মিষ্টির তনুদা পর্ব-২১

0
4

#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২১

তনুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডাক্তার প্রাথমিক ভাবে দেখে কিছু টেস্ট লিখে দিয়েছে। টেস্টগুলো ইতিমধ্যে করানো হয়েছে। তবে এখনো রিপোর্ট বের হয়নি। সবাই অপেক্ষার প্রহর গুনছে। তনুর জ্ঞান ফিরেছে। এখন সবকিছু স্বাভাবিক। আর মাথা ব্যথা নেই। তবে তনু কিছুতেই টেস্ট গুলো করতে চায়নি। এই নিয়ে মায়ের সাথে বেশ রাগারাগি করেছে। তনুর মা কান্নাকাটি করতে করতে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে ছেলেকে টেস্টগুলো করাতে সক্ষম হয়েছে। এখন তনুর খুব ভয় করছে। টেস্টের রিপোর্টে কী লেখা আছে। তনু আগে থেকেই জানে। সবাই জানার পর কেমন রিয়াকশন করবে। কে জানে! বিশেষ করে মিষ্টিটা একটু বেশিই ইমোশনাল। যখন জানতে পারবে তনুর আয়ু ফুরিয়েছে। ওর হাতে খুব বেশি সময় নেই। কেঁদে-কেটে একাকার করে ফেলবে। মাকেও সামলানো যাবে না। অথচ তনু তো তা চায়নি। যে কটাদিন বেঁচে আছে। সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই হাসি, আনন্দে কাটাতে চেয়েছিল তনু। তা আর হবে না বোধহয়। যে কয়টা দিন বেঁচে থাকবে। প্রতিটা মুহূর্তে প্রিয় মানুষের কান্নাকাটি হজম করতে হবে তনুকে। তনু যা-কিছু মন থেকে চায়। সবসময় হয় তার উল্টোটা। তনুর মাথা ব্যথা আজ নতুন না৷ অনেকদিন ধরেই। প্রথম প্রথম ভেবেছিল মাইগ্রেনের ব্যথা৷ সেই কৌতূহল থেকেই একদিন একা এসে টেস্ট করেছে। দুভার্গ্যবশত রিপোর্ট ভালো আসেনি। ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছে। এবং খুব শীঘ্রই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করতে চলেছে তনু। সেদিন কথাগুলো ডাক্তার সরাসরি তনুকে বলতে চায়নি। বার বার জিজ্ঞেস করছিল, বাড়ির লোক কেউ সাথে আসেনি? তনু ভয়ে ভয়ে বলেছে, কী হয়েছে ডাক্তার? আমাকেই বলুন না? সেদিন থেকেই সম্পূর্ণ পাল্টে গেল তনু। নিজের কৃতকর্মের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে বার বার ক্ষমা চেয়েছে। মিষ্টিকে যেহেতু বিয়ে করেই ফেলেছে। আর ছাড়তে ইচ্ছে করল না। জীবনের শেষ সময়ে এসে মিষ্টির সাথে কিছু সুখস্মৃতি জমাতে ভীষণ ইচ্ছে করল। এরজন্যই তো এত আয়োজন। কিছুদিন আগে চাকরির একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিল তনু। ভেবেছিল চাকরিটা হবে না। গতকাল মেইল এসেছে। সৌভাগ্যক্রমে চাকরিটাও হয়ে গেছে। জীবনের অন্তিম সময়ে এসেই কেন সৌভাগ্যগুলো একে একে ধরা দিচ্ছে? তনুর খুব ইচ্ছে ছিল। যে-কটাদিন বেঁচে থাকবে। সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কাটাবে। কাউকে তনুর ব্যাপারে জানতে দেবে না। মা খুব ভেঙে পড়বে। মিষ্টিটাও পাগল পাগল হয়ে যাবে। কথাগুলো ভেবেই বুকচিরে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল তনু। সিরিয়াল অনুযায়ী তনুকে ডাকছে। তৃণা রানীও ছেলের সাথে উঠে গেল। উঠে গেল মিষ্টিও। মেয়েটা বউ বেশেই কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতালে ছুটে এসেছে। এখনো চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। কাজল লেপ্টে গেছে। তবুও দেখতে কী সুন্দর লাগছে। তনু বলল,
“তোমাদের কাউকে আমার সাথে যেতে হবে না। আমি একাই যাব।”
তৃণা রানী ছেলের কথা শুনল না। একপ্রকার জোর করেই চেম্বারে ঢুকল। মিষ্টি যেতে চেয়েছিল। দুজনের বেশি এলাউ না দেখে, মিষ্টি যেতে পারল না। তনুর অসুখের কথা মা জানলে, এখানেই কান্নাকাটি জুড়ে দেবে। তনু প্রাণপনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। পারছে না। ভেতরে ভেতরে একদম শেষ হয়ে গেছে ছেলেটা। তৃণা রানী ডাক্তারকে বলল,
“তনুর রিপোর্ট ভালো এসেছে, ডাক্তার?”
ডাক্তার রিপোর্টে আবারও চোখ বুলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ। মেজর কোনো সমস্যা নেই।”
তনু চমকে উঠল। হৃদপিণ্ড খুব জোরে জোরে লাফাচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব? শুকনো ঢোক গিলে কম্পিত কণ্ঠে বলল,
“ভালো করে দেখে বলুন প্লিজ? সত্যিই আমার কিছু হয়নি?”
“আশ্চর্য মিথ্যে বলব কেন? রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা আছে। সবকিছু নরমাল।”
“তাহলে মাথা ব্যথা হয় কেন?”
”এটা মাইগ্রেনের সমস্যা। ঔষধ লিখে দিচ্ছি। নিয়মিত খাবেন। ঔষধ শেষ হলে আর একবার দেখিয়ে যাবেন।”
তনুর কৌতূহল মিটছে না। তৃণা রানীকে বলল,
“মা তুমি একটু বাইরে যাও তো। ডাক্তারের সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
যেহেতু ছেলের রিপোর্ট ভালো এসেছে। তৃণা রানী আর দ্বিমত করল না। বিনাবাক্যব্যয়ে চলে গেল। তনু বলল,
“কিছুদিন আগে আমি একটা হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করিয়েছি। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলেছে, আমার ব্রেন টিউমার হয়েছে। এবং আমি আর খুব বেশিদিন বাঁচব না।”
“কোথায় রিপোর্ট দেখি?”
“রিপোর্ট তো সাথে আনিনি।”
“রিপোর্ট না দেখে তো আমি কিছু বলতে পারছি না।”
“সত্যিই কী আমার ব্রেন টিউমার হয়নি ডাক্তার?”
“না। আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ।”
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“বিশ্বাস না করলে আমার কিছুই করার নেই। পঁচিশ বছর এই পেশায় আছি। ভুল হওয়ার চান্স নেই। দেখুন আগের রিপোর্টে হয়তো কোনো গড়মিল আছে।”
এতদিন কী পরিমাণ মানসিক ডিপ্রেশনে ভুগছিল তনু তা যদি এই ডাক্তার জানত। তনুর যে কেমন অনুভূতি হচ্ছে। কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব না। আজকেই তনু মিষ্টিকে ঘরে তুলবে আর আজকেই এত ভালো একটা খবর পেল। তনু কাঁপা হাতে রিপোর্ট গুলো নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল। চোখে জল, মুখে হাসি। মৃত্যু চিরন্তন সত্য। জানার পরও বেঁচে থাকার কী অদম্য ইচ্ছে পুষে প্রতিটা মানুষ মনের ভেতরে।
তনু ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতেই মিষ্টি আচমকা দৌড়ে এসে তনুকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজল। কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল,
”আমি খুব ভয় পেয়েছি।”
তনু হেসে দিল। মন ভালো করা হাসি। বলল,
“আমার কিছুই হয়নি রে মিষ্টি। চেয়ে দ্যাখ.. আমি একদম ফিট।”
তনু মিষ্টিকে নিয়ে সরাসরি নিজের বাড়িতে চলে গেল। আসার সময় ডাক্তারের নাম্বার নিয়ে এসেছে তনু। আগের রিপোর্টের ছবি তুলে ওনার হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ট করে দিল তনু। ডাক্তার রিপোর্টগুলো দেখে, রিপ্লে দিল। এটা আপনার রিপোর্ট না। বয়সটা দেখুন। আচ্ছা সেদিন কী তনু নামের অন্যকেউ কাকতালীয় ভাবে এই একই টেস্ট করতে গিয়েছিল?
“হয়তো। আমার সঠিক জানা নেই।”
“রিপোর্টটা আপনার না। হয়তো কোনোভাবে আপনাদের রিপোর্ট বদল হয়ে গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কীভাবে এতবড় ভুল করতে পারল?
তনু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জীবনে এত খুশি কোনোদিনও হয়নি তনু।

আকাশে পূর্ণিমার ঝলমলে চাঁদ। তনু মিষ্টিকে বলল,
“ছাদে যাবি মিষ্টি?”
“এত রাতে?”
“চল না প্লিজ?”
“ভারি লেহেঙ্গা চেঞ্জ করে নেই?”
তনু একগুঁয়ের মতো বলল,
“না।”
মিষ্টি লাজুক হেসে বলল,
“আচ্ছা চলুন তবে।”
বাসার বাইরে এসে তনু মিষ্টিকে কোলে তুলে নিল। তারপর একটা একটা করে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে গেল। ছাদে গিয়ে আস্তে করে মিষ্টিকে নামিয়ে দিল। ছাদে মাঝারি সাইজের একটা শিউলি ফুল গাছ আছে। এই মধ্যরাতে গাছে অজস্র ফুল ফুটে রয়েছে। শিউলি ফুলের সুবাসে চারপাশ মাতোয়ারা। তনু মিষ্টির পেছনে দাঁড়িয়ে দুইহাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরল। মিষ্টি আবেশে কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর দাবানল। তনু মিষ্টির কাঁধে চিবুক রেখে আকাশের দিকে তাকাল। ফিসফিস করে বলল,
“দ্যাখো আকাশ..আমার কাছেও ব্যক্তিগত একটা চাঁদ আছে। তোমার ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের থেকেও হাজারগুন সুন্দর আমার চাঁদ। প্রতিনিয়ত আমার জীবনে দ্যুতি ছড়িয়েই যাচ্ছে। আমি আমার চাঁদকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি।
মিষ্টি লজ্জা পেয়ে পেছন ফিরে তনুর বুকে মুখ গুঁজল। ওই দূর আকাশের বুকে লেগে থাকা চাঁদটাও আজ লজ্জা পেল কী? নাহলে ওমন করে মেঘে ঢেকে গেল কেন?

চলবে