#মুগ্ধতায়_তুমি_আমি
লেখিকা: #ইয়ানূর_মাশিয়াত
#পর্ব_০৯
ঢাকায় দিনগুলো বেশ ভালোই কেটেছিল আমাদের। এক সপ্তাহ হলো রাজশাহীতে চলে এসেছি আমরা। আমাকে আর জেনিসাকে রেখে আবার চলে গেছেন তিনি। জেনিসা আমার কাছেই থেকে গেছে। উনি বার বার নিয়ে যেতে চেয়েছেন কিন্তু জেনিসা যায় নি। তাই ওকে এখানেই একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন উনি। যাওয়ার সময় ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছিল তাকে। যাওয়ার সময় উনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মনে করো আমার প্রাণটা তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। সামলে রেখো। জানোই তো ও কেমন।’
আমি তাকে ভরসা দিয়েছি যে আমি জেনিসাকে সামলে রাখবো। কিন্তু আমি পড়ে গেছি এক গোলক ধাঁধায়। ঢাকাতে জেনিসার স্কুলে স্টুডেন্ট ইনফরমেশনে মায়ের নামের জায়গায় আমার নাম দেখেছিলাম আমি। আমার সাথে আরশের বিয়ে হয়েছে প্রায় দুই মাস হলো। কিন্তু জেনিসার স্কুল ফর্মে আমার নাম কিভাবে গেল? আরশকে এ কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি। উনি তখন চমকে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, ভুল দেখেছো হয়তো।
এরপর দ্রুত আমার কাছ থেকে চলে গিয়েছিলেন উনি। এ বিষয়ে কথা উঠালে উনি বার বার এড়িয়ে যান। ওনার মতলব বুঝতে পারি না আমি। তবে বিষয়টা আমার কছে বেশ সন্দেহ জনক মনে হলো।
.
কেটে গেল আরো চারটা মাস। জেনিসা, শ্বশুর, শাশুড়ির সাথে ভালোই চলে যাচ্ছে দিন। শাশুড়ি আমার আগের থেকে নরম হয়েছেন। এখন আমার সাথে কথা বলেন, ভালো ব্যবহার করেন, কোন ভুল হলে ধরিয়ে দেন। ওনার আমার সাথে সহজ হওয়া দেখে ভীষণ খুশি হয়েছি আমি। আরশের সাথেও সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে আমার। আরশও বেশ পরিবর্তন হয়েছেন। শুরুতে শুরুতে জেনিসাকে ঘিরে আমাদের কথাবার্তা থাকলেও ইদানিং আমার খোঁজখবর নেন উনি। ভালো লাগে আমার। বেচারা মেয়ে আমার কাছে দিয়ে পড়েছে ভীষণ বিপদে। মেয়েকে দেখতে পনেরো দিনের আগায় মাথায় আসে সে। প্রতিদিন দুই থেকে তিন বার ফোন করে আমার কাছে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করবে, মেয়ের সাথে কথা বলবে। মেয়ে একটু রাগ করে কথা না বললে পরের দিন চলে আসবে। কাটছে এভাবে দিনগুলো।
আজ আবার যাবো আমার মায়ের বাড়িতে। বিয়ের পর দু’বার মায়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি। ঢাকা থেকে এসে একবার গিয়েছিলাম। একবার গিয়েছিলাম গতমাসে। আজ যাচ্ছি আবার। মিতুকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। ছোট মামি বার বার আমাকে যেতে বলেছিলেন। প্রত্যেকবারই জেনিসাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম আমি। প্রথমবার যখন গিয়েছিলাম তখন মাকে শুধু প্রশ্ন করেছিলাম, মা তুমি আমাকে এভাবে কেন বিয়ে দিলে? এটা যে কত যন্ত্রণাময় জানো তুমি?
মা সেদিন চুপ করে ছিলেন। ছোট মামির সামনেই জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি। ছোট মামি তখন মাকে রা’গ দেখিয়ে বললো, বলেন আপা বলেন। জবাব দেন আপনার মেয়েকে। বলেন আপনার গুণধর ভাইয়ের বউয়ের কথা।
আমি বুঝলাম না ছোট মামির কথার অর্থ। ছোট মামি তখন নিজেই বলা শুরু করলেন, তোর বড় মামি তো একটা গিরগিটিকেও হার মানিয়েছে রে মৌ! জানিস সে কি করেছে? এলাকার প্রত্যেকটা মানুষকে বলেছে তোর বাচ্চা হয় না। তোর মায়ের ঝগড়া হয়েছিল না তার সাথে? তোর বড় মামা অনেক কথা শুনিয়েছে তাকে। তাই সে পুরো এলাকা তোর নামে এই গীত গেয়ে বেড়াইছে। দেখতি না তোর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসতো? এক ছেলের বাপ, তিন মেয়ের বাপ সব ঘটকালি সে নিজে করতো। যে মোটা অঙ্কের টাকা দিবে বলতো তার কথাই তোর মাকে এসে বলতো। কোনটতেই তো তোর মা রাজি হয় নি। শেষে আরশের বাপের কাছ থেকেও অনেক টাকা নিয়েছে আর তোর নামে বদনাম ও ছড়িয়ে দিয়েছে। তোর মাকে এসে বলেছে কে জানি পুরো এলাকায় ছড়িয়েছে এসব। তোর মা ভেবেছে তোর আর বিয়ে হবে না। তাই তোকে বিয়ে দিয়ে দিল তাদের পছন্দ করা ছেলের সাথেই! তোর মাকে আমি যতটা চালাক আর শক্ত ভেবেছিলাম সে ততটাও না। একদম দিল সব শেষ করে।
সেদিন অন্তরের মা আর বড় মামির মধ্যে অনেকটা মিল খুঁজে পেয়েছিলাম আমি। দুজনেই এক রকমের মানুষ। নিজেদের দোষ যাদের চোখে পড়ে না।
মা আর ছোট মামি প্রায়ই আমাকে এ বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করেন। সবাই ভালো ব্যবহার করে কিনা, শ্বশুর, শাশুড়ি কেমন, আরশ খারাপ ব্যবহার করে কিনা এসব আরকি। আমি সত্য কথাই বলেছি। ছোট মামি তো সরাসরি বলেই বসলেন আরশের সাথে আমার সম্পর্ক ঠিক কিনা। আমি বলেছি সে আমার সাথে কখনো খারাপ আচরণ করে নি। কিন্তু সে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের কথাই বার বার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আমি তখন তাকে আমাদের ভিতর সম্পর্কটা খুলে বলেছি। মামি তখন আমাকে বলেছিলেন, যাই হোক বিয়ে হয়ে গেছে। সম্পর্কটা এবার স্বাভাবিক করে নিয়ে সংসার কর। দোয়া করি জীবনে সুখী হ তুই।
এরকম বিভিন্ন কথাই জিজ্ঞেস করেন উনি। আজও গেলে করবেন। জেনিসাকে প্রথম প্রথম আমার মা মেনে নিতে পারেন নি। ও যখন নানু বলে কাছে যেতো দূরে সরিয়ে দিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে জেনিসার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে তার। এখন জেনিসাকে অনেক আদর করেন তিনি।
.
মিতুকে পাত্রপক্ষ দেখে যাওয়ার পরই শ্বশুর বাড়িতে ফিরে যাই আমি। আরশ বলেছেন চলে যেতে। আমি এর কারণ জিজ্ঞেস করি নি। রাতে আরশ ফোন করে বললেন আগামীকাল উনি সুইজারল্যান্ড যাবেন। আমার বুকটা ধুকপুক করে উঠেছিল তখন। উনি কেন সুইজারল্যান্ড যাবেন এখন? ওনার প্রাক্তনের সাথে দেখা করতে? মনে কু ডাকলো আমার। ওনাকে যেতে দিতে ইচ্ছে হলো না। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যাবেন কেন। উনি বলেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আমি তাকে আবার যখন বললাম না গেলে হয় না। তখন তিনি হেসে ফেললেন। বললেন একটা কাজ আছে যেতেই হবে। দ্রুত ফিরবেন উনি। টেনশন করার কিছু নেই। আমি যেমনটা ভাবছি সে রকম কোনো উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন না উনি। আমি ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলাম। আমি যে কি ভাবছি বুঝে গেছেন উনি। ফোন কেটে দিয়েছি এরপর। উনি আর ফোন করেন নি।
রাতে জেনিসাকে নিয়ে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন জেনিসাকে বললাম, তোমার বাবা সুইজারল্যান্ড যাবে কাল।
জেনিসা শোয়া থেকে উঠে বসলো। বললো, উফ্ বাবা আবার সুইজারল্যান্ড যাবে? আমাকেও নিয়ে যাবে? তোমাকেও নিবে? তোমাকে না নিলে আমি যাবো না। আমার ওখানে একা ভালো লাগে না। ভীষণ বোরিং লাগে।
আমি চমকে উঠলাম। বললাম, তুমি কি গিয়েছিলে সুইজারল্যান্ড?
আমরা তো সুইজারল্যান্ডেই ছিলাম মম। তোমার জন্যই আসলাম। আর ভালো লাগে না। বাবা যে কি করে!
ওর কথায় খটকা লাগলো আমার মাথায়। ওরা সুইজারল্যান্ড থাকতো মানে? আমাকে তো কেউ জানালো না। চারপাশের সব গোলক ধাঁধায় পরিণত হয়েছে। এর জট খুলতে এখন আরশকে লাগবে। কবে আসবে উনি?
.
একটা সপ্তাহ কেটে গেলো। আরশ ওইদিনের পর আর ফোন করেন নি। অনেক চিন্তা হয় আমার ওনার জন্য। ফোন করবো তারও কোন উপায় নেই। এখন শুধু অপেক্ষাই করতে হবে। মাত্রই জেনিসাকে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরলাম আমি। ফিরেই দেখি ড্রইং এ এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা বসে আছেন। ভদ্রলোককে দেখে বাংলাদেশী কিছুতেই মনে হচ্ছে না। আমাকে দেখে আমার শ্বশুর শাশুড়ি এগিয়ে আসলেন। ভদ্রমহিলাও এগিয়ে এলেন আমার কাছে। এসেই বললেন, জেনিসা দাদুর কাছে আসো।
উনি আমার কাছ থেকে জেনিসাকে নিতে চাইলো। কিন্তু জেনিসা আমার পিছনে এসে লুকালো। উনি বার বার ডাকার পরও জেনিসা গেল না। উনি জোর করছেন এর মাঝেই কোথা থেকে যেন আরশ এসে পড়লো। এসেই ছো মেরে জেনিসাকে নিয়ে গেল। ভদ্রমহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললো, আমার কাছ থেকে জেনিসাকে নেওয়ার চিন্তা ভুলেও করবেন না । এরপর যদি আপনি না সুধরান তাহলে ওর চেহারাও কখনো দেখবেন না আপনি। মানবতা দেখিয়েছিলাম আপনার জন্য কিন্তু আপনি তার মর্যাদা রাখেন নি।
বলেই আরশ জেনিসাকে নিয়ে উপরে রুমে চলে গেলেন। বেশ শব্দ করে দরজা ধাক্কা দিলেন। আমি শুধু তাদের কাহিনী দেখছিই কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না। আমি আমার শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করলাম, ওনারা কারা বাবা?
শ্বশুর বললেন, জেনিসার দাদা দাদি।
ভীষণ চমকে উঠলাম আমি। ওনারা যদি জেনিসার দাদা দাদি হয় তাহলে আমার শ্বশুর শাশুড়ি জেনিসার কি হয়? তাদেরকেই তো জেনিসা দাদা দাদি জেনে এসেছে। আরশ! আরশ তো ওর বাবা। তবে কি জেনিসা আরশের সন্তান নয়?
চলবে….