#মুগ্ধতায়_তুমি_আমি
লেখিকা: #ইয়ানূর_মাশিয়াত
#পর্ব_১২
আরশের সাথে আমার বিয়ের এক বছর হয়ে এসেছে। এখন আমাদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক। আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতোই স্বাভাবিক ভাবেই সংসার করছি আমরা। জেনিসাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখাশোনা করছি। ও কষ্ট পাক তা আমিও চাই না। ও জানে আমিই ওর মা। আরশ সেদিন আমাকে নিজে থেকেই বলেছিল উনি গতবছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার সময়েই জেনিসাকে স্কুলে দিয়েছিলেন। তখন ওর মায়ের নমের জায়গায় আমার নামই দিয়েছিলেন তিনি। আর স্কুলে বলেছিলেন আমি রা’গ করে বাপের বাড়ি গিয়েছি। আমি অবাক হয়েছিলাম তখন। আমাকে দেখেই আমার নাম দিয়ে দিলেন? যদি আমার সাথে বিয়ে না হতো তখন? আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার সাথে যদি আমার বিয়ে না হতো তখন কি করতেন?
উনি হাসলেন। এরপর বললেন, সেটা তখন ভাবতাম। বিয়ে তো হয়ে গেছে তাই আর এ বিষয়ে ভাবি নি আমি।
আপনি সুইজারল্যান্ড থেকে এসেছেন কবে ? আমাকে একটাবারও তো কল করলেন না।
সময় পাই নি। আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো তাই গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম একেবারে বাড়ি এসে তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো। কিন্তু এখানে এসে তো নিজেই সারপ্রাইজ পেয়ে গেলাম। আমি না আসলে মহিলা যে কি করতো তোমার ধারণার বাহিরে মৌ!
আমি কিছু বলি নি। সব ঠিক আছে কিন্তু একটা জিনিস মাথায় ঢুকছে না যে এলাকার লোকজন কি জানে না জেনিসা আরিশার মেয়ে? ও বড় হলে কি জানবে না?
আমি সেদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে ব্যাপারে। সে বললো, তারা জানে এক্সিডেন্টে আরিশার মেয়েও মারা গেছে। আমি সুইজারল্যান্ডে বিদেশীকে বিয়ে করেছিলাম। জেনিসা তার মেয়ে।
এলাকার লোকজন যদি এটা জেনে থাকে তাহলে তো তারা এটাও জানে আমি জেনিসার সৎ মা। বড় হলে এলাকাবাসীই তো বলে দেবে যে আমি ওর মা নই। তখন কি ও কষ্ট পাবে না? আমি তাকে বললাম, আচ্ছা তাহলে তো এলাকার লোকজন জানে আমি ওর সৎ মা। ও বড় হলে তো জানবেই আমি ওর মা নই। আপনারটা বাদ দিলাম। তখন কি করবেন? ও তো তখন বেশি কষ্ট পাবে।
ও এখানে থাকলে তো জানবে! আমরা এখানে থাকছি না মৌ। শুধুমাত্র আর কটা দিন তোমার অনার্স শেষ হলেই আমরা সুইজারল্যান্ড চলে যাবো। আর কখনো দেশে ফিরবো না।
আমি চমকে উঠলাম। কখনো দেশে ফিরবে না মানে। আমি বললাম, কখনো ফিরবেন না? আমার মা তো একা! তাকে রেখে যাবো কি করে আমি? তাছাড়া আপনার মা বাবা?
উনি সেদিন বলেছিলেন, আমরা সবাই চলে যাবো। তোমার মা, আমার মা বাবাসহ সবাই। আমরা আরিশার কাছেই থাকবো মৌ। এখানে আমার একটুও ভালো লাগে না। আরিশার কাছাকাছি থাকলে আমার ভালো লাগে।
আমি আর কিছু বলি নি সেদিন। বোনকে তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। আরিশার জন্য আমারও কষ্ট লাগলো। আমার শাশুড়ি আমাকে আরিশা আর জোহানের একটা ছবি দেখিয়েছিলেন।জেনিসা হচ্ছে তাদের মিক্সড। কিছুটা জোহানের মতো কিছুটা আরিশার মতো। তবে আরিশার চেহারার ভাবটাই তার মধ্যে বেশি। চোখ দুটো শুধু তার বাবার মতো। আরিশা আর আরশের চেহারায় প্রচুর মিল আছে। তাই বলা যায় জেনিসাও আরশের মতো দেখতে। না বললে কেউ বুঝতে পারবে না জেনিসা আরশের মেয়ে নয়।
এভাবেই কাটতে থাকলো দিন। আরশ দেশে ফেরার পর থেকে তার বাবার ব্যবসা দেখছেন। সেইজন্য তাকে বেশিরভাগ সময় ঢাকা থাকতে হচ্ছে। আমি জেনিসাকে নিয়ে রাজশাহীতে আছি। শ্বশুর শাশুড়ি আমাকে খুব পছন্দ করেন এখন। এই পরিবারটার সাথে মানিয়ে নিয়েছি আমি। আমার সব এখন এই পরিবারকে ঘিরে। এখানের প্রত্যেকটা মানুষকে নিয়ে এখন ভাবি আমি। সবার খেয়াল রাখার চেষ্টা করি। এর মধ্যে আমার মাও এ বাড়িতে এসেছিলেন কয়েকবার। মাকে সব ঘটনা খুলে বলেছি আমি। মা শুনে খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, আরশ যেভাবে চলতে বলে সেভাবে চলিস। তোর বড় মামি ভুল করে হলেও জীবনে আমার একটা উপকার করেছে। তার জন্য এখন থেকে দোয়া করবো আমি।
আমি হেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু মা ঠিকই বলেছেন। মামি একটা তো উপকার করেছে। নাহলে এমন সুন্দর একটা পরিবার আমি কোথায় পেতাম? তার জন্য আমিও দোয়া করি এখন আল্লাহ্ তার মাথার কুবুদ্ধি গুলো নিয়ে তাকে সুবুদ্ধি দান করুন।
দেখতে দেখতে আরো কটা দিন গেলো। এর মাঝেই বুঝতে পারলাম আমি প্রেগন্যান্ট। আরশকে কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিলাম না। শুনলে উনিই বা কি রিয়েকশন দিবেন বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আমার বা আমার বাচ্চার তো কোন দোষ নেই এতে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আরশকে বলে দেবো। আরশ যখন ঢাকা থেকে ফিরলো তখন বেশ খানিকটা সাহস সঞ্চয় করেই তাকে আমি বললাম, আপনাকে একটা কথা বলার ছিলো।
উনি মিষ্টি করে বলেছিলেন, কি কথা বলে ফেলো।
আমি সময় নিয়েই বললাম, আমি প্রেগন্যান্ট।
আরশের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ আশ্চর্য হয়েছেন তিনি। কিন্তু নিজেকে মুহুর্তেই স্বাভাবিক করে নিলেন উনি। এরপর বললেন, আমার এই মুহুর্তের অনুভূতি তোমাকে আমি বোঝাতে পারবো না। তাই তুমিই এক্সপ্লেইন করো ।
এরপর আমার জীবনের সমস্ত ঘটনা ওনাকে জানালাম। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন আমার কথা। এরপর বললেন, তুমি বিয়ের সময় প্রতিবাদ করো নি কেন?
আমি বললাম, করে কি লাভ হতো?
উনি বললেন, করেই দেখতে কি হতো আর না হতো!
তাহলে আপনি আমাকে বিয়ে করতেন না?
আরশ চুপ থাকলেন। এরপর বললেন, এমনটা নয়।
তাহলে কেমন?
উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, আমি তোমার সম্পর্কে যত জায়গাই খবর নিয়েছি সবাই এক কথাই বলেছে। কেউ কখনো তোমার সত্যিটা আমাকে বলে নি। তোমার নিজের মামিই তো এমন বলেছে আর লোকদের কথা বাদই দিলাম। তোমার উচিত ছিলো আমাকে সত্যটা বলা।
‘কেউ তো বিশ্বাস করলো না। যেখানে আমার নিজের মামিই পুরো এলাকায় কথাটা ছড়িয়েছে সেখানে আমি কিছু বললে বলতো আমি ভালো সাজার জন্য বলছি। নিজের দোষ ঢাকতে চাচ্ছি। উল্টো আমাকেই নানা কথা শোনাতো। আমার মা একবার হার্ট অ্যাটাক করেছেন আমার কারণে। লোকদের মন্দ কথা না নিতে পেরে যদি আবার মায়ের কিছু হয়ে যেতো আমি কি করতাম? আমি কি করতাম তখন? মাও চাচ্ছিল আপনার সাথে আমার বিয়ে হোক। তাই কিছু বলি নি আমি।’
আরশ চুপ থাকলেন। আমি তাকে বললাম, আপনি বিশ্বাস করতেন আমাকে?
বলেই দেখতে।
তাহলে তো বোধহয় আমাকে আর বিয়ে করতেন না।
উনি হেসে ফেললেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, না জেনে ভালোই হয়েছে। বউ পেয়ে গেছি আমি।
আমি ওনাকে বললাম, এখন কি করবেন?
উনি বললেন, কি করবো মানে?
মানে আমি তো এখন প্রেগন্যান্ট। আপনি কি করবেন তা জানতে চাচ্ছি।
কি আর করবো তোমার সেবা যত্ন করবো।
আর কিছু?
উনি কিছুক্ষণ ভাবলেন। এরপর বললেন, আপাতত গিয়ে জেনিসা আর মা বাবাকে বলবো। এরপর সবাইকে মিষ্টি মুখ করাবো।
উনি হেসে ফেললেন। আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো বলবেন আমরা ওনাকে মিথ্যে বলেছি আরো হাজার খানেক কথা। কিন্তু উনি স্বাভাবিক ভাবেই সন্তান আসার আনন্দ ভোগ করতে চাচ্ছেন। আমি ওনার দিকে তাকিয়েই থাকলাম। উনি তখন আমাকে বললেন, এতো কি ভাবছো তুমি? ভাবাভাবি করে শরীর খারাপ করো না। বাবুর কষ্ট হবে। ও তো আমারই সন্তান মৌ। নিজের সন্তানকে না মেনে নেওয়ার মতো পাপ কাজ আমি করতে পারবো না। জেনিসা আমার বড় মেয়ে আর ও ছোট। আমার দুই সন্তানসহ বউকে নিয়ে আমি আমার বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবো। আমার আর কিছু চাই না মৌ।
আরশ নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। নাহলে বোনের মেয়ের জন্য এমন কজন করে? বোনের সন্তানের জন্য এতো করছেন নিজের সন্তানের জন্য কত করবেন তা বোঝার বাকি নেই আমার। ওনাকে ওইদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা এখন আর আপনার ভয় লাগে না? আমার একটা বাচ্চা হলে আমি কি জেনিসাকে আগের মতো ভালোবাসবো?
আরশ হেসে ফেলেছিল। বলেছিলো, জেনিসার জন্য তুমি যেমন করো আমার মনে হয় না তুমি এখন ওমন কিছু করবে। বিশ্বাস আছে আমার তোমার প্রতি।
আমি সেদিন ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আর ভালোবাসা? আমাকে ভালোবাসেন আপনি?
উনি সেদিন বলেছিলেন, তোমাকে ভালো না বাসলে কাকে ভালোবাসবো? আমার কি আরো পাঁচটা বউ আছে নাকি প্রেমিকা আছে? হুহ?
আমি চুপ থাকলাম। বললাম, আমাকে নিয়ে আপনি সংসার করছেন। আপনি তো চাইলেই একটা অবিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করতে পারতেন।
উনি তখন বলেছিলেন, দেখো এর প্রথম কারণ আল্লাহ আমার কপালে তোমাকে রেখেছিলেন। তা না হলে তুমি যেমনটা বলেছো তেমনটাই হতো। আর দ্বিতীয় কারণ জেনিসা। তোমার অতীত নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই মৌ। এতে তো তোমার কোন দোষ নেই। তাছাড়া তোমাকে দেখেশুনে তোমার সম্পর্কে জেনেই তোমাকে বিয়ে করেছি আমি। আমি তোমাকে নিয়ে সংসার করছি। ভালো আছি আমি। তোমার অতীত যাই হোক তোমার বর্তমান আমি। তাই অতীতকে নিয়ে আর না ভেবে আমাকে নিয়ে ভাবো। আমাদের সন্তানদের নিয়ে ভাবো।
চলবে…