#মুগ্ধতায়_তুমি_আমি
লেখিকা: #ইয়ানূর_মাশিয়াত
#পর্ব_০৩
মায়ের চোখে পানির ছিটা দিয়ে, হাত পা মালিশ করার পরও যখন মায়ের জ্ঞান ফিরলো না তখন ডেকে আনলাম পাশের ঘরের আন্টিকে। উনি পরামর্শ দিলেন মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার। বাড়ির সবাই মিলে মাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার মাকে দেখে বললেন হার্ট অ্যাটাক করেছে। শুনে কষ্ট পেলাম অনেক। আমার সাথেই এমন কেন হচ্ছে? একে তো অন্তর এমন করলো তার উপর মায়ের এমন অবস্থা! কোথায় যাবো আমি? কি থেকে কি করবো ভেবে পাচ্ছি না আমি। মায়ের পাশে মায়ের হাতটা ধরে বসে থাকলাম। মায়ের জ্ঞান ফিরলো কিছুক্ষণ পর। জ্ঞান ফিরতেই শক্ত করে মায়ের হাত ধরলাম। মা কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, মা রে এমন হলো কেন বল তো? তোর কপালে এমনটাই হওয়ার ছিলো? মা হয়ে আমি এসব কিভাবে সহ্য করি বল? এখন তোর কি হবে?
মায়ের কথায় আমিও কেঁদে ফেললাম। মাকে বললাম, তুমি কেঁদো না। কপালে যা হওয়ার হয়েছে। ওপর ওয়ালা ঠিক বিচার করবেন। তুমি টেনশন করো না মা। তোমার কিছু হলে আমি মেনে নিতে পারবো না।
মা ও আমি দুজনেই সমান তালে কাঁদছি। আমি মাকে বার বার শান্তনা দিচ্ছি। মাকে বোঝাচ্ছি আমার একটা ব্যবস্থা হবেই। কিন্তু আসলেই কি হবে আমার?
.
হাসপাতালে কেটে গেলো তিনদিন। তিনদিন পর বাড়িতে ফিরলাম আমরা। রাস্তা দিয়ে আসার সময়ই দেখছিলাম আশেপাশের মানুষ আমাদের দিকে কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল। কেউ কেউ হেসে হেসে কানাকানি করছিলো। বুঝলাম না এমন কেন করছে। আমরা বাড়ি চলে আসলাম। বাড়িতে এসে সব গুছিয়ে মায়ের জন্য রান্না করে নিলাম। মাকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিলাম। এরপর বিকেলের দিকে আমাদের পাশের ঘরের আন্টি আসলেন। ওনার নাম রুমা। উনিই ওইদিন মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। আন্টি এসে মায়ের ভালোমন্দ খোঁজখবর নিলেন। এরপর বললেন, তোমার মেয়েকে না তুমি ডাক্তার দেখাইছিলা সুমি? তুমি না আমারে বললা তোমার মেয়ের কোন সমস্যা নাই তাইলে এগুলা কি শুনি সুমি?
ওনার কথার মানে কিছুই বুঝলাম না। মা আর আমি একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি ওনাকে বললাম, কি হয়েছে আন্টি?
আন্টি বললেন, তোমার জামাই নাকি আবার বিয়া করছে। অন্তরের মা পুরা এলাকা বলে বেড়াইতাছে তুমি বন্ধ্যা তাই তার ছেলে আবার বিয়ে করছে। তোমাকে তালাক দিয়ে দিবে। আরো নানান কথা।
অবাক হলাম আমি। এরমধ্যে সারা এলাকায় বলেছে আমার বাচ্চা হবে না? মানে আমার ঘাড়ে সব দোষ দিয়ে দিলো? কি করবো আমি? এখন কে বিশ্বাস করবে আমার কথা? ভিতরে ভিতরে ভে’ঙে পড়লাম। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিলাম না। মা তো কেঁদে ফেললেন। বললেন, ওরা খুব খারাপ আপা। আমার মেয়েটার কোন দোষ নেই। ওরা মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আমার মেয়েটাকে ঘর ছাড়া করেছে আপা।
আন্টি বললেন, আমি তো জানি বোন। কিন্তু মহল্লার সবাই তো জানে না। অন্তরের মা যেই ভাবে সবার কাছে বইলা বেড়াইতাছে তোমারে আর কি বলমু। মহল্লার একটা মানুষরেও জানানের কাম বাদ নাই।
মা বললেন, ওই মহিলাকে আর তার ছেলেকে আমি যদি আগে চিনতাম তাহলে জীবনেও মেয়েকে ওদের বাড়িতে বিয়ে দিতাম না আপা। ওরা মানুষ না।
মহিলা মাকে শান্তনা দিলেন। আমাকেও বিভিন্ন উপদেশ দিলেন। এরপর চলে গেলেন।
আমি শুধু নিজের পরিস্থিতি কতটা ভয়া’বহ তাই ভাবছি। একে তো আমার উপর মিথ্যে অপবাদ দিলো এখন তো মহল্লায় ছড়িয়ে দিলো সেই অপবাদ। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম এসব ভেবে।
.
এর মাঝে কেটে গেলো কয়েকদিন। ঘর থেকে বের হওয়াই দায় হয়ে গেলো। কেউ দেখলেই নানান কুটুক্তি করে। আমাদের দেখলেই নানান কথাই শোনাচ্ছে। চুপচাপ শুনেই যাচ্ছি কোন উত্তর দিচ্ছি না। ওপর ওয়ালার বিচারের আশায়ই তাকিয়ে আছি। আজ বিকেলে আবার ডিভোর্স পেপার চলে এসেছে আমাদের বাড়িতে। এর কথা আগেই জানতাম। কারণ এটা বাড়িতে আসার আগে মহল্লার সবার কানে পৌঁছে গেছে যে এটা আজ আসবে। অন্তরের মা গিয়ে গিয়েই সবার কাছে বলেছে এই খবর। বাতাসে বাতাসে আমার কানেও চলে এসেছে এই খবর। এই যন্ত্র’না যেন ম’রণ যন্ত্র’ণার সমতুল্য। নিজেকে এখন পাগল পাগল লাগছে। শেষ পর্যন্ত অন্তরের সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলো। সে নিজের হাতে সবকিছু শেষ করে দিলো। আলাদা হয়ে গেলাম আমরা! এখন দুজনের রাস্তা আলাদা আলাদা। তার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই ভাবলেই বুকটা খা খা করে উঠে। মানতে পারছি না যেন এটা আমি। কিন্তু সত্যি তো আর মিথ্যা হয় না!
.
সময় চলতে থাকে। কেটে গেলো আরো কয়েকটা দিন। একে তো এমন যন্ত্র’না তারউপর আশেপাশের মানুষের কটু কথা! ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে আমাকে এগুলো। গতকাল তো দেখেছি অন্তর তার নতুন বউ নিয়ে আমাদের বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কি সুন্দর হেসে হেসে যাচ্ছে আর কথা বলছে তার সাথে! এসবের পর নিজেকে সামলাতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিলো আমার। মাও বোধহয় আমার কষ্ট বুঝলেন। একদিন বিকেলে মা আমাকে বললেন, তোকে একটা কথা বলার ছিলো।
আমি তখন জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিলাম। মায়ের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, বলো।
মা বললেন, আগামীকাল তোর ছোট মামা তোকে নিতে আসবে।
আমি আশ্চর্য হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? কি হয়েছে?
মা বললেন, কিছু হয় নি। তুই এখন থেকে সেখানেই থাকবি।
মায়ের কথা ঠিক বুঝলাম না। আমি এখন থেকে সেখানেই থাকবো মানে? আমি মামার বাড়িতে থাকতে যাবো কেন? মাকে বললাম, মানে? সেখানে পাঠাচ্ছো কেন আমাকে?
মা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, পাঠাচ্ছি না চলে যাচ্ছি। এখানে আর থাকছি না। বাড়িওয়ালাকে না করে দিয়েছি। টেইলার্স ও বন্ধ করে দিয়েছি। এমাস শেষ হলে আমিও তোর মামা বাড়ির দিকে চলে যাবো। এ এলাকায় আর থাকা যাবে না রে মা। তোকে এমন দেখতে আমার একটুও ভালো লাগে না। এসব মানুষের কথাবার্তা শুনে তুই মন খারাপ করে থাকিস তা আমি চাই না। সবাই না জানলেও আমি তো জানি আমার মেয়ের দোষ না গুণ। কিন্তু কাউকে কিছু বলে লাভ হবে না যে। তাই এ শহর ছাড়াই আমাদের জন্য ভালো হবে। তুই কাল তোর মামার সাথে যাবি ব্যাস।
মায়ের কথার বিপরীতে কিছুই বললাম না। ঠিকই বলেছে। এলাকায় থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো। অন্তর এভাবে আমার সামনে ঘুরলে আমি ঠিক পাগল হয়ে যাবো। তাই তৈরি হলাম এ শহর ছাড়ার জন্য। আগামীকাল মামার সাথে রওয়ানা হবো রাজশাহীর উদ্দেশ্য।
.
ছোট মামা এলেন সকাল দশটা নাগাদ। মামা আসার পরপরই মা কেঁদে দিলেন। মামা মাকে শান্তনা দিলেন কিছুক্ষণ। এরপর আমাকেও ধৈর্য ধরতে বললেন। আমার ব্যাগপত্র আমি গুছিয়ে নিয়েছি গতকাল রাতেই। মা মামার জন্য খাবার বাড়লেন। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমাকে নিয়ে রওয়ানা হলেন মামা। ব্যাগপত্র নিয়ে গেইটে আসতেই দেখা হলো অন্তরের সাথে। অন্তর আমাকে দেখেই বিশ্রি ভাবে হাসলো। বললো, কোথায় যাচ্ছিস? কোথাও গিয়ে লাভ নেই। তোর কলঙ্ক মুছবে না। তুই কারো ঘর করতে পারবি না কখনো দেখিস। তোর মতো বন্ধ্যা মেয়েকে কে বিয়ে করবে?
বলেই সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আমার খুব ঘৃণা হলো। এই মানুষটার জন্য প্রেম ভালোবাসা কিছুই অন্তরে অবশিষ্ট থাকলো না তার কথা শুনে। তাকে কিছু না বলে মামার সঙ্গে চললাম। সে পেছন থেকে আরো নানান কথা শোনালো। আমি কিছু বললাম না। স্টেশনে পৌঁছে টিকেট কাটলাম ট্রেনের। রওয়ানা হলাম রাজশাহীর দিকে। এ শহর থেকে বহু দূরে চলে যাচ্ছি আমি। যেখানে আমাকে কেউ চিনবে না কেউ এসব ব্যাপারে কথা বলবে না…
চলবে…