#মুগ্ধতায়_তুমি_আমি
লেখিকা: #ইয়ানূর_মাশিয়াত
#পর্ব_০৫
ছোট ছোট হাতে কেউ আমার চোখের পানি মুছতেই মস্তিষ্ক সচল হলো আমার। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখলাম ছোট একটা মেয়ে। দেখতে বিদেশীদের মতোই। মেয়েটা আমার চোখের জল মুছে দিয়ে বললো, তুমি কাঁদছো কেন? বাবা কি তোমাকেও বকেছে? বাবা একটুও ভালো না আমাকেও খালি বকাবকি করে। তুমি কেঁদো না। আমি তোমাকে খুব আদর করবো। তোমার সব কথা শুনবো।
আমি চুপ করে মেয়েটার কথাগুলো শুনলাম। এটা যে আমার স্বামীর মেয়ে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মেয়েটার চেহারাটা ভীষণ মায়াবী। মেয়েটা বার বার আমাকে দেখছে আর হাসছে। মাঝে মাঝে আমার গাল টেনে দিচ্ছে। হঠাৎ করে ও বললো , আমার মা।
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। ভীষণ সুন্দর ওর হাসি। কিন্তু আমি চমকে উঠলাম। কখনো মা ডাক শুনি নি আমি
ওর মুখে মা ডাক শুনে বেশ ভালো লাগলো। মেয়েটা আমাকে বললো, তোমাকে একটা চুমু দেই?
আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম সবাই কথাবার্তায় ব্যস্ত। আমি একদম নিচু স্বরে ওকে বললাম, দাও।
ও আমার দু গালে দুটো চুমু খেল। এরপর বললো, আরো দেই?
আমি হেসে ফেললাম ওর কথায়। আমার পাশের মানুষটা এ যাত্রায় বললো, জেনিসা দুষ্টুমি করো না মায়ের সাথে।
তাহলে মা তোমাকে একটুও আদর করবে না।
আমি চমকে উঠলাম তার কথায়। পাশ ফিরে তার দিকে তাকালাম। গম্ভীর মুখে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন তিনি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। মেয়েটা মুখটা ভার করে তার কোলে গিয়ে বসলো। সেও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেলো। এরপর সবার দিকে মনোযোগ দিলো । আমি চুপচাপ বসে রইলাম।
সন্ধ্যার দিকে আমাকে নিয়ে তাদের বাড়িতে রওয়ানা হলো তারা। হঠাৎ করে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছি । কি থেকে কি হয়ে গেলো! কে ভেবেছিল আজ টিউশন থেকে ফিরেই এমন একটা কান্ড হবে? যাই হোক মা যে এতে খুশি হয়েছে তাই অনেক। এ বয়সে আমাকে নিয়ে চিন্তিত থাকুক সেটা আমি চাই না। সেই আমার ছোট্টকাল থেকেই আমাকে নিয়ে চিন্তা করে এসেছেন তিনি। আমার যখন বয়স পাঁচ তখন আমার বাবা মা’রা গিয়েছিল। আমার বাবা পেশায় একজন উকিল ছিলেন। কি যেন একটা কেস লড়তে গিয়ে বিরোধী পক্ষের শ’ত্রুদের হাতে খু’ন হন তিনি। এরপর থেকে মা একা হয়ে যান। মাকে দ্বিতীয় বার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মামারা কিন্তু মা তা করেন নি। আমাকে নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন সারাজীবন। ছোট থেকে একার হাতে লালন পালন করেছেন আমাকে। তাকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছে বা মন মানসিকতা কিছুই আমার নেই । তাই তো আজ তার হঠাৎ বিয়ের আয়োজনটা মেনে নিলাম। এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমার পাশেই বসে আছে আমার স্বামী আরশ চৌধুরী। তার কোলে তার মেয়ে জেনিসা চৌধুরী। জেনিসা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ওর হাসি দেখে আমিও হেসে ফেললাম। তা দেখে ও বার বার ওনার কোল থেকে আমার কোলে আসতে চাচ্ছে। উনি আটকে রেখেছেন। বার বার এমন করায় উনি বললেন, জেনিসা বেশি বেশি করছো কেন তুমি?
মেয়েটা মুখ ভার করে নিলো। এরপর আর একটা কথাও বললো না। আমার অনেক মায়া হলো। আমিই দু হাত বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে। ও এবার বললো, মামণি আমায় নিতে চাচ্ছে ছাড়ো তুমি আমাকে। তুমি একটুও ভালো না। আমি মামণির কাছে যাবো।
ওর কথায় উনি আমার দিকে তাকালেন। আমি দুই হাত বাড়িয়ে দিয়েছি দেখে জেনিসাকে ছেড়ে দিলেন উনি। আমি ওকে কোলে নিলাম। ওর গালে একটা চুমু খেলাম। ও তা দেখে আমার গালেও চুমু খেলো। এরপর আমাকে বললো, তোমার নামটা খুব সুন্দর।
আমি হেসে বললাম, তুমি আমার নাম জানো?
হ্যাঁ। সুজানা কবির মৌ।
তোমার নাম?
‘তুমি আমার নামও জানো না? এতো রা’গ আমার সাথে? আমার নাম জেনিসা চৌধুরী। জানো তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। তুমি ভীষণ মিষ্টি দেখতে। আমি এখন থেকে সবসময় তোমার সাথে থাকবো।’
বলেই ও আমার গলা জড়িয়ে ধরলো। আমি শুধু বললাম, আচ্ছা।
এরপর থেকে ওর কথার শেষ নেই। একটার পর একটা কথা বলেই যাচ্ছে। এতো পাকা পাকা কথা বলে মেয়েটা! শুনতে শুনতে বিরক্ত হলাম আমি। কিন্তু পাশ ফিরে দেখছি উনি মুচকি মুচকি হাসছে আর জেনিসার দিকে তাকাচ্ছে। সে মোটেও ওর কথায় বিরক্ত হচ্ছে না। মেয়ের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে টুকটাক জবাব দিচ্ছে।
শ্বশুর বাড়ি এসে পৌঁছেছি কিছুক্ষণ আগে। তাদের বাড়িটা অনেক বড় আর সব জায়গায় আভিজাত্যের ছোঁয়া। ভালোই টাকা পয়সা আছে। আমি গাড়ি থেকে নামতেই জেনিসা আমার হাত ধরে টেনে আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলো। ভিতরে যেতে যেতেই বললো, রূপা আন্টি! রূপা আন্টি! দেখো আমার মাকে নিয়ে এসেছি। কোথায় তুমি? তাড়াতাড়ি এসো দেখে যাও।
ওর কথা শুনে একটা মহিলা বেড়িয়ে আসলো। এসে আমাকে দেখে বললো, আপনি মি. আরশ চৌধুরীর ওয়াইফ?
আমি মাথা নাড়লাম। মহিলা বললো, আমি রূপা আহমেদ। জেনিসাকে দেখা শোনার দায়িত্ব পালন করছি আমি।
আমি কিছু বললাম না। আমার শাশুড়ি এসে বললেন, অনেকটা পথ জার্নি করেছো। যাও ঘরে যাও। আমি টগরকে বলছি তোমার জিনিসপত্র গুলো উপরে দিয়ে আসতে।
ওনার বলা মাত্রই জেনিসা আমাকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। বললো, আমি মামণিকে নিয়ে যাচ্ছি আমাদের রুমে। এখন থেকে আমি মামণির সাথে ঘুমাবো।
পিছন থেকে আমার শাশুড়ি বললেন, জেনিসা আস্তে আস্তে যাও। পড়ে যাবে তো!
ও আমাকে টেনে সিঁড়ি বেয়ে একটা রুমে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়েই ও খাটের উপর উঠে বসলো। আমাকে ডাকতে ডাকতে বললো, তুমি একপাশে ঘুমাবে বাবা একপাশে ঘুমাবে আর আমি মাঝে ঘুমাবো।
বলেই ও মাঝে শুয়ে পড়লো। আমি হেসে ফেললাম। গিয়ে ওর পাশে বসলাম। ও বললো, তুমি এতো দিন কেন আসো নি মম? জানো আমি তোমাকে কত মিস করেছি। আমি একদম ভালো মেয়ে হয়ে থাকবো তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না।
বলেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, স্কুলে সবাই বলে আমার মা নেই। ওদের কতবার বলেছি আমার মা আছে ওরা বিশ্বাসই করে না। এখন আর কেউ বলতে পারবে না। এখন থেকে তুমি আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবে ঠিক আছে।
অনেক মায়া হলো মেয়েটার জন্য আমার। মা ছাড়া জীবন আসলেই বড় কঠিন। এতটুকু একটা বাচ্চাকে রেখে তার মা কি করে চলে যেতে পারে? এতো পাষাণও কোনো মা হয়? আমি যখন এগুলো ভাবছিলাম তখন উনি রুমে আসলেন। জেনিসা ওনাকে দেখেই ওনাকে ওর অপর পাশে ডাকলো। বললো, তুমি এখানে আসো। আজ থেকে তুমি এখানে শোবে আর আমি মাঝে মম ওইপাশে। আমরা একসাথে থাকবো।
উনি হাসলেন। বললেন, ঠিক আছে তাই হবে। কিন্তু এখন তোমার খেতে হবে যাও রূপা আন্টির কাছে যাও। উনি তোমাকে খাইয়ে দিবে।
জেনিসা বললো, আমি মমের হাতে খাবো।
উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, তোমার মম তোমাকে কাল খাইয়ে দিবে। এখন জি’দ ধরো না। তুমি এমন করলে মম তোমাকে একটুও আদর করবে না। চলে যাবে।
ওনার কথায় জেনিসা মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন উনি। আমিও কিছু বললাম না। এরপর উনি আমাকে বললেন, জেনিসা অনেক চঞ্চল স্বভাবের। ভীষণ দুষ্টু। ওকে আমি সবকিছু দিতে পারলেও মায়ের আদর দিতে পারি নি। এজন্যই তোমাকে বিয়ে করেছি। ওর সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করবে না। নিজের মেয়ের মতো দেখবে ওকে। সন্তান কি জিনিস তা তো বোঝই। আশা করছি এমন কিছু করবে না যাতে জেনিসা কষ্ট পায়। আমার জীবন ওকে ঘিরেই। কিন্তু এখন তোমাকে বিয়ে করেছি তোমার দায়িত্ব এখন আমার। তোমার কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে।
বলেই উনি চলে গেলেন। আমি চুপচাপ ওনার কথাগুলো শুনলাম।
চলবে…