উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ৩২
লেখাঃ মিশু মনি
সকালে আড়মোড়া ভেঙে হাস্যজ্জ্বল মুখে ভায়োলেট বলল, ‘আজকের দিনটা খুব ভালো কাটবে আপু।’
জাহ্নবী জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যরশ্মি গায়ে মাখছিল। ভায়োলেটের কথা শুনে বিস্মিত সুরে জানতে চাইলো, ‘তুই কিভাবে বুঝলি?’
‘আজকের সকালটাই অন্যরকম মনে হচ্ছে। তাছাড়া আমার ভালো ঘুম হয়েছে তো। মনটা দারুণ ফ্রেশ। দেখো তুমি, দিনটা খুব ভালো যাবে।’
জাহ্নবী বিছানায় এসে বসল। ভায়োলেটের আদুরে চিবুকে ঘুমের দাগ স্পষ্ট। ওকে দেখতে বেশ বিশুদ্ধ লাগছে। শ্যাম্পু করা ভায়োলেটের ঝলমলে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে জাহ্নবী বলল, ‘তুই অনেক সুন্দর রে। রুশো এমনি এমনি প্রথম দর্শনেই পাগল হয় নি।’
ভায়োলেট মুচকি হেসে বলল, ‘আরও কত লোকে পাগল হয়েছে সেই খবর কী রাখো? চা খেতে যাবো চলো।’
‘কোথায়?’
‘নিচের দোকানে। “when tea meet toast” এ। চা খেয়ে আমি চলে যাবো।’
‘কী বলিস? আজকের দিনটা এত সুন্দর। আমারও অফ ডে। আজকে আমরা একটু মজা করতে পারতাম।’
ভায়োলেট হাই তুলতে তুলতে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। হাতমুখ ধুয়ে এসে বলল, ‘তুমি রেডি হয়ে নাও। আজকে সারাদিন আমরা বাইরে ঘুরবো।’
‘সত্যি!’
বিস্ফারিত হল জাহ্নবীর চোখ। ভায়োলেটের সঙ্গে সারাদিন বাইরে ঘুরবে মানেই তো দারুণ একটা দিন কাটবে তার। সে দ্রুত ছোটাছুটি করে তৈরি হতে লাগল।
“When tea meet toast” এ শুক্রবার সকালের চা’য়ের আলাদা বিশেষত্ব আছে। এদিন শুধু টোস্ট নয়, চায়ের সঙ্গে গরম গরম লুচি তরকারিও পাওয়া যায়। জাহ্নবী’র ধারণা ছিল আজ বোধহয় দোকান পুরোদস্তুর ফাঁকা থাকবে। শুক্রবার মানেই তো দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা। সকাল নয়টায় নিশ্চয়ই লোকজন চা খেতে হাজির হবে না। কিন্তু তার ধারণাকে উলটে দিয়ে আজকে দোকানে প্রচুর ভীড়ের সমাগম হয়েছে। জাহ্নবী ভেতরে ঢুকেই বলল, বাবারে! আমরা বসার জায়গা-ই তো পাবো না। যা ভীড়!
ভীড়ের রহস্য বুঝতেও তাদের খুব বেশী সময় লাগল না। প্রত্যেক টেবিলে ধোঁয়া ওঠা তরকারির সঙ্গে গরম গরম ফুলকো লুচি। দম্পতিরা আড্ডা দিতে দিতে আয়েশ করে লুচি খাচ্ছে। সাথে এক কাপ মালাই চা, আহা! এমন দৃশ্য দেখেই তো জিভ ভিজে যায় জলে।
ওরা বসার জায়গা পাচ্ছিল না। বেয়ারাকে ডেকে ভায়োলেট জানতে চাইলো, ‘কোনো টেবিল ফাঁকা হবে কিনা দেখুন না।’
‘দেখছি ম্যাডাম।’
মিনিট খানেক ঘুরে এসে বেয়ারা জানালো, ‘সরি ম্যাডাম, কিছুক্ষণ ওয়েট করতে হবে।’
‘ ঠিক আছে, আমরা ওদিকে দাঁড়াচ্ছি। টেবিল ফাঁকা হলে বলবেন।’ উত্তর দিলো ভায়োলেট।
হঠাৎ জাহ্নবীর বামপাশের টেবিল থেকে একজনের গলা শোনা গেল, ‘আপনারা চাইলে এখানে বসতে পারেন। যদি সমস্যা না থাকে।’
আগন্তুকের দিকে তাকালো দু বোন। ভদ্রলোকের আমন্ত্রণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল ভায়োলেট। তাদের বেঞ্চে দুজন অনায়াসে বসা যাবে। বড় আপু বসবে কিনা সেটা জানার জন্য জাহ্নবীকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল সে। খেয়াল করে দেখল জাহ্নবীর দৃষ্টিতে মুগ্ধতা, মুখে লাজুক হাসির আভাস। তাকে ভীষণ অপূর্ব দেখাচ্ছে হঠাৎ করেই। যেন স্বর্গ থেকে ভেসে আসা কোনো আলোয় আলোকিত হয়েছে জাহ্নবী।
আলোকিত তো হতেই হবে তাকে। পান্নাবাহার স্বয়ং তাদেরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে! জাহ্নবী লাজুক হেসে চেয়ে রইল তার দিকে।
জাহ্নবী’র মতোই বিস্ময় নিয়ে পান্নাবাহারকে দেখছে তার বাকি তিন বন্ধু। তাদের টেবিলে সম্ভবত কখনো বাইরের কাউকে যোগ দিতে বলা হয় নি।
পান্নাবাহার বন্ধুদেরকে বলল, ‘উনি আমার পরিচিত।’
বন্ধুদের মধ্য হতে একজন উঠে অপরপাশের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। এই বেঞ্চিতে শুধুমাত্র পান্নাবাহার বসা। জাহ্নবী’র হৃদস্পন্দন বাড়তে শুরু করেছে। পান্নাবাহারের বেঞ্চিতে তারা বসবে! এ যেন বিভ্রম অথবা নিছক স্বপ্ন।
পান্নাবাহার তাকে বলল, ‘আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি নাদিরের কাজিন। গতকাল একটা ফাইল দিতে আপনার অফিসে গিয়েছিলাম।’
জাহ্নবী হাসিমুখে বলল ‘হ্যাঁ।’
হাসিমুখের অন্তরালে সে কতটা বিস্মিত তা টের পেলো না কেউই। সবাই ধরে নেবে জাহ্নবী হয়তো অপরিচিত কারও আমন্ত্রণে অবাক হয়েছে। কিন্তু এইমুহুর্তে সে মনে মনে ভাবছে, ‘আমার জগতটা খুব ছোট্ট জনাব পান্নাবাহার। এ জগতে কেউ নেই আমার পরিবার ছাড়া। কিন্তু আমার এই ছোট্ট জগতে আপনি আছেন। আপনাকে চিনবো না, সেটা কী কভু হতে পারে!
ভায়োলেট বলল, ‘আপু, বসবে?’
জাহ্নবী বলল, ‘ওনাদের অসুবিধা হবে না তো?’
পান্নাবাহারের একজন বন্ধু উত্তর দিলেন, ‘আজ তো পুরা হাউজফুল। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন? আরে বসুন তো।’
ভায়োলেট জাহ্নবীকে ইশারায় ভেতরে যেতে বললে জাহ্নবী অপ্রস্তুত বোধ করল। ইতস্তত করতে করতে পান্নাবাহারের পাশে বসে পড়ল সে।
পান্নাবাহার বেয়ারাকে ডেকে বলল, ‘আরও দুজনের লুচি তরকারি দেবেন।’
বন্ধুরা তাদের স্বাভাবিক কথোপকথন চালিয়ে গেল। পান্নাবাহার তার এত কাছে, সেই ভেবেই জাহ্নবী শিহরিত হয়ে উঠছে। তার পাশে বসে কথা বলছে পান্নাবাহার! তার গলার স্বরের ওঠানামা স্পষ্ট বুঝতে পারছে জাহ্নবী। পান্নাবাহারের পরনে একটা কুঁচকানো পলো শার্ট। খুব সম্ভবত ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছে এখানে। জাহ্নবী টেবিলের দিকে তাকিয়ে তার হাতের দিকে খেয়াল রাখছে। কথা বলতে বলতে পান্নাবাহারের হাত নাড়ানোর ভঙ্গী দেখছে সে।
নিজের জড়তা আষ্ঠেপৃষ্ঠে চেপে ধরে আছে জাহ্নবীকে। সবার সঙ্গে সহজে মিশতে না পারার কষ্টটা তার বহু বছরের। এখানে বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছে, ভায়োলেট চেষ্টা করছে তাদের কথায় তাল মেলাতে। সে একান্তই জঙ্গলে সামুদ্রিক মাছ সেজে বসে থাকবে, নিজের কাছে নিজেকে বিব্রতকর লাগছে জাহ্নবীর।
অনেক্ষণ চেষ্টা করে জাহ্নবী মনেমনে একটা কথা গুছিয়ে নিলো। এটা বলতে পারলে অন্তত কিছুটা সামাজিকতা রক্ষা করতে পারবে সে। কিন্তু কথাটা যেন বলাই হয়ে উঠছে না। সকলের কথার ফাঁকে সুযোগই পাচ্ছে না সে।
হঠাৎ ভেতর থেকে সাহস সঞ্চার করে পাশে বসা পান্নাবাহারের দিকে তাকালো জাহ্নবী। এত কাছ থেকে মানুষটাকে দেখে তার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। জাহ্নবী ঘামতে শুরু করেছে। তবুও অনেক কষ্টে দ্রুত শ্বাস ফেলতে ফেলতে জাহ্নবী বলে ফেলল, ‘নাদির স্যার কেমন আছেন এখন?’
কথাটা বলেই জাহ্নবী মাথা ঘুরিয়ে দৃষ্টি সংযত করে নিলো। দ্রুত শ্বাস পড়ছে তার। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলো জাহ্নবী।
পান্নাবাহার উত্তর দিলো, ‘ভালো আছে। আজকে সেলাই খুলে দেবে। কিন্তু শুনুন, আমার সামনে নাদিরকে স্যার বলবেন না তো। ও আমার ছোট ভাই। ওকে স্যার ডাকলে নিজেকে কেমন অকর্মা অকর্মা লাগে।’
বাকিরা হেসে উঠল। জাহ্নবীও হাসির মাধ্যমে সহজ হওয়ার চেষ্টা করল। এর আগে অনেক অপরিচিত মানুষের সঙ্গে প্রয়োজনের খাতিরে তাকে কথা বলতে হয়েছে। অর্ণবের সঙ্গেও টুকটাক কথা বলেছে সে। কিন্তু কই, আগে তো এমন লাগে নি তার! বুকের ভেতর এমন উথালপাথাল হয়নি তো আগে, কখনো তো কারও দিকে তাকাতেও এমন সাহসী হতে হয়নি। তবে এই মানুষটার জন্য তার এমন কেন লাগে! উনি কী এমন কেউ, ভায়োলেট যেমন রুশোর কেউ ছিল?
জাহ্নবী আবারও অবাক চোখে এক পলক তাকালো পান্নাবাহারেরর দিকে।
পান্নাবাহার তার এক বন্ধুকে বলল, ‘সংসার জীবন কেমন চলছে বন্ধু রাহুল?’
‘আরে আমার বউ আজকে আসতে চাইছিল। তোরা বলবি যেখানে যায় বউ নিয়ে যায়, সেই জন্য আমি নিয়ে আসলাম না। এখন মনে হচ্ছে নিয়ে আসলেই ভালো করতাম।’
অন্য একজন উত্তর দিলো, ‘তার মানে আমরা যদি বলি, ছি ছি, রাহুল একটা ছেলে হয়ে একটা মেয়ের সঙ্গে ঘুমায়। তাহলে কি তুই তোর বউকে রেখে আলাদা ঘুমাবি?’
রাহুল বলল, ‘অবশ্যই বন্ধু। আমি তখন অচীন দ্বীপে চলে যাবো। হাজার হলেও আমার বন্ধুরা বলেছে।’
পান্নাবাহার হেসে বলল, ‘কোন দ্বীপে যাবি? শাটার আইল্যান্ডে?’
হেসে উঠল বাকিরা। পান্নাবাহার ভায়োলেট ও জাহ্নবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনারা আমাদের কথায় বিরক্ত হচ্ছেন না তো?’
ভায়োলেট হাসিমুখে বলল, ‘না ভাইয়া। বরং আপনাদের আড্ডা উপভোগ করছি।’
একজন ছেলে উত্তর দিলো, ‘আমাদের সকালে ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে দৌড়ে এখানে আসাটা তাহলে সার্থক। কেউ আমাদের আড্ডা উপভোগ করছে।’
বলেই হেসে উঠল সে। হাসি থামিয়ে বলল, ‘আমি তূর্য। আপনার নামটা জানতে পারি?’
‘আমি ভায়োলেট।’
‘ভায়োলেট! মানে বেগুনী? আপনি কি তাহলে পিয়াজু? সরি পিয়াজুর ইংরেজি জানিনা।’ জাহ্নবী’র দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো তিনজনের মাঝখানের ব্যক্তিটি।
বাকিরা তখন হাসছে। পান্নাবাহার বলল, ‘আপনারা কিছু মনে করবেন না। আমরা বন্ধুরা একসঙ্গে হলে একটু বেশীই হাসি আড্ডা হয়। ছোট বড় কাউকে মানেনা ওরা।’
তূর্য বলল, ‘আরে বেগুনী আপু তো বললেনই উনি আমাদের আড্ডা উপভোগ করছেন। আপনারা নিশ্চয়ই দুবোন?’
জাহ্নবী এবার কথা বলার চেষ্টা করল, হ্যাঁ। তবে আমার নাম পিয়াজু নয়, আমি জাহ্নবী।’
‘সুন্দর নাম।’
খাবার চলে এলো। গরম গরম ফুলকো লুচি ছিঁড়ে মজাদার তরকারি দিয়ে সবাই আয়েশ করে খাচ্ছে। লজ্জায় খেতে পারছে না জাহ্নবী। ভায়োলেট এক টুকরো লুচি জাহ্নবী’র মুখে তুলে দিয়ে বলল, ‘খাও আপু।’
জাহ্নবীও লজ্জা ভুলে ভায়োলেটকে খাবার তুলে খাওয়ালো। চা শেষ করে ভায়োলেট বলল, ‘আপু, চলো আমরা উঠি।’
তূর্য বলল, ‘বসুন আরও কিছুক্ষণ। আমাদের অসুবিধা নেই তো।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আমাদেরকে এক জায়গায় যেতে হবে তো।’
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে পড়ল জাহ্নবী। পান্নাবাহারকে ‘ধন্যবাদ’ জানাতে গিয়েও জড়তার কারণে কথা বলতে পারল না। ভায়োলেট ই বিদায় নিলো সবার কাছ থেকে।
রাস্তায় বেরিয়ে একটা রিকশা নিলো ভায়োলেট। জাহ্নবী’র মনটা ভীষণ ফুরফুরে। সতেজ বাতাসে নিজেকেও আজ বড্ড চনমনে লাগছে। ভায়োলেটের পছন্দের একটা জায়গায় সে নিয়ে যাবে আজ। হাওয়ায় রিকশার ছেঁড়া পলিথিন ফতফত করে উড়ছে৷ জাহ্নবী’র ইচ্ছে করছে খুশিতে ভায়োলেটকে জড়িয়ে ধরে রাখতে।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেল ওরা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হৈ হুল্লোড় চোখে পড়ল। কেউবা ফুটপাতে বন্ধুরা মিলে বসে গিটারের সুরের সঙ্গে গান ধরেছে। কোথাও আবার বসেছে আড্ডার আসর। আজকের দিনটা রঙিন, ভীষণ ঝলমলে।
হঠাৎ ভায়োলেটের ফোনে কল এলো সামারের নাম্বার থেকে। ফোনে কানে ধরতেই শুনতে পেল সামারের উদ্বিগ্ন গলা, ‘ভায়োলেট, আমার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। অর্ণবের বাবা মা এসেছে। কিন্তু আম্মুর কথাবার্তা আর ওই মহিলার আচার আচরণ দেখে আমার মনে হচ্ছে আমার আর অর্ণবের বিয়ের ব্যাপারে কথা হচ্ছে। মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার। কখন আম্মুকে গালিগালাজ শুরু করবো বুঝতে পারছি না। অর্ণবের বাবাকে বলতে শুনলাম রেজিস্ট্রি নিয়ে কথা হচ্ছে। ওরা কি আজকেই আমার সঙ্গে ওনার ছেলের বিয়ে দিতে চায় নাকি? সব ভেঙে চুড়ে ফেলবো আমি। নয়তো পালাবো বাসা থেকে। তুই বাসায় আয়।’
ভায়োলেট ধীরগলায় বলল, ‘শান্ত হ আপু। ভুলভাল কিছু করিস না। আমি এসে মাকে বোঝাচ্ছি।’
কল কেটে দিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে ভায়োলেট বলল, ‘ ঠিক যে ভয়টা পেয়েছিলাম, সেটাই হল।’
জাহ্নবী উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো, ‘কী হয়েছে?’
‘আমাদেরকে এক্ষুনি বাসায় যেতে হবে আপু।’
চলবে..
উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ৩৩
লেখাঃ মিশু মনি
প্রচণ্ড রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘরময় পায়চারি করছে সামার। অর্ণবকে বিয়ে করা তার পক্ষে অসম্ভব।
ভায়োলেট জানতে চাইলো, ‘তুই সেদিন রাতে ওনাকে আরজুর কথা বলিস নি?’
সামার রাগী স্বরে উত্তর দিলো, ‘বলেছি। তারপরও উনি কেন বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো আমি বুঝতে পারছি না। আমার ওর সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে হবে।’
‘এই মুহুর্তে ওনার সঙ্গে মুখোমুখি হবার দরকার নেই আপু। রেগে উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলবে। আমি ওনার সঙ্গে কথা বলে দেখছি। তুমি শান্ত হও।’
সামার ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তোরা দুজন থাকতে আমার সঙ্গেই কেন এমন হতে হবে?’
জাহ্নবী ও ভায়োলেট একে অপরের দিকে তাকাল। দুজনের দৃষ্টিতে একই কথা বিদ্যমান, ‘অর্ণব প্রথম থেকেই সামারকে পছন্দ করে। আমাদেরকে নয়।’
পারভীনকে দেখে কথা বলার সাহস হচ্ছে না ভায়োলেটের। শেষ কবে মাকে এতটা হাসিখুশি দেখেছিল, সেটা ভায়োলেট মনেই করতে পারে না। অনেক ফুরফুরে মেজাজে আছেন পারভীন। নিজের হাতে রান্নাবান্না করে টেবিল সাজিয়েছেন, অর্ণবের পরিবারের সঙ্গে মেতে উঠেছেন হাসি গল্পে।
ভায়োলেট জাহ্নবীকে বলল, ‘আপু, মায়ের পরনে আজ জামদানী শাড়ি। বাসায় মা কখনো জামদানী পরেছিল?’
জাহ্নবী বলল, ‘মাকে কখনো আলমারি থেকে নতুন শাড়িই বের করতে দেখিনি।’
‘চোখে কাজল দিয়েছে মনে হচ্ছে না?’
‘হুম। মা আজকে অনেক আনন্দে আছে রে।’
ভায়োলেট জাহ্নবী’র হাত চেপে ধরে বলল, ‘জানো আপু, মায়ের মুখের এই হাসিটুকু আমার সবসময় ধরে রাখতে ইচ্ছে করছে। মাকে কিছু বললেই উনি ভয়ংকর রেগে যাবেন। কান্নাকাটি করবেন। তারচেয়েও বড় কথা, ভীষণ কষ্ট পাবেন।’
জাহ্নবী অবাক হল ভায়োলেটের কথা শুনে। অদ্ভুতভাবে এই ইচ্ছেটা তারও হচ্ছে। মেয়েকে নিজের পছন্দে বিয়ে দেবেন এই স্বপ্ন বোধহয় প্রতিটা বাবা মায়ের মনেই সুপ্ত থাকে!
ভায়োলেট অর্ণবকে ডেকে বলল, ‘আপনার সাথে কিছু কথা আছে ভাইয়া। ছাদে চলুন।’
অর্ণবের মুখে আজ লজ্জার রক্তিম বর্ণ রাঙা হয়ে উঠেছে। লাজুক হাসিই বলে দেয়, সে কতটা নিষ্পাপ। রহস্য জট পাকিয়ে উঠছে ক্রমশই।
অর্ণবকে ছাদে ডেকে মুখোমুখি দাঁড়াল জাহ্নবী ও ভায়োলেট। এসব ব্যাপারে জাহ্নবী একেবারেই আনাড়ি৷ ঝামেলা মেটানোর ভারটা তাই ভায়োলেটের ওপর।
ভায়োলেট জানতে চাইলো, ‘আপনি সত্য করে একটা কথা বলুন তো। সেদিন আপু আপনাকে কী বলেছিল?’
অর্ণব লাজুক হেসে উত্তর দিলো, ‘উনি বাসায় জানাতে বলেছিলেন।’
‘আপনার বাসায়?’
‘না। আপনাদের বাবা মাকে জানাতে বলেছিলেন।’
‘কী জানাতে বলেছিল?’
অর্ণব আরও লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হাসল। তারপর উত্তর দিলো, ‘এইযে উনি বিয়ে করতে চান।’
ভায়োলেট অবাক হয়ে জানতে চাইলো, ‘তা বুঝলাম। কিন্তু আপনাকে বিয়ে করতে চায় এটাই বলেছিল?’
‘হ্যাঁ মানে সরাসরি তো বলেনি। বলল যে, বাবা মা আপনাকে পছন্দ করেন। আপনি যদি ওনাদেরকে আমার পছন্দের কথা জানান, ওনারা না করবেন না। আমিও তো লজ্জা পাই। আংকেল আন্টিকে কিভাবে বলি? তাই মাকে বললাম। মা খুশি হলেন। আংকেলের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে পারলে উনি সৌভাগ্য মনে করবেন। মা বলল, আমরা তাহলে ঢাকায় আসি৷ মেয়েটাকে দেখি, কথাবার্তা বলি।’
ভায়োলেট ও জাহ্নবী মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। রহস্য জট খুলতে শুরু করেছে সবে!
ভায়োলেট জানতে চাইলো, ‘কিন্তু আপু বাসায় কোন পছন্দের কথা জানাতে বলেছিল এটা আপনি শিওর?’
অর্ণব অবাক হয়ে তাকাল, ‘মানে!’
ভায়োলেট বলল, ‘কষ্ট পাবেন না ভাইয়া। আপু আরজু নামে একটা ছেলেকে ভালবাসে। তার কথাই আপনাকে বাসায় জানাতে বলেছিল। যেন আপনি আব্বু আম্মুকে রাজি করান।’
মুহুর্তেই সমস্ত লাজুকতা উবে গিয়ে নিগুঢ় অন্ধকারে পর্ববসিত হল অর্ণবের মুখটা। সামারের জন্য তার বুকে পরম যত্নে গড়ে তোলা মহলটা ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়তে লাগল। তার সামার তার নয়! সে অন্য কাউকে ভালবাসে।
অর্ণবের ইচ্ছে করছে লজ্জায়, অপমানে মাটির নিচে ঢুকে যেতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে সে পরিস্থিতি ঠেকাতে বলল, ‘তাহলে তো আমি বড় ধরনের ভুল করে ফেলেছি। বোঝার ভুল ছিল আমার। সামারের সামনে কী করে দাঁড়াব এখন আমি?’
অর্ণবের বিব্রত অবস্থা দেখতে জাহ্নবী কিংবা ভায়োলেট কারোরই ভালো লাগছে না। ভায়োলেট অনুরোধ করে বলল, ‘ভাইয়া, আমরা মাকে সরাসরি কিছু বলতে পারব না। আপনি প্লিজ বিষয়টা সামলান।’
অর্ণব আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা। আপনারা চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি।’
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জাহ্নবী ও ভায়োলেট নিচে চলে এলো। হতভম্ব ভঙ্গীতে আকাশের দিকে তাকালো অর্ণব। তার ভেতরটা কষ্টে খানখান হয়ে যাচ্ছে। কেউ তা জানল না। সামারের সামনে সে কীভাবে দাঁড়াবে সেটা বড় কথা নয়। চিন্তার বিষয়, সে নিজের মা বাবার সামনে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবে? কীইবা বলবে তাদের?
মা বাবা অনেক আশা নিয়ে, আনন্দ নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে এসেছেন। ছেলের পছন্দের মেয়েকে দেখবেন বলে মা তড়িঘড়ি করে স্বর্ণের চেইন বানিয়ে নিয়েছেন। মায়ের বুক ভেঙে দিতে পারবে না সে। তাই মনেমনে সিদ্ধান্ত নিল, মা বাবাকে এখন মিথ্যে কথা বলতে হবে। তারপর কী হয় পরে দেখা যাবে।
অর্ণব নিচে এসে তার মাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ধীরগলায় বলল, ‘মা, আপনারা আজকেই ম্যারেজ রেজিস্ট্রি করার কথা বলছিলেন। এখন এসব করার দরকার নেই।’
অর্ণবের মা ভীষণ অবাক হয়ে বললেন, ‘তুই না রাত্রে বললি যত তারাতাড়ি শুভ কাজটা করা যায়?’
‘মা, আসলে সামার এখনো বিয়ের জন্য প্রস্তুত না। ও আরও সময় চায়।’
‘এ আবার কেমন কথা! মেয়ে নাকি নিজেই তোকে বলেছে বাসায় প্রস্তাব দিতে।’
‘আসলে আমারই বোঝার ভুল ছিল। ও আমাকে পছন্দ করে সেটাই বুঝিয়েছে। এত তারাতাড়ি বিয়ে করতে চায় না ও।’
‘আজকাল দিন দুনিয়া ভালো না বাবা। তারাতাড়ি কাজ সারাই ফেলাই ভালো। আর কোনো চিন্তার কারণ থাকল না।’
অর্ণব মায়ের মুখখানা ধরে নরম গলায় বলল, ‘প্লিজ আম্মু, আপনি বোঝার চেষ্টা করুন। ও একটু রাগী। আমার সঙ্গে রাগ করেছে। ও আরও কিছুদিন সময় চায়। এখন যদি আমি ওকে জোর করে বিয়ে করি, ও খুব কষ্ট পাবে।’
‘তোকে পছন্দ করে, তাইলে কষ্ট পাবে কেন?
অর্ণব কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো, ‘এখনো চেনাজানা হয়নি তেমন। ও আমার সম্পর্কে আরও জানতে চায়। ছয় মাস পর বিয়ে করতে চায় ও।
‘ছয় মাস পরে যদি ওর আর তোকে ভালো না লাগে? আমার ছেলে কী বানের জলে ভেসে আসছে বাবারে?’
‘মা, আপনি এসব বুঝবেন না। আপনি এত তারাহুরো না করে সবার সাথে ভালভাবে কথাবার্তা বলেন। ও যেদিন বিয়ে করতে চাইবে, সেদিন আমরা বিয়ে করব। তার আগে না।’
অর্ণব বুঝতে পারল না, সে মাকে ঠিকঠাক বোঝাতে পেরেছে কী না! মায়ের মন ছেলের মুখের দিকে তাকালেই সবকিছু অনুমান করতে পারে। হয়তো তিনিও বুঝতে পারছেন অর্ণব কষ্ট পাচ্ছে, কোথাও একটা ঝামেলা নিশ্চয়ই হয়েছে। তারপরও তিনি ছেলেকে খুশি করতে বললেন ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমরা যা চাইবা। মেয়েটাকে ডাকলে আমি একটু বুঝাইয়া দেখতাম।’
‘প্লিজ মা, অনুরোধ লাগে৷ এই বিষয় নিয়ে ওকে কিছু বুঝাইতে গেলেই ও রাগ করবে।’
‘এমন পিরিত আগে দেখি নাই বাবা। দুইজন দুইজনারে পছন্দ করে, আবার সময়ও চায়।’
অর্ণবের মা পুনরায় ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলেন। এতক্ষণ ধরে দূর থেকে মা ও ছেলের কথোপকথন খেয়াল করছিলেন পারভীন। কী কথা হয়েছে তা শোনেননি ঠিকই কিন্তু অর্ণবের মায়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি কোনো কিছুতে অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
পারভীন এসে জানতে চাইলেন, ‘রেজিস্ট্রি আজকেই করে ফেললে ভালো হবে আপা।’
‘আপা, আপনি আগে আপনার মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন। তার মতামত না নিয়া কিছুই করার দরকার নাই।’
পারভীনের মুখে শঙ্কার ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠল। সামারের সঙ্গে কথা বলার জন্য তিনি মেয়েদের ঘরে এলেন।
দরজা খুলে দেখলেন সামার বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। পাশে বসা দুই বোন, জাহ্নবী ও ভায়োলেট।
পারভীন বললেন, ‘সামার, তোর সাথে কথা ছিল।’
‘বলো।’
‘উঠে বস।’
সামার উঠে বসল। চোখমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। পারভীন বলল, ‘অর্ণবের মা বাবা আজকে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি করাতে চায়।’
সামার জাহ্নবী ও ভায়োলেটের দিকে তাকাল। ভায়োলেট বলল, ‘মা, তুমি অর্ণব ভাইয়াকে একটু আমাদের রুমে পাঠাও৷ ওনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।’
‘কিসের জরুরি কথা?’
‘মা, আপুর লাইফের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত, ওকেই নিতে দাও না।’
‘একজনকে তো দিয়েছিলাম। সিদ্ধান্ত নিতে নিতে তিনি বুড়ি হয়ে গেলেন। এই বয়সে এসে মানুষের কাছে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না। আমি তোদেরকে পেটে ধরছিলাম এটা আমার বিশ্বাস হয় না।’
পারভীনের মুখে বিতৃষ্ণা। ভায়োলেট আস্তে করে সামারের হাতের ওপর একটা চাপ দিলো। যার অর্থ হচ্ছে, মাকে এখন কিছু বলা যাবে না।
সামার চোখমুখ শক্ত করে বসে রইল। পারভীন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ভায়োলেট অর্ণবকে ফোন করে তাদের রুমে আসতে অনুরোধ করল।
সামার মুখ কালো করে বসে আছে। অর্ণব যথেষ্ট অপরাধী গলায় বলল, ‘সব দোষ আমার। আমি আপনার কথার ভুল অর্থ করেছিলাম। আমাকে মাফ করে দিবেন। আরেকটা ভুল করেছি। আমার মাকে বলেছি, আপনি এখন বিয়ে করতে চান না, ছয় মাস সময় নিয়েছেন। আসলে তারা অনেক বড়মুখ করে এসেছে, আমি এখনই সত্যিটা তাদেরকে বলে দিলে আব্বু আম্মু অপমানিত বোধ করতেন। তাই ভাবলাম আপাতত এটা বলে সামাল দিই। পরে নাহয় সবকিছু ঠিক করে নেয়া যাবে।’
সামার জানতে চাইলো, ‘কী ঠিক করে নেবেন?’
অর্ণব বলল, ‘পরে একদিন বলব আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভেঙে গেছে। এটা সময় নিয়ে একদিন বললেই হবে। প্লিজ আপাতত আমার এই উপকারটুকু করেন।’
অনুরোধ করে দাঁড়িয়ে রইল অর্ণব। ভায়োলেট বলল, ‘মেজো আপু, ভাইয়া ঠিক কাজটাই করেছে। আম্মু অল্পতেই যা রেগে গেলেন, এখন তাকে সত্যিটা জানালে দেখা যাবে স্ট্রোক করে বসে আছে। এমনিতেই আম্মু হাই প্রেশারের রোগী। তুইও এখন এটা বলে সময় নে। আপাতত সবাই জানুক তোরা একে অপরকে পছন্দ করিস৷ কয়েক মাস গেলে একদিন বলবি তোদের আর বনিবনা হচ্ছে না। তোরা ব্রেক আপ করে ফেলেছিস । তখন আর কারও কিছু বলার থাকবে না।’
সামার অবাক হয়ে ভায়োলেটের কথা শুনল। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘একটা মিথ্যার আশ্রয় নেবো?’
অর্ণব বলল, ‘পরিস্থিতি ঠেকাতে এখন এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সব দোষ আমার। আমারই ভুলের জন্য একটা মিথ্যা বলতে হচ্ছে। এই মিথ্যা ঢাকতে আরও অনেক মিথ্যা বলতে হবে। তবুও বাবা মাকে কষ্ট দিতে না চাইলে এছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।’
ক্ষণিকের জন্য নিরবতা নেমে এলো ঘরজুরে। সামার দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বলল, ‘বেশ। আমিও বাসায় এটাই বলবো। আরজু নিজেও বিয়ে করার জন্য কিছুদিন সময় চেয়েছে। আশাকরি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
চলবে..
উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ৩৪
লেখাঃ মিশু মনি
পারভীনের অনুরোধে শাড়ি পরল সামার। অর্ণবের মা তার গলায় স্বর্ণের চেইন পরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সুখী হও মা। আমার ছেলেকে নিয়ে একটা সুখের জীবন হোক তোমার।’
বাঁকা চোখে সামার অর্ণবের দিকে দৃষ্টিপাত করল। এসব ন্যাকামি তার ভালো লাগছে না। অর্ণবের চাহনিতে অনুরোধ। অপরাধবোধের যন্ত্রণা সেখানে স্পষ্ট।
সামার চুপ করে রইল। অর্ণবের মা গর্ব করে বললেন, ‘তুমি তো অনেক সৌভাগ্যবতী। আমার অর্ণব অনেক ভালো ছেলে। আমরা চট্টগ্রামের বাইরে কখনো ছেলের বিয়া দিতাম না। কালচারের সঙ্গে কালচারের একটা পার্থক্য আছে না? আমি হইলাম রাউজানের মেয়ে। পড়াশোনা করছি চট্টগ্রাম কলেজে। অনেক মেধাবী ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইছিলাম বুঝছো, সাবজেক্ট পাইছিলাম ইসলামের ইতিহাস। আমি ইংরেজি নিয়া পড়ার স্বপ্ন দেখতাম। এজন্য সরকারি কলেজে ভর্তি হই। চট্টগ্রামের সব কালচারই আমি জানি। তুমি হইলা ঢাকার মেয়ে। ঢাকার ঐতিহ্য আর চিটাগাংয়ের ঐতিহ্য কী মিলে? শেষে দেখা যাবে তোমার আর আমার মিল হইল না। এইজন্য আমি চিটাগাংয়ের বাইরে থেকে ছেলের বউ আনতে চাইনাই। ছেলেরে বলছিলাম, তোমার যারেই পছন্দ হবে তারেই বউ করবো কিন্তু চিটাগাংয়ের মেয়ে হইতে হবে।’
বিরক্তমুখে সামার কথাগুলো শুনছে। প্রচণ্ড রাগে উঠে যেতে পারছে না পরিবারের কথা ভেবে। রাগ সামলে নিয়ে শুধু এটুকু বলল, ‘ঢাকার মেয়েকে চেইন পরিয়ে আবার এসব বলছেন? চেইন পরায়েন না আমাকে।’
অর্ণবের মা থতমত খেয়ে গেলেন। শঙ্কায় শুকিয়ে গেল পারভীনের মুখ। পরক্ষণেই মুখে হাসি ফুটিয়ে অর্ণবের মা বললেন, ‘মা দেখি রাগ করছে। রাগ কইরো না মামনি। ছেলে আমার পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি পেয়েছে, স্বাবলম্বী হয়েছে। আল্লাহ চাইলে সে ঢাকা শহরেই থাকবে যতদিন চাকরি জীবন আছে তার। ঢাকাতে বিয়া দিতে আর আপত্তি আসবে কেন? সবচাইতে বড় কথা, তোমার আব্বা খুব ভালো মানুষ। মানুষের সঙ্গে মিশলে মানুষ চেনা যায়। ওনার মেয়েকে ছেলের বউ করতে পারলে আমরা তো সৌভাগ্যবান হই।’
সামার কড়া স্বরে বলল, ‘বাবার গুণ দেখে বিয়ে করানোর দরকার আছে? আপনি যাকে বউ করবেন তার কী গুণ, তার চরিত্র দেখে করবেন।’
মহিলা হেসে বললেন, ‘এক্কেরে ঠিক কথা বলছো। তোমাকে তো আমাদের অনেক ভালো লাগছে। আমার ছেলে তো সারাক্ষণ তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।’
সামার হাসিমুখে বলল, ‘ধন্যবাদ আন্টি। আমি তাহলে উঠি?’
‘আচ্ছা মা, যাও।’
সামার নিজের ঘরে চলে এলো। পিছনে চলে এল জাহ্নবী ও ভায়োলেট। ঘরে ঢুকেই গলা থেকে চেইন খুলে বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে সামার বলল, ‘কী এক বিপদে পড়লাম।’
ভায়োলেট বলল, ‘শান্ত হও আপু। ভাইয়ার সাথে সবকিছু শেয়ার করো।’
সামার বলল, ‘ওকে এসব বললে আমিই ছোট হবো ভায়োলেট। ও বলবে, তুমি এ কোন ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা করানোর জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলে, যে নিজেই তোমার কথার অর্থ বুঝে না। বিয়ে করতে চলে আসছে। এসব বলে খুব পঁচাবে আমাকে।’
ভায়োলেট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় গিয়ে বসল। তার এসব দেখতে ভালো লাগছে না। সে চায়, সবাই শান্তিতে থাকুক। জগতে নেমে আসুক স্বর্গ।
সামার হেসে বলল, ‘তুই এজন্যই সেদিন বলেছিলি? অর্ণব ভাইয়াকে আজকেই বল নয়তো পরে পস্তাতে হবে। আসলেই পস্তাচ্ছি ওকে বলে। ওকে কিছু না বলাটাই উচিৎ ছিল আমার।’
কথাগুলো বলতে বলতে শাড়ি খুলে ফেলে বাথরুমে প্রবেশ করল সে। ভায়োলেট ও জাহ্নবী শান্তভাবে বসে রইল।
খানিকক্ষণ পর পারভীন এসে জানতে চাইলেন, ‘কই ওই বেয়াদবটা?’
ভায়োলেট বলল, ‘মা, বাদ দাও না।’
‘কী বাদ দিবো? পড়াশোনা জানা শিক্ষিত মেয়ে, সে বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলে। আমার মান সম্মান তোরা সব শেষ করার জন্য জন্মাইছিস।’
সামার বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘মা, বড়রা ভুল কথা বললে তাদের ভুলটাকে শুধরে দিতে এরকম উত্তর দিতেই হয়। সে আমাকে দেখতে এসে বলছে, চিটাগাংয়ের বাইরের মেয়ে আনতাম না। তাহলে এসেছে কেন? এটা কী আমাকে অপমান করা নয়?’
পারভীন ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, ‘একেকটা মেয়ে যেন রাজ সম্মান নিয়ে জন্মাইছে আমার।’
ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। সামারের কান্না এসে গেল। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই চোখের নোনা জল চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ল তার।
জাহ্নবী ভায়োলেটকে বলল, ‘থাক রে বোন, আমি আসি। তুই ফোন দিস আমাকে।’
পারভীনের কাছে বিদায় নিতে গেলে তিনি কোনো কথা বললেন না জাহ্নবী’র সঙ্গে। জাহ্নবী বিমর্ষ মনে বাসা থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিলো। সে ভেবেছিল আজকের দিনটা অনেক ভাল কাটবে। শুরুটা ছিল যতটা সুন্দর, দিনের শেষটা ততটাই যন্ত্রণা’র।
দুদিন ধরে অফিসের কর্মব্যস্ততায় সময় কাটছে জাহ্নবী’র। পরিবার, মন মানসিকতা সবকিছুকে এক পাশে সরিয়ে সে কাজে মন দিয়েছে। দুপুর পেরোতেই এমডি স্যারের চেম্বারে ডাক পড়ল তার।
তিনি জাহ্নবী’র প্রশংসা করে বললেন, ‘ইউ আর এ জিনিয়াস। এত দ্রুত সময়ে এত নির্ভুল কাজ করেছেন, আমি ইমপ্রেসড।’
ধন্যবাদ জানিয়ে মিষ্টি হাসল জাহ্নবী। আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হল তার।
এমডি স্যার বললেন, ‘নাদির সাহেব ছুটিতে আছেন। আপনিও যেহেতু এই প্রজেক্টটার সঙ্গে ছিলেন, আপনি বরং এটার সেকেণ্ড প্রজেক্ট টাও দেখুন। যেকোনো প্রয়োজনে নাদিরের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। অফিসের গাড়ি নিয়ে যাবেন প্রয়োজনে।’
জাহ্নবীর চিবুকে উজ্জ্বল আলো খেলা করে গেল। মধুর ভঙ্গীতে হেসে এমডি স্যারকে ধন্যবাদ জানাল জাহ্নবী। নতুন আরেকটা কাজ পেতে চলেছে সে। স্যারদের প্রিয় হতে পারার আনন্দ যে কতখানি, তা স্কুল কলেজেই বুঝতে পেরেছে জাহ্নবী। কর্ম জীবনেও স্যারদের নজরে আসার মত সুপাত্র হতে পারাটা গৌরবের।
আজ অফিসের গাড়ি নিয়ে রওনা দিয়েছে জাহ্নবী। নাদিরের বাসায় যেতে হবে। গতকাল অনলাইনে মিটিং হয়েছিল। তিনি আজকে বাসায় ডেকেছেন। পুরোটা পথ জাহ্নবী’র মনে উষ্ণ আনন্দ টগবগ করে ফুটছে। আজকেও দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকতেই পারে পান্নাবাহারের সঙ্গে। তবে দেখা হলেই বা কী! তার আত্মবিশ্বাস তখন চুপসে মিয়ানো মুড়ি হয়ে যাবে। ওই মানুষটাকে দেখলেই তার বুকের ভেতর কেমন একটা হয়!
জাহ্নবী পান্নাবাহারের ভাবনাকে মন থেকে তাড়িয়ে কাজের ব্যাপারে মন দিলো।
নাদিরকে আজ অনেকটাই সুস্থ দেখাচ্ছে। যদিও এখনো হাঁটতে পারে না সে। সাহিদা আজকেও কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছিল জাহ্নবীর দিকে। জাহ্নবী হাসিমুখে জানতে চাইলো, ‘ভাল আছেন?’
উত্তর দিলো না সাহিদা। ঘাড় ঘুরিয়ে ‘ভাল আছি’ জানান দিলো। জাহ্নবী কাজের ফাঁকে বারবার মাথা তুলে ড্রয়িংরুমে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল সেখানে কেউ বসে আছে কী না! ওখানে একটা পরিচিত ছায়া দেখতে পেলে ভীষণ ভালো লাগত তার।
তিন ঘন্টা পর নাদিরের বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও জাহ্নবী অবচেতন মনে চাইছিল, মানুষটার সঙ্গে তার দেখা হোক। কিন্তু হায়, আজ প্রকৃতি তা চাইল না!
জাহ্নবী খুব করে চেয়েছিল বারবার যাওয়ার প্রয়োজন আসুক নাদিরের বাসায়। কিন্তু এরপর আর যাওয়া হয়নি তার। হোয়াটসঅ্যাপ, ইমেইল কিংবা কখনো ফোনে কথা বলেই কাজ করতে হল। দ্বিতীয় প্রজেক্টটাও প্রায় শেষ হতে চলল। পান্নাবাহারের সঙ্গে আরও একবার দেখা হওয়ার আশা ছেড়ে দিলো জাহ্নবী। মনকে বোঝালো, ‘আর কখনো এই লোকটার কথা ভাবা যাবে না। যদি ভুল করে আর একবার দেখা হয়ে যায়, তবে ধরে নেবো সে শুধুই আমার।’ আত্মবিশ্বাসী মনে কথাগুলো নিজেকে বলে দিলো জাহ্নবী।
একদিন হঠাৎ ফোন করল নাদির। বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, ‘জাহ্নবী, আমাকে ওয়েলকাম করুন। I am now completely healed. আগামীকাল তন্বীর বাড্ডে। দুইয়ে মিলে আমরা একটা অসাধারণ পার্টির আয়োজন করতে যাচ্ছি। আপনি অবশ্যই আসবেন। আগামীকাল সন্ধ্যায়, আর যেন বলতে না হয়।’
জাহ্নবী অসম্ভব আনন্দিত গলায় জানতে চাইলো, ‘সত্যি বলছেন স্যার! আপনি হাঁটতে পারছেন?’
‘ইয়ো ইয়ো। হেঁটে হেঁটে কাল রেস্টুরেন্টে যাবো। ধানমণ্ডি আড্ডা রেস্টুরেন্ট চেনা আছে আপনার?’
‘না স্যার।’
‘ধানমণ্ডি ল্যাব এইডের ঠিক উল্টো দিকে। আপনি সাত টার দিকেই চলে আসবেন। ওকে?’
জাহ্নবী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ফোন রেখে দিলো৷ উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে তার। পার্টিতে সে নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে যাবে! সে চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে, সেখানে পান্নাবাহার থাকবেই। কিন্তু পার্টিতে কী পরে যাবে সে? তার তো সেরকম কোনো জামাকাপড় নেই।
জাহ্নবী ফোন করল ভায়োলেটকে। এত খুশি খুশি গলা শুনে ভায়োলেট বলল, ‘কী গো আপু? আজ এত আনন্দ?’
‘একটা পার্টির ইনভাইটেশন পেয়েছি। আমি কী পরবো বল তো? আমার জামাগুলো কী একটাও পার্টিতে পরে যাওয়া যাবে?’
‘শাড়ি পরে যাও।’
‘আমার তো শাড়িও নেই।’
‘আমার কালো শাড়িটা দিয়ে আসবো তোমায়?’
‘আচ্ছা শোন, একদিন বাসায় পার্টি দিয়েছিলাম না? আমাকে তোরা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছিলি মনে আছে?’
‘মনে থাকবে না কেন?’
‘কাল আমাকে এভাবে সাজিয়ে দিতে হবে।’
‘ওসব মেজোপু পারে। আমি পারি না।’
‘তুই মেজোকে ম্যানেজ কর। কাল তোরা সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসবি। আমি অফিস থেকে তারাতাড়ি ফিরব। তারপর তোরা আমাকে সাজুগুজু করিয়ে দিবি। ঠিক পরীর মতো করে। ‘
ভায়োলেট ভীষণ অবাক হল। জাহ্নবীকে কখনো সাজতে দেখেনি সে। তার সাজসজ্জা করার মতো একটা উপকরণও নেই। কোনোদিনও কাজলও লাগায়নি মেয়েটা। আজ কী কারণে তার এত সাজতে ইচ্ছে করছে তা বুঝে আসছে না ভায়োলেটের। তবে জাহ্নবী’র এই আনন্দঝরা কণ্ঠ শুনতে দারুণ আনন্দ হচ্ছে তার।
জাহ্নবী বলল, ‘আর শাড়িটাও নিয়ে আসবি। সামারের একটা মখমলি ব্লাউজ আছে না? ওটাও আনবি।’
‘কী ব্যাপার আপু? হঠাৎ মখমলি ব্লাউজ? হুম’
‘উফফ স্পেশাল একটা পার্টিতে যাচ্ছি। একটা ব্যাপার আছে না?’
কথাটা বলেই উচ্চ শব্দে হেসে উঠল জাহ্নবী। তার হাসির শব্দে মুখরিত হল চারপাশ। বারান্দা থেকে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল অতিথি শালিক পাখিটি। ফোনের অপর প্রান্তে মুগ্ধ হয়ে হাসির শব্দ শুনছে ভায়োলেট। এ যেন ভুবনজয়ী হাসি!
চলব..