোনটা রিসিভ করলি না কেন মিষ্টি?”
“এমনিই।”
“তোর কণ্ঠ ভেজা কেন? তুই কী এতক্ষণ কেঁদেছিস?”
মিষ্টির আবারও কান্না পেল। এই মানুষটা এত কেন বুঝে মিষ্টিকে। মিষ্টি কান্না চেপে মিথ্যে করে বলল,
“না।”
“আমার কাছ থেকে কী লুকাচ্ছিস মিষ্টি? মা চলে আসার পর তোর বাবা কী তোকে কিছু বলেছে?”
“হুঁ।”
“কী বলেছে?”
“বলেছে, একটা পেপারে সাইন করে দিতে।”
“কিসের পেপার জানিস?”
“জানি।”
“তুই কী বলেছিস?”
“আমি কিছুই বলিনি।”
“এখন কী করবি মিষ্টি?”
“জানি না।”
“ব্যালকনিতে আয়। তোকে দেখব।”
“আমি আমার ঘরে নেই।”
“কোথায় তুই?”
‘’তমালের ঘরে।”
“কেন?”
“বাবা এই ঘরে থাকতে বলেছে।”
তনুর রাগ হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তোর বাপ চাইছে টা কী? খবরদার “জানি না” বলবি না মিষ্টি।”
মিষ্টি চুপ করে রইল। তনু নিজেকে সামলে নিল। বলল,
“তুই যদি আমার সংসার করতে চাস। এখন একটাই পথ খোলা আছে।”
“কী পথ?”
“তুই আজ রাতে পালিয়ে আসবি। আমরা দুজন কিছুদিনের জন্য দূরে কোথাও চলে যাব।”
মিষ্টি ভীতু কণ্ঠে বলল,
“বাবা যদি জানতে পারে। মেরে ফেলবে আমাকে।”
তনু দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“তুই এখন শুধু তোর বাপের মেয়ে নয়। আমার “বউ”। তোর বাপের থেকেও এখন তোর উপর আমার অধিকার বেশি।”
“তবুও।”
“তোর বাপ কতদিন আটকে রাখবে তোকে?”
“জানি না।”
“আব্বেহ্..আর একবার জানি না বললে…
“কী করবেন?”
তনু রেগে গিয়েও হেসে ফেলল। ফিসফিস করে বলল,
“চুমু দিয়ে গাল লাল করে দেব।”
মিষ্টির মুখেও লাজুক হাসি ফুটে উঠল। ইশ, মানুষটার মুখে কিছুই আটকায় না।
‘’আমি অপেক্ষায় থাকব মিষ্টি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তুই আজ আমাকে নিরাশ করবি না।”

(চলবে)