মিষ্টির তনুদা পর্ব-২২ এবং শেষ পর্ব

0
1

#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
#২২_ও_শেষপর্ব

“মিষ্টি?”
“হুঁ?”
“তোকে একটা কথা বলা হয়নি।”
মিষ্টি মুখ তুলে তাকাল। চাঁদের আলোতে তনুকে দেখতে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। তনু মিষ্টিকে নিয়ে ছাদের কার্ণিশে বসল। মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার পরিবর্তন হওয়ার পেছনে একটা গোপন সত্যি আছে।”
“কী সত্যি?”
“তুই যে প্রায়ই বলতি না, খারাপ মানুষ সহজে ভালো হয় না। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা না।”
“তারমানে আপনি..
” আগে আমার পুরো কথাটা শোন?”
“বলুন?”
“আমাদের বিয়ের পর আমি আর খারাপ জায়গা যাইনি ঠিকই। যেহেতু মন চাইলেই তোকে কাছে পাইতাম। তাই আর যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। তবে ফোনে প্রায়ই মেয়েদের সাথে গোপন চ্যাট করতাম। গোপন চ্যাট বুঝিস তো?”
মিষ্টি দুইহাতে মুখ ঢেকে ফেলল। ওর খুব কান্না পাচ্ছে। মা ঠিকই বলে, খারাপ মানুষ কখনো ভালো হয় না৷ তনু মিষ্টির মুখ থেকে হাতদুটো জোর করে সরিয়ে দিল। মিষ্টির কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল,
“পুরো কথাটা আমাকে শেষ করতে দে! অর্ধেক শুনেই এত ভেঙে পড়িস না মিষ্টি।”
মিষ্টি বিড়বিড় করে বলল,
“শুনতে ইচ্ছে করছে না।”
“প্লিজ মিষ্টি।”
মিষ্টি বিরসমুখে অন্যদিকে তাকাল। ওর বুকের ভেতর খুব কষ্ট হচ্ছে। তনুটা সত্যি সত্যিই ভালো ছেলে হয়ে গেলে খুব কী ক্ষতি হতো? হতো না। তাহলে কেন ভালো হলো না মানুষটা! তনু মিষ্টির বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
“তোকে বিয়ে করার পরও আমার ভেতরে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে একটা ভয় সবসময় কাজ করতো। যদি সবাই জেনে যায়। আমার মানসম্মান থাকবে না। আমাকে তোর বাবা অপমান করবে। ছোটদের সামনে আমার ইমেজ নষ্ট হবে। আমার ভয়কে সত্যি করে দিয়ে সত্যি সত্যিই প্রায় অনেকেই আমার ব্যাপারে জেনে গেল। তবুও আমার ভেতরে সেভাবে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আসলে যে একবার নীল-সাদার রঙিন দুনিয়ায় পা রাখে। সে চাইলেও সহজে আর বের হতে পারে না। আমিও পারিনি।
হঠাৎ একদিন প্রচণ্ড মাথা ব্যথা নিয়ে একা একা ডাক্তার দেখাতে গেলাম। বলে রাখা ভালো। আমার মাথা ব্যথা নতুন না। মাঝে মাঝে তীব্র মাথা ব্যথা হয়। তো সেদিন ডাক্তার কিছু টেস্ট দিল। কাকতালীয় ভাবে আমার টেস্টের রিপোর্ট তনু নামের অন্য একটা ছেলের সাথে বদলে গিয়েছিল। এই দোষটা অবশ্য আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই দেব। তো সেই রিপোর্টে লেখা ছিল, আমার ব্রেন টিউমার। বাঁচার সম্ভবনা নেই। আমার দুনিয়ায় আয়ুকাল ছয়মাস বা তারও কম। বিশ্বাস কর। সেদিন আমি সারারাত কেঁদেছি। কেন আমিই এত তাড়াতাড়ি মারা যাব! একটাই তো জীবন আমাদের। আরও বেশকিছু বছর বেঁচে গেলে, খুব কী ক্ষতি হতো! এখনো গোটা একটা জীবন পরে আছে আমার। কত শখ, ফূর্তি পুরণ করা বাকি। সব ফেলে নাকি আমাকে চিরতরে চলে যেতে হবে। আমার নিথর দেহখানা পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
আমার যে গার্লফ্রেন্ডের মোহে পড়ে আমি যৌবন নষ্ট করেছি। তাদের সবাইকে একে একে মেসেজ দিয়ে আমার রোগের কথা বলেছি। দিনশেষে কেউ আমার পাশে থাকেনি। সবাই সহানুভূতি দেখিয়ে আমাকে ওদের জীবন থেকে ইনিয়ে-বিনিয়ে ব্লক করে দিয়ে কেটে পড়েছে। অথচ ওদের জন্য আমাদের পবিত্র স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একসময় নষ্ট হয়ে যেতে বসেছিল। দিন দিন আমার ভেতরে ভয় বাড়তে লাগল। তোকেও খুব করে মানানোর চেষ্টা করলাম। তবে তোকে সত্যিটা বলতে ইচ্ছে করল না। যদি তুইও সবার মতো আমাকে ছেড়ে চলে যাস। তাহলে আমার কী হবে! ততদিনে তোর প্রতি ভীষণ মায়া জন্মে গিয়েছিল। তোকে অন্তত একটা বার না দেখলে আমার খুব অস্থির লাগত। একদিন কৌতূহল থেকে মরার পর মৃত মানুষের সাথে ঠিক কী কী হয়। সার্চ দিয়ে একটা মুভি পেলাম৷ এতই ভয়ংকর ছিল। পুরো মুভি দেখার সাহস হয়নি। অর্ধেক দেখেই আমি ভগবানের কাছে আমার পাপকর্মের জন্য বার বার ক্ষমা চেয়েছি।
তুই একবার ভাব মিষ্টি। আমার আয়ুকাল মাত্র ছয়মাস। যে কোনো সময় আমার মৃত্যু হবে। আমার জীবন তো পাপে পরিপূর্ণ। একটা ভালো কাজ করেছি নাকি আমার সঠিক মনে পড়ে না। মরার পর আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কী জবাব দেব। এইসব ভাবতে ভাবতে আমি পাগল পাগল হয়ে যেতাম। তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। নতুন করে আর কষ্ট দিতে চাইনি। তোর মনে আছে? তোর কাছে আমি ছয়মাস সময় চেয়েছিলাম। ভেবেছি মরেই তো যাব। যে-কটাদিন বেঁচে আছি। তোকে ভালোবেসে আপন করে নেব। তোর সাথে আমার শেষ সময়ের বেস্ট কিছু স্মৃতি জমিয়ে তোকে উপহার দিয়ে যাব। মাঝে মাঝে ভাবতাম। আমি মারা যাওয়ার পরে তোর তো অন্যকারো সাথে বিয়ে হয়ে যাবে। তুই অন্যকাউকে আদর করবি, ভালোবাসবি, স্বামীর অধিকার দিবি। তখন না আমার খুব কষ্ট হতো। আবার অনুশোচনাও হতো। আমি মরে যাওয়ার পর তুই অন্যকারো বউ হবি ভাবলেই আমার দম বন্ধ হয়ে যেত। অথচ তুই আমার বউ থাকা অবস্থায় আমার সম্পর্কে কতকিছু জেনে গেছিস। তোর কত ধৈর্য রে মিষ্টি। কথাগুলো চিন্তা করলেই তো আমি অনুভূতিশূণ্য হয়ে যেতাম। আর তুই এতকিছুর পরও কীভাবে মুখ বুঁজে মেনে নিলি?” কথাগুলো বলতে বলতে তনু মিষ্টির দিকে তাকাল। দেখল, মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তনু মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“এই বোকা কাঁদছিস কেন? চেয়ে দ্যাখ.. আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। আমার কিছুই হয়নি। তবে বেঁচে থেকেও আমি মৃত্যুর অনুভূতির আসল স্বাদ পেয়েছি। আমার ভালো হওয়ার জন্য এই একটা কারণই যথেষ্ট ছিল।
আজ আমি এই মায়াময় রাত, চাঁদ, তারাকে সাক্ষী রেখে বলছি, জীবনে যতগুলো দিন বেঁচে থাকব। শুধু তোর ‘বর’ হয়েই থাকব রে মিষ্টি। তুই শুধু তোর মতো করে তোর ভালোবাসায় আমাকে রাঙিয়ে নিস।
মিষ্টি তনুর বুকে নির্ভয়ে মুখ গুঁজল। আদুরে কণ্ঠে বলল,
” সত্যি তো?”
তনু মিষ্টির কপালে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিল। বলল,
“তিন সত্যি বউ।”
“অনেক রাত হয়েছে। ঘরে চলুন।”
“আর একটু থাকি না?”
“না আমার খুব খিদে লেগেছে।”
তনু একচোখ টিপে দুষ্টুমি করে বলল,
“কী খাবি মিষ্টি?”
মিষ্টি লজ্জায় নুয়ে গেল। একটু একটু রাগও লাগছে। চোখ রাঙিয়ে বলল,
“ভাত খাব ভাত।
তনু হেসে দিল। মন ভালো করা হাসি। বলল,
“চোখদুটো বন্ধ কর মিষ্টি?”
মিষ্টি ভয়ে ভয়ে বলল,
“গলা-টলা টিপে মেরে ফেলবেন নাকি?”
তনু অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। হাসতে হাসতে চোখের কোণে জল জমল। বলল,
“মারতেও পারি।”
মিষ্টির ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠল। আলতো করে দুচোখ বুঁজল। তনুর গরম নিঃশ্বাস মিষ্টির ঘাড়ে উপচে পড়ছে। তনু মিষ্টির গলায় শিউলি ফুলের মালা পরিয়ে দিল। আবেশে কেঁপে কেঁপে উঠল মিষ্টি। শিউলি ফুলের স্নিগ্ধ ঘ্রাণে মিষ্টির মন জুড়িয়ে গেল। তনুর চোখে চোখ রাখল মিষ্টি। মিষ্টির মায়া মায়া চাহনিতে তনুর বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল।
তনু মিষ্টির কাঁধ জড়িয়ে ধরে মিষ্টিকে কাছে টেনে নিল। মিষ্টির গলায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আজ ফুলের মালা দিলাম। খুব শীঘ্রই তোকে একটা সোনার চেইন গড়িয়ে দেব মিষ্টি।”
মিষ্টি তনুর বুকে নিশ্চিন্তে মাথা রাখল। আদুরে কণ্ঠে বলল,
“লাগবে না। শুধু এভাবেই ভালোবেসে সারাজীবন আপনার মায়ায় জড়িয়ে রাখবেন আমাকে।”
তনুর হাতের বাঁধন আর একটু শক্ত হলো। মিষ্টি বুকভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। মনটা আনন্দে পুলকিত।
আজ থেকে এই মানুষটাকে নিয়ে মিষ্টির আর কোনো ভয় নেই, সংশয় নেই। কোনো জড়তা নেই, কোনো অভিযোগ নেই। এই মানুষটা শুধুই মিষ্টির। যতগুলো দিন সে বেঁচে থাকবে। মিষ্টির ভালোবাসার মানুষ হয়েই বেঁচে থাকবে। এক পুরুষে আসক্ত প্রত্যেকটা নারীই মিষ্টির মতো ভাগ্যবতী হোক। তনুরা দেরিতে হলেও মিষ্টিদের গুরুত্ব বুঝুক। ভালোবেসে আপন করে নিক তাদের রাজ্যের রানীকে। সারাজীবন রাজরানী করে রাখুক তাদের যত্নে-ভালোবাসায়।
মিষ্টি আজীবন তার ‘তনুদাকে’ নিয়েই ভালো থাকুক, সুখে থাকুক। শান্তিতে সংসার করুক।

(সমাপ্ত)