মৃদুমন্দ পর্ব-০১

0
282

মৃদুমন্দ
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

আমার ঘরের জানালা বরাবর একটা বিরাট বারান্দা আছে। সেখানে একজন সাহেব থাকেন। বিলেতি সাহেব। বিলেতি বলার কারণ এটাই, সে বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছেন। সেই ভাবসাব! গানও জানেন টুকটাক। রাত দুটো, তিনটে হলেই তার গানের গলা শোনা যায়। মিহি সুর, মিহি কণ্ঠ! আমি ঘুমাতে পারি। ঠিক ঠিক ঘড়ির কাটা রাত দুটোর কোঠায় পৌঁছাতেই বারান্দা থেকে টুংটাং গিটারের আওয়াজ পাওয়া যায়। তখন কি আর ঘুমানো সম্ভব? জানালার পর্দা অল্পসল্প টেনে তীক্ষ্ণ চোখে গায়কটাকে দেখি। অন্ধকারে বিশেষ মুখ দেখা দায়। দামী মানুষটাকে দামী লাইটেই বোধহয় দেখা যায়। যেহেতু লাইট বন্ধ, তার আবছা অবয়বই একমাত্র সম্বল। সাথে আছে সুরেলা গম্ভীর, পুরুষালী কণ্ঠ।

গায়ক গাইছে, “কোন প্রিয় নামে ডাকি তারে? কোন…. প্রিয় নামে ডাকি?”

আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, আসলেই তো! এই প্রিয়র নাম কি? এই প্রিয়কে কি নামে ডাকব আমি? এলো তো এইযে, সপ্তাহ খানেক হলো। গলার উত্থাল কণ্ঠস্বর ছাড়া এ গায়কের কিছুই তো জানি না আমি। নাম, ধাম, সুরত– কিছুই না!

গায়কের গান আমি ছাড়াও পাড়ার অনেকেই শুনে। রোজ রাত্রিবেলা জানালা দিয়ে তাকে দেখতে গিয়ে অন্য মানুষদেরও আমার নজরে পরে। ভূতের মতো কিছু রাক্ষসী মেয়ে সরাসরি ছাদে উঠে তাকে দেখে, তার গান শুনে। কিছু ছেলেকেও দেখা যায় তালে তাল মিলাতে। তারা জমজ ভাই। রফি, শফি। আমার পাশের বিল্ডিংয়েই থাকে। তাদেরকে বলতে শুনলাম, “মিলহান ভাই? নতুন একটা গান ধরেন। ওইযে? বুলবুলি তোর… ওইটা।”

কাজী নজরুলের গান। আমার খুব প্রিয়। কিন্তু আমার মন বসলো না। গায়কের নাম জেনেও উত্তেজিত হলাম না খুব একটা। আমার জলুনি অনুভূত হচ্ছে। কি আশ্চর্য! ছাদের মেয়েগুলো এত চঞ্চল!

_

ভোরে বাবার সঙ্গে দেখা হলো। খাবার টেবিলে। আমরা রক্ষণশীল পরিবার। সকাল সকাল সবার ঘুম থেকে ওঠার নিয়ম। একসাথে বসে সবার নাস্তা খাওয়ার নিয়ম। এরপর যে যার কাজে।
রাতে বিশেষ ঘুম না হওয়ায় আমি ঝিমুচ্ছিলাম। টুকরো টুকরো করে মুখে নিচ্ছিলাম খাবার। বাবা খেয়াল করলেন। গম্ভীর কণ্ঠে শুধালেন, “ঝিমাচ্ছ কেন? রাতে ঘুম হয়নি?”

একটু হকচকালাম। আস্তে করে বললাম, “একটু ক্লান্ত ছিলাম, বাবা। ঘুম হয়েছে।”

বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভাবলেন। খাবার মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে। চিবানো শেষে খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, “আমাদের সামনে বিল্ডিংয়ের আজিজ সাহেব, তার ছেলে মিলহান। এইতো কয়েকদিন হলো বিদেশ থেকে এসেছে। এসেই ফালতু কাজকারবার শুরু। রাত বিরেতে কিসব গান গায়। ঘুমানো দায়। ওটার কারণেই ঘুম হয়নি তোমার। আমি বুঝতে পারছি।”

ছোট ভাইটা খেতে খেতে লাফিয়ে উঠলো তক্ষুণি! বিরোধ করে বললো, “কেন বাবা? ভাইয়ার গান তো সুন্দর। আমি তো বলছি, উনাকে টিভিতে গান করা উচিত। প্রফেশনালি।”
বাবা ধমকালেন, “নিজের প্রফেশন নিয়ে ভাবো আগে। স্কুলের রেজাল্ট দিয়েছে তোমার? কত পেয়েছিলে যেন?”

মা ওমনি চট করে বললেন, “আহা! ওকে বকো নাতো। ও ভুল কি বলছে? তাছাড়া ছেলেটার সাথে দেখা হয়েছে দু’বার। অনেক ভদ্র, সভ্য।সালাম ছাড়া কথা বলে না।”

খারাপ মনটা আরও বিষাদের রসাতলে তলিয়ে গেল। এবাড়ির সবার গায়কের সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। শুধু মাত্র আমারই হয়নি। ভাগ্যটা এত খারাপ কেন? এখন কি তবে চিরুনি তল্লাশি চালাতে হবে তাকে দেখতে, কথা বলতে? ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললাম আমি। পরোটা ছিঁড়ে মুখে পুরতে পুরতে আনমনা হয়ে কি যে ভাবলাম! ভাবনাটা মোটামুটি বড়ই ছিল। তবে আমার মনে নেই। ভীষণ ভুলোমনা হয়েছি তো! আজকাল কিছু মনে থাকে না। এই ভাবলাম, এই ভুলে গেলাম!

_

গায়ককে খুঁজতে আমার অবশ্য চিরুনি তল্লাশি করা লাগলো না। তার দেখা সেদিনই পেলাম। ভার্সিটি থেকে আসার সময়। তখন প্রায় সন্ধ্যা হবে হবে সময়। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সকাল সকাল ট্রেনে করে ভার্সিটি, ক্লাস শেষে আবার ট্রেনে ফিরতে ফিরতে গায়ের জোর তলানিতে ঠেকেছে। ঠোঁট শুকনো, চুল উসকোখুসকো, ক্লান্ত শরীর। পা যেন চলছে না। টেনে টুনে বাসার দিকে যাওয়ার পথে বিশাল এক ডাক শুনলাম। রফির গলা, “এই প্রিয়তা? এদিকে আয়। তোকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।”

রফির সাথে শফিও ছিল। ওরা আমার সমবয়সী। ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছি। চুলোচুলির সম্পর্ক।

যেয়ে দেখলাম, তারা একা নয়। তাদের সঙ্গে আরেকজন লোক ছিল। লম্বা মতো। চিনি না। চেহারাও বিশেষ আগ্রহ নিয়ে খেয়াল করিনি। শফি বললো, “এটা মিলহান ভাই। বিদেশ থেকে কয়েকদিন আগে এসেছেন। হেব্বি গান করেন। তোর অবশ্য জানার কথা। তোদের বিল্ডিংয়ের সামনেই তো উনি থাকেন। আজিজ কাকার ছেলে।”

চমকালাম। খুব, খুব, খুব! এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। চট করে মাথা তুলে তাকাতেই বুঝলাম, ভুল করেছি। লোকটা অসম্ভব সুদর্শন। গায়ের চামড়া তমাটে ছিল বোধহয়। বিদেশ থেকে হলেটে হয়ে ফিরেছেন।
আমি যেমন তার দিকে তাকিয়ে আছি, গায়কও তাই। কিন্তু আমার মতো করে না। তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। বোঝা যায়, সে কিছুর হিসেব মিলাচ্ছেন। কিন্তু কিসের?

আমি বললাম, “ভালো আছেন, ভাইয়া?”

তার গানের গলার চেয়েও সুস্পষ্ট বাংলা আরও আকর্ষনীয় ঠেকলো, “ভালো, তুমি?”
—“ভালো আছি।”

কথা ওটুকুতেই থামলো। রফি ততক্ষণে আমার ক্লান্ত মুখ থেকে বিরক্ত হয়ে তাকালো একটু। নাক ছিটকে বললো, “তোকে এমন ম্যারার মতো লাগছে কেন, প্রিয়তা? ছ্যাঁ! কালা কয়লা লাগছে। ছ্যাঁ! ছ্যাঁ! কোক খাবি? ঠান্ডা ঠান্ডা?”

রাগে আমার পিত্তি জ্বলে উঠলো। শয়তান ছেলে! এত ধকলে ম্যারা না তো সিনেমার নায়িকা লাগবে আমাকে? দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, “খাবো না।”
শফি পাত্তা দিলো না। রফিকে নিয়ে যেতে যেতে বললো, “দাঁড়া, নিয়ে আসছি।”

ওদের দুজনেরই যেতে হবে কেন? একজন গিয়ে আনতে পারছে না? আমাকে গায়কের সঙ্গে একা রেখে গেছে। এমনি হলে আমি সেচ্ছায় থাকতাম। কিন্তু এখন বিষয় আলাদা। অপ্রস্তুত দেখা। তারওপর চেহারার অবস্থা বিশেষ না। ঘেমে নেয়ে আছি। ঘামের গন্ধ আসছে নাতো? ইয়া মাবুদ!

আমার ভাবনার মাঝেই মিলহানকে কথা বলতে দেখা গেল। লম্বা মতো লোকটা একটু ঝুঁকেছেন, “তুমি ওই মেয়েটা না? আমার লুকানো ভক্ত? যে রাতে চুপিচুপি আমার গান শোনে? পর্দার আড়ালে?”

আমি থমকালাম। আড়চোখে তাকালাম। লোকটা হাসছে। হাসি সুন্দর। কিন্তু কথার ধরনটা ম্যানার্সলেস। আমাকে আবার বললো, “আমার গান শুনতে তো টাকা লাগে, ম্যাম। এমনি এমনি তো শোনা যায় না।”

কেন রে? ওই মেয়েগুলা যে শুনে? ওদের তো কিছু বলতে শুনিনি। নাকি চুপেসারে চাদাটাদা কিছু নেওয়া হয়? রয়েসয়ে বললাম, “আপনি ভুল ভাবছেন।”

মিলহান ভাবুক হওয়ার ভান করে বললেন, “তাই নাকি? কিন্তু আমার তো তা মনে হয় না। তোমার চেহারা দেখেই মনে হয়, তোমার চোরেদের স্বভাব আছে।”

বিশাল অপমান! সহ্য হলো না। পছন্দ, টছন্দ ভুলে খেকিয়ে উঠলাম, “ম্যানার্সলেস লোক! গান পারে না ছাই! রোজ রাতে কি বিশ্রী গান গেয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেন। এর দায় কে নিবে?”

সে হাসছেন।আমি আর অপেক্ষা করলাম না। এমনিতেই ক্লান্ত। এখন আরও বেশি ক্লান্ত। দ্রুত পায়ে চলে যেতে যেতে বুঝলাম রফি শফি কোল্ডড্রিংস নিয়ে চলে এসেছে। মিলহান বলছেন, “প্রিয় মনে হয় খাবে না, রফি। ওরটা আমাকে দাও। আমি বরং দুটো খাই।”

রাগে শরীর রি রি করলো। প্রিয় কে? আমি প্রিয়তা।

_______________

চলবে~