#মুগ্ধতায়_তুমি_আমি
লেখিকা: #ইয়ানূর_মাশিয়াত
#পর্ব_(১০+১১)
ভদ্রমহিলা আরশকে যা ইচ্ছে তাই বলতে লাগলো। ভদ্রলোক এসে ক্ষমা চেয়ে তাকে জোর করে বাড়ি থেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমার শাশুড়ি বা শ্বশুর কেউ কিছু বললেন না। আমি শুধু দেখছি। তারা যেতেই আমার শাশুড়ি আমার হাত ধরে টেনে সোফায় নিয়ে বসালেন আমাকে। মুখটা তার মলিন হয়ে আছে। আমাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে উনি বললেন, তোমাকে আজকে কিছু সত্য কথা বলবো যেটা আরশের বাবা, আমি আর গুটি কয়েক মানুষ জানে। তোমাকে আমার আগেই বলা প্রয়োজন ছিলো কিন্তু আমার পাগল ছেলেটার জন্য বলি নি। বললে সে আরেক পাগলামি শুরু করে দিতো।
আমি কিছু বুঝলাম না। শাশুড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগলেন, আরশের বয়স যখন আট বছর তখন আমাদের ঘর আলো করে আসে আমার মেয়ে আরিশা। আরিশাকে পেয়ে সে কি যে খুশি হয়েছিলো সেটা তোমাকে আমি বোঝাতে পারবো না। ছোট থেকেই ও ওর বোনকে ভীষণ ভালোবাসতো। অনেক আদর আহ্লাদ করে বড় করেছে তাকে। যখন যা চেয়েছে মেয়েকে তাই দিয়েছে। মেয়েটাও ছিলো ভাই পাগল। কিন্তু কি থেকে যে কি হয়ে গেলো!
বলতেই শাশুড়ির চোখ থেকে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। শাশুড়ি আবার বললেন, আরশ সুইজারল্যান্ড থেকেই পড়াশোনা করে। এরপর আরশ সুইজারল্যান্ড এ স্যাটেল হয়ে যায়। এ নিয়ে আমরা কখনো দ্বিমত করি নি। ছেলের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়েছি। তখন আরিশার মাত্র আঠারো। সবে মাত্র ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছিল আরিশা। আরিশা জেদ ধরলো সুইজারল্যান্ড যাবে আরশের কাছে বেড়াতে। সে সুইজারল্যান্ড ঘুরবে। আমরাও বারণ করি নি। ভাইয়ের কাছে বেড়াতে যেতে চাচ্ছে এখানে বারণ করার কি আছে? কিন্তু সেবার মেয়ে যে আমার এতো বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে আমরা বুঝি নি।
শাশুড়ি থামলেন। এরপর বললেন, সুইজারল্যান্ড এ আরিশার সাথে পরিচয় হয় জোহানের। আমরা কেউ জানি না কিভাবে কোথায় ওর সাথে জোহানের পরিচয় হয়েছিল। জোহান সুইজারল্যান্ড ঘুরতে গিয়েছিল বন্ধুদের সাথে। পরিচয়ের পর ধীরে ধীরে তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছিল। সুইজারল্যান্ড থেকে এসেও জোহানের সাথে কথা চলতে থাকে তার। জোহানের বাবা কানাডিয়ান আর মা বাংলাদেশী। তারা কানাডাতেই থাকতো। আমরা ওদের ব্যাপারে জানতে পারি এক বছর পর। আমরা জানার পরপরই জোহান তার মা বাবা নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে আসে। আরিশার তখন মাত্র উনিশ। ওই বয়সে আরিশাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা কেউ রাজি ছিলাম না। ওনারা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে শুনে আরশ আসলো সুইজারল্যান্ড থেকে। এসে খুব রা’গারা’গী করলো আমার সাথে। যত যাই হোক এত ছোট বয়সে বোনকে সে কিছুতেই বিয়ে দিবে না। যদি সত্যিই তার বোনকে বিয়ে করতে চায় তাহলে অপেক্ষা করুক। আরিশার পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর খুব ধুমধাম করে বিয়ে দিবে ওদের। কিন্তু আরিশা তখন মনমরা দিয়ে যায় অনেক। একদম শান্ত একদম চুপচাপ। আমার মেয়েকে এতো চুপচাপ কখনো দেখি নি আমি। ও ছোট থেকেই চঞ্চল। এখন জেনিসাকে যেমন দেখছো ও ঠিক তেমন ছিলো। সবার সাথে এক প্রকার কথা বন্ধ করে দিয়ে একা একা থাকা শুরু করে ও। বিষয়টায় আমরা সবাই খুব কষ্ট পেতাম। একদিন আরশ ওকে জিজ্ঞেস করেছিল ওর কি সমস্যা। ও কিছু না বলে এড়িয়ে দিয়েছিল। আরশ বার বার জিজ্ঞেস করলে ও কেঁদে ফেলেছিল। এরপর আরশকে জানালো জোহানের মা জোহানকে এক্ষুনি বিয়ে করাবেন। তিনি পাত্রী দেখা শুরু করেছেন।ওর জন্য জোহানকে ওয়েট করতে দিবেন না উনি। যদি ও সত্যিই জোহানকে ভালোবাসে তাহলে এক্ষুনি বিয়ে করতে হবে। নাহলে উনি অন্য জায়গা থেকে জোহানের জন্য বউ নিয়ে আসবে। জোহান ওনার কথা না মানলে জোহান ওনার ম’রা মুখ দেখবে। আরো নানান কথা। আরিশা সেদিন কেঁদে ফেলেছিল। ওর কান্না দেখে নরম হয়ে যাই আমরা। ছোট থেকে এতো আল্লাদে বড় করেছি যে ওর কান্না দেখার প্রয়োজন হয় নি। কিন্তু ওইদিন খুব খারাপ লাগলো। এরপর আরশ আর ওর বাবা জোহান সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে লাগলেন। জোহান ভালো ছেলে। মা বাবার একমাত্র সন্তান। গ্রাজুয়েট! কানাডায় একটা কোম্পানিতে নতুন চাকরি নিয়েছে। খোঁজখবর নিয়ে ওর সম্পর্কে খারাপ কোন তথ্য পাই নি আমরা। তখন জোহানের সাথে আরিশার বিয়েতে আর দ্বিমত করি নি আমরা। তবে আরশ ওকে শর্ত দিলো বিয়ের পর ওকে পড়াতে হবে। জোহান মেনে নেয়। তারপর আর কি? বিয়ে হয়ে যায় ওদের। বিয়ের পর ওকে কানাডা নিয়ে যায় জোহান। দু মাস পর জানতে পারি আরিশা গর্ভবতী। আমার ছোট মেয়েটা মা হবে। জোহানের উপর সেদিন খুব রে’গে গিয়েছিলাম আমি। ওর এতো ছোট বয়সে বাচ্চা নেওয়ার কি প্রয়োজন ছিলো? একটু সবুর করা যেত না? আমার রা’গ পানি হয়ে যায় জেনিসা জন্মগ্রহণ করার পর। আমি মেয়ের ঘরে নাতনির মুখ দেখি। খুশিতে আত্মহারা ছিলাম তখন আমি। এরপর আরশকে বিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু আরশ শুধু কথা ঘুরাচ্ছিল।বিয়ের কথা বললেই বলে কিছুদিন পর। তখন আমি আরিশাকে বলি ওকে রাজি করাতে। আরিশা ফুসলে ফাসলে রাজি করিয়ে ফেলে আরশকে। ছোট থেকেই আরিশার কোন কথা ও ফেলে নি। এর মধ্যেই আরিশার অ্যানিভার্সারি এসে পড়ে। জোহান আর আরিশা জেনিসাকে নিয়ে সুইজারল্যান্ড চলে যায়। তাদের ইচ্ছে ছিলো প্রথম অ্যানিভার্সারি সুইজারল্যান্ড কাটাবে। আরিশা আমাকে বলেছিল এরপর ওর ভাইকে নিয়ে দেশে আসবে একবারে। ভাইকে বিয়ে করাবে। আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। নাতনিকে তখনো সামনাসামনি দেখি নি আমি। কিন্তু হলো কি! ওর ভাই ঠিক দেশে ফিরলো। কিন্তু ও ফিরলো না!
বলেই কান্নায় ভে’ঙে পড়লেন উনি। কিছুক্ষণ পর্যন্ত উনি কেঁদেই গেলেন। আমি তাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এরপর উনি বললেন, ওদের অ্যানিভার্সারির দিন জেনিসাকে আরশের কাছে রেখে কিছুক্ষণের জন্য বেড়াতে বের হয় আরিশা আর জোহান। কিন্তু রাস্তায় এক ভয়াবহ কার এক্সিডেন্ট হয়। আরিশা স্পটেই মা’রা যায়।
গলা ধরে গেল ওনার। উনি বললেন, জোহান তখনও বেঁচে ছিলো। দুজনকেই তখন ধরে হাসপাতালে নিয়ে যান সুইজারল্যান্ড এর পুলিশ। এরপর আরশ খবর পায়। আরশ জেনিসাকে নিয়ে পাগলের মতো ছুটে যায় হাসপাতালে। বোনের নিথর দেহ দেখে বাকশূন্য হয়ে যায় ও। একদম ভে’ঙে পড়ে। এদিকে আমি তো একদম পাগল হয়ে গেলাম। আমার মেয়েটা শেষ কিন্তু আমার যাওয়ারও কোন ব্যবস্থা নেই। মেয়েকে শেষ দেখাও দেখতে পারি নি আমি। সুইজারল্যান্ডেই আরিশাকে দাফন করা হয়। জোহানের অবস্থাও ততটা ভালো নয়। এক সপ্তাহ পরে জ্ঞান ফিরে জোহানের। জোহানের মা বাবা তখন সুইজারল্যান্ডে। আমরা যেতে পারি নি ভিসা ছিলো না আমাদের। জোহানের জ্ঞান ফিরতেই আরিশার কথা জিজ্ঞেস করে জোহান। জোহানের মা কেঁদে ফেলেন। জোহানকে উনি তখন বলেন আরিশার জন্যই নাকি তার ছেলের এই অবস্থা। আরিশা মা’রা গেছে এ ও বলেন। সাথে আরিশাকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা বলেন। জোহান সেদিন চুপচাপ তার কথা শুনেছিল। কোন উত্তর দেয় নি। আরশও উপস্থিত ছিলো। ওই মহিলার কথা শুনে সেদিন হাসপাতাল থেকে চলে গিয়েছিল ও। পরদিন জোহান তাকে ডেকে পাঠায়। আরশ হাসপাতালে গেলে জোহান ওকে বলে জোহানের কিছু হয়ে গেলে জেনিসার দায়িত্ব তাকে নিতে। জোহানের শরীরের অবস্থা বেশি ভালো না। নিজের মায়ের কাছে জেনিসার দায়িত্ব দিতে চায় না ও। জেনিসাকে ওনার হাতে গেলে জেনিসা ভালো থাকবে না। সেদিন জোহানের কাছ থেকে আর কিছু সত্যি ঘটনা জানতে পারে আরশ। আরিশাকে জোহানের মা মেনে নিতে পারেন নি। আরিশাকে তার কখনোই পছন্দ হয় নি। শুধুমাত্র ছেলের জন্য আরিশার আর জোহানের বিয়েতে রাজি হয়েছেন তিনি। আমরা যখন আরিশাকে দেরিতে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম তখন তিনি ইচ্ছে করেই এমন বিয়ের জন্য তাড়াহুড়ো করেন যাতে আমরা বারণ করে দেই। কিন্তু আমরা রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। জোহান সেদিন সব খুলে বলে আরশকে। আর কাগজকলমে সহ একটা ভিডিও স্ট্যাটমেন্ট দেয় সে। যেখানে সে বলে তার কিছু হয়ে গেলে জেনিসার সব দায়িত্ব আরশের। আরশ সারাজীবন জেনিসাকে নিজের কাছে রাখতে পারবে। এতে করে তার বাবা মা কোন হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এর কিছুদিনের মধ্যেই জোহানও মারা যায়। এরপর থেকে জেনিসাকে নিয়ে আরশ দিন কাটানো শুরু করে। সুইজারল্যান্ডেই জেনিসাকে নিয়ে থাকা শুরু করে ও। আরিশার মৃত্যুর দু মাস পর জেনিসাকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল একবার সে। আমাদের ভিসা হলো। আমাদের নিয়ে গেলো মেয়ের কবর দেখাতে। শেষ দেখা মেয়েকে দেখে আসলাম। আরশ জেনিসার সব দায়িত্ব নিলো। একাই লালন পালন করতে লাগলো ওখানে ওকে। কতবার বলেছি তুই পারবি না ওকে আমার কাছে দে। ও দেয় নি নিজের কাছেই রেখেছে। নিজের মেয়ের পরিচয়ে জেনিসাকে পালা শুরু করে। জেনিসা একটু বড় হয়। ওর বয়স দু’বছর হলে ওকে নিয়ে দেশে ফেরে আরশ। তখন ওকে জোর করে বিয়ে করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমি। মেয়ে তো আমার গেছে। ছেলের জীবনটা কি এভাবেই একা একা কাটবে? সেই চিন্তা থেকে ওকে বিয়ে করাতে চাইলাম আমি। ও বুঝতে পেরে জেনিসাকে নিয়ে আবার চলে গেলো সুইজারল্যান্ড। এরপর আর ফেরে নি ও। জেনিসার সাথে মোবাইলে মোবাইলেই কথা হতো আমাদের। আস্তে আস্তে জেনিসা আরেকটু বড় হলো। সবার সাথে মেশা শুরু করলো। আরশ ওকে একার হাতে সামলালেও মা তো মাই। জেনিসা ওর কাছে শুধু মাকে চাইতো। আরশ চাইতো না যে ও জানুক ওর মা নেই আর কষ্ট পাক। তাই ওকে মিথ্যে আশ্বাস দিতে লাগলো। ও ওকে বলতে থাকলো তোমার মা বাংলাদেশে। আমাদের সাথে রা’গ করে চলে গেছে। জেনিসা এক সময় ওকে মায়ের জন্য খুব বিরক্ত করতে থাকে। জেনিসার কোন আবদার ও ফেলে নি। কিন্তু এই আবদার মানতে ও নারাজ। ও সবসময় এক কথাই বলতো ও যদি বিয়ে করে এমনও হতে পারে যে ওর বউ জেনিসাকে দেখতে পারলো না। তখন কি হবে? আর যদি দেখতেও পারে নিজের একটা বাচ্চা হওয়ার পর আর দেখতে পারবে? যার জন্য বিয়ে করবে তাকেই না দেখতে পারলে তো বিয়ে করার মানে নেই। আর কোন মেয়ে এটা জেনে ওকে বিয়ে করবে যে বিয়ের পর তাকে তার স্বামীর বোনের মেয়েকে পালতে হবে? তাও আবার নিজের পরিচয় দিয়ে! ও নাকচ করে দেয়। কিন্তু জেনিসা ওদিকে মা মা করে পাগল করে দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে রাজি হয় ও। কিন্তু সাথে এক শর্ত জুড়ে দেয়। ও বিয়ে করবে এমন কাউকে যার কোনো বাচ্চা নেই বা বাচ্চা হয় না। । তাহলে সে আর জেনিসার প্রতি কোন অবহেলা করবে না। জেনিসাকে নিজের মেয়ের মতো আদর করবে। ওর কথায় অনেক রাগ হয়েছিলাম আমি। নাকচ করে দিলাম আমি। ব্যাস ও তখন বললো তাহলে ও আর জীবনেও বিয়ে করবে না। এভাবেই কাটিয়ে দিবে জীবন। ওর জীবন কি এভাবেই চলবে? তখন ওর বাবা আমাকে বললো রাজি হয়ে যেতে। আমি রাজি হতে পারলাম না তাও মেনে নিলাম ছেলের জন্য। তখন ওর বাবা ওর জন্য মেয়ে দেখা শুরু করলো। তোমার বড় মামি তখন আমাদেরকে তোমার সন্ধান দিলো। আমি মেনে নিতে পারলাম না।আমার অবিবাহিত ছেলে। ও একটা বিবাহিত ডিভোর্সী মেয়েকে বিয়ে করবে আমি মানবো কি করে? আমি ওর বাবাকে বললাম তোমার বিষয়ে ওকে না জানাতে। কিন্তু ওর বাবা তোমার কথা ওকে বলে দিলো। ও তোমার আগের বিয়ের ব্যাপারে সব জানলো। তোমার খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করলো। কিছুদিন পর বাংলাদেশে আসলো ও। ছয় মাস নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ করলো তোমাকে। এরপর বিয়ের জন্য রাজি হলো। প্রস্তাব পাঠালো তোমাদের বাড়িতে। তোমার মাসহ বাকি পরিবারও রাজি হলো। বিয়ে হয়ে গেলো তোমাদের। এরপর তো তুমি সব জানোই।
আমি দীর্ঘক্ষণ বসে ওনার সবগুলো কথা শুনলাম। উনি কথা শেষ করে কিছুক্ষণ থামলেন। এরপর বললেন, জেনিসার দাদি মানুষটা বেশি ভালো না। আমার মেয়েটা যখন মা’রা গেল তখন তিনি নিজের ছেলের অবস্থার জন্য আমার মেয়েকে দায়ী করলেন! আর এদিকে আমি আমার মেয়ে হারিয়েছি আমার কি বলা উচিত? এতেও ওনার শেষ হলো না। জোহান যখন মারা যায় তখন তো যা ইচ্ছে তাই বলেছেন আমাদের। জেনিসাকেও দেখতে আসতেন না তিনি। আমার মেয়ের মেয়ে জেনিসা তাই জেনিসাকেও কাছে টানেন নি তিনি। অথচ তার বংশধর জেনিসা!জেনিসার দাদা মাঝে মাঝে আরশের কাছ থেকে জেনিসার টুকটাক খোঁজখবর নিতেন। দাদি তা করতো না কিন্তু ওর যখন দু’বছর আরশ দেশে এসেছিল তখন উনি জেনিসাকে দেখতে এসেছিলো। সেবার কাঁদতে কাঁদতে মাফ চেয়েছিলেন। তার ভুল হয়ে গেছে তার মাথা ঠিক ছিলো না। আরো নানা ধরনের কথা বললেন তখন। আমরা আর বেশি কিছু বলি নি। বলে কি হবে? আমি মেয়ে হারিয়েছি। উনিও ছেলে হারিয়েছেন। আমি মেনে নিয়েছি ধৈর্য ধরে ছিলাম। উনি মানতে পারেন নি তাই এরকম করেছেন। কুকুর কা’মড় দিলে তো আর উল্টে কুকুরকে কা’মড়ানো যায় না। তাই আর বেশি কিছু বলি নি ওনাকে। এরপর থেকে উনি প্রায় সময়েই জেনিসার খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু আরশ সুইজারল্যান্ড এ থাকা অবস্থায় একবার আরশের কাছ থেকে জেনিসাকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য যান তিনি। আরশ তার প্রস্তাবে নাকচ করে দেয়। তখনই তিনি হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে দেন। সুইজারল্যান্ডে পুলিশ কমপ্লেইন করেন। আরশ তখন জোহানের স্ট্যাটমেন্ট দেখায় তাদের। দেখানোর প্রয়োজন ও ছিলো না যদিও। কারণ পুলিশের উপস্থিতিতেই জোহান স্ট্যাটমেন্ট দিয়েছিল। এরপর উনি আরেকবারও এমন কান্ড করেছিলেন। কিন্তু লাভ হয় নি। আজ আবার করলেন !
সম্পূর্ণ ঘটনা শুনলাম আমি। কথা শেষে আমি যখন উঠে যাচ্ছিলাম তখন আমার শাশুড়ি বললেন, তোমাকে শুরুতে আমার পছন্দ ছিলো না কিন্তু এখন তোমার প্রতি কোন অভিযোগ নেই আমার। এতে তো তোমার কোন দোষ নেই। আমার ছেলে নিজের পছন্দে তোমাকে বিয়ে করেছে। তুমি তো আর এগিয়ে আসো নি। শুধু তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ ওদের দেখে রেখো। আরশ ভীষণ একা। ওকে সঙ্গ দিও। আর জেনিসাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখো। ও কিন্তু আসল মা সৎ মা কি বোঝে না। তোমাকেই মা হিসেবে জানে।
আমি কিছু বলি নি। আমি আমাদের রুমে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে দেখি চারপাশের সব পর্দা দিয়ে রুমটাকে একদম অন্ধকার করে দিয়েছেন আরশ। জেনিসা খাটে ঘুমাচ্ছে। আরশ খাটের সাথে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। আমি দরজা আটকে দিলাম। ওনার পাশে গিয়ে বসলাম। উনি মাথা উঠিয়ে আমাকে দেখলেন। এরপর আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন।
আমি তাকে শান্তনা দিতে থাকলাম। উনি একটু শান্ত হলেন। এরপর বললেন, আমি তোমার থেকে অনেক কিছু লুকিয়েছি মৌ!
আমি বললাম, জানি। মা বলেছেন।
উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এরপর চোখমুখ মুছে নিলেন। এরপর বললেন, আরিশার মৃ’ত্যুটা আমাকে অন্যরকম বানিয়ে ফেলে মৌ। ওই সময় আমি কি করবো ভাবতে পারছিলাম না। এর কিছুদিন পর জোহানও মা’রা গেল। আমার কাছে রেখে গেল আমার ছোট বোনটার অংশকে। জেনিসাকে কিভাবে পালবো, কিভাবে ওর দেখাশোনা করবো কিভাবে ওকে বড় করবো তাই ভাবতে লাগলাম। ওইদিকে ওর দাদি নানান কুটুক্তি করছিলো। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের পরিচয়ে ওকে আমি বড় করবো। ওকে নিজের সন্তান বানিয়ে নিলাম। জীবনে বিয়ে করবো না সিদ্ধান্ত নিলাম। বিয়ে করলে অন্য একটা মেয়ে তো আর ওকে মেনে নিবে না! নিজের সব আনন্দ, সব খুশি ওর মধ্যেই পেলাম আমি। কিন্তু যখন ও বড় হচ্ছিল তখন মা মা করতে লাগলো। আমি কখনো ওকে কোন কষ্ট পেতে দেই নি। ও যখন মায়ের জন্য পাগলামি করতো আমি বলতাম তোমার মা বাংলাদেশে। আমাদের সাথে রাগ করে চলে গেছে। ও জিজ্ঞেস করতো কেন গেছে। আমি বলতাম তুমি দুষ্টুমি করো দেখে চলে গেছে। তুমি ভালো হয়ে গেলে ফিরে আসবে। ও তখন শান্ত হয়ে যেতো। এভাবে অনেকগুলো দিন ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছি আমি ওকে। এরপর যখন আর পারছিলাম না তখন সিদ্ধান্ত নেই বিয়ে করবো। যদি আমি একটা সাধারণ মেয়েকে বিয়ে করতাম তাহলে তো জীবনেও সে জেনিসাকে মেনে নিতো না। তাই আমি অসাধারণ কাউকে খুঁজতে লাগলাম। যার কোন সন্তান নেই, যে সন্তানের মর্ম বুঝবে। মায়ের মতো আদর যত্ন করে দেখে রাখবে ওকে। তখন তোমাকে পেলাম। তোমার থেকে সব লুকিয়ে বিয়ে করলাম তোমাকে। তোমাকে জানাতে চাই নি আমি এসব।
আমার তখন খুব বলতে ইচ্ছে হলো আমি অসাধারণ কেউ নই। কিন্তু ওনার অবস্থা দেখে আর বললাম না। ওনাকে শান্তনা দিচ্ছিলাম। উনি তখন বললেন, ওর দাদি মানুষ না মৌ। মানুষ হলে আমার বোনটা মা’রা গিয়েছে দেখেও উনি এতো গুলো কথা বলতে পারতেন না।
বলেই কান্নায় ভে’ঙে পড়লেন। আমি তাকে দেখছি। কখনো এভাবে কাঁদতে দেখি নি ওনাকে। পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। কিছুক্ষণ পর উনি আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, আমরা সুইজারল্যান্ড চলে যাবো মৌ। আমরা এখানে থাকবো না। জেনিসাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো। ওকে খুব আদর করে বড় করবো আমরা। ও আমাদেরকেই মা বাবা বলে জানবে।
আমি ওনাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। ওনার কথার উত্তরে শুধু বললাম, আচ্ছা।
সেদিন সারাদিন বাড়ি থেকে বের হলেন না উনি। জেনিসার কাছে কাছেই ছিলেন। আমার মাথায় শুধু ঘুরছে উনি তো সুইজারল্যান্ড ছিলেন। তাহলে হঠাৎ করে চলে আসলেন কোথা থেকে? ভাবলাম একবার জিজ্ঞেস করবো। কিন্তু ওনাকে বিষন্ন দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করি নি। সেদিন রাতে উনি একহাতে জেনিসা আরেক হাতে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। ছাড়লেই বুঝি চলে যাবো আমরা।সেদিন বুঝতে পারলাম আমিও তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কেউ হয়ে উঠেছি।
চলবে..