উপন্যাসঃ মেঘফুল ☁
পরিচ্ছেদঃ ২৩
লেখকঃ মিশু মনি
ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলো জাহ্নবী। নিজের জীবনের অদ্ভুত পরিবর্তন ওকে অবাক করছে। যে মানুষটা নিজের ঘর থেকে বের হয়ে পরিবারের সঙ্গে অনায়াসে মিশতে সংকোচ করত, সেই মানুষটাই এখন পরিবারের সবার মধ্যমণি! পারভীনের প্রত্যেকটা ফোনকল ওকে আনন্দ দেয়। গতকাল থেকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন তিনি। শেষ ফোনকলে জাহ্নবীকে বাসায় যেতে বলেছেন। জাহ্নবী অবশ্যই যাবে। আজকে শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। কাজের চাপ ছিল অনেক। আগামীকাল সে যাবে ওই বাড়িতে। পারভীনকে জড়িয়ে ধরে মায়ের চিরচেনা ঘ্রাণ অনুভব করবে।
ঘর অন্ধকার করে জানালা খুলে রাখলে বাইরে থেকে আলোকচ্ছটা ঘরে এসে পুরো ঘরের সৌন্দর্য বদলে দেয়। দেয়ালে আলোছায়ার অদ্ভুত খেলা দেখে জাহ্নবী অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। সেদিন ‘পান্নাবাহার’কে দেখার পর সারা রাত অস্থির লেগেছে তার। আগে কখনো এমন হয়নি। আর হবেই বা কী করে! জাহ্নবী জীবনের বেশিরভাগ সময় এসব প্রেমানুভূতিকে অপছন্দ করে এসেছে। কারও প্রেমের প্রস্তাবকে মুখের ওপর ‘না’ বলে দিয়েছে। আঠাশ বছরের পূর্বে কখনো পুরুষ মানুষের প্রতি কোনোরকম আকর্ষণ অনুভব করেনি সে। ধীরেধীরে বয়স যতই বাড়তে লাগল, একাকীত্ব গ্রাস করল তাকে। একটা সময়ে এসে মনে হল, জীবনে নিজের একটা মানুষ বড্ড প্রয়োজন। যে তাকে বুঝবে, ভালোবাসবে। মানুষটা হবে একান্তই তার। এই ভাবনা ধীরেধীরে জাহ্নবীকে প্রেমের প্রতি দুর্বল করে তুলেছে। গত কয়েকটা মাস সে প্রেমে পড়ার জন্য ব্যকুল হয়ে আছে। এই ছেলেটাও হয়তো সেরকমই একটা অনুভূতি বৈ আর কিছুই না। কিন্তু জাহ্নবী ‘পান্নাবাহার’কে যতবারই ভোলার চেষ্টা করেছে, প্রত্যেকবারই তার মনে হচ্ছে, ‘এ অনুভূতি সবার চাইতে আলাদা।’
জাহ্নবী বেলকনিতে এসে দাঁড়াল। গত দুদিন সে একটিবারও ওই চায়ের দোকানের দিকে তাকায় নি। সে বুঝতে চেষ্টা করছে, এটা প্রেম নাকি শুধুই আবেগ। আজ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে বলল, ‘আমি ওই দোকানের দিকে তাকাবো না।’
রাস্তা প্রায় ফাঁকা। দু একটা রিকশা মাঝেমাঝে হর্ন বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। জাহ্নবী ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঢাকা শহরটাকে দেখছে। রাস্তাঘাট, ফুটপাত, বড় বড় বিল্ডিং। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা দোকান। ওপরে একটা সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে, ‘when tea meet toast’.
জাহ্নবী একটা নিশ্বাস ফেলে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। তার গাছগুলো বড় হচ্ছে। জাহ্নবী গাছে হাত বুলিয়ে বলল, ‘তোরা কী অনুভব করিস? তোদেরও কি অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যথা হয়? আবেগ আছে তোদের?’
জাহ্নবীর মনে হলো গাছ ওর সঙ্গে কথা বলছে। একটা বেবিটিয়ার্সের চারা বেলকনির গ্রিলে ঝুলিয়ে রেখেছে সে। দ্রুত বাড়ছে সেটা। বড্ড আদর করতে ইচ্ছে করে গাছটাকে। জাহ্নবী বলল, ‘তুই সবসময় এত হাসিখুশি থাকিস কেন রে?’
ওর মনে হলো, গাছ উত্তর দিচ্ছে, ‘কারণ আমার কোনো দুঃখ নাই।’
জাহ্নবী হো হো করে হেসে উঠে আপন মনে বলল, ‘আমারও কোনো দুঃখ নাই। আমার একটাই দুঃখ ছিল, বিয়ে হচ্ছে না। এটা আবার কোনো দুঃখ হল? বিয়ে না হলে কী আমার ফাঁসি হবে? হবে না। তাহলে আমিও তোর মত হাসিখুশি মানুষ। হা হা হা।’
জাহ্নবী জোরে জোরে হাসছে। ঘরের দরজা বন্ধ। তার হাসির শব্দ এই ঘরের বাইরে যাবে না। জাহ্নবী আবছা অন্ধকার ঘরে এসে ফ্যান চালিয়ে দিলো। শিরশির করে বাতাস লাগছে গায়। তার খুব উড়তে মন চাইছে। সুখের বাতাসে গা ভাসিয়ে।
জাহ্নবী হেডফোন কানে গুঁজে গান ছেড়ে দিলো। গান শুনতে শুনতে মনে হল বাতাসে ভাসছে সে। সুখের বাতাসে ভেসে যাচ্ছে।
‘তোমাকে জানিনা প্রিয়, জানো না তুমি আমায়…’
গানটা ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠেছে জাহ্নবীর। গত তিনদিনে সাতাশ বার গানটা শুনেছে সে। গানটা প্রায় মুখস্থই হয়ে গেছে তার। আজকে সে গুণগুণ করে গানও গাইল।
খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। মাঝেমাঝে গ্লাস ও জগের টুংটাং আওয়াজ আর খাবার চিবানোর চাপুতচুপুত শব্দ। বলার মতো কথা কেউই খুঁজে পাচ্ছে না হয়ত।
পারভীন নীরবতা ভাঙলেন। ভায়োলেটকে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেদিনের ওই ছেলেটা কে সেটা জানার ইচ্ছা নাই আমার। ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ করবি না।’
‘আচ্ছা মা। ও আমার ক্লাসমেট। এর বাইরে কিছুই না।’
‘আমরাও সেটাই মনে করি। এরকম ছেলেদের আমাদের পছন্দ না।’
সামার দুষ্টুমি করে বলল, ‘চুল দাড়ি কেটে আসলে পছন্দ হবে?’
পারভীন কটমট করে তাকালেন সামারের দিকে। দুষ্টুমি হাসি সামারের চেহারায়। সে ঠোঁট টিপে হাসছে।
বলল, ‘না মানে অর্ণব ভাইয়াকে প্রথম প্রথম তোমার ভালো লাগেনি। এখন তো ভালো খাবার রান্না হলেই অর্ণবকে ডাকো, অর্ণবকে ফোন দাও। তাই বলছিলাম। চুল দাড়ি কেটে এলেই হবে?’
সামার হেসে উঠল কথাটা বলেই। জাভেদ আলী ইশারায় সামারকে চুপ করতে বললেন। পারভীন খুব অল্পতেই রেগে যান। কিন্তু আজকে তিনি রাগলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘জাহ্নবী কাল আসবে। তোমরা সবাই মিলে মেয়েটাকে ভালো করে বুঝাও। যেন বিয়েতে অমত না করে।’
ভায়োলেট নিঃশব্দে খাবার খেয়ে উঠে পড়ল। এসব বিষয় নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার। প্রত্যেকের জীবনটা তার নিজের, নিজের মতোই গোছাতে দেয়া উচিৎ।
অফিস শেষ করেই জাহ্নবী আজ বাসায় এলো। পারভীন জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরলেন। দীর্ঘসময় পর এতটা আন্তরিকতা নিয়ে জাহ্নবীকে খাওয়ালেন তিনি। আদর স্নেহে ভরিয়ে দিলেন বড় মেয়েকে। তারপর নরম গলায় বললেন, ‘মা জাহ্নবী, মোস্তফা কামাল ছেলেটা ভালো।’
জাহ্নবী মুহুর্তেই বুঝে ফেলল নিশ্চয়ই আবারও বিয়ের সম্বন্ধটা এগিয়েছে। সে জানতে চাইলো, ‘ভায়োলেটের সঙ্গে ওনার বিয়ে দিচ্ছো?’
‘না। উনি তোকেই বিয়ে করতে চাচ্ছে।’
জাহ্নবী চমকে উঠলো। কয়েকদিন আগেও কথাটা শুনে নিশ্চয়ই খুশি হওয়ার মতো অবস্থায় ছিল সে। কিন্তু আজকে সে খুশি হতে পারল না। ভালো লাগছে না লোকটাকে। মনে হচ্ছে আর যাই হোক, ওনাকে সে বিয়ে করতে পারবে না।
জাহ্নবী মায়ের মুখের ওপর কিছু বলতে পারল না। নিঃশব্দে বসে রইল। পারভীন আশাবাদী হলেন। জাহ্নবী শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করবেই, এটা নিশ্চিত তিনি। ওনার আনন্দ হচ্ছে এখন।
জাহ্নবী দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরল। মনের শান্তি নষ্ট হয়েছে তার। কঠিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। মা বলেছেন দ্রুত মোস্তফা কামালকে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। ওনারা স্বপরিবারে জাহ্নবীকে দেখতে আসবেন। কী করবে জাহ্নবী?
জাহ্নবী এক মগ কফি নিয়ে এসে বারান্দায় বসল। অদূরে ‘when tea meet toast’ দোকানটির দিকে তাকিয়ে মনেমনে ভাবল, ‘ওই পান্নাবাহার একটা মরিচীকা। তাকে একদিন দেখেছি মাত্র। আর কখনো দেখা হবে না। দেখা হলেও দেখা যাবে সে বিবাহিত। পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর বয়সে কেউ অবিবাহিত থাকে না। লোকটার কথা ভাবা বন্ধ করা উচিৎ আমার।’
কফির মগে চুমুক দিলো জাহ্নবী। পান্নাবাহারকে নিছক কল্পনা ভেবে ভুলে যেতে পারবে হয়তো। কিন্তু মোস্তফা কামালকে এইমুহুর্তে তার বিয়ে করতে একদমই ইচ্ছে করছে না। তবুও কী বিয়ে করতে হবে তাকে? এদেশের বেশিরভাগ মেয়েই তো ইচ্ছের বাইরে গিয়েই বিয়ে করে। সবাই তো সুখে সংসার করছে৷ সেও নিশ্চয় পারবে। জোরপূর্বক মনকে একজনের দিকে টেনে এনে বেঁধে রাখাটাই তো মেয়েদের জীবন!
মোস্তফা কামালের পরিবার যেদিন জাহ্নবীকে দেখতে এলো, সেদিন বাড়ি জুরে আনন্দের বন্যা। অর্ণব এসেছে, বড় মামা, মামী এসেছেন। দাদু এসেছেন গ্রাম থেকে। কুমিল্লা থেকে এসেছেন দোলন চাচা। সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে আজকেই বিয়ে পড়িয়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচতে চান তারা। জাহ্নবী শাড়ি পরেছে আজ। ভায়োলেট নিজ হাতে তাকে সাজিয়ে দিয়েছে।
মোস্তফা কামালের দুলাভাই বললেন, ‘মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমাদের কোনো দাবী দাওয়া নাই। বিয়ে আপনারা কোন ক্লাবে করবেন নাকি ঘরোয়া ভাবে করবেন সেটা নিয়েও আমাদের চিন্তা নাই। তবে বিয়ের পর মেয়েকে কুমিল্লায় গিয়ে থাকতে হবে। শাশুড়ীর দেখাশোনা করতে হবে। উনি একলা মানুষ। ওনাকে দেখাশোনার জন্যই বিয়েটা দেয়া।’
জাহ্নবী মাথা নিচু করে রাখল। সে জানে তার আত্মীয় স্বজন সকলেই এতে রাজী হয়ে যাবে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে সংসার করাটাই সবার মতামত হবে। তার একমাত্র আশার কারণ ভায়োলেট। কেবল ভায়োলেটই এই পরিস্থিতিতে তাকে আশার আলো দেখাবে। কিন্তু ভায়োলেট বাসায় নেই!
মোস্তফা কামাল তাকিয়ে আছেন জাহ্নবীর দিকে। সামান্য ভ্রু কুঁচকানো ওনার। খুব সম্ভবত মেয়ের বয়স নিয়ে চিন্তিত তিনি। তবুও মনকে বুঝাতে চাইছেন, বয়স বেশী হওয়াটা কোনো ব্যাপার না। দুলাভাই গ্রামে বেশ কয়েকটা মেয়ে দেখেছে। সবাই অল্পবয়সী, সুন্দরী তরুণী। তারা মোস্তফাকে পছন্দ করেছে বলে বিয়ে করবে না, বিয়ে করবে মোস্তফার টাকার কারণে। এ কারণে সেসব মেয়েগুলোকে মোস্তফার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। তাদেরকে গ্রামে রেখে গেলে যদি পরকীয়া করে? এই দুশ্চিন্তা নিতেই পারবে না সে। জাহ্নবীকে দেখে তার অন্যরকম একটা মেয়ে মনে হয়েছে। এ ধরনের মেয়েরা স্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত লক্ষী হয়। আদর্শ স্ত্রী হয়। এখন তার একমাত্র দুঃখ জাহ্নবীর বয়স বেশী।
বিয়ের কথাবার্তা একরকম পাকা হয়েই যাচ্ছে। জাহ্নবী অবস্থা বেগতিক দেখে ভায়োলেটকে ফোন দিলো। ফোনে দুবার রিং হলেও কল রিসিভ হল না। চিন্তা হচ্ছে জাহ্নবীর। তাকে কী অবশেষে চাকরিটা ছাড়তেই হবে! কুমিল্লায় গিয়ে বাধ্য স্ত্রী হয়ে সংসার করতে হবে? কিন্তু জাহ্নবী এখন তার বর্তমান জীবন নিয়েই সুখী। তার এখন মোটেও বাধ্যগত স্ত্রী হতে ইচ্ছে করছে না। আরও কিছুদিন এভাবে একা থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু উপায় নেই। সেদিন জাহ্নবী নিজ মুখেই বাবা মাকে বলেছে পাত্র দেখতে। এখন নিজেই ‘না’ বলার দুঃসাহস করলে বাবা মা কষ্ট পাবেন।
চলবে..
উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ২৪
লেখকঃ মিশু মনি
জাহ্নবী বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রইল। বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক হয়েছে কী না সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে সে। অস্থিরতা ক্রমশ ওর মাথা ভারী করে তুলল। ঠিক এমন সময় স্বস্তির বৃষ্টি নামল। ভায়োলেট ফোন করেছে।
জাহ্নবী ফোন রিসিভ করে অস্থির গলায় বলল, ‘তুই কোথায়? আমার এদিকে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
‘কিছুই শেষ হবেনা যদি তুমি চাও।’
‘আমি কী চাই সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’
‘তাহলে বাবার কাছে যাও। গিয়ে বলো, আমাকে কয়েকদিন সময় দাও। আমি আরও ভেবে দেখি।’
‘আমি পারছি না রে।’ হতাশ গলায় বলল জাহ্নবী।
‘না পারলে চুপচাপ বিয়ে করে ফেলো।’
জাহ্নবী চুপ হয়ে গেল। অন্যপাশে ভায়োলেটও কোনো কথা বলছে না। জাহ্নবী বলল, ‘আমি এখন বিয়ে করতে চাইছি না। মানে এটা আগের গুলোর মতো নয়। আগে তো সত্যিই বিয়ে করতে চাইতাম না। কিন্তু এবার আমার ঠিক মোস্তফা কামালকে.. বুঝাতে পারছি না। আমি পাগল হয়ে যাবো ভায়োলেট।’
ভায়োলেট ধীরগলায় বলল, ‘তাহলে আব্বুর রুমে যাও। গিয়ে বলো, তোমার আরও কিছুদিন সময় লাগবে। তুমি বললে আব্বু অবশ্যই সময় দেবে। জোর করে বিয়ে দেয়ার হলে আগেই দিয়ে দিতো। আমাদের আব্বু সেরকম মানুষ নন।’
জাহ্নবী বলল, ‘আব্বুকেই তো বলতে পারছি না।’
‘যাও, গিয়ে বলো। সময় নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
জাহ্নবী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আচ্ছা আমি যাচ্ছি। কিন্তু সময় নেয়ার পরও আমার মতামত ‘না’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। ওনাদের দাবী, মেয়েকে ওরা চাকরি করতে দেবে না। গ্রামে গিয়ে শাশুড়ীর সঙ্গে থাকতে হবে।’
ভায়োলেট বলল, ‘তাহলে সেরকম মেয়েকেই খুঁজতে বলো। যে মেয়ে চাকরি করেনা, শাশুড়ীর সেবায় নিজেকে সবসময় নিয়োজিত রাখবে। চাকরি করা একটা মেয়েকে ওরা চাকরি ছাড়তে বলবে কেন? তুমি তো মোস্তফা কামালের প্রেমিকা নও। ওনাকে বিয়ে করতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি তোমাকে কেউ দিয়ে রাখেনি।’
জাহ্নবী ভরসা পেলো ভায়োলেটের কথায়। লজ্জাকে ভেতর থেকে টেনে বের করে একদিকে সরিয়ে রাখল। তারপর গেল জাভেদ আলীর সঙ্গে কথা বলতে।
পারভীন বিছানায় শুয়ে আছেন। জাভেদ আলী বসে আছেন সোফায়। ওনার সবচেয়ে ভালো গুণ হল, তিনি কখনোই চিন্তিত থাকেন না। বেশ সুখী সুখী মানুষ মনেহয় তাকে।
জাহ্নবীকে দেখে তিনি বললেন, ‘কিছু বলবি মা?’
লজ্জাকে সরাতে চেয়েও সরানো যায়নি বোধহয়। জাহ্নবী কথাটা বলতে গিয়ে মাথা নিচু করে রাখল। মৃদু স্বরে বলল, ‘আব্বু আমার কিছুদিন সময় লাগবে।’
জাভেদ আলী পারভীনের দিকে তাকালেন। স্ত্রী’র প্রতিক্রিয়া দেখে তারপর কথা বলবেন। কিন্তু পারভীন শুয়েই রইলেন, ওনার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।
জাহ্নবী বলল, ‘আমি চাকরি ছাড়তে পারবো না আব্বু। তুমি চাও তোমার মেয়েরা মাথা উঁচু করে বাঁচুক। আমি আর মরার মতো বাঁচতে চাই না।’
‘ঠিক আছে। আমি ছেলের সঙ্গে কথা বলবো। তুই চিন্তা করিস না। তোর মতো থাক।’
জাহ্নবী বাবাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পারভীন উঠে বসলেন। ওনার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে স্বামীর ওপর। কঠিন মুখ করে রেখেছেন তিনি।
জাভেদ আলী বললেন, ‘কী হল? রেগে গেছ মনে হচ্ছে?’
পারভীন বললেন, ‘মেয়েটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করা যেত না? তুমি বুঝালে ও ঠিকই রাজী হতো। এত বছর বিয়ে করতেই চায় নি। এখন যেটুকু হোক রাজী তো হয়েছে। ভালো করে বুঝাতে পারতে।’
জাভেদ আলী উঠে যেতে প্রস্তুত হলেন। ছেলেপক্ষ বাইরে অপেক্ষা করছে। পারভীনের কথাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করলেন তিনি। অশান্তিতে পড়ে গেলেন পারভীন। এই লোকটা আজীবন নিজের মতো থেকে এসেছে। কখনো তার কথাকে গুরুত্ব দেয় নি। ওনার আহ্লাদেই মেয়েগুলো এমন হয়েছে। বিরক্তমুখে বসে রইলেন পারভীন। রাগ ঝাড়ার মতো সুযোগ পাচ্ছেন না।
জাভেদ আলী মোস্তফা কামালকেই সরাসরি বলে দিলেন, ‘আমার মেয়েটা চাকরি ছাড়বে না। ও কিছুদিন সময় চেয়েছে। আপনারাও ভেবে দেখুন। আমি জোর করে মেয়েদের ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না।’
দোলন চাচা তৎক্ষনাৎ বললেন, ‘আরে এতে চাপিয়ে দেয়ার কী আছে? তুমি ওর বাবা। জোর করার হলে করবা। আমরা মেয়ের ওপর জোর খাটাবো না তো কে খাটাবে? এত ভালো ছেলে আমাদের মোস্তফা, ওর মতো ছেলে দ্বিতীয়টা আমাদের গ্রামে আর পাবা না। মেয়েকে ভালো করে বুঝাইলেই হবে। আমি বুঝেছি ওর মত আছে।’
দোলন চাচা দাঁত বের করে হাসলেন। জাহ্নবীর বড় মামা বললেন, ‘আমিও মা’র সাথে কথা বলবো। মেয়ে আমার বড়ই লক্ষী। আমাকে যথাযথ সম্মান করে। আমার কথা নিশ্চয়ই ফেলবে না।’
জাভেদ আলী বিব্রতবোধ করছেন। সবার সামনে জোর গলায় কিছু বলতেও পারছেন না। কিন্তু জাহ্নবীকে মন খারাপ হতে দিতে পারবেন না তিনি। তার মেয়েটা সদ্য হতাশা থেকে বেঁচে উঠেছে। এই মেয়েকে নিয়ে ওনার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না।
তিনি বললেন, ‘জাহ্নবী চাকরি করুক। আমিও চাই ও চাকরি করুক। আপনারা ভেবে দেখুন মোস্তফার মাকে ঢাকায় নিয়ে এসে রাখা যায় কী না। মোস্তফা দেশের বাইরে থাকল ওনার স্ত্রীকে ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট নিয়ে রাখলে তাতে কোনো অসুবিধা তো দেখি না।’
মোস্তফা কামালের দুলাভাই উত্তর দিলেন, ‘গ্রামে এত টাকা পয়সা করে বাড়িঘর করেছে, ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার জন্য তো না। আপনারাও নাকি ফ্ল্যাট কিনতেছেন শুনেছি। আপনারা নিজের বাসা রেখে কী ভাড়া বাসায় থাকবেন?’
জাভেদ আলী চুপ করে রইলেন। অতিথির মুখের ওপর তিনি কিছু বলতে চান না। মুচকি হাসলেন তিনি। হেসে বললেন, ‘আপনারা ভেবে দেখেন। আমি আমার মেয়েদের কোনো ইচ্ছাকে অপূর্ণ রাখিনি কখনো।’
মোস্তফা কামালের পরিবার খাওয়াদাওয়া শেষে বিদায় নিলো। বাড়িতে থমথমে পরিবেশ বিরাজমান। পারভীন ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। সামারের ঘরে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে জাহ্নবী।
কিছুক্ষণপর পারভীন ও তার ভাইয়ের কথোপকথন শোনা গেল, ‘তোর মেয়ের বিয়ে আর দেয়ার দরকার নাই। এত করে ছেলেপক্ষকে ম্যানেজ করলাম। দুলাভাই কী বলল? মেয়ের ইচ্ছে অপূর্ণ রাখবে না। তাতে আমাদের কী? তোমার মেয়ের ইচ্ছে সারাজীবন আইবুড়ো হয়ে থাকবে। রাখো ঘরের খুঁটি বানিয়ে। ছোটবোনদেরকে বিয়ে দিতে হবে না?’
পারভীন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমার কপাল খারাপ। এ জীবনে এত দুঃখ সইতেছি। না পারি সইতে, না পারি কাউকে কিছু বলতে।’
‘তোর দোষ আছে আপা। তুই মেয়ের ওপর জোর করলে আজকে এই দিন দেখা লাগত না। তোমরা মেয়েদেরকে বড় বড় ভার্সিটিতে পড়াও। কত মেধা, কত জ্ঞান। এই জ্ঞান নিয়েই এখন ঘরে বসাই রাখো। চাকরি করুক। কী আর করবে..’
জাহ্নবী একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে বসল। প্রায়ই মায়ের মুখে এমন কথা শোনাটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে। মাঝেমাঝে বিভিন্ন আত্মীয়রা বাসায় বেড়াতে এলে তখনও নানান কথা শুনতে হয় তার। সে সবসময় মনেমনে চেয়েছিল, যদি আজ কোথাও চলে যেতে পারতাম! এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। আজকে তার চলে যাওয়ার মতো একটা স্থান আছে। তার নিজের বাসা আছে!
শত যন্ত্রণাতেও জাহ্নবীর মুখে জয়ের হাসি ফুটে উঠল। সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। স্বাভাবিক ভঙ্গীতে মাকে বলল, ‘আম্মু আমি যাই। বাসায় ভাত তরকারি আছে। সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।’
পারভীন ও তার ভাই অবাক হয়ে জাহ্নবীর চলে যাওয়া দেখলেন। জাহ্নবী জাভেদ আলীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। এখন খুব শান্তি শান্তি লাগছে তার। এইমুহুর্তে মনে হচ্ছে, কে কী বলল তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে নিজের মতো বাঁচতে হবে। হঠাৎ ভায়োলেটের কথা মনে পড়ল তার। জাহ্নবী ফোন বের করে ভায়োলেটের নাম্বারে কল দিলো। ফোন ধরল ভায়োলেট। ব্যস্ত গলায় বলল, ‘আপু, বলো?’
‘বাসায় কোনোমত ম্যানেজ করা গেছে। তুই কই?’
‘আমি একটা কাজে আছি।’
‘রাত হচ্ছে। বাসায় আসবি না?’
‘যাবো। তুমি বাসায় আছো?’
‘না। আমি চলে যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা আপু। নিজের যত্ন নিও।’
‘তুইও যত্ন নিস।’
ফোন কেটে দিলো জাহ্নবী। ফুটপাত ধরে হাঁটতে ভালো লাগছে। এই উষ্ণ শহরে আর শীতল হাওয়া বইছে। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা। মৃদুমন্দ বাতাসে নিজেকে বয়ে নিয়ে চলল জাহ্নবী। বয়ে নিয়ে চলল তার নতুন করে বাঁচার স্বপ্নকে।
বেশ কিছুদিন কেটে গেল। জাহ্নবী নিজের জীবন ও কর্মব্যস্ততাকে সঙ্গে নিয়ে ভালোই আছে। কাল পরশু বেতন পাবে সে। প্রথম স্যালারি। মনে অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে তার। অনেকদিন সে বাবার বাসায় যায় নি। কাল বেতন পেলেই পুরো টাকাটা বাবার হাতে তুলে দেবে৷ তারপর বাবার কাছে চেয়ে নেবে তার বাসার ভাড়া ও হাত খরচের টাকা। নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবেন জাভেদ আলী।
জাহ্নবী সন্ধ্যার অন্ধকারে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে। মাঝেমাঝে চোখ চলে যাচ্ছে ‘when tea meet toast’ দোকানটির দিকে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে প্রায়ই জাহ্নবী সেদিকে তাকায়। কাউকে দেখার প্রত্যাশা করে। তবে সেটা কেবলই অবচেতন মনে। সচেতন মনে সে জানে, ওই পান্নাবাহারের সঙ্গে আর কখনো দেখা হবেনা তার। এই ভাললাগার অনুভূতিটুকু কেবল ক্ষণিকের জন্যই ছিল।
জাহ্নবী কফি শেষ করে গাছের সঙ্গে কথা বলল। তার এখানে মোটেও একলা লাগে না। বরং একা থাকার এই চমৎকার জীবনকে সে উপভোগ করছে ভীষণ। এমন সময় দরজায় দাঁড়িয়ে পাশের রুমের একজন মেয়ে বলল, ‘আপু আপনার কাছে একজন গেস্ট এসেছে। আপনি গিয়ে দেখে আসেন।’
চমকে উঠলো জাহ্নবী। তার কাছে আসার মতো তেমন কেউ নেই। সে গেটে এসে দেখল ভায়োলেট এসেছে। জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরল ভায়োলেট। অনেকদিন পর ভায়োলেটের উষ্ণতা ভালো লাগল জাহ্নবীর।
ঘরে এসেই বিছানায় শুয়ে পড়ল ভায়োলেট। জাহ্নবী কফি বানিয়ে আনলো। ভায়োলেট কফির ঘ্রাণ শুঁকে বলল, ‘তোমার বানানো কফিতে একটা আলাদা স্মেল পাই আপু।’
জাহ্নবী হেসে বলল, ‘তাই নাকি? খা। আরও এক কাপ বানিয়ে দিবো। এক কাপ না, এক মগ।’
ভায়োলেট দুষ্টুমি করে বলল, ‘তুমি এক বালতি ই বানিয়ে দিও। হা হা হা।’
জাহ্নবী কফি শেষ করে ভায়োলেটের পাশে শুয়ে পড়ল। ভায়োলেটের ভরা যৌবন। রূপের স্নিগ্ধ মাধুরি মেশানো তনু। দ্রুত বড় হয়ে গেল মেয়েটা। অথচ সেদিনই ছিল ছোট্ট, চুল ঝুটি করে পুরো বাড়ি দৌড়ে বেড়াত!
ভায়োলেট বলল, ‘কী দেখছ আপু?’
‘তোর কথা শুনবো আজ। তুই বলেছিলি সময় হলে বলবি। আজ বলতেই হবে।’
‘আচ্ছা আপু। আজকে বলবো। আজ অনেক কথা বলবো তোমায়।’
জাহ্নবী মনেমনে ভীষণ খুশি হল। কৌতুহল ফুটে উঠল তার চোখেমুখে। বলল, ‘সত্যি! আমি শুনবো। তোকে আমার কেমন যেন রহস্যময়ী লাগে ভায়োলেট।’
ভায়োলেট শব্দ করে হাসলো। ‘কী যে বলো আপু!’
জাহ্নবী বলল, ‘সব কাজ শেষ করে আসি। তারপর শুনবো তোর সব কথা।’
ভায়োলেট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মুখে লেগে রইল ম্লান হাসি। তার কথাগুলো সে কক্ষনো কাউকে বলেনি!
চলবে..
উপন্যাসঃ মেঘফুল ☁
পরিচ্ছেদঃ ২৫
লেখাঃ মিশু মনি
প্রেম ঈশ্বরপ্রদত্ত এক অদ্ভুত শক্তি। কারও কারও জীবনে প্রেম আসে বৃষ্টির মতো, ঝমঝমিয়ে। আকাশ কাঁপিয়ে, ভূধর কাঁপানো গর্জন সাথে নিয়ে। ভায়োলেটের জীবনে প্রেম এভাবে আসেনি, এসেছিল জানালা গলে ঘরে ঢোকা প্রজাপতির মতো, নিঃশব্দে। টেরই পায়নি সে, অথচ ভালো লেগেছিল, যার প্রবল রেশ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে ভায়োলেট।
রুশো’কে যেদিন প্রথম দেখেছিল সে, সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল। ছিপছিপে বৃষ্টি নয়, একেবারে বড় বড় ফোঁটা নিয়ে তুমুল বর্ষণ। বাড়িতে কেউ ছিল না। তখন ওরা যে বাড়িতে থাকত, তার সামনে ছিল বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। আর ছিল একটা উঠোন, যেখানে বড় গাছে একটা দোলনা বাঁধা ছিল। ওইদিন বাবা মা কেউ ছিলেন না বাড়িতে। কোনো কারণে বাড়ির সবাই সেদিন বাইরে। কিশোরী ভায়োলেটও তাই সুযোগ পেয়ে হয়ে উঠেছিল ভয়ংকর দুঃসাহসী। বয়স আর কতই হবে, বারো কিংবা তেরো। দুঃসাহস দেখানোর মতোই বয়স। ভায়োলেট প্রবল বৃষ্টির ভেতর দোলনায় দোল খাচ্ছিল। মনের আনন্দে সেদিন জোয়ার নেমেছিল তার। কোমর সমান চুলগুলোকে পিঠের ওপর এলিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে দোলনার রশিটা ধরে ছিল দুহাতে। পাগলের মতো দোল খাচ্ছিল ভায়োলেট। উঠোনে বৃষ্টি পড়ছিল পাথরের মতো।
হঠাৎ একটা দৃশ্যে তার চোখ আটকে যায়। বাড়ির গেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে। মাথায় ঝাকড়া চুল, গায়ে চেক শার্ট। ছেলেটার মাথায় ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির স্রোত তার চিবুক বেয়ে নেমে যাচ্ছে ঠোঁটে। ভায়োলেটের থেকে কয়েক হাত দুরত্বে দাঁড়িয়ে আছে সে। মুহুর্তের জন্য ভায়োলেট খেই হারিয়ে ফেলল। ছেলেটার অপূর্ব মায়াভরা মুখটা ওর হৃদয়ে তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে মুহুর্তেই। ভায়োলেট জানেনা প্রেম মানে কী, এটা কীভাবে আসে। তবে সেদিন এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল সে। বর্ষণের প্রবলতা তাদের কাউকেই চিন্তিত করে নি। ছেলেটা বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভায়োলেটকে দেখেছে, অনেক্ষণ ধরে। বিশ বছর বয়সী সেই ছেলেটা ভায়োলেটের মনে নতুন সুর তোলে। দোলনার রশি ধরে থাকা ভায়োলেটের গলা শুকিয়ে কাঠ। মাত্র দু থেকে তিন মিনিট দাঁড়িয়ে ছিল সেই অদ্ভুত ছেলেটা। তারপর দৌড়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়।
কিন্তু ফেলে যায় মোহ। তার ফেলে যাওয়া মোহের আচ্ছনতায় ভায়োলেটের সবকিছু ওলট পালট করে রেখে যায়। তেরো বছর বয়সের সেই গভীর আবেগে প্রায় রাতেই ভায়োলেট ছেলেটাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনত। সে বুঝতে পেরেছিল, এটাই তার জীবনে আসা প্রথম প্রেম। ভ্রমরের মতো গুণগুনিয়ে না এলেও, সে এসেছে নিরবে, নিভৃতে। তারপর অনেকদিন ভায়োলেট ঘুমাতে পারেনি রাতে। সামান্য দুই মিনিটের চোখাচোখি আর সেই দর্শন, তার কাছে দুই যুগের মতোই স্মৃতিমধুর হয়ে ছিল।
তারপর! কতগুলো বছর কেটে গেছে। কই, রুশোর সঙ্গে আর দেখা হয়নি তার। রুশোর চেহারাটা তো কয়েকদিন বাদেই ভুলে গিয়েছিল ভায়োলেট। একদিন হঠাৎ…
জাহ্নবীর ধাক্কায় ভাবনা থেকে ফিরে এলো ভায়োলেট। তাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। চিন্তিত মুখে জাহ্নবী জানতে চাইলো, ‘কী হল রে? মন খারাপ?’
ভায়োলেট একটা নিশ্বাস ছেড়ে শুকনো হাসি হেসে বলল, ‘আমাদের প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে গেছে। অনেক বছর আগের কথা। অথচ আমার মনে হচ্ছে যেন সেদিনই। এই মধুর ঘটনাটা আমি এতবার স্মরণ করেছি, এতবার ভেবেছি! সবকিছু স্পষ্ট মনে আছে।’
জাহ্নবী অবাক হল। ভায়োলেটের চোখে লেগে থাকা অপূর্ব এই আবেশ ওর ভীষণ ভালো লাগল। এতটা মায়াভরা কখনোই লাগেনি ভায়োলেটকে। প্রথম দেখা হওয়ার সেই দৃশ্যটা শোনার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছিল না জাহ্নবী।
সব কাজ শেষ করে দু বোন পাশাপাশি শুয়ে পড়ল। জাহ্নবী বলল, ‘কী ভাবছিস? এখনো সেই প্রথম দেখা হওয়ার কথা?’
‘না আপু৷ একটা উপকার করবে আমার?’
‘বল। আমি যদি তোর উপকার করতে পারি, সেটা আমার জন্য ভীষণ আনন্দের একটা ব্যাপার হবে।’
‘আপু, তোমার স্যালারি কত পাবে?’
‘সাতচল্লিশ হাজার। কেন রে?’
‘আপু, আমি একটা বিপদের মধ্যে আছি। তোমার বাসা ভাড়া দেয়ার পর বাকিটা আমাকে ধার দেবে? প্লিজ?’
জাহ্নবী ভীষণ অবাক হলেও বিস্ময় লুকিয়ে রাখল সে। ভায়োলেটের হাত ধরে বলল, ‘অবশ্যই দেবো৷ তুই পুরোটাই নিয়ে নিস। আমার কাছে বাড়তি কিছু আছে। আমি সেটা দিয়ে চালিয়ে নেবো।’
‘সত্যি আপু?’
‘হুম। কী হয়েছে? কিসের বিপদ আমাকে বলবি না?’
ভায়োলেট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘বলবো আপু। এখন না। সময় হলে বলবো। আমি একটা ঝামেলায় পড়ে একজনের কাছে টাকা ধার নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখন সে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না কীভাবে দেবো। আমার টাকা আসার মতো কোনো পথ নেই।’
জাহ্নবী ভায়োলেটকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘আপু আছি না? একদম টেনশন করবি না। আমার লক্ষী বোন। কত টাকা লাগবে?’
‘পঞ্চাশ হাজার।’
‘আচ্ছা। আমি ম্যানেজ করে তোকে পঞ্চাশ হাজারই দেবো।’
‘তুমি কোথ থেকে ম্যানেজ করবে আপু?’
‘সেটা আমার ওপর ছেড়ে দে। তুই নিশ্চিন্তে থাক।’
ভায়োলেট জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ করেই ভীষণ চিন্তামুক্ত লাগছে ওর।
জাহ্নবী বলল, ‘আচ্ছা একদিন বাসায় যে ছেলেটা এসেছিল, তুই কী ওর কাছেই টাকা ধার নিয়েছিলি?’
ভায়োলেট মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘হুম আপু। তুমি কীভাবে বুঝলে?’
‘আমার মনে হল। ওরকম ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার মত মেয়ে তুই না। এখন বুঝতে পারছি আসলে সে কেন এসেছিল। যাইহোক, তুই একদম চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
ভায়োলেট জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। বহুদিন পর তার নিজেকে আর একা মনে হচ্ছে না৷ ভাললাগা ও খারাপ লাগার মিশ্র অনুভূতিতে ভায়োলেট বিমোহিত হয়ে পড়ল।
জাহ্নবী তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইলো, ‘তোদের প্রথম দেখা কীভাবে হয়েছিল রে?’
ভায়োলেট কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো, ‘বাড়ির উঠোনে আপু। সে অনেক আগের কথা। আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। তুমি তখন একটা প্রজেক্টে চাকরি করতে। আব্বুও কাজে ছিল। মেজোপু আমি আর মা থাকতাম বাসায়। মাঝেমাঝে আম্মু মেজোপুকে নিয়ে বাইরে যেতেন। তখন আমি থাকতাম একদম একা। আমি পুরো বাড়ি নেচে বেড়াতাম। আপন মনে গান গাইতাম, একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলতাম। সে এক আনন্দময় সময় কাটত আমার। আব্বু বাড়িতে থাকলে বৃষ্টিতে ভিজতে দেয় না সেটা তো তুমি জানোই। আম্মুও বকা দেয়। সেদিন কেউই বাড়িতে ছিল না আপু। আকাশ কাঁপিয়ে কী যে বৃষ্টি! আমাদের বাড়ির উঠোনে গাছে একটা দোলনা ছিল আমার। মনে আছে আপু? অনেক কান্নাকাটি করে তোমার কাছে বেঁধে নিয়েছিলাম। বাজার থেকে রশি কিনে এনেছিল মেজোপু। তুমি তক্তা দিয়ে খুব সুন্দর করে একটা দোলনা বানিয়ে দিয়েছিলে?’
জাহ্নবী নস্টালজিক হয়ে পড়ল। এমনিতে ভায়োলেট খুব একটা ওর কাছে আসত না। সেদিন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বারবার উঁকি মারছিল। যেন কিছু বলতে চায়। জাহ্নবী ইশারায় ডেকে নেয় ভায়োলেটকে। নিজের চেয়ে বয়সে বারো/তের বছরের ছোট বোনটাকে সে কখনোই কাছে ডেকে আদর করে নি। সে সবার থেকে সবসময় নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। কারও সাথে মিশতে পারেনি জাহ্নবী। ভায়োলেট জাহ্নবীর কাছে দাঁড়িয়ে মুখে আঙুল দিয়ে লাজুক হাসছিল। একসময় আদুরে ভঙ্গীতে বলল, ‘আপু আমাকে একটা দোলনা টাঙিয়ে দিবা?’
জাহ্নবী চমকে উঠেছিল। এ কেমন আবদার! সে জানে না কীভাবে দোলনা বানাতে হয়। তাছাড়া আব্বু প্রায়ই বাড়িতে আসেন। দোলনা দেখলে ভয়ংকর রেগে যাবে আব্বু। মা’র সাথে জাহ্নবী কথা বলে খুবই কম। মাকে রাজী করাতে পারবেই না সে। কিন্তু ছোটবোন প্রথমবারের মতো তার কাছে কিছু আবদার করেছে। জাহ্নবী অনেক চিন্তাভাবনা করে ভায়োলেটের হাতে একশ টাকা দিয়ে বলল, ‘রশি কিনে আনো। আমি দেখি আম্মুকে ম্যানেজ করা যায় কি না। রাজী না হলে লুকিয়ে লুকিয়ে দোল খেতে হবে তোমাকে।’
ভায়োলেট এক দৌড়ে সামারকে সঙ্গে নিয়ে রশি কিনতে গিয়েছিল বাজারে। পারভীন দুই মেয়েকে না বলে বাজারে যাওয়ার কারণে সেদিন প্রচণ্ড বকা দিয়েছিলেন। জাহ্নবীর মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পারভীন তখনও বেশিরভাগ সময় নিজের ঘরেই কাটাতেন। বোনদেরকে পাহারায় রেখে লুকিয়ে লুকিয়ে গাছের ডালে দোলনা ঝুলিয়ে দিয়েছিল জাহ্নবী। পরে জানতে পেরেছিল, পারভীন দোলনা নিয়েও ভায়োলেটকে অনেক বকা দিয়েছিলেন।
হেসে উঠল জাহ্নবী। সবকিছু যেন চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে আছে। তার জীবনে তখনও সবকিছু ছিল, অথচ সে নিজেকে জীবন্ত ভাবতে পারতো না!
জাহ্নবী বলল, ‘হ্যাঁ আমার সব মনে আছে। সব।’
ভায়োলেটকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল জাহ্নবী।
ভায়োলেট আবারও বলতে শুরু করল, ‘আমি মাঝেমাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে দোলনায় বসে থাকতাম। আবার দোলনা উঠিয়ে রাখতাম গাছের ডালে। আব্বু বলেছিল একটা বড় দোলনা এনে দিবেন, কিন্তু দেন নি। আম্মু ও আপু সেদিন বাসায় নেই। আমি বাসার গেট ভালোভাবে বন্ধ আছে কিনা খেয়ালই করিনি। দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিলাম। আমাদের বাড়িটাতে গেট থেকে বাসার মেইন দরজা অবধি অনেকটা ফাঁকা জায়গা ছিল। ওই জায়গাটাতেই আপু। ওই জায়গাটাতেই…’
‘কী!’ বিস্ময় লুকাতে পারল না জাহ্নবী।
ভায়োলেট বলল, ‘রুশো। সেদিন আমার বাঁধ ভাঙা আনন্দের দিন ছিল। একদিকে দোলনায় চড়া নিষেধ, অন্যদিকে বৃষ্টিতে ভেজাও নিষেধ। বাসায় কেউ নেই। তাই আমি মুক্ত পাখির মতো দোল খাচ্ছিলাম। আর বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দোল খাচ্ছি, মনে হচ্ছে বাতাসে ভেসে যাচ্ছি। এত্ত আনন্দে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তখনই দেখি সেই ফাঁকা জায়গাটায় একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আপু, বিশ্বাস করো। ওকে অসম্ভব পরিমাণে মায়াবী লাগছিল। বড় বড় চুল থেকে কপাল ভিজে পানি গড়াচ্ছিল মুখে। ছেলেটা কপাল থেকে চুল সরাচ্ছিল না। আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। দু থেকে তিন মিনিট। আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অথচ এই দু মিনিটই আমার কাছে দুই যুগের সমান। ছেলেটা তারপর দৌড়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরে বুঝলাম, সে গেট খোলা পেয়ে এসেছিল বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু আমাকে দেখার পর আর আমার হাত থেকেই বাঁচতে পারেনি।’
হেসে ফেলল ভায়োলেট। জাহ্নবীর বুকে দ্রুত স্পন্দন অনুভূত হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন এই ঘটনা তার নিজের। তার জীবনে ঘটে যাওয়া এক অদ্ভুত আবেশ। সে ভায়োলেটের কানের কাছে মুখ রেখে জানতে চাইল, ‘প্রথম দেখার পরই তুই প্রেমে পড়েছিলি?’
ভায়োলেট হেসে বলল, ‘জানি না। তখন প্রেম টেম বুঝতাম না। কিন্তু একটা কিছুতে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম। আমার ডায়েরিতে ওর কথা লিখেছিলাম। এক সপ্তাহের মতো ওর ছবি আমার মন থেকে সরছিল না। তারপর আস্তে আস্তে ওর চেহারা ভুলে গেছি। শুধু ঘটনাটা আমার স্মরণ ছিল। প্রায়ই রাতে ঘুম না এলে আমি এই ঘটনাটা মনে করতাম। ভালো লাগত, খারাপ লাগত। কিন্তু রুশোর চেহারা মনে করতে পারতাম না।’
জাহ্নবীর কৌতুহল বেড়ে গেল। যদি মনে না-ই করতে পারে, তবে কী করে জানলো ছেলেটার নাম রুশো! জানার তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে জাহ্নবী বলল, ‘তারপর তোদের আর দেখা হল না?’
‘হুম। দেখা না হলে তো ভালোই হতো। আমি আর ওকে মনে করতে পারতাম না। কিন্তু দেখা হল। হয়তো এটা হবার ছিল।’
‘কীভাবে দেখা হল? তোর ওইটুকুন বয়সেই?’
‘না আপু। আমি বড় হবার পর। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তির সময়। আমার ভিকারুননিসায় চান্স হল। আমরা ওই বাসাটা বদল করলাম। কিন্তু কতটা ভাগ্যবান হলে রুশো সেদিনই আমাদের বাড়িতে এসে পৌঁছাল, যেদিন আমরা বাসার জিনিসপত্র সব ট্রাকে তুলছি। ভাবো?’
জাহ্নবী’র গা শিউরে উঠল। এমনটা আবার হয় নাকি! চার বছর আগে হওয়া ছোট্ট একটা দেখা। তারপর কেউ আবার সেই বাড়ি খুঁজে খুঁজে এখানে এসে হাজির হবে। এ তো অকল্পনীয় ব্যাপার!
ভায়োলেট বলল, ‘জানিনা কেন এই অকল্পনীয় ব্যাপারটাই আমার সঙ্গে ঘটল। আমি বাসার সাধারণ জামা পরে আছি, চুল দুই বেণী করা। গেটে দাঁড়িয়ে আমাদের জিনিসপত্র ট্রাকে তোলা পর্যবেক্ষণ করছি। যাতে কোনোকিছু চুরি না হয়ে যায়। এজন্য আম্মু আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। বিশ্বাস করো আপু, রুশো এসে আমার সামনে দাঁড়াল। আমার কলিজাটা ছ্যাৎ করে উঠেছে। আমি ওকে চিনতে পারিনি প্রথমে, চার বছর আগে দেখা হওয়ার কথা আমার মনেই নেই। তবুও কেন যেন ওকে আমার চিরচেনা মনে হল, বুক ধক করে উঠল আমার। এখনো রুশোর চুল বড় বড়। ও যখন বলল, আপনি কি ভায়োলেট? আমি উত্তর দিলাম, হ্যাঁ। আপনি কে? রুশো উত্তর দিলো না। অনেক্ষণ আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। ট্রাকে জিনিসপত্র তোলা হচ্ছে, আমি সেদিকে তাকালাম। কিন্তু আমার বুকের ভেতর কেমন যেন করছে। ছেলেটাকে এত আপন মনে হচ্ছিল আমার। তারপর রুশো একটা সাল ও তারিখ বলল। জানতে চাইল, আপনার কী মনে আছে এই দিনে কী হয়েছিল? হয়তো মনে নেই। আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। তার আগে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিন।’
জাহ্নবী ভায়োলেটের কথার স্মৃতিতে প্রবেশ করেছে। সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া, চুলে দুই বেণী করা সেই ভায়োলেটের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল তার চোখে। আর রুশো? নিশ্চয়ই চব্বিশ বছর বয়সী একজন যুবক। কী অসম্ভব অনুভূতিই না হচ্ছিল দুজনের!
ভায়োলেট বলল, ‘রুশো গেটের ভেতর ঢুকল। আমিও এলাম ওর পিছুপিছু। বাসার সামনে থাকা গাছটা দেখিয়ে বলল, এই গাছে একটা দোলনা ছিল। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন.. এরপর রুশো কী বলেছে আমি শুনতে পাইনি। দোলনা ও বৃষ্টি শব্দটা শুনেই আমি অন্যরকম হয়ে যাই। মনে হচ্ছিল আমার পা মাটির ভেতর প্রথিত। কিশোরী বয়সের আবেগ, এতটা তীব্র ছিল। আমি নিষ্পলক চোখে ওই গাছটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেই কিশোরী বেলার স্মৃতি আমার মনে জেগে উঠল। ইচ্ছে করছিল ছেলেটাকে বলি, আমি আপনার কথা অনেকদিন ভেবেছি। অনেক রাত ঘটনাটাকে মনে মনে আওড়েছি। কিন্তু আপনি আসেননি। আপনি এমন দিনে এলেন, আজকেই আমরা এই বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আপনি ভাগ্যবান। আর এক ঘন্টা পর এলেই আমাকে আর দেখতে পেতেন না। সৌভাগ্যবান ছেলেটাকে আমার মনের কোঠরে এঁকে নিলাম। আমি জানতে চাইলাম, হ্যাঁ আমার মনে আছে। কিন্তু কেন?’
রুশো বলল, ‘আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। সেদিনের ওই ছেলেটার কথা আপনার মনে আছে? ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মনে আছে। আমিই সেই ছেলে।’
রুশোর সঙ্গে আর কথাই হয়নি আমার। মা এসে রাগারাগি করল আমাকে। রুশোর সামনেই খুব বকল। জিনিসপত্র ট্রাকে তোলা শেষ আর আমি এখানে কার সঙ্গে কথা বলছি? আম্মু রুশোকে একটা কথাও বলেনি। কিন্তু আমাকে খুব বকল। আমার দুচোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। রুশো ভেতরে ভেতরে খুব রেগে যাচ্ছে। ওর সামনে আমাকে বকা দেয়ার অপমান সহ্য হচ্ছিল না আমার। আমি রাগ করে বাড়ির ভেতর চলে আসি। তার প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে আব্বু গাড়িতে করে আমাদেরকে নতুন বাসায় নিয়ে যান। আমি বের হওয়ার সময় দেখি রুশো গেটের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।’
প্রসন্ন হাসি ভায়োলেটের মুখে। রুশো এত বছর পর তার কাছে এসেছে, তার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, এই আনন্দ নিশ্চয়ই সেইমুহুর্তে ওর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা আনন্দ হয়ে উঠেছিল। জাহ্নবী চোখ বন্ধ করে রইল।
ভায়োলেট বলল, ‘আমি সেই ছোট্টবেলার অনুভূতি ভুলে গিয়েছিলাম সত্য। ভুলে গিয়েছিলাম আগের রুশোকেও। কিন্তু নতুন করে সে এসেছিল যেদিন, সেদিনই ওর প্রেমে পড়েছি। তীব্র প্রেমে।’
জাহ্নবী ভায়োলেটের হাত চেপে ধরে জানতে চাইলো, ‘রুশোকে এরপর খুঁজে পেলি কীভাবে?’
ভায়োলেট হেসে বলল, ‘সে একটা লম্বা ইতিহাস। সারা রাত বললেও এই গল্প ফুরাবে না আপু।’
‘না ফুরাক। তুই বল। আমি শুনবো। এখনই বল।’
ভায়োলেট আবারও ফিরে গেল তার স্মৃতিতে। নতুন বাসায় ওঠার দিনকয়েক পর…
চলবে..