#মুগ্ধতায়_তুমি_আমি
লেখিকা: #ইয়ানূর_মাশিয়াত
#পর্ব_০৬
এ বাড়িতে আমার দিনগুলো জেনিসাকে নিয়েই কাটতে লাগলো। জেনিসা খুব আপন হয়ে উঠেছে আমার।
সারাক্ষণ আমার সাথে থাকে। আমার হাতে খাবে, আমার সাথে ঘুমাবে নানান বাহানা তার। আমার ভালোই লাগে। ছোট মানুষ মিষ্টি একটা মেয়ে। এ বাড়িতে এসেছি এক সপ্তাহের বেশি হয়ে গেছে। আরশ আমার সাথে তেমন কথাবার্তা বলেন না। প্রয়োজন হলেই টুকটাক কথা বলেন। যাও বলেন সব জেনিসার ব্যাপারে। জেনিসার কি পছন্দ, কি পছন্দ নয় ওইসব বিষয়েই কথা বলেন আরশ। এছাড়া তেমন কথা বলেন না। আমিও বেশি মাথা ঘামাই না এসব ব্যাপারে। এ বিয়ে তো করার ইচ্ছে আমার ছিলো না। হয়তো ওনারও ছিলো না। দুজন দুজনের মতো থাকি। তাতেই বেশ ভালো হবে। তাছাড়া জেনিসার প্রতি আমারও মায়া জন্মে গেছে। ও যেভাবে মা, মম, মামণি বলে ডাকে এরপরও ওর মায়ায় না পড়ে থাকি কি করে আমি? মেয়েটা একেক সময় একেকটা বলে ডাকে আমাকে। কখনো মা, কখনো আম্মু, কখনো বা মম। ওকে গতকাল আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এমন কেন করে ও। মা অথবা আম্মু নাহলে মম একটা ডাকলেই তো হয়। ও হেসে আমাকে বলেছিল, ‘আমার ভালো লাগে বলতে। তুমি এতো দিন ছিলে না তোমাকে আমি কত মিস করেছি জানো? তোমাকে আমি যখন যা ইচ্ছে তাই বলবো। এতো দিন পর পেয়েছি তোমাকে। আমার যা ইচ্ছে বলবো। আম্মু, আম্মু, আম্মু ।’
ওর কথায় হেসে ফেলেছিলাম। যা ইচ্ছে বলুক ও। আমার তো শুনতে ভালোই লাগে। এ বাড়িতে সবাই ভালো ব্যবহার করলেও আমার শাশুড়ি আমার থেকে দূরে দূরে থাকে। শাশুড়ি আর আরশ দুজন এক ধাঁচের মানুষ। একদম সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকে। তেমন কথাবার্তা বলে না। শাশুড়িকে দেখলে মনে হয় আমাকে দেখলে বুঝি বিরক্ত হয়। আমি জানি না এর পিছনে কারণ কি। আমাকে ওনার পছন্দ হয় নি নাকি আমি কোন ভুল করেছি? জানি না এমন হচ্ছে কেন। আমার ভুল হলে বলেও তো দিতে পারে উনি কিন্তু তাও না। কিন্তু আমার শ্বশুর আবার ভীষণ মজার মানুষ। তিনি ভীষণ রসিক। সুযোগ পেলেই আমার সাথে গল্প জুড়ে দেন। ওনার জীবনের নানান সময়ে ঘটে যাওয়া নানান মজার ঘটনা বলেন উনি। আমারও ভীষণ ভালো লাগে। সব মিলিয়ে দিনগুলো ভালো যাচ্ছে। হঠাৎ আজ বিকেলে আরশ এসে বললেন, আগামীকাল আমরা ঢাকা যাচ্ছি।
আমি তখন জামাকাপড় ভাজ করছিলাম। ওনার কথায় চমকে উঠলাম। আমি তাকে বললাম, ঢাকা যাবো মানে?
উনি ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। বললেন, মানে আবার কি হবে? এভাবে বেড়ালেই কি চলবে? কাজ করতে হবে না? কাজ না করলে খাবো কি?
‘আপনি ঢাকা থাকেন?’
তুমি জানতে না?
না কেউ বলে নি।
উনি আর এ বিষয়ে কিছু বললেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, ‘তোমার আর জেনিসার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিও। আগামীকাল সকালের ট্রেনে যাবো আমরা।’
আমি মাথা নাড়লাম।উনি যাওয়ার পর সব গুছানো শুরু করলাম। একটু পড়েই জেনিসা এলো মুখ ভার করে। এসেই বললো, মম আমরা ঢাকায় যাচ্ছি জানো? আমার খুব মন খারাপ হচ্ছে। দাদা ভাই আর দাদুকে আর দেখবো না। আবার আমাকে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হবে। বাবার সব কথা শুনতে হবে আর ভালো লাগে না।
আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। বললাম, আমরা আবার আসবো তোমার দাদা ভাই আর দাদুর কাছে। এখন আমাদের যেতে হবে। একটুও মন খারাপ করবে না তুমি। তাহলে আমি কিন্তু তোমার সাথে যাবো না।
জেনিসা বললো, একদম মন খারাপ করবো না। তুমি কিন্তু আমার সাথে যাবে। নাহলে আমিও যাবো না।
আমি হেসে ফেললাম ওর কথায়। কিন্তু আমার পড়াশোনার কি হবে? আমি এখানে ভর্তি হয়েছি দু বছর হলো। অনার্স শেষ হতে আরো দুবছর লাগবে।
রাতে যখন বাড়িতে আসলো আরশ তখন তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঢাকায় গেলে আমার পড়াশোনার কি হবে?
উনি আমার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এরপর বললেন, বছরের আর একটা মাসই তো আছে একটু কষ্ট করো। জেনিসা তোমাকে ছাড়া এখন ঢাকা যাবে না। ওর স্কুলও খোলা। এমনিতেই অনেক দিন বন্ধ দিয়েছে। এ বছর ওখানেই পড়ুক। সামনের বছর কি করা যায় দেখি।
আমি কিছু বললাম না। তার কথা মেনে নিলাম।
পরদিন সকালে আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আসার সময় আমার শাশুড়ি বললেন, শোনো ওদের খেয়াল রেখো। ঠিকমত বুঝেশুনে চলাফেরা করো।
আমি শুধু বলেছিলাম, আচ্ছা।
আচ্ছা বলে যখন আমি চলে আসছিলাম তখন তিনি আমায় ডেকে বললেন, আর শোনো নিজেরও খেয়াল রেখো। এমনিতেই পাটকাঠির মতো শরীর ওখানে গেলে আবার বাতাসে উড়ে যেয়ো না। খাওয়া দাওয়া কিছু করো কিন্তু। এখন আসো।
আমাকে ধমকে কথাগুলো বললেন শাশুড়ি। কথাগুলো ভালো লাগলো আমার। এই কয়েকদিনে উনি তো আমার সাথে কথাই বলেন নি। ধমকের সুরে আজ মিষ্টি কিছু কথা বলে দিলো আমাকে। আমরা বের হয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। চলে আসলাম ঢাকা।
.
ঢাকায় ওনাদের একটা ফ্ল্যাট আছে। সেখানেই আরশ জেনিসাকে নিয়ে থাকেন। এখন থেকে আমিও এখানে থাকবো। বাসায় ফিরেই আরশ আমাকে সবকিছু দেখিয়ে দিতে লাগলেন। কোথায় কি আছে না আছে কোনটা রান্নাঘর সব। বাড়িতে মোট পাঁচটা রুম আছে। দুটো বেডরুম, একটা গেস্ট রুম, একটা ড্রইং আর একটা ডাইনিং। এ বাড়ির রান্নাঘরটা বেশ বড়। আমি হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পালটে রান্নাঘরে গেলাম রান্না করতে। জেনিসা ঘুমিয়ে গেছে ট্রেন থেকে নেমে গাড়িতে চড়ার পর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। এখন রান্না না করলে মেয়েটা উঠে খাবে কি । এমনিতেই ট্রেনে বাহিরের অনেক খাবার খেয়েছে। এতো বাহিরের খাবার খেলে তো পেট খাবার করবে। ফ্রিজে মুরগির মাংস ছিলো সেটা ভিজিয়ে নিলাম। ভাত, মুরগির মাংস আর ডাল রান্না করবো ঠিক করলাম। আমি চাল ধুয়ে চুলায় বসিয়েছি মাত্র। তখনই আরশ রান্নাঘরে এলেন। আমাকে বললেন, আমি খাবার অর্ডার করে দিয়েছি। জার্নি করে এসে এখন রান্না করতে হবে না। তুমি গিয়ে বিশ্রাম নাও।
‘কি বলছেন আপনি! এখনো বাহিরের অর্ডার করা খাবার খাবে মেয়েটা? সারাদিন মেয়েটা চিপস টিপস হাবিজাবি খেয়েছে। একটা কথাও শুনে নি। কতবার বারণ করলাম মানলো না। এতো বাহিরের খাবার খেলে তো শরীর খারাপ করবে!’
আমার কথা শুনে আরশ কপাল কুঁচকে নিলেন। এরপর আমার দিকে কিছুটা এগিয়ে আসলেন। আমার দিকে কিছুক্ষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ভুল কিছু বলে ফেললাম নাকি আমি ? উনিই গম্ভীর স্বরে বললেন, তুমি যা দেখাচ্ছো সত্যিই কি তুমি তা? নাকি দুদিন পর পাল্টে যাবে? মায়ের মতো আগলে রাখবে তো ওকে? তুমি পাল্টে গেলে কিন্তু জেনিসা একদম মেনে নিতে পারবে না। ও কিন্তু খুব নরম মনের তার উপর ছোট্ট একটা মানুষ। ওকে কষ্ট পেতে একদম দেখতে পারি না আমি। আমার সহ্য হয় না। জেনিসাকে ছাড়া আমার পৃথিবী শূন্য। ওকে ছাড়া থাকা আমার জন্য অসম্ভব। ও কিন্তু তোমাকে খুব সহজেই আপন করে নিয়েছে। তোমাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে।
ওনার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলাম আমি। হঠাৎই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আর আপনি?
মুখে এ কথা বলে নিজেই চমকে গেলাম আমি। আরশও কেশে উঠলেন। আমি দৌড়ে টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি এনে দিলাম ওনাকে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কাশা বন্ধ হয়ে গেছে ওনার। আমি গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছি উনি নিচ্ছেন না। আমি উনাকে বললাম, কি হলো পানিটা নিন। আপনার কাশি চলে গেছে?
পানি লাগবে না বলে উনি চলে গেলেন। আমি সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজের কর্মকান্ড দেখে নিজেরই লজ্জা লাগছে এখন।
চলবে….