#মুগ্ধতায়_তুমি_আমি
লেখিকা: #ইয়ানূর_মাশিয়াত
#পর্ব_০৮
শত ভাবনা চিন্তার পরও যখন তার কথা আমার মাথায় পৌঁছাল না তখন সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালাম আরশের দিকে। উনি মিটিমিটি হাসছেন। দেখে আমার সন্দেহ আরো বাড়লো। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি দেখেই উনি হাসা বন্ধ করে দিলেন। নিত্যদিনের মতো মুখটা গম্ভীর করে নিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হচ্ছে এসব? আপনি তাদের কি বলেছেন?
আরশ বললেন, জেনিসাকে এখানে ভর্তির সময় বলেছি ওর মা তার বাবার বাড়ি। আমার সাথে তুমুল ঝগড়া হয়েছে তাই বাবার বাড়ি চলে গেছে।
‘আপনার আগের স্ত্রীর কথা বলছেন?’
আরশ চমকে উঠলেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। এরপর হাঁটা ধরলেন। আমিও তার পিছন পিছন হাঁটা শুরু করলাম। গাড়িতে উঠে উনি বললেন, ‘সে অনেক আগেই চলে গেছে মৌ! জেনিসার ভর্তির সময় আমি মিথ্যে বলেছি যাতে কেউ এটা বুঝতে পারে না যে ওর মা নেই। আমি চাই না ওর মায়ের ব্যাপারে কেউ জানুক। এ বিষয়ে আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না প্লিজ।’
আমি আর কিছু বললাম না। উনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন। কিছুদূর যেতেই জানালা দিয়ে দেখলাম একটা ভ্যানগাড়ি। যার উপর বিভিন্ন ধরনের সবজি বিক্রি করছে এক লোক। বাড়িতে ফ্রিজে মাছ মাংস পেলেও কোনো শাকসবজি পাই নি আমি। শাকসবজি নেওয়া দরকার। আমি আরশকে বললাম, ঐ দেখুন সবজি বিক্রি করছে। বাড়িতে সবজি নেই কিছু সবজি কিনে নিন।
আরশ গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। শিম, গাজর, ফুলকপি আর বাঁধাকপি নিয়ে আসলেন। এগুলো পিছনে রেখে আবার গাড়ি স্টার্ট দিলেন গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। বাজার নিয়ে গাড়ি থেকে বের হলেন উনি। আমিও বের হলাম। লিফটে উঠে উনি বললেন, আজ থেকে নাহার চাচি আসবেন। আমাদের বাসার রান্নাবান্না সহ যাবতীয় কাজ তিনিই করে দেন। তোমার একার হাতে সব করার প্রয়োজন নেই।
আমি কিছু বললাম না। লিফট চলে এসেছে। ঘরে জিনিসপত্র গুলো দিয়ে উনি চলে গেলেন। যাওয়ার সময় আমাকে বার বার বলে গেলেন কেউ আসলে দরজা খুলতে না। এমন একটা ভাব মনে হয় আমি কিছু জানি না। নাহার চাচির একটা ছবি দেখিয়ে বলেছেন ওনাকে দেখলে শুধু দরজা খুলতে। আমি শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ বলে মাথা দুলিয়ে গেছি। উনি যেতেই বোরকা খুলে খেয়ে নিলাম। এরপর কি কি রান্না করবো আজ সেগুলো গুছিয়ে নিলাম। তখন এলেন নাহার চাচি। উনি আসার পর আমার সাথে কিছুক্ষণ কুশল বিনিময়ের পর রান্নার কাজে লেগে পড়লেন। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে জেনিসাকে নিয়ে রতন ভাইয়া বাসায় আসলো। আরশ আমাকে আগেই ফোন করে বলে দিয়েছিলেন। রতন ভাইয়াই জেনিসাকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে আসে। উনি আরশের ড্রাইভার। এছাড়াও বাসার টুকটাক কাজ করেন উনি। জেনিসা আসার পর ওকে গোসল করিয়ে দিলাম। নাহার চাচি রান্নাবান্নার পর ঘর দুয়ার গুছিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
.
সারাদিন বাসায় আমি আর জেনিসাই ছিলাম। সন্ধ্যায় আমি ওকে পড়তে বসিয়ে ছিলাম। পড়া শেষে ও আবার ওর কথার ঝুড়ি নিয়ে বসলো। আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে আরেক প্রশ্ন। যদি জেনিসাকে নিয়ে আরশ একাই থাকেন। আর উনি তো সারাদিন অফিসে থাকেন তাহলে জেনিসার খেয়াল রাখে কে? আমি জেনিসাকে জিজ্ঞেস করলাম, জেনিসা তোমার বাবা তো সারাদিন অফিসেই থাকে। তুমি বাসায় একা থাকতে কি করে?
জেনিসা হেসে ফেললো। বললো, আমি তো সারাদিন বাবার কাছেই থাকতাম। সকালে বাবা আমাকে স্কুলে দিয়ে আসতো। রতন আঙ্কেল এসে আবার আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যেতো। বাবার সাথে আমি সারাদিন থাকতাম। সন্ধ্যায় আমরা দুজনে বাসায় আসতাম। আর শুক্রবার আমরা দুজনে বেড়াতে যেতাম।
রাজশাহীতে থাকা অবস্থায় রূপা আহমেদ নামের একজন ভদ্রমহিলা জেনিসাকে দেখাশোনা করতো শুনেছিলাম। আমি ও বাড়িতে যাওয়ার পর আর আসেন নি। তার কথা জানতে ইচ্ছে হলো। আমি জেনিসাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার রূপা আন্টি না তোমার দেখাশোনা করতো?
‘রূপা আন্টিতো শুধু দাদুর কাছে গেলেই আসে। এখানে তো আসে না।’
আমি আর কিছু বললাম না। আরশ এলেন রাতে। আসার সময় জেনিসার জন্য কিছু চকলেট আনলেন। ও ওগুলো পেয়ে ভীষণ খুশি। ওগুলো নিয়ে রুমে চলে গেল ও। আরশ জামাকাপড় পাল্টে আমার কাছে আসলেন। বললেন, খাবার দাও।
আমি টেবিলে খাবার দিলাম। জেনিসাকেও ডাকলাম খাওয়ার জন্য। ও এখনো খায় নি আজ। ওকে খাইয়ে দিলে ও চলে গেলো। আরশের খাওয়াও প্রায় শেষ। আমি নিজের জন্য খাবার বাড়লাম। আরশ খেয়ে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে আসলো। আমি খাচ্ছি। সে আমার সামনেই ঘুরঘুর করছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। নাহলে আমার আশেপাশে ওনাকে এমন করে কখনো ঘুরতে দেখি নি আমি। ওনার এমন আচরণের কারণে আমি খেতেও পারছি না ঠিকমতো। আমি খাওয়া থামিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলবেন? এভাবে ঘুরঘুর করছেন কেন?
আরশ থেমে গেলেন। স্বাভাবিক ভাবেই বললেন, হ্যাঁ।
আমি আবার খাওয়া শুরু করলাম। এক লোকমা ভাত মুখে নিয়ে বললাম, বলে ফেলুন জলদি।
উনি চুপ করেই রইলেন। আমি এক নজর ওনার দিকে তাকালাম। উনি কিছু বলছে না দেখে খাওয়া শুরু করলাম।
হঠাৎ উনি বললেন, জেনিসার জন্ম নিবন্ধন করবো।
আমি বললাম, করুন। সমস্যা কোথায়?
মায়ের নাম দিবো।
দিন তাতে সমস্যাটা কি?
তোমার নাম দিবো। তোমার কোন সমস্যা নেই তো?
চমকে উঠলাম আমি। খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো আমার। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক দেখিয়েই বললাম, আমার নাম কেন? ওর মায়ের নাম দিন। আমার নাম দেওয়া ঠিক হবে না।
উনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এরপর বললেন, আমি তোমার নাম দিতে চাচ্ছি।
আবার একনজর ওনাকে দেখলাম। এরপর বললাম, কেন?
উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এরপর বললেন, যে চলে গেছে তার কোন কিছুই আমার জীবনে রাখতে চাই না আমি। আমার মেয়ের জীবনেও না।
আমি মাথা নাড়লাম। ভাবলাম প্রাক্তন বুঝি খুব ঘৃণা করেন উনি। কিন্তু যত যাই হোক সে তো জেনিসার মা। হঠাৎ করে এসে যদি মেয়ের অধিকার চায় তখন? মেয়ে তো ওনারই। এটা তো আর মিথ্যে নয়। তাই ওনাকে আমি বললাম, আপনি রাখতে চাচ্ছেন না ঠিক আছে। কিন্তু সে তো জেনিসার মা। ধরুন কোন এক সময় সে এসে জেনিসার অধিকার চাইলো। তখন কি করবেন আপনি?
আমার কথা শেষ হতেই আরশ দ্রুত বললেন, সে আসবে না।
আপনি এতো সিউর হয়ে কিভাবে বলছেন?
আমি জানি।
ওনার এমন কথায় কি বলবো বুঝলাম না। আমি চুপই থাকলাম। আরশ আবার বললেন, উত্তর দিলে না তো।
কি উত্তর দিবো আমি? আমি তো জেনিসার আসল মা না। ও কি বড় হয়ে কখনো জানতে পারবে না? আমি তাকে বললাম, দিন সেটা তো কোন বিষয় না । কিন্তু জেনিসা কি বড় হয়ে জানবে না আমি যে তার মা নই? তখন কি করবেন আপনি?
উনি বললেন, তুমি না বললে জানবে না। ও জানে তুমিই ওর মা। এসব বিষয়ে আর কথা বলো না। শুধু একটা প্রমিজ করো যে কখনো ওকে বলবে না তুমি ওর আসল মা নও। মায়ের মতো সবসময় ওকে আগলে রাখবে। আমার উপস্থিতিতে অথবা অনুপস্থিতিতে কখনো তুমি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না।
কথাগুলো বলার সময় অন্যরকম লাগছিল আরশকে। করুণার সুরে কথাগুলো বলছিলেন উনি। আমি কি বলবো বুঝে আসলো না। আমি শুধু মাথা নাড়লাম। উনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এরপর উঠে চলে গেলেন। আমি চুপচাপ সেভাবেই বসে থাকলাম। মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ওনার সব কথার মাঝেই কেমন যেন একটা কিন্তু লুকিয়ে আছে যেটা আমি জানি না।
চলবে…