মুগ্ধতায় তুমি আমি পর্ব-০৭

0
18

#মুগ্ধতায়_তুমি_আমি
লেখিকা: #ইয়ানূর_মাশিয়াত
#পর্ব_০৭

আমি রান্নাবান্না শেষ করে জেনিসাকে ঘুম থেকে উঠালাম। ওকে খাইয়ে দিয়ে নিজে খেয়ে নিলাম। আরশ অনেক আগেই বেড়িয়েছেন। কোথায় গেছেন জানি না আমি। বলেও যান নি। জেনিসা খাওয়া শেষে বললো, এখন থেকে তুমি আমাকে স্কুলে দিয়ে আসবে। আমি আর বাবার সাথে যাবো না। আমার সব ফ্রেন্ডদের মায়েরা এসে তাদের স্কুলে দিয়ে যায়। আবার ছুটি হলে নিয়ে আসে। তুমিও তাই করবে ঠিক আছে?

কথাটা বলেই ও মলিন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এতো সুন্দর করে বললে কি আমি আর না করতে পারি? ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওর গাল দুটো টেনে দিলাম। এরপর বললাম, ঠিক আছে।

ও হেসে ফেললো। আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি একটা ভালো মা।

আমিও ওকে বুকে জড়িয়ে নিলাম।

.

আরশ ফিরলেন রাতে। জেনিসাকে কিছুক্ষণ পড়িয়ে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। আরশ এসে জিজ্ঞেস করলেন, জেনিসা কোথায়?

আমি বললাম, ঘুমিয়েছে।

উনি ওহ্ বলে ভিতরে চলে গেলেন। আমিও ওনার পিছু পিছু গেলাম। বিকেলে আমি রান্না করছিলাম যখন, তখন চলে গিয়েছিলেন উনি। খেয়ে যান নি। ওনার পিছু পিছু যেতে যেতে বললাম, আপনি তখন না খেয়ে চলে গিয়েছিলেন কেন?

আরশ আমার দিকে ফিরে তাকালেন। আমি উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিনি বললেন, খিদে ছিলো না।

‘এখন খিদে আছে? ভাত বাড়বো?’

উনি আমার দিকে তাকিয়েই রইলেন। আমার রাগ হলো ভীষণ। এই পর্যন্ত ওনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেও সাথে সাথে উত্তর পাই নি আমি। খুব ভেবেচিন্তে প্রত্যেকটা কথার উত্তর দেন তিনি। আর সাথে তার গোমড়া মুখটা তো আছেই। উনি মিনিট দুই পর বললেন, খেয়েছি।

রা’গে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। ‘খেয়েছি’ তিন অক্ষরের এই শব্দটি বলতে জনাবের দু মিনিট সময় লেগেছে! রাগে আমি তাকে বললাম, এই একটা শব্দ বলতে দু মিনিট লাগিয়ে দিলেন? আপনার মস্তিষ্ক কি ধীরে কাজ করে? খেয়ে এসেছেন এটা বলতে এতো সময় কার লাগে?

বলে আমি আর তাকাই নি তার দিকে। রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। নিজের জন্য খাবার বেড়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলাম। একাই খাওয়া শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর জামাকাপড় পাল্টে আরশ এলেন আমার কাছে। টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন উনি। এরপর বললেন, জেনিসা খেয়েছে?

আমি খাওয়াতে মন দিলাম। কিছু বললাম না। প্রায় দুই মিনিট পর বললাম, হ্যাঁ।

আরশ বললেন, ঘুমিয়েছে কখন?

আমি আবারো আগের নিয়মে দু মিনিট পর বললাম, কিছুক্ষণ আগে।

ও কাল তোমার সাথে স্কুলে যেতে চাচ্ছে। যাবে তুমি?

আমি আবারো একই কাজ করলাম। কিছুক্ষণ পর বললাম, হ্যাঁ।

উনি বোধহয় এবার বিরক্ত হলেন। বিরক্তি নিয়ে বললেন, এতোক্ষণ সময় নিচ্ছো কেন উত্তর দিতে?

আমার খাওয়া শেষ। প্লেট বাটি গুছিয়ে রান্নাঘরে যাওয়ার সময় বললাম, আপনার ঔষধই আপনাকে দিচ্ছি। আপনারও বোঝা উচিত ঔষধটা কতটা বিরক্তিকর।

আমি চলে গেলাম। আরশ আমার দিকে হা করে তাকিয়েই থাকলেন। আমার মেজাজ তো উনিই বিগড়ে দিয়েছেন। রান্নাঘরে গিয়ে প্লেট বাটি ধুয়ে গোছগাছ করে রুমে এলাম। আরশ বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে এগিয়ে আসলেন।আমি ততক্ষণে বিছানায় জেনিসার পাশে গিয়ে বসেছি। জেনিসাকে একটু চাপিয়ে নিজের শোয়ার জন্য জায়গা করে নিলাম। মেয়েটার শোয়া একটুও ভালো না। হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ইচ্ছে মতো ঘুমায় ও। আমি আবার এতো ছোটাছুটি করি না। এদিকে ভীষণ ভালো আমি। রাতে যেভাবে ঘুমাই সকালেও নিজেকে সেভাবে পাই। ঘুমের মধ্যে ওত নড়াচড়া করি না। আমি শোয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন আরশ এসে বললেন, আমি আজকে ওই রুমটায় ঘুমাই। তুমি জেনিসাকে নিয়ে এখানে শোও।

ওনার কথায় ফিরে তাকালাম ওনার দিকে। বিয়ের দিন থেকেই জেনিসা মাঝে আর আমরা দুজন দুপাশে শুই। আজ হঠাৎ ওনার কি হয়েছে জানা নেই আমার। আমি এ ব্যাপারে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাইলাম না। ওনার যেখানে ইচ্ছে ঘুমাক আমার কি? আমার সাথে তো ঠিক মতো কথাই বলে না ভালোবাসা তো দূরে থাক। আমি কম্বল গায়ে দিতে দিতে বললাম, আপনার যা ইচ্ছে। যাওয়ার সময় লাইটটা অফ করে দিয়ে যাবেন।

বলে শুয়ে পড়লাম আমি। কিছুক্ষণ পরেই লাইটটা অফ হয়ে গেলো। উনি দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।

.

সকালে ঘুম ভাঙলো ফজরের আযান শুনে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। শীতের দিনে সকাল হতে সময় লাগে বেশ। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। সাতটায় জেনিসার স্কুল। ওর জন্য নাস্তা বানিয়ে, খাইয়ে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে। আমি হুড়মুড়িয়ে উঠলাম। চোখটা ডলে জেনিসার দিকে তাকাতেই দেখলাম ও মা সে তার বাবার কোলে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। রাতে না বললো ও ঘরে ঘুমাবে তাহলে এখানে কি করছে সে? মন চাচ্ছে এখন উঠিয়ে জিজ্ঞেস করি এতো ঢংয়ের কারণ কি। কিন্তু করলাম না। আমি উঠে বাথরুমে গিয়ে অযু করে আসলাম। অযু করে এসে দেখি সে উঠে গেছে। কিন্তু এখনো কম্বলের নিচে বসে আছে।এবার আমি আমার ইচ্ছেটা পূরণই করে ফেললাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, রাতে না বললেন ও ঘরে শুবেন তাহলে এখানে কি করছেন আপনি?

আমার কথায় চমকে উঠলেন উনি। আমার দিকে হা করে তাকিয়েই থাকলেন জবাব দিলেন না। রেগে গেলাম আমি। ধমকের আওয়াজে বললাম, কি হলো জবাব দিচ্ছেন না যে?

উনি কেঁপে উঠলেন। আমি এমন করে বলবো হয়তো ভাবতে পারেন নি। উনি বললেন, ঘুম আসছিল না। জেনিসাকে ছাড়া কখনো থাকি নি আমি। অভ্যেস হয়ে গেছে বোধহয়।

বলে উনি বিছানা ছাড়লেন। আমিও নামায পড়তে চলে গেলাম। নামায শেষে রান্নাঘরে গেলাম নাস্তা বানাতে। জেনিসা রাতে বলেছিলো আলু পরোটা খাবে। তাই আলু সিদ্ধ দিয়ে আমি আটা গুলিয়ে নিলাম। পরোটা বানাতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যাচ্ছে দেখে জেনিসাকে ডাকতে গেলাম। গিয়ে দেখি সে উঠে গেছে। তার বাবা তাকে উঠিয়ে দাঁত ব্রাশ করাচ্ছে। তাই আমি আবার রান্নাঘরে চলে গেলাম। রান্নাঘরে গিয়ে বাকি পরোটা গুলো ভেজে নিলাম। ডাইনিং টেবিলে পরোটা রেখে জেনিসাকে ডাকলাম। জেনিসা আসলো স্কুল ড্রেস পড়ে। সে একদম রেডি। ওকে বসিয়ে পরোটা খাইয়ে দিলাম আমি। জেনিসার খাওয়া যখন শেষ তখন আরশ আসলেন। একদম ফর্মাল পোশাক। অফিসের জন্য রেডি হয়ে এসেছেন। তাড়াহুড়ো করে বললেন, জলদি চলো। লেট হচ্ছে।

আমি বললাম, আপনি খাবেন না?

তার সংকীর্ণ উত্তর, না।

ভীষণ কষ্ট পেলাম তার উত্তরে। গতকাল থেকে দেখছি যাই সাধছি খাচ্ছেন না উনি। আমি কিছু বললাম না। জেনিসার খাওয়া শেষ উঠে গেলাম । উনি বললেন , তুমি যাবে না?

আমি আসছি বলে রুমে গেলাম। বোরকা পড়ে হ্যান্ড ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে আসলাম। জেনিসা এসে আমার হাত ধরলো। উনি বললেন, দ্রুত আসো। ওকে স্কুলে দিয়ে তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে এরপর অফিসে যেতে হবে আমাকে। অনেক সময় লাগবে। আসো।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি করেন আপনি?

উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হয়তো তাড়াহুড়োর সময় এমন প্রশ্ন আসা করেন নি। বললেন, বাবার ব্যবসা সামলাই। আমার সম্পর্কে কিছু না জেনেই বিয়ে করে ফেলেছো? অদ্ভুত মেয়ে তো তুমি! আর কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে পরে করো। এখন দ্রুত আসো।

আমি আর কিছু বললাম না। আমাকে তারা সময় দিয়েছে? জেনিসাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। স্কুলে যাওয়ার পথে জেনিসা এটা সেটা নিয়ে অনেক কথা বললো। আমি শুনতে থাকলাম মাঝে মাঝে টুকটাক জবাব দিচ্ছি। এ কয়েক দিনে ওর এমন হাজারো কথা শুনেছি আমি। এখন আর একটুও বিরক্ত লাগে না এসব আমার কাছে।

স্কুলে পৌঁছে জেনিসাকে ভিতরে নিয়ে গেলাম। আরশও এলেন আমাদের সাথে। জেনিসা একটা মহিলাকে দেখে দৌড়ে গেলো। তার কাছে গিয়ে বললো, লিলি মিস লিলি মিস ওইতো আমার মম এসেছে।

জেনিসা আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলো আমার দিকে। মহিলাটা মিষ্টি হেসে আমার দিকে আসলো। এসে বললো, আমি জেনিসার ক্লাস টিচার। আপনাকে দেখে অনেক ভালো লাগলো। রাগ করে স্বামী সংসার মেয়ে রেখে কেউ এতো দিন বাপের বাড়ি থাকে মিসেস চৌধুরী? একটু রা’গটা কন্ট্রোল করবেন।

বলেই মিষ্টি হেসে উনি জেনিসাকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি বোকার মতো তাকিয়েই রইলাম। কি থেকে কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকলো না আমার। মহিলাটা এসব কি বলে গেলো? রাগ করে বাপের বাড়ি কবে গেলাম আমি?

চলবে….