মুগ্ধতায় তুমি আমি পর্ব-০৪

0
25

#মুগ্ধতায়_তুমি_আমি
লেখিকা: #ইয়ানূর_মাশিয়াত
#পর্ব_০৪

আমি রাজশাহীতে এসেছি প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। আপাতত ছোট মামার বাসাতেই আছি। মা বলেছেন উনি এখানে আসলে আমরা ভাড়া বাসায় চলে যাবো। মা আরো বলেছেন নানা বাড়ির যে জায়গাটুকু মা পেয়েছেন সেখানে ঘর করবেন। এরপর আমরা সেখানেই থাকবো। আমার ছোট মামি মানুষটা খুব ভালো মনের মানুষ। আসার পর থেকে আমাকে বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছেন। জীবনে সামনে চলার মনোবল যোগাতে বলেছেন। কারো জন্য জীবন থেমে থাকে না। তিনি কয়েকটা দিনে আমাকে অনেকটাই সাহস জুগিয়েছেন। অন্তরের জন্য ভালোবাসা গুলো বদলে ঘৃণায় পরিণত হচ্ছে এখন। আমার মা এসেছেন দুইদিন আগে। মা আসার পর বড় মামা এসেছেন ছোট মামার বাড়িতে। বড় মামা নানার থেকে পাওয়া জমি বিক্রি করে শহরের দিকে বাড়ি করেছেন। উনি এখন ওখানেই থাকেন। আজকে উনি এসেছেন এ বাসায়। মামাকে দেখে মা আবার কান্না করে দিলো। এরপর মামাকে সব ভে’ঙে বললো। শুনেই মামা রে’গে গিয়ে বললেন, আমি তোকে আগেই বলেছিলাম ওই ছেলের সাথে তোর মেয়ের বিয়ে না দিতে। ছেলেটাকে আমার সুবিধার মনে হয় নি। তোরা তো আমার কথা শুনলি না। ভালো চাকরি দেখে দিয়ে দিলি বিয়ে। এবার দেখ আসল রূপ বেড়িয়ে এলো তো।

মামা রা’গে ফুঁসছেন। মা কান্না করছে। বড় মামি ফোড়ন কেটে বললো, ছেলের দোষ আছে তোমার ভাগনির ও দোষ আছে। ছেলে যা করছে খারাপ করছে ঠিক আছে। কিন্তু তোমার ভাগনির তো বাচ্চা হয় না। ছেলে কি তোমার ভাগ্নিকে মুখ দেখে রাখবো? ছেলের কি বাপ হইতে মন চায় না?

আমি মামা মামিদের কথার মাঝখানে যাই নি। পাশের ঘরেই ছিলাম। সেখান থেকেই তাদের কথা শোনা যাচ্ছে।ওনার কথা শুনে বিস্মিত হলাম । মা বললেন, ভাবি আমার মেয়ের কোন সমস্যা নাই। ওরা ওর নামে মিথ্যে অপবাদ ছড়িয়েছে।

বড় মামি আবারও বললেন, তারা তোমার মেয়ের নামে মিথ্যা অপবাদ ছাড়াইছে এটা তুমি বলো কেমনে? ছয় বছর হইছে বিয়া দিলা বাচ্চা হইলো না তাহলে তুমি এইটা কও কেমনে?

‘কারণ আমার মেয়েকে আমি ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেছে ওর সমস্যা নাই।’

বড় মামি এবার মুখ ভেঙচি দিলেন। এরপর বললেন, বলতে পারি না বাপু কি কও না কও তুমি। কি ডাক্তার ফাক্তার দেখাও তোমরা কে জানে। পুরুষ মানুষের কি দোষ থাকে কোন? দেখাও গিয়া তোমার মাইয়ারই দোষ।

মামির কথায় মা রে’গে গেলেন। এক কথায় দু কথায় মামির সাথে মায়ের খুব লাগলো। এরপর বড় মামা ধমকে মামিকে চুপ করালেন। আমি খালি চুপচাপ তাদের কথা শুনলাম। কোন উত্তর দিলাম না। তখন ছোট মামি আমার কাছে আসলো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, দেখেছিস তো কি হচ্ছে? এর মানে এই না তুই হেরে গেছিস। তোকে লড়তে হবে। ওদের মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে।

ছোট মামির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম সেদিন। আর মনে মনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলাম।

.

সময় চলতে চলতে চলে গেলো দুই বছর। নিজেকে অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছি আমি। অন্তরের জন্য কোন অনুভূতিই অবশিষ্ট নেই। যা আছে তা কেবল ঘৃণা। আমি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তি হয়েছি। মা এখানে এসে আবার একটা টেইলার্স দিয়েছেন। নানার জমিতে একটা ছোটোখাটো ঘর উঠিয়েছি আমরা। আমি পড়াশোনার পাশাপাশি কয়েকটা টিউশনি করছি। নিজেকে সামলে বেশ ভালোভাবেই দিন কাটাচ্ছি আমি। দিনগুলো ভালোই চলছিলো কিন্তু হঠাৎ একদিন বিকেলে টিউশনি থেকে ফিরে ঘর ভর্তি মেহমান দেখে চমকে গেলাম। আমাকে দেখে আমার ছোট মামার মেয়ে মিতু দৌড়ে এসে বললো, মৌ আপু আম্মু বলেছে তোমাকে পিছনের দরজা দিয়ে ঘরে যেতে। সামনে অনেক মেহমান। তোমাকে দেখতে এসেছে।

আমি ওকে কিছু বললাম না। পিছনের দরজা দিয়ে ঘরে গেলাম। দেখলাম বড় মামা আর বড় মামি এসেছে। মায়ের সাথে তারা কি যেন বিষয়ে কথা বলছে। ছোট মামি আমাকে দেখে আমার কাছে আসলেন। মন খারাপ করে বললেন, তোর জন্য আমার খুব কষ্ট হয় রে মৌ। আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে আমি এদের ঝাটাপিটা করে বাড়ি থেকে তাড়াতাম। কিন্তু আমার সেই ক্ষমতা নেই রে। আমি তোকে সাহস নিয়ে চলতে বললেও আমার সাহস নেই রে। আজ তোর জন্য কিছু করতে পারলাম না আমি। আমাকে ভুল বুঝিস না তুই।

আমি মামির কথার মানে কিছুই বুঝলাম না। মামিকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে মামি? এভাবে কথা বলছো কেন?

মামি বললেন, তোকে দেখতে এসেছে। পছন্দ হলে এক্ষুনি আকদ পড়িয়ে নিয়ে যাবে। তোর বড় মামা আর মামি নিয়ে এসেছে সম্বন্ধটা। এবার বোধহয় তোর বিয়েটা হয়েই যাবে।

আমি অবাক হলাম। তারা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে কেন? গত দুই বছরে বড় মামা আর মামি অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব এনেছে আমার জন্য। মা বা আমি কেউই রাজি হই নি। এবার একদম পাত্রপক্ষ নিয়েই এসেছে? মামিকে জিজ্ঞেস করলাম, মা কি বলেছে?

মামি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, তোর বড় মামা আর মামি তোর মায়ের মাথাটা খেয়ে নিয়েছে । ফুসলে ফাসলে তাকে রাজি করিয়ে নিয়েছে। তোর মাও রাজি হয়ে গেছে।

আমি অবাক হলাম। ছোট মামি আবার বললেন, ছেলে আগে সুইজারল্যান্ড এ ছিলো। সেখানে এক বিদেশীকে বিয়ে করেছিলো। কিন্তু সে চলে গেছে অন্য একজনের সাথে। একটা মেয়ে আছে। বয়স পাঁচ বছর হবে। মেয়েটা শুধু মা মা করে তাই আবার বিয়ে করতে চাচ্ছে। ভাই-বোন নেই কিন্তু মা বাবা আছে। পাত্র বেশ বড়লোক ও। তাই তোর মামা মামি ধরে এনেছে। এটুকুই জেনেছি আমি।

আমি কিছু বললাম না। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর মা এলেন আমার কাছে। এসে মামির বলা কথাগুলো বললেন। এরপর বললেন, আমারও ছেলে পছন্দ হয়েছে এবার। আমি চাই তুই এই ছেলেকে বিয়ে কর
আমি আর কতদিন থাকবো? আমার পর তোর খেয়াল কে রাখবে?

বলেই মা কেঁদে ফেললেন। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। মাকে কখনও কষ্ট দিতে চাই না আমি। এমনিতেই অনেক কষ্ট করেছে মা আমার জন্য । তাই মায়ের কথায় রাজি হয়ে গেলাম। মা একটা লাল রঙের শাড়ি এনে দিলেন আমাকে। শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে আমি তৈরি হলাম পাত্রপক্ষের সামনে যাওয়ার জন্য। আমি তৈরি হয়ে বসে আছি। তখন ছোট মামি আমার কাছে আসলেন। তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার বিয়ের ব্যাপারে ছেলে জানে?

ছোট মামি মলিন মুখে বললেন, এরজন্যই তো তোকে বিয়ে করছে।

আমি বললাম, মানে?

‘পাত্র বিয়ের জন্য এমন মেয়ে খুঁজছিল যার বাচ্চা হয় না। যাতে তার মেয়েকে নিজের ভেবে লালন পালন করে। সৎ মায়ের মতো আচরণ যাতে না করে। সন্তানের মর্ম বুঝে। তোর মামি তোর কথা বলেছে। তুই বন্ধ্যা শুনেই তারা এসেছে ।’

শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এই মিথ্যা অপবাদ নিয়ে আমায় জীবন কাটাতে হবে? কি বলবো আমি ? এর প্রতিবাদ করবো না আমি? ছোট মামিকে কিছু বলবো এর আগেই মা আর বড় মামি চলে আসলো ।আমাকে নিয়ে গেলো পাত্রপক্ষের সামনে । মা যেতে যেতে আমাকে বললো, মা রে একদম শান্ত থাকবি। এমন কোন কাজ করবি না যাতে তোর বিয়েটা ভেঙে যাক । আমি খুব করে চাই তোর এই বিয়েটা হোক।

আমি চুপ থাকলাম। এক নজর মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের মলিন মুখটা দেখে আর কিছু বললাম না। চুপচাপ এগিয়ে গেলাম। মাও চাইছে এই অপবাদ নিয়ে দ্বিতীয় বার বিয়ের পীড়িতে বসি আমি?

পাত্রপক্ষের আমাকে পছন্দ হলো। সাথে সাথেই বিয়ে পড়িয়ে দিলো আমার। বন্ধ্যা পরিচয় নিয়েই অন্য কারো স্ত্রী হয়ে গেলাম। চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। জীবনটা একদম তি’ক্ত মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে!

চলবে….