মেঘফুল পর্ব-৫৩+৫৪+৫৫

0
298

মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৫৩

সারল্য’র পরিবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে জাহ্নবীর বাসায় আসতে চায়। কথাটা ভায়োলেট নিজেই জানালো বাবা মাকে। শুরুতেই মুখ অন্ধকার করে ফেললেন পারভীন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, ‘শেষ পর্যন্ত একটা ডিভোর্সি ছেলে? এত বছর ধরে আত্মীয় স্বজন সবার কথা শুনতে শুনতে আমার কান পঁচে গেছে। আমি কারও বাসায় যাইনা, কারও সাথে কথাও বলিনা। মেয়ে বিয়ে দেইনা কেন এই এক কথা সবার। এখন এই বয়সে এসে এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাইলো যার আগেও একবার বিয়ে হয়েছে, ছাড়াছাড়িও হয়েছে, বাচ্চাও আছে। আমি আর কারও সামনে মুখ দেখাতেও পারবো না। সেই অবস্থাও আর থাকবে না।’

অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইলেন পারভীন। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে ওনার। জাভেদ আলী শান্ত গলায় বললেন, ‘এভাবে চিন্তা করো না তো। মেয়েটা বিয়ে করতে রাজি হয়েছে এটাই অনেক। সে যাকে নিয়ে সুখী হতে চায় হোক। তার জীবন, তার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে।’
‘তোমার জন্যই নষ্ট হয়েছে ওরা। খালি স্কুল কলেজে ভালো রেজাল্ট করলেই হয়না। সমাজের নিয়ম কানুন মেনে চলা লাগে। মানুষের কাছে মান সম্মান কিচ্ছু নাই আমাদের।’

জাভেদ আলী উত্তেজিত হলেন না। বরং আগের মতোই শান্ত স্বরে বললেও বললেন, ‘মান সম্মান নেই সেটা তোমার ভুল ধারণা। অনেকদিন পর দেখা হলে আত্মীয় স্বজন বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করবেই। জাহ্নবীর বিয়ে হয়েছে শুনলে সবাই খুশিই হবে। ছেলের ডিভোর্স হয়েছে না কী হয়েছে এসব নিয়ে কে মাথা ঘামাবে এখনকার দিনে?’

পারভীনের রাগ আরও খানিকটা বেড়ে গেল, ‘তোমার এসব চিন্তা ভাবনার জন্যই মেয়েগুলোকে মানুষ করতে পারো নাই। একটাও হইছে মানুষের মতো মানুষ? বড় জনকে এত বছরেও বিয়ের জন্য রাজি করাইতে পারি নাই। এখন এসে তিনি জানালেন ডিভোর্সি একটা ছেলেকে বিয়ে করবেন। আরেকজনের কথা কি বলবো, ছেলের সঙ্গে এনগেজমেন্ট হইছে সেটা দুনিয়ার সবাইকে জানাইছি। তারপর তিনি বললেন ওই ছেলের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নাই তার। তাহলে এতদিন নাটক করার কী দরকার ছিল? বাপ মাকে বোকা বানিয়ে ওরা মজা নেয়। জীবনে শিক্ষা দিতে পারলাম না মেয়েগুলোকে।’

জাভেদ আলী নিজেকে শান্ত রাখলেন, ‘দেখো পারভীন। আমার মেয়েদের কেউ খারাপ বলতে পারবে না। ওরা হয়তো শুধু বিয়ে নিয়েই আপত্তি করেছে, এটা দোষের কিছু না। সবার যে বিয়ে করে সংসারী হওয়ার মনোভাব থাকবে এটা ভুল ধারণা। আমরা নিজেরাই তো সারাজীবন বলে এসেছি বিয়ে করে ভুল করেছি। ওরা যখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে চায় নেবে। এতে আমি আগেও কথা বলিনি, এখনও বলবো না।’
পারভীন উঠে পড়লেন। স্বামীর ওপরেই এখন ওনার সব রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই লোকটার সঙ্গে সংসার করা বৃথা। তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

ভায়োলেট বিব্রতবোধ করছে। জাভেদ আলী ভায়োলেটকে শান্ত গলায় বললেন, ‘তুই চিন্তা করিস না। এই সপ্তাহেই একদিন ওদেরকে আসতে বল। আমরা কথাবার্তা বলি, পরিচিত হই।’
‘বাবা, মা যদি জানতে পারে আমি তোমার কাছে বিশ লাখ টাকা নিয়েছি তাহলে তো হার্টফেল করে মরবে।’

জাভেদ আলী হেসে বললেন, ‘ও চিরকালই ওরকম। ওর কথা বাদ দে। জাহ্নবীর সঙ্গে আমি কথা বলবো। সময় করে ওরা আসুক। তোর মাকে আমি দেখছি।’
‘মা খুব রেগে গেছে। বিয়েটা হলেও মা’র ইচ্ছের বিরুদ্ধে হবে।’
‘তাতে কীইবা আসবে যাবে? জাহ্নবী আমার খুব শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে। জীবন নিয়ে ওর কোনো চাহিদা নাই। ছোট থেকে সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখত। কখনো কিছু চাইতো না, কোনো খরচ করতো না, মন দিয়ে পড়াশোনা করতো। নিজেকে কখনো বুঝতে দেয়নি কাউকে। আমার মেয়েটা যখন নিজে থেকে কাউকে বিয়ে করতে চাইছে, আমার পুরো সাপোর্ট পাবে। এখানে আত্মীয় স্বজন কে কী বলল আমার দেখার বিষয় না। এখন যদি সিনেমার নায়কের সঙ্গেও বিয়ে দেই, তারা নায়ক দেখে খুশি হবেনা। উলটো বলবে ছেলেটা ছবিতে রোল করে, এদের চরিত্র ভালো হয় না। মানুষের কথায় এজন্যই আমি কান দেই না।’

ভায়োলেটের ইচ্ছে করল বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু ধরলো না। মুগ্ধ হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল সে। জাভেদ আলী খুশি হয়েছেন। প্রতিটা বাবাই চান মেয়েকে সুখী দেখতে। তিনি হয়তো কল্পনায় মেয়ের সুখী সুখী একটা সংসার দেখতে পাচ্ছেন।

পারভীন আরও কয়েকদিন রাগ করে রইলেন। কারও সাথে তেমন কথা বললেন না। জাভেদ আলী বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করলেন বিয়ের ব্যাপারে। প্রত্যেকবারই বিষয়টাতে বিরক্তি প্রকাশ করলেন তিনি। সবসময় একটাই উত্তর দিলেন, ‘যার যা ভাল্লাগে করো। আমার কী?’
জাভেদ আলী বুঝলেন পারভীনকে আর বুঝিয়ে লাভ নেই। বিয়েটা হয়ে গেলে যখন মেয়ের আনন্দোচ্ছ্বাস দেখবে, নিজেই আশির্বাদ করবে মেয়েকে। তিনি একটা দিন ঠিক করে ছেলেপক্ষকে আসতে বললেন।

জাহ্নবী আগের দিন সন্ধ্যাতেই বাড়ি চলে এসেছে। পারভীনের খুব একটা মত নেই সেটা ভায়োলেট আগেই বলেছে তাকে। জাহ্নবী অবাক হয়নি। সে জানতো মা রাজি হবেন না। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে রাজপুত্র এলেও মা এমন গোমড়া মুখে করে থাকতেন। ওনার অদ্ভুত চরিত্র সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা আছে।

সকাল থেকে মেহমানদের জন্য খাবারের আয়োজন শুরু হল। পারভীনের মুখ অন্ধকার। তাকে জোর পূর্বক রান্নাঘরে নিয়ে আসার ইচ্ছেও নেই জাহ্নবীর। তাই সে নিজেই গতকাল জাভেদ আলীকে বাজারের লিস্ট করে দিয়েছে। সকাল হতেই রান্নার আয়োজন শুরু করেছে সে। উত্তেজনায় সারা রাত ঘুম হয়নি। ক্রমশ হাত পা কাঁপছে। অস্থিরতায় এঘর ওঘর করছিল কেবল। এভাবেই রান্নার প্রস্ততি নিচ্ছে সে।

সকালে উঠেই পারভীনকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মা, কী কী রান্না করবে?’

পারভীন উত্তর দেননি। উত্তরের আশাও করেনি জাহ্নবী। সে জাভেদ আলী, সামার ও ভায়োলেটকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘সবাই মতামত দাও কী কী রান্না করবো?’
প্রত্যেকেই যে যার মতো দু একটা খাবারের আইটেম বলে দিলো। সকাল সকাল দুটো ডেজার্ট রেডি করে ফ্রিজে রেখে দিলো জাহ্নবী। এরপর গরুর মাংস মেরিনেট করে রাখল। ভায়োলেট মশলা বাটতে তাকে সহায়তা করছে। রান্নাবান্নার কাজে একদমই নেই সামার। সে ঘুরে ঘুরে বাদাম, কিশমিশ খাচ্ছে আর কখনোবা টিভির সামনে সোফায় পা দুলিয়ে বসে মোবাইলে চোখ রাখছে। এসব নিয়ে আক্ষেপ নেই জাহ্নবী’র। সে আপন মনের আনন্দ নিয়েই রান্না করছে। ভায়োলেট কিছু মিষ্টি খাবারের রেসিপি খুঁজছে ইউটিউবে। দুই বার্নারের চুলায় একদিকে রান্না বসিয়েছে জাহ্নবী। অন্য চুলায় ভায়োলেট রেসিপি দেখে চেষ্টা করছে বানানোর।

রান্নার ফাঁকে দৌড়ে দৌড়ে জাহ্নবী ঘরের আসবাবপত্র মোছামুছি করছে। গুছিয়ে রাখছে পুরো ঘর। জাভেদ আলী অস্থির চিত্তে পায়চারি করছেন। সামারকে দেখতে অর্ণবের পরিবার এ বাড়িতে এলেও তখন এমন অনুভূতি হয়নি ওনার। আগেও বহুবার পাত্রপক্ষ এসেছে এ বাড়িতে। জাহ্নবীকে দেখতে বহু সম্বন্ধই এসেছে। কিন্তু কই, আগে তো এমন লাগেনি। এবার সত্যি সত্যি বিয়ের আমেজ টের পাচ্ছেন তিনি।

দুপুরের পরপরই পারভীন আর নিজের ঘরে থাকতে পারলেন না। রান্নাঘরে এসে ঢুকলেন। কোনোকিছুতে হাত দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিঃসংকোচে জাহ্নবী এক চামচ তরকারি তুলে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘মা দেখো তো লবণ ঝাল ঠিক আছে?’

পারভীন অবাক হলেন। জাহ্নবীর আচরণে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। তিনি তরকারি চেখে দেখলেন। লবণ একটু কম হয়েছে। তবে সেটা মুখে না বলে নিজেই লবণের বয়াম থেকে খানিকটা লবণ মিশিয়ে দিলেন তরকারিতে।

জাহ্নবী বলল, ‘তোমাকে একটু ভাত দেই মা? ভাত হয়নি এখনো। পোলাও হয়েছে। একটু পোলাও খাও?’
পারভীন একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোরা খাইছিস?’
‘না।’
‘তরকারি তো হয়েছে। রেজালা আমি বানাই। তোরা দুইবোন অল্প করে খেয়ে নে। তোর বাবাকেও দে।’

জাহ্নবী মনেমনে অবাক হল, আবেগে চোখ ভিজে আসতে চাইলো। কিন্তু সেটা কাউকেই বুঝতে দিলো না। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘তুমিও আমাদের সঙ্গে খাও। টেবিলে খাবার দেই। খেয়েদেয়ে রান্না কোরো।’

জাহ্নবী পারভীনের উত্তরের আশায় না থেকে পোলাওয়ের পাতিল নিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর রাখল। সবাই মিলে একসঙ্গে বসে খেলে মায়ের রাগটা পড়ে যাবে।

কিন্তু টেবিলে আসলেন না পারভীন। তিনি ব্যস্ত হয়ে রান্নার জোগাড় করতে লাগলেন। ভায়োলেট ওনাকে ডাকতে গেলে তিনি বললেন, ‘পোলাও সব আমরা খেয়ে ফেললে মেহমান খাবে কী?’

জাহ্নবী বলল, ‘আবার রান্না করবো। তুমি আসো তো।’

দুইবোন পারভীনকে ধরে নিয়ে এসে টেবিলে বসালো। খাবার খেতে খেতে জাভেদ আলী বললেন, ‘ফলমূল আর কিছু আনবো?’

ভায়োলেট বলল, ‘বাবা, ড্রাগন ফ্রুটস নিয়ে এসো আর স্ট্রবেরি।’
‘ওদেরকে ফোন করেছিলি? কখন আসবে জানায়নি কিছু?’
জাহ্নবী লাজুক স্বরে উত্তর দিলো, ‘গতকাল তো বলেছিল সন্ধ্যার দিকে আসবে।’
‘আজকে আর কথা বলোনি? এক্ষুনি ফোন দাও। সুন্দর করে জিজ্ঞেস করো কখন আসবে। মেহমান আসবে বাসায়, আগ্রহ না দেখালে কী ভাব্বে? একবার ফোন করো।’
‘আচ্ছা বাবা।’ মৃদু স্বরে বলল জাহ্নবী।
‘আর তুমি ভাত খেয়ে উঠে কিছুক্ষণ রেস্ট নাও। ক্লান্ত হয়ে গেছো। পারলে ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নাও। তারপর গোসল করে পরিপাটি হয়ে থাকো। বাকি রান্নাবান্না তোমার মা করবে।’

জাহ্নবী মাথা নিচু করে রইল। আর কেউ কোনো কথা বললো না। বাকি খাবারটা শেষ হল নিরবে।

জাহ্নবী যখন আবারও এসে রান্নাঘরে ঢুকল, তখন পারভীন বললেন, ‘তোর আব্বা কী বলছে শুনিস নাই?’

মায়ের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে জাহ্নবী নিজের ঘরে চলে এলো। কিন্তু ঘুম এলো না তার। ক্লান্ত হলেও সেটা নিজেই বুঝার উপায় নেই। অস্থির অস্থির লাগছে। গত কয়েকদিনে সারল্য’র সঙ্গে তার সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। খুব আপন আপন লাগে মানুষটাকে। আজ সে আসবে বিয়ের কথা বলতে। এইমুহুর্তে কী করে ঘুমাতে পারবে সে!

সারল্য ও তার পরিবার এলো সন্ধ্যা নামার খানিক আগেই। মা, বোন, নাদির ও তার পরিবার আর শার্লিনের শ্বশুরমশাই। জাহ্নবী শাড়ি পরেছে। তাকে জোর করে সাজগোজ করিয়ে দিয়েছে সামার ও ভায়োলেট। সে তো কিছুতেই সাজবে না। এতদিনের পরিচিত মানুষদের সামনে সেজেগুজে যেতে লজ্জা লাগছিল তার।

সারল্য’র মা কোনো আনুষ্ঠানিক কথাবার্তার ধারেকাছেও গেলেন না। এমনভাবে সবার সঙ্গে মিশতে লাগলেন যেন তিনি সত্যিই জাহ্নবীর খালা। নাস্তা খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই তিনি সারল্যকে বললেন, ‘নে, এটা পরিয়ে দে ওকে।’
সারল্য অবাক হয়ে দেখল মায়ের হাতে লাল ভেলভেট বাক্সে জ্বলজ্বল করছে একটা হিরের আংটি। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে সে একবার শার্লিনের দিকে তাকাল। এটার কথা সে জানতো না।
মা বললেন, ‘ওর দিকে কী দেখছিস? আমি কিনেছি এটা। ছেলের বিয়ে পাকা করতে আসবো আর আংটি আনবো না? আমার পরিবারের একটা ঐতিহ্য আছে।’

সারল্য লাজুক হেসে মাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর ধীরেধীরে হাত বাড়িয়ে জাহ্নবী’র হাতটা ধরলো সে। লজ্জার রঙিন আস্বাদনে রাঙা হয়ে উঠল জাহ্নবী। সারল্য আলতো করে তার আঙুলে আংটি পরিয়ে দিলো। জাহ্নবী হাতের দিকে তাকালো। স্থিরচোখে আঙুল টাকে দেখতে লাগল সে। আগে কখনোই সে আংটি পরেনি। মুগ্ধ হয়ে দেখল তার সরু আঙুলে উজ্জ্বল হয়ে আছে একটা আকর্ষণীয় ডায়মন্ড রিং!

চলবে..

মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৫৪

সপ্তাহ খানেক পরেই খুব সাদামাটা ধাচে সারল্য ও জাহ্নবী’র বিয়েটা হয়ে গেল। ঘরোয়াভাবে আয়োজন করা হলো বিয়ের। কেবল দুই পরিবারের উপস্থিতিতে বিয়ে পড়ানো হয়েছে। আত্মীয় স্বজন তেমন কাউকে ডাকা হয়নি। তবে এরমধ্যেই অনেক কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে কাছের ও দূরের আত্মীয়দের কাছ থেকে। কেউবা বলছে, জাহ্নবী এক বাচ্চার বাপকে বিয়ে করেছে তাই কাউকে বিয়েতে দাওয়াত করেনি। আবার কেউ বলছে, এই বুড়ি বয়সে বিয়ে করেছে এইতো অনেক, দাওয়াত দিবে কিসের দুঃখে? এমন নানান কথা কানে আসছে পারভীনের। তিনি কষ্ট পেয়েছেন কারণ তার বাবার বাড়ির কাউকে অন্তত দাওয়াত করা উচিৎ ছিল। মেয়েরা তার বাবার সঙ্গে বুদ্ধি করে কাউকে দাওয়াত দেয়নি। অবশ্য পরিস্থিতি শুরুতে এমন ছিল না। ওনার ভাইকে ফোন করে বলা হয়েছিল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোড়ন কেটে বলেছেন, এত্ত ভালো ভালো বিবাহের সম্বন্ধ নিয়ে গেছিলাম। মাইয়ার দেমাগ, রাজি হইল না। শেষ পর্যন্ত এই বয়স্ক পোলা, তাও বিয়াইত্তা? – এমন কথা শুনেই জাভেদ আলী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কাউকেই দাওয়াত করবেন না। পাছে বিয়েটা অশান্তিতে পরিণত হয়, সেই ভয় পাচ্ছিলেন তিনি।

বিয়ের পরই জাহ্নবীকে নিয়ে এলো সারল্য’র পরিবার। খয়েরী কাতান শাড়িটাতে খুব মিষ্টি লাগছে তাকে। হাতভর্তি কাঁচের লাল চুড়ি, অন্য হাতে স্বর্ণের বালা। জাহ্নবীর শাশুড়ী এই চুড়ি দুটো দিয়েছেন তাকে। গলায় জ্বলজ্বল করছে সাদামাটা ডিজাইনের একটা নেকলেস।
সারল্য’র ঘরটা আগের মতোই আছে, বিয়ে উপলক্ষে বিশেষ কোনো সাজসজ্জা নেই। তবে অনাড়ম্বর ঘরটাও আলোকিত হয়ে উঠল জাহ্নবীর উপস্থিতিতে।

ঘরে ঢুকে নিঃশব্দে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল সে। সারল্য তার পাশে এসে দাঁড়াল। মুচকি হেসে বলল, ‘ভেবেছিলাম তুমি বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকবে।’

জাহ্নবী কম্পনরত বুকে সারল্য’র দিকে তাকালো। বিশ্বাসই হচ্ছে না এই মানুষটা তার স্বামী। তার এত বছরের একাকীত্ব ঘুচল অবশেষে। একটা নিজের মানুষ হলো তার। এমন একটা নিজের মানুষের অভাব সর্বক্ষণ তাকে তাড়া করে বেড়াতো।

সারল্য জানতে চাইলো, ‘কী দেখছো?’

একটা ছোট্ট নিশ্বাস আড়াল করল জাহ্নবী। সে দেখছে তার হাজার জনমের প্রতীক্ষিত পুরুষটাকে। বলতে ইচ্ছে করছে, আমি তোমার অপেক্ষায় কত শত রাত নিদ্রাহীন কাটিয়েছি, তুমি যদি তা জানতে! আফসোস, কখনোই তুমি তা জানবে না। জাহ্নবী কাউকে নিজের আবেগ বুঝতে দেয় না।

লাজুক হেসে মুখ নামিয়ে নিলো জাহ্নবী। তার মাথায় এখন ঘোমটা নেই। শাড়ির লম্বা আঁচল পিঠের ওপর বিস্তৃত। খোপায় মিইয়ে যাওয়া ফুল। ঠোঁটে রঙ ক্ষয়ে যাওয়া লিপস্টিক। মায়াবতী লাগছে মেয়েটাকে।
সারল্য বলল, ‘এই বারান্দাটা তোমার খুব পছন্দের তাই না?’
‘পছন্দ নয়, প্রিয়। আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা।’
‘আচ্ছা। তুমি শাড়িটা বদলে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমরা সারা রাত এখানে বসে গল্প করবো।’

জাহ্নবীর আনন্দ হতে লাগলো। এমন মধুর রাত তার জীবনে কক্ষনও আসেনি। এক সেকেণ্ড সময়ও সে অযথা নষ্ট করতে চায় না।

তারাহুরো করে গোসল সেরে সে একটা পুরনো সুতি শাড়ি পরলো। নতুন শাড়িতে অস্বস্তি লাগে, আরাম করে বসে থাকা যায় না। গোসলের পর সব প্রসাধনী ধুয়ে যাওয়ায় অনেক সতেজ বোধ করছে সে।
সারল্য নিজেও পাঞ্জাবি ছেড়ে একটা টি শার্ট গায়ে জড়িয়েছে। বারান্দায় শীতল পাটি আর বালিশ নিয়ে অপেক্ষা করছে সে। জাহ্নবীর লজ্জা লাগছে। হাত পা আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার। দরজায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সে সারল্যকে দেখছে। দুই পা এগিয়ে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না।

সারল্য জিজ্ঞেস করল, ‘কই? আসো এদিকে?’
জাহ্নবী দুরুদুরু বুকে এগিয়ে এসে পাটির ওপর বসলো। সারল্য জানতে চাইলো, ‘নার্ভাস লাগছে?’
‘হুম।’
‘দাঁড়াও তোমার নার্ভাসনেস কাটিয়ে দিচ্ছি।’

সারল্য দুম করে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। মুহুর্তের জন্য জাহ্নবীর হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। সে মৃদুস্বরে বলল, ‘কাটিয়ে দিতে পারলেন কই? আরও বেড়ে গেল যে।’

সারল্য জাহ্নবীর হাতটাতে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুপ করে রইল। জাহ্নবীর শাড়িতে মুখ গুঁজে দিয়ে শান্ত হয়ে গেল সে। মনে হচ্ছে যেন ছোট্ট শিশু। বহুদিন পর মাতৃস্নেহ পেলে শিশুরা যেমন চুপটি করে জড়িয়ে রাখে, সেভাবেই চুপটি করে রয়েছে সারল্য। জাহ্নবীর নাকে মিষ্টি সুঘ্রাণ ভেসে আসে। সে জানে এই সুঘ্রাণ সারল্য’র।
জীবনের একাকীত্ব, হাহাকার সবকিছুকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে যেই মানুষটা তার বুকে নির্ভরতা খুঁজছে, তাকে কখনোই বিন্দুমাত্র আঘাত করবে না জাহ্নবী।

মিনিট দশেক নিস্তব্ধতায় কেটে গেল। স্বাভাবিক হয়েছে জাহ্নবী। স্বপ্ন স্বপ্ন ভাবটা কেটে গেছে। সারল্যকে ভীষণ আপন মনে হচ্ছে তার। অনেক্ষণ হাত ধরে রাখলে হয়তো এমন নির্ভার লাগে।

সারল্য বলল, ‘আমার নিজের জন্য তোমার কাছে কিছুই চাইবার নেই। প্রত্যাশা করা ছেড়ে দিয়েছি বহু আগেই। তুমি আমার মাকে যত্ন কোরো জাহ্নবী।’
‘মা আমাকে অনেক স্নেহ করেন। এটার মর্যাদা আমি রাখবো। ভাব্বেন না আপনি।’
‘জাহ্নবী, আমি আমার অতীতকে ছেড়ে দিয়েছি। সেইসব স্মৃতি আর কখনো মনে করতে চাই না। তুমি কখনো মনে করতে দিও না।’
‘ওই প্রসঙ্গে আমার আগ্রহ নেই। আমিও চাই আপনি এখন আমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকুন।’
‘চাও?’
‘চাইবো না?’
‘অবশ্যই চাইবে। আমি যদি ভালবাসতে ভুলে গিয়ে থাকি, যদি তোমার কোথাও কমতি মনে হয় তাহলে আমাকে ভুল বুঝবে না। আমি মনের ওপর জোর খাটিয়ে কিছু করতে পারিনা। তবে আমার কাছ থেকে তুমি যেটুকু পাবে, জেনে রেখো তাতে কোনো ভেজাল নেই। পুরোটাই খাঁটি।’

জাহ্নবী সারল্য’র হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, ‘আজ রাতে এটাই আমার শোনা সবচেয়ে সুন্দর কথা।’
‘আরও অনেক সুন্দর কথা বলবো। আচ্ছা, বলোতো এইযে আমি তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি, এটাকে কিসের মতো মনে হচ্ছে?’

জাহ্নবী কিঞ্চিৎ ভেবে বলল, ‘জানিনা তো। কীসের মতো?’
‘একবার তোমাকে এক ডালি ফুল দিয়েছিলাম। তুমি ডালিভর্তি ফুল নিয়ে রিকশায় বসে ছিলে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল জগতের সবচাইতে সুখী মেয়ে, আনন্দময়ী।বএখন আমাকে কি তোমার সেই ফুলের মতো লাগছে না?’

জাহ্নবী মিষ্টি করে হাসলো। সারল্য অবশ্যই একটা ফুল। তার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর ফুল। নিষ্পাপ, বিশুদ্ধ ও সুন্দর!

বিয়েবাড়ির আমেজ এখনও ফুরায়নি। বাড়িটা মেহমানভর্তি না হলেও কিছুক্ষণ আগেই এ বাড়িটা একটা বিয়ের আসর ছিল, সেটা স্পষ্টতই মনে প্রলেপ ঢেলে রেখেছে। তথাপি কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে সামারের। দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে সে। কাঁদছে কারণ তার জীবনটা আর আগের মতো নেই। সে হারিয়ে ফেলেছে সবকিছু। হারিয়ে ফেলেছে নিজেকেও। সে ছিল একটা হাসিখুশি, প্রাণবন্ত মেয়ে। জীবন নিয়ে যার কোনো আক্ষেপ ছিল না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ঘোরাঘুরি আর আনন্দেই কেটে যেতো তার সময়। অথচ আজকের সামারের জীবনে বন্ধুরা সবাই ব্যস্ত। আগের মতো কাউকে পাওয়া যায় না। পেলেও আর আড্ডা’টা জমে না। সবাই কেমন যেন দূরে সরে গেছে। সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এসেছে গতকাল। আরজু পরোক্ষভাবে জানিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, তার সঙ্গে সামারের জুটিটা ঠিকঠাক নয়। তারা দুজন দুজনের জন্য নয়। তারমানেই তো ছেড়ে চলে যাওয়া। সামার মেনে নিতে পারছে না এই বিচ্ছেদ। দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে সে। নিজেকে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলার দুঃখে বুক ভার হয়ে আছে। অন্ধকার ঘরে শুয়ে সে কেন কাঁদছে জানেনা নিজেই।

বিয়েতে অর্ণব এসেছিল। অর্ণব ভালবাসে তাকে। সামার দূরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল অর্ণবের দিকে। একতরফা ভালবাসলেই কী হয়? অর্ণবকে সে ভালবাসতে পারবে না। অর্ণব তার জন্য নয়। আরজুও তার জন্য নয়। সে কী নিজেই তার জন্য? এমন কেন সে? পরিণত বয়সেও বড্ড অপরিণত। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে সামারের কান্না পায়। নিজেকে বদলে ফেলতে ইচ্ছে করে খুব করে৷ খুব হাসিখুশি চঞ্চল মেয়েগুলো বোধহয় সময়ের স্রোতে হঠাৎ করেই শান্ত সমুদ্রের মতো চুপ হয়ে যায়!

কালবৈশাখীর দিন ফুরিয়ে বর্ষা এলো। ভায়োলেটের বিজনেসটা বেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এর পুরো কৃতিত্বটাই সারল্য ও জাহ্নবীর। ওরা দুজন মিলে যেভাবে দিনরাত পরিশ্রম করছে, আর সঙ্গে আছে দুজনের অনবদ্য মেধা।

এমনই এক বর্ষার দিনে সারল্য ছুটে এসে জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘একটা ভালো খবর আছে। শুনলে তুমি পাগল হয়ে যাবে।’

জাহ্নবী বেশ অবাক হয়। সারল্যকে বেলীফুলের মতো ফুরফুরে লাগে তার। কী এমন ভালো খবর! ভ্রু কুঁচকে জানতে চায় সে।

সারল্য ল্যাপটপ খুলে তার সামনে মেলে ধরে। জাহ্নবী চোখ বড়বড় করে দেখে জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর খবরটা। অনেক বড় একটা প্রযুক্তিগত ব্রাণ্ড তাদের ব্যবসায়ে ইনভেস্ট করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যেটা এইমুহুর্তে স্বপ্নের মতো বিশাল। জাহ্নবী খুশিতে একটা চিৎকার দিয়ে উঠল। সারল্যকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় সে বলল, ‘তোমার জন্য সম্ভব হয়েছে এটা।’

সারল্য জাহ্নবী’র নাক টেনে দিয়ে বলল, ‘কখনোই না। তুমি জিনিয়াস জাহ্নবী। তোমার ট্যালেন্ট, ইনোভেটিভ আইডিয়া, কাজের দক্ষতা সবকিছুর জন্য এটা তোমার প্রাপ্য।’
‘তাই বলে এত অল্প সময়ের মধ্যে আমরা ইনভেস্টমেন্ট পেয়ে যাবো ভাবতেই পারছি না।’

জাহ্নবী মুহুর্তেই ফোন করল ভায়োলেটকে। খবরটা জানাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল ভায়োলেট। ওপাশ থেকে কোনো সাড়া নেই। গলা ধরে আসছে তার। দুচোখ ছলছল করছে।

জাহ্নবী বলল, ‘বাবার কাছ থেকে নেয়া টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দেবো ভায়োলেট।’
‘হুম।’
‘তুই খুশি হোস নি?’

ভায়োলেট উত্তর দিলো না। ফোন কেটে দিলো। আকাশ অন্ধকার করে এসেছে। এখনই নামবে বৃষ্টি। সে বৃষ্টিতে ভিজবে। তার চোখের জল বৃষ্টির জলে মিশে যাক। কেউ তা দেখবে না। জগতের কেউ জানবে না কেন এই মেয়েটা আজ কাঁদছে!

বৃষ্টি নামলো। শহুরে রাস্তায়, মাঠের ঘাসে, খোলা বারান্দায়। বারান্দায় বাতাসে দুলে দুলে উঠছে বাগানবিলাসের লতাটা। সব জানলা দিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা আসছে। জাহ্নবী জানলা বন্ধ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। বারান্দায় ভিজছে কে!

সে দৌড়ে এসে বারান্দায় দৃষ্টি মেললো৷ কয়েকদিন আগেই একটা আরাম কেদারা নিয়ে এসেছে সে। সারল্য রোজ সকালে সেখানে বসে পত্রিকা পড়ে। চেয়ারের হাতলে রাখা পত্রিকা আর চায়ের জলভর্তি৷ কাপে টুপটুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। জাহ্নবী ক্ষণিকের জন্য নড়াচড়া করতে ভুলে যায়। অঝোর ধারায় নেমেছে শ্রাবণ। মন চায় আজ উদাসী হতে! এমনই উদাসী সে হয়েছিল বহুবার, বহুকাল আগে। কই, তখন তো ছিল না এমন কেউ! কেবল একটা শূন্য বারান্দা পড়ে ছিল কল্পনায়..

চলবে..

মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৫৫

বিয়ের পরের জীবনে ভীষণ আনন্দে আছে জাহ্নবী৷ বিশাল বাড়িটাতে তার নিজস্ব সংসার। সবকিছু সাজানো গোছানো হলেও তার সংসারী মন নতুন করে সব সাজাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ঘরের সাজসজ্জা বদলেছে। বদলেছে জানালার পর্দার রং, বিছানার চাদর, দেয়ালে নতুন করে যুক্ত হয়েছে কিছু পেইন্টিং। সংসারে খুব একটা মন না থাকলেও সারল্য মুগ্ধ হয়ে জাহ্নবীর ঘর সাজানো দেখে। প্রায়ই রাস্তার পাশের দোকান থেকে একটা গাছের চারা, কিংবা সময় পেলেই মার্কেটে ছুটে গিয়ে ঘর সাজানোর একটা উপকরণ হাতে নিয়ে ফেরে। মাঝরাত্তিরে কাজ শেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার আগে জাহ্নবী কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করে। সারল্য যখন জিজ্ঞেস করে, এই কী করছো?
– দেখছো না চিন্তা করছি?
– কী চিন্তা করছো?
– এখানে একটা নকশীকাঁথার ফ্রেম দেবো ভাবছি। আর একটা বেতের চেয়ার।

সারল্য মুচকি হাসে। এই বয়সে এসে মেয়েটা নতুন বিয়ে করেছে। মনের মতো করে সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার সাধ জাগতেই পারে। এতে বাধা নেই সারল্য’র। দুজনে একসাথে মন দিয়ে ব্যবসাটাকে গড়ে তুলছে। মা বাবা যেমন নবজাতক শিশুকে তিলে তিলে বড় করে তোলে, তেমনই ধীরেধীরে একটা ছোট্ট নাম’কে ব্রাণ্ড করে তুলতে দুজনেই একসঙ্গে লড়ছে।

শরতের এক উষ্ণ বিকেলে কাজের ফাঁকে জাহ্নবীকে নিয়ে কাশবনে ঘুরতে গেল সারল্য। ধূসর কাশবনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জাহ্নবী থমকে দাঁড়ায়। মাথার ওপর স্বচ্ছ নীল আকাশে তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘের দল। জাহ্নবী উদাস গলায় বলল, ‘শরতের আকাশে মেঘগুলো যেন একেকটা ফুল। মেঘের ফুল। তুমি আমার জীবনে একটা মেঘফুল হয়ে এসেছো।’

সারল্য কণ্ঠে মুগ্ধতা ছড়িয়ে জানতে চাইলো, ‘আমার জীবনে তুমি এসেছো নাকি তোমার জীবনে আমি?’
‘আমার জীবনে তুমি। আজ তোমায় একটা গোপন কথা বলবো।’
‘গোপন কথা!’
‘হুম। আমার কাছে তোমার একটা নাম আছে। যেটা তুমি জানো না। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই তোমার নাম রেখেছিলাম পান্নাবাহার।’

সারল্য খানিকটা চমকায়। ভ্রু কুঁচকে সে জাহ্নবী’র দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জানতে চাইলো, ‘প্রথম কবে দেখেছো আমাকে? নাদিরের বাসায় না?’
‘উহু। সেটা সিক্রেট। কবে, কোথায়, কীভাবে দেখেছি, আর কেন তোমার নাম পান্নাবাহার এটা আমি তোমাকে কখনোই বলবো না।’

সারল্য বিস্মিত হয় জাহ্নবী’র কথায়। কৌতুহল জাগলেও সেটাকে দমন করে। থাক না কিছু বিষয় গোপনেই। সবকিছু জানা হয়ে গেলে তাতে আনন্দ থাকে না।
কাশবনে হাঁটতে হাঁটতে সারল্য জাহ্নবী’র হাতটা মুঠোয় চেপে ধরে। আজকাল আর নিজেকে একা একা লাগে না তার। অথচ সে ভেবেছিল বাকি জীবনটা বুঝি একাকীত্বকে সঙ্গী করেই কাটাতে হবে, কী অদ্ভুত!

ব্যবসাকে নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে জুড়ে ফেলায় উদাসীন ভায়োলেটের হস্তক্ষেপ আর ভালো লাগে না জাহ্নবীর। সবসময় মনে হয় ভায়োলেট এটাকে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করতে পারছে না। সবকিছুতে একটা খাপছাড়া ভাব, উদাসীনতা। জাহ্নবী নিজের মতো এটাকে গড়ে নিয়েছে, ভায়োলেট যেন তাতে অযথাই তরকারির এলাচির মতো। ভায়োলেটকে সবকিছুর আপডেট দিতেও ওর ভালো লাগে না। কী মনে করে একদিন জাহ্নবী ডেকে নিলো ভায়োলেটকে।

দুই বোন মুখোমুখি বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল। ভায়োলেট যথারীতি হাসিখুশি ভঙ্গীতে বসে আছে। জাহ্নবী’র চেহারায় কাঠিন্য। সে যথেষ্ট গম্ভীরতার সঙ্গে তাকাচ্ছে। ভায়োলেটের মনে হল নিশ্চয়ই একটা ঝামেলা হয়েছে। ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে।

জাহ্নবী বলল, ‘তোকে একটা কথা বলবো বলে ডেকেছি।’
‘বলো আপু।’
‘তোর স্বপ্ন পূরণ করে ফেল।’

ভায়োলেট চমকে উঠলো। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা থেকে নড়েচড়ে বসলো সে। জাহ্নবী বলল, ‘তুই আমাকে বলেছিলি না তোর স্বপ্নের কথা? যার জন্য স্টার্টআপটা জরুরি। এখন তো বিজনেস দাঁড় হয়ে গেছে বলা যায়। তুই স্বপ্ন পূর্ণ করতে চলে যা।’

ভায়োলেট শুকনো হাসি দিয়ে বলল, ‘এখনও সময় আসেনি আপু। এটাকে মিলিয়ন ডলার ভ্যালুয়েশন না বানিয়ে আমি কোথাও যেতে পারবো না।’
জাহ্নবী ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘মিলিয়ন না, বিলিয়ন ডলার হবে। সেটা আমি করবো। তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।’

ভায়োলেট খানিকটা বিব্রতবোধ করল, ‘আপু, তুমি কি আমার সঙ্গে কোনো কারণে রেগে আছো?’
‘দ্যাখ, এটা শুরুর আগে তুই যেরকম সিরিয়াস ছিলি, আমার এখন তোকে ওরকম সিরিয়াস মনে হয় না। একটা কোম্পানি যেকেউ শুরু করতে পারে কিন্তু লেগে থাকাটা এত সহজ না। এটা সবাই পারে না। এভাবে যুগে যুগে বহু কোম্পানি, নামীদামী ব্রাণ্ড গুলো দেউলিয়া হয়ে গেছে।’

ভায়োলেট চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চাইলো, ‘তুমি কী ভাবছো আমি লেগে থাকতে পারবো না?’
‘তুই আজকাল নিজের মধ্যে নেই। তোর কী হয়েছে আমি জানিনা। তবে স্পষ্ট বুঝতে পারছি তোর ব্যবসায়ে মন নেই। নিতান্তই দায়সারা ভাবে কাজ করে যাচ্ছিস।’

ভায়োলেটের খানিকটা সময় লাগল কথাগুলো হজম করতে। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে রইল সে। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কোনো ধোঁয়া নেই। সেও কী ঠাণ্ডা চায়ের মতো হয়ে গেছে আজকাল? আপনমনে কথাটা বলল সে। অথচ তার এখন আগের চাইতে বেশী প্রোডাক্টিভ হওয়ার কথা।

ভায়োলেট অকপটে স্বীকার করে নিলো, ‘আপু, আমার কোনো কিছু ভালো লাগছে না। সারাক্ষণ অস্থির লাগে। কী যেন আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।’

জাহ্নবী ভায়োলেটের হাতের ওপর হাত রাখল, ‘আমি বুঝি রে। তুই ভেবেছিলি অনেক বড় হবি, অনেক টাকা হবে তারপর নিরুদ্দেশ হয়ে যাবি। তোর জীবন থেকে হয়তো সব অশান্তি দূর হয়ে যাবে। কিন্তু এত সহজ না রে। জীবন খুব অদ্ভুত। মানুষ সবকিছু ভুলতে পারলেও ভালবাসার অভাব ভুলে থাকতে পারে না। তুই যেখানেই যাস না কেন, মনে অশান্তি থাকবেই। আমি জানিনা তোকে কী বলবো। তুই এখনো ভুলতে পারিস নি ওকে।’

ভায়োলেট ম্লান হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘জীবনটা কারও জন্য থেমে থাকে না।’
‘কিন্তু মনের শান্তি?’
‘শান্তির জন্য সবসময় ভালবাসাই কেন দরকার হবে?’
‘কারণ ভালবাসা পৃথিবীর সবকিছুর চাইতে দামী। যেটা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। তুই যতই বিলাসী জীবনযাপন কর, ভালবাসা পাবি না কিনতে। এটার জন্য কারও কাছে আসতেই হবে। ভায়োলেট, তুই নতুন করে কাউকে নিয়ে জীবন সাজিয়ে তোল। ভালো থাকবি।’

ভায়োলেট আবারও শুকনোভাবে হাসলো। তারপর নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘বাদ দাও আপু। তবে তুমি একটা বিষয় বুঝতে পেরেছো এতে আমি খুশি হয়েছি। ইদানীং কাজে মন দিতে পারছি না। আমি কিছুদিন ঘুরে আসি কোথাও।’
‘তোর ইচ্ছে। তবে আমি বলবো আমি আর সারল্য যখন এটাকে আঁকড়ে ধরেছি, তুই এখন স্বাধীন হয়ে যা। জীবনের সব পিছুটান ভুলে তুই আপন মনের ঠিকানায় হারিয়ে যা। বিজনেস নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। তোর জন্য যখন যা প্রয়োজন, যত টাকা লাগবে আমি পাঠাবো। তুই নিশ্চিন্তে থাকবি। যেহেতু তুই এই প্রতিষ্ঠানের মালিক, গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো কাজে অবশ্যই তোকে দরকার হবে। বাদ বাকি সব আমার ওপর ছেড়ে দে। আমি এটাকে নিজের মতো করে গড়ে তুলবো।’

ভায়োলেট অনেক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আমায় বাঁচালি আপু। নিজেকে খুব স্বাধীন মনে হচ্ছে আজ। তুই এটাকে তোর মতো করে আগলে রাখ। আমাকে ছেড়ে দে।’
‘সেটাই তো বলছি। তোর যখন যা প্রয়োজন, সময়মত পেয়ে যাবি। যা, এবার নিজের কাঙ্খিত লাইফটা এনজয় কর।’

কথাগুলো বলতে পেরে জাহ্নবী নিজেও যেন স্বস্তিবোধ করলো। সে একা এই ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ভায়োলেটের জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত সে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানকে এতদিনে সে এতটাই ভালবেসে ফেলেছে যে, এখানে সারল্য’র মতামতও তার ভালো লাগে না। নিজের শক্তিতে এটাকে সে বড় করে তুলবে। স্বাধীনভাবে কাজ করবে সে।
ভায়োলেট জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরল। এমন একটা দিনের অপেক্ষাতেই যেন ছিল সে। মনে হচ্ছে বহুকাল ধরে দেখে আসা স্বপ্নটা আজ পূর্ণতা প্রাপ্তির পথে। এখন শুধুই পা ফেলা বাকি! নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে।

জাভেদ আলী ও পারভীন খুব অবাক হলেন ভায়োলেট দেশের বাইরে চলে যেতে চায় শুনে। তবে বরাবরের মতোই মেয়ের ইচ্ছায় কোনো বাঁধা দিলেন না জাভেদ আলী। তিনি ভায়োলেটের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অবশ্যই যাবি। আমাদের ভুলে যাস না।’
‘ভুলবো না বাবা।’

বাবাকে জাপটে ধরে সে। জাভেদ আলী মেয়েদের নিয়ে গর্ববোধ করেন। তার মেয়েদের বিজনেস দ্রুত সময়ের মধ্যে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। আজকাল তিনি কথায় কথায় পারভীনকে বলতে পারেন, দেখো আমার মেয়ে কী করেছে দেখো? আমি জানতাম আমার মেয়েরা একদিন বড় হবে, অনেক বড়।

পারভীন নিজেও বেশ তৃপ্তি পান মেয়েদের কথা ভেবে। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করেন না। জাহ্নবী শ্বশুর বাড়িতে থাকে। সামার আজকাল ঘরকুনো হয়েছে বেশ। খুব একটা কথাবার্তা হয় না ওর সঙ্গে। ভায়োলেট বিদেশে চলে যাবে শুনে মনটা যেন মুষড়ে পড়ল ওনার। বড্ড মন খারাপ লাগছে।

আজীবন মেয়েদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন তিনি। কখনো কাছাকাছি আসতে পারেননি তাদের। কেন যেন সবসময় নিজের চারপাশে দেয়াল তৈরি করে রেখেছেন। সন্তানের বন্ধু হতে পারেননি কখনো। আজ মনে হচ্ছে তিনি একজন ব্যর্থ মা। রাজকন্যার মতো তিনটা মেয়েকে পেয়েও যাদের আপন হতে পারেননি।

ভায়োলেট যেদিন বিদায় নিলো, সেদিনও পারভীন মুখে কাঠিন্য ধরে রাখলেন। যেন দুদিনের জন্য বেড়াতে যাচ্ছে ভায়োলেট। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করার প্রবল ইচ্ছেটাকেও দমিয়ে রাখলেন। তবে ভায়োলেট মাকে জড়িয়ে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদলো। সেই কান্নার অশ্রুতেই বলা হয়ে গেল শত না বলা অভিমান। বুঝলেন পারভীন। কিন্তু বড্ড শেষটায় বুঝলেন!
সব পিছুটান ছেড়ে ভায়োলেট পাখির মতো উড়াল দিলো তার স্বপ্নের জীবনের উদ্দেশ্যে..

চলবে..