মুগ্ধতায় তুমি আমি পর্ব-০২

0
24

#মুগ্ধতায়_তুমি_আমি
লেখিকা: #ইয়ানূর_মাশিয়াত
#পর্ব_০২

মুখে মুখে অন্তরকে যাই বলি না কেন তাকে যে আমি ভালোবাসি তা কিন্তু সত্যি। ছয়টা বছর মানুষটার সঙ্গে আছি তার প্রতি ভালোবাসা থাকাটা স্বাভাবিক। ভালো খারাপ সবসময়ই তার পাশে ছিলাম তার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে। এতো গুলো বছরে যত কষ্টই উনি দিক না কেন তাকে ছাড়ার চিন্তা মাথায় আনি নি। বেশি কষ্ট পেলে তখন এরকম চিন্তা মাথায় আসে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার চলে যায় মাথা থেকে। সে যাই হোক আমার সাথে যেমনই করুক সে আমার স্বামী। তার পাশে থাকা আমার দায়িত্ব।কিন্তু আজ সে আমার সাথে কি করলো এটা? আমার জন্য সতীন নিয়ে এলো? সতীনের সংসার করতে হবে আমাকে? আমার দু চোখ দিয়ে নোনাজল পড়ছে। অন্তর চেঁচিয়ে উঠে বললো,

‘কি করলি এটা তুই? তোর সাহস দেখি কম না! তুই আমার নতুন বউকে পুড়ি’য়ে মা’রতে চাস?’

ওর কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। তাদের গায়ে শুধু ডালের ছিটা গিয়েছে। নতুন বউয়ের তো শুধু শাড়িতে লেগেছে। আমার তো পা ঝলসে গেছে মনে হচ্ছে। আর সে কি বললো!

দরজার সামনের এমন হট্টগোল শুনে আমার শাশুড়িও চেঁচামেচি করতে করতে চলে আসলো। শাশুড়ি বললো, দরজার সামনে কি হয়েছে? সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছো যে? ডালটাও তো ফেলে দিলে। বলি কি তুমি কি শুধু হাত পায়েই বড় হয়েছো তোমার এখনো আক্কেল হয় নি ?

শাশুড়ি হাঁটতে হাঁটতে দরজার সামনে এলো। দরজার দিকে তাকিয়ে অন্তরকে দেখে তিনি বললেন, কিরে বাবা কি করেছিস তুই? তুই আবার বিয়ে করেছিস?

অন্তর হাসলো। পাশের মেয়েটা এগিয়ে এসে শাশুড়িকে সালাম করলো। শাশুড়ি কিছু বললেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়েই রইলেন। অন্তর বললো,

আবার বিয়ে করেছি মা। ওর তো প্রমাণ লাগবে আমি পুরুষ কিনা! দেখো না বার বার ডাক্তারের কথা বলে আমাকে। তাই ওকে সত্যিকারের প্রমাণ দিবো আমি এবার। সমস্যা যে ওর এটা আমি প্রমাণ করবো।

শাশুড়ি বললেন, ‘তাই বলে এভাবে হুট করে বিয়ে করে নিবি? বলা নেই কওনা নেই কোন মেয়েকে বিয়ে করলি তুই? ওর বংশ পরিচয় কি?

অন্তর বিরক্ত হলো। বললো, ‘উফ মা ওকে বিয়ে যেহেতু করেছি ওর সম্পর্কে ভালোমতো জেনে শুনেই বিয়ে করেছি আমি। এবার ভিতরে আসতে দাও তো আমাদের। ওই অপ’য়া তো ওকে একটু আগে পুড়ি’য়ে মারতে চেয়েছিল। দেখো না কেমন ডাল ফেলে দিলো ওর গায়ে।

এতোক্ষণ ধরে ওদের কথা শুনেই যাচ্ছি আমি। উত্তর দেওয়ার মতো বল শক্তি কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। পাবো কিভাবে? আজ তো আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। এতো দিন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে এ বাড়িতে ছিলাম। এখন এবাড়িতে থাকবো আমি কিসের আশায়?

অন্তরের কথার জবাবে আমি বললাম, আপনার নতুন বউয়ের তো গায়ে পড়েছে ডাল এতেই পু’ড়ে গেছে? আপনি যে আজ আমার মনটাই পুড়ি’য়ে দিলেন তার কি হবে?

বলেই আমি ভিতরে চলে আসলাম। আমার বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। আমার শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। এখন কি করবো বুঝতে পারছি না। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। বিছানায় বসেছি দু মিনিট ও হয় নি। দরজার ধিরিম ধিরিম শব্দে উঠে দাঁড়ালাম। মনে হচ্ছে যেন দরজাটা ভেঙেই ফেলবে। আমি দ্রুত দরজাটা খুলে দিতেই অন্তর কর্কশ শব্দে বললো, দরজা দিয়ে রুমে কি করছিস? বের হ এখান থেকে। নতুন বউ এনেছি দেখছিস না? আজ থেকে এ বাড়ি এ ঘর সবকিছু ওর। তোর যা ছিলো সব ওর।

বলেই বিশ্রি হাসি দিলো সে। নতুন বউটা এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এ যাত্রায় মুখ খুললো। বললো, তুমি বিবাহিত জেনে বিয়ে করলেও আমি সতীনের সংসার করবো না অন্তর। ওকে এ বাড়ি থেকে তোমায় বিদায় করতে হবে।

অন্তর বললো, ডোন্ট ওয়ারি। এক সপ্তাহের মধ্যে ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো আমি। এরপর এ বাড়ি থেকে আউট।

তাদেরকে শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আমি। সে ভাবলো কিভাবে সে এমন একটা কাজ করার পর আমি তার বাড়িতে থাকবো তাও একটা সপ্তাহ। বাড়ি তো এই মুহূর্তেই ছাড়ব। আমি তাকে বললাম, আপনি ভাবলেন কি করে আপনার সংসার আমি আরো করবো? আমার ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলেন আপনি? এটা কি করে পারলেন আপনি অন্তর?

বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। অন্তর বললো, সেটা তোর ওসব কথা বলার আগে ভাবা উচিত ছিলো। তাছাড়া বিয়ে আমি আগে পরে করতামই। তুই তো জীবনেও আমাকে বাচ্চার মুখ দেখাতে পারতি না।

আমি আর কিছু বললাম না। তার সাথে কথা বলতেও মন চাচ্ছে না। সেখান থেকে বেরিয়ে ড্রইং এ চলে আসলাম। আমার শাশুড়ি সোফায় বসে ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, দেখলে পুরুষ মানুষের সাথে মুখ নাড়ালে কি হয়? তাছাড়া ছেলেটা ভালোই করেছে। এবার নাতিনাতনির মুখ আমি দেখতে পারবো।

আমি তাকে কোন উত্তর দিলাম না। নাকের নাকফুল আর কানের দুলজোড়া খুলে তার সামনে দিলাম। হাতের চুড়ি দুটোও খুলে ফেললাম। এরপর মেইন দরজার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। শাশুড়ি আমাকে ডেকে বললেন, কোথায় যাচ্ছো?

আমি শান্ত ভাবেই বললাম, চলে যাচ্ছি। আপনাদের আর আমার মতো অ’পয়াকে দেখতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু আমার সাথে আপনারা যা করেছেন তার পরিণাম আপনারা ভোগ করবেন মা। আমি সহ্য করেছি আপনাদেরকে, আপনাদের প্রত্যেকটি অপবাদকে। কিন্তু ওপার ওয়ালা সইবে না মা । তিনি আপনাদের বিচার ঠিকই করবেন।

এতটুকু বলে চোখের পানি মুছে নিলাম আমি। আমার শাশুড়ি কিছু একটা বলার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে আমি বললাম, আপনার ছেলেকে বলবেন ডিভোর্স পেপারটা আমার মায়ের বাসায় পাঠিয়ে দিতে। এখন আসি। ভালো থাকবেন।

বলেই সে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম আমি। এক কাপড়ে সে বাড়ি ছাড়লাম আমি। বাড়ি থেকে বের হয়ে ইচ্ছে হলো গাড়ির নিচে ঝাঁপ দেই কিন্তু আমার মাটা পৃথিবীতে একা। আমি শেষ হয়ে গেলে সেও শেষ হয়ে যাবে। তাই রওয়ানা হলাম মায়ের বাসার দিকে। মায়ের বাসা এবাসা থেকে বেশি দূরে না। বলা যায় প্রতিবেশী। মা একাই থাকেন। আমার মা আগে এ এলাকায় থাকতেন না। আমার বিয়ের পর এসেছেন। আমার কাছাকাছি থাকতে চাওয়ার কারণেই এখানে এসেছেন তিনি। পায়ে হেঁটেই মায়ের কাছে চলে গেলাম আমি। দরজায় কলিং বেল দেওয়ার আগে মুখ চোখ মুছে নিলাম। নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। দরজায় কলিং বেল দিতেই মা দরজা খুলে দিলেন। মিষ্টি হেসে আমাকে বললেন, তুই এসেছিস? কতদিন পর আসলি? মায়ের খোঁজ নিতে ইচ্ছে হয় না এখন আর?

শত চেষ্টা করেও নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। মাকে জরিয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ফেললাম। মা আমাকে শান্তনা দিয়ে বললো, কিরে কাঁদছিস কেন? এভাবে কাঁদে কেউ? কি হয়েছে? আয় আয় জলদি ঘরে আয়।

মা আমাকে ঘরে নিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে দিলেন। এরপর বিছানায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে কি হয়েছে? এভাবে কাঁদছিস কেন? ও বাড়ির কেউ আবার কিছু বলেছে তাই না? তুই বলিস নি তোর কোন সমস্যা নেই? অন্তর ডাক্তার দেখিয়েছে? ওর ও তো কোন সমস্যা থাকতে পারে। ওর মাকে….

মা থেমে গেলো।আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, একি পায়ের কি অবস্থা বানিয়েছিস! পু’ড়লো কি করে?

মা দ্রুত গিয়ে পেস্ট নিয়ে আসলো। আমার পায়ের পো’ড়া অংশে লাগিয়ে দিতে দিতে বললো, এভাবে পুড়’লো কি করে? রান্না করতে গিয়ে পুড়িয়েছিস? নিজের খেয়াল রাখতে…

‘অন্তর আবার বিয়ে করেছে মা। তাই আমি চলে এসেছি মা। উনি আমায় ডিভোর্স দিবে।’

আমার কথায় মায়ের মুখ বন্ধ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ মলিন হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর হঠাৎ ই বুকে হাত দিয়ে জ্ঞান হারান…

চলবে..