উপন্যাস: মেঘফুল
শেষ পরিচ্ছেদ
ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জের ছোট্ট দ্বীপ বারবাডোস। রাশি রাশি নীল জল ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছে ধবধবে শুভ্র বালির ওপর। তীর ঘেষে লম্বাটে সব নারকোল গাছের সাড়ি। পেছনে সবুজাভ সামুদ্রিক লতাপাতায় আচ্ছন্ন। ঠিক তারই মধ্যে উঁকি দিচ্ছে ছনের চালা দেয়া বারান্দা। পাশেই সমুদ্রের নীল জলের মতো সুইমিংপুলে জল টলমল করছে। সূর্যের আলো চিকচিক করছে সেই পানিতে। ভায়োলেট পুলে পা ডুবিয়ে বসে আছে। তার চিবুকে খেলা করছে ঝিলিমিলি রোদ। গালের পাশে লেপ্টে আছে দুয়েক গোছা ভেজা চুল। সে সন্তপর্ণে ভেজা চুল কানের পেছনে গুঁজে রাখে। আজ মনে ভীষণ আনন্দ তার। বহুদিন পর আজ জাহ্নবী’র সঙ্গে দেখা হবে। বাংলাদেশ থেকে তার কাছে আসছে জাহ্নবী ও সারল্য।
ভায়োলেট মৃদু শব্দে গুণগুণ করে গান গায়। পা দোলায়। অদূরেই সমুদ্র। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু নীল আর নীল। মনে হয় খানিকটা দূরেই আকাশটাও সমুদ্র হয়ে গেছে।
একজন এসে খবর দিলো জাহ্নবী’রা পৌঁছে গেছে। লম্বা ফুরফুরে সাদা জামাটা দুই হাতে ওপরে তুলে ভায়োলেট দৌড়ে চলে যায় ভেতরে। বাসায় প্রবেশ করে দেখে জাহ্নবী ও সারল্য মুগ্ধ চোখে বসার ঘরটা দেখছে। এই ঘরের একদিকের দেয়ালের পর্দা সরালেই সমুদ্র দেখা যায়।
ছুটে গিয়ে জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরলো ভায়োলেট। কতদিন পর দেখা তাদের! দুইবোন একে অপরকে বিস্মিত চোখে দেখছে। উভয়ের মাঝেই এসেছে পরিবর্তন। ভায়োলেটকে দেখে মনে হচ্ছে যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা একটা পরী। জাহ্নবী নিজেকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। ওরা একজন আরেকজনকে ছুঁয়ে দেখে। বিস্মিত হয়।
জাহ্নবী বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ভায়োলেট তুই এত্ত সুন্দর হয়ে গেছিস!
‘যাহ আপু কী যে বলো! তুমি কেমন আছো আপু?’
‘ভালো আছি বলেই তো তোর কাছে এলাম। কিংবা বলতে পারিস তোর কাছে এসে আমি এখন সবচেয়ে আনন্দে আছি।’
‘তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম আপু। বসো।’
‘এটা কি হোটেল?’ জাহ্নবী আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো।
ভায়োলেট জাহ্নবীকে সোফায় বসতে বলে। নিজের অর্ধভেজা জামাটা তুলে সে বলে, ‘একটু বসো। আমি এক্ষুণি এটা চেঞ্জ করে আসছি।’
ভায়োলেট দ্রুতপদে ভেতরে চলে যায়। ফিরে এসে বলল, ‘এটা হোটেল না আপু। হোম স্টে। এই ভিলা’টা আমরা এয়ারবিএনবি থেকে নিয়েছি। ভাড়ায় থাকার মতো অনেকটা।’
‘কিন্তু এখানে ভাড়া থাকতে হলে তো বোধহয় অনেক খরচ?’
ভায়োলেট মুচকি হেসে বলল, ‘তা আছে মোটামুটি। সবসময় এখানে থাকি না তো। তোমরা আসবে বলে এই ভিলায় উঠেছি।’
‘ওহ আচ্ছা।’
সারল্য এতক্ষণ গভীরভাবে আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করছিল। সে এবার বলল, ‘এরকম একটা ভিলা কিনতে কত টাকা লাগতে পারে?’
ভায়োলেট হাসতে হাসতে জানতে চাইলো, ‘কেন ভাইয়া? আপনি কিনবেন নাকি?’
‘না। আমার ভায়োলেট বোনটাকে কিনে দেবো। যেন আরামসে এখানে বাকিজীবন কাটিয়ে দিতে পারে।’
ভায়োলেট চোখ বড়বড় করে বলল, ‘তাই! তোমাদের বিজনেসটা যখন বিলিয়ন ডলার বিজনেস হবে, তখন দিও। এখন আমার এভাবেই কেটে যাক। ফ্রেশ হয়ে নাও। খাবার দিই।’
রান্নাঘরের একপ্রান্তে বিশাল ডাইনিং স্পেস। কাঁচের জানালার ওপাশে সবুজাভ ছোট ছোট টিলার মতো জায়গা। রৌদ্রে জ্বলজ্বল করছে। ওরা টেবিলে বসে একসঙ্গে খাবার খেয়ে নিলো। খেতে খেতে সাম্প্রতিক ব্যবসা, দেশ, পরিবার সবকিছু নিয়েই চললো আড্ডা।
খাওয়া শেষ করে ওদেরকে নিয়ে বাইরে এলো ভায়োলেট। তার ব্যক্তিগত সুইমিংপুলের পাশে রাখা আরাম কেদারায় এসে বসলো। সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে। চিকচিক করা বালি দেখে উৎফুল্ল হয়ে জাহ্নবী সারল্যকে বলল, ‘চলো না নামি?’
‘নামবো।’
ভায়োলেট নিজ হাতে দুই গ্লাস ঠাণ্ডা জুস এনে দিলো ওদেরকে। তারপর কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে শিশুসুলভ ভঙ্গীতে বলতে লাগল এখানে রোজ সে কী কী করে সময় কাটায়। কখনো সার্ফিং করতে নেমে যায় সমুদ্রে। কখনোবা বোট নিয়ে দূর সমুদ্র পাড়ি দেয়ার বাহানা খোঁজে। লোকাল এরিয়ায় গিয়ে ঘুরে ঘুরে মানুষদের সঙ্গে মিশে সময় কাটায়। আবার কখনো একাকী বসে তার সময়কে উপভোগ করে। জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করছে সে।
এমন সময় হাতে বড়শি ও থলে হাতে এক যুবক’কে আসতে দেখা যায়। ছেলেটার হাঁটার ধরনে ফুটে উঠেছে আভিজাত্য। পরনে হাফপ্যান্ট। ভেজা চুল কপালের ওপর ছড়ানো। দূর থেকে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘কত্ত বড় বড় মাছ পেয়েছি দেখো, হু হু।’
ভায়োলেট দুই পা এগিয়ে গেল তার দিকে। উচ্ছ্বসিত হাসি ভায়োলেটের মুখে। যুবক হাতের জিনিস গুলো মাটিতে রেখে দুইহাতে ভায়োলেটের কোমর জড়িয়ে ধরে ওকে শূন্যে তুলে ধরল। তারপর হো হো করে হাসতে হাসতে ওপরে ঘোরাতে লাগল ভায়োলেটকে। ভায়োলেট শিশুর মতো শব্দ করে হাসতে লাগল। পরম যত্নে ও ছেলেটার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে। স্বাভাবিক ভাবেই এমন দৃশ্যে সারল্য ও জাহ্নবী’র ভড়কে যাওয়ার কথা। তবে ওরা খানিকটা বিস্মিত। চোখেমুখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল ওরা। এই ছেলেটা আবার কে? ভায়োলেটের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক?
ছেলেটা ভায়োলেটকে নামিয়ে দিলো। মুখভর্তি হাসি নিয়ে জানতে চাইলো, ‘আপু এসেছে?’
‘ওই তো আপু।’
‘ইস, এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। তুমি সামনে থাকলে আমার আর কোনোদিকে খেয়াল থাকে না।’
কথাটা বলেই মুখ টিপে হাসলো ছেলেটা। ভায়োলেট একটা মাইর বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘হয়েছে। আসো আপুর সঙ্গে পরিচিত হও।’
ভায়োলেট যুবক’কে নিয়ে এগিয়ে আসছে। এই ভায়োলেটের হাস্যোজ্জ্বল মুখ, উচ্ছ্বলতা আর প্রেমময় চাহনি সবটাই অচেনা জাহ্নবী’র কাছে। এমনভাবে কখনোই ভায়োলেটকে কল্পনাও করেনি সে। জাহ্নবী উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার দৃষ্টিতে বিস্ময়।
ভায়োলেট কাছে এগিয়ে এসে প্রথম কথাটি বলল, ‘আপু, ও রুশো।’
মুহুর্তেই ভূপৃষ্ঠ কেঁপে ওঠার মতো কম্পন অনুভব করল জাহ্নবী। রুশো! নিজেকে সামলে রাখতে পারল না সে। মনে হল এই বুঝি অকস্মাৎ ঝড়ের ঝাপটায় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে সে। সারল্য জাহ্নবীকে ধরে ফেলল। আস্তে আস্তে চেয়ারে এনে বসালো ওকে। ভায়োলেট সময় দিলো ওকে স্বাভাবিক হওয়ার। তারপর টেবিলে নাস্তা দিতে বলে দিলো। মুখোমুখি বসলো ওরা চারজন।
ভায়োলেট জাহ্নবীর চোখে চোখ রেখে বলল ‘আমি জানি তুমি এটার জন্য প্রস্তুত ছিলে না। কিন্তু এখন যেটা বলবো সেটা শোনার পর তুমি আমাকে দোষারোপ করার কথাও ভাবতে পারবে না। আসলে এখান অনেক বড় একটা ব্যাপার আছে। যার কারণে একটা সত্য গোপন করতে হয়েছে আমাকে। আমি হাজার চাইলেও সেই সত্যটা তোমাকে আগে বলতে পারতাম না।’
জাহ্নবী অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে আছে। সে জানতে চায় সব রহস্য। রুশো এখানে কীভাবে আসলো, কীভাবে দেখা হল তাদের? নাকি রুশোর হারিয়ে যাওয়ার গল্পটা নিছক-ই বানানো? হাজারও প্রশ্ন ঘুরছে জাহ্নবী’র মাথায়। সবকিছুর জট না খোলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না সে।
ভায়োলেট বলল, ‘আপু, আমি রুশোর জন্যই এখানে এসেছি। বলতে পারো আমার স্টার্টআপ, বড় হওয়ার চেষ্টাটাও মূলত রুশোর জন্য। যাতে দুজনের একটা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারি। এখানে থাকতে তো আমাদের অর্থের প্রয়োজন হবে।’
জাহ্নবী অস্ফুটে বলে ফেলল, ‘তারমানে রুশোর সঙ্গে তোর যোগাযোগ ছিল?’
‘সত্যি বললে যোগাযোগ ছিল। তবে সেই অর্থে যোগাযোগ নয়। প্রয়োজনের খাতিরে আমরা একে অপরকে আপডেট জানাতাম। আমি আগেই তোমাকে সব বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এটা এমনই এক সত্য, যা কাউকে বলার সুযোগ ছিল না। এতে আমার রুশোর জন্য হুমকিও হতে পারত।’
রুশো জড়িয়ে ধরল ভায়োলেটকে। ওর হাত চেপে ধরে বলল, ‘আই লাভ ইউ ভায়োলেট।’
ভায়োলেট বলল, ‘আপু, আমি জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। রুশো বলুক বাকিটা।’
জাহ্নবী রুশোর দিকে দৃষ্টিপাত করল। রুশোর স্নিগ্ধ মায়াবী মুখ। ভেজা চুলে বড্ড শান্ত দেখাচ্ছে ওকে। দেখেই বিশ্বাস করা যায় এমন একটা মুখশ্রী ওর। জাহ্নবী ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
রুশো বলল, ‘আমি শুনেছি ভায়োলেট আপনাকে কী কী বলেছে। ও আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে যা যা বলেছে সবই সত্যি। এমনকি আমার হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটাও সত্যি। তবে হারিয়ে যাওয়ার পর আমি আবার ওর সঙ্গে যোগাযোগ করি, এটা ভায়োলেট আপনাকে বলেনি। আমার লাইফে একটা বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছিল। শুরু থেকেই বলি। এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে ছিলাম দুদিন। উনি আমাকে এক বাসায় নিয়ে যান। প্রথমদিকে উনি নিজে, পরে ওনার বন্ধু বান্ধব আমাকে বিভিন্ন কায়দায় বোঝায় । মূলত ওরা ছিল একটা জঙ্গী সংগঠন। আমি ওদের কথার ধরনে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে সেখান থেকে চলে আসি। কিন্তু ভাই আমার পিছু ছাড়েনা। উনি কৌশলে আমাকে হাত করল। আমার বুঝে ওঠার আগেই ওরা আমার ব্রেইনওয়াশ করে ফেলেছে। বুঝতে পারলাম আমি ওদের হাতে বন্দি। জালে আটকা পড়েছি কিন্তু বের হবার পথ পাচ্ছিলাম না। আমাকে ওরা ট্রেনিং দেয়। সবকিছু স্পষ্ট মনেও নেই আমার। সম্ভবত মানসিক রোগীর মতো কিছুদিন কাটিয়েছি। আমি ওদের সঙ্গে দুটো অপারেশনেও যাই। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এই পথ থেকে ফিরে আসার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু হঠাৎ আমার একদিন কী হল, আমি ভায়োলেটের সঙ্গে দেখা করলাম। ও আমাকে দেখেই বুঝতে পারল আমি স্বাভাবিক নেই। কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু সেই কিছুটা কী, সেটা আমার মুখ থেকে বের করা ওর পক্ষে অসম্ভব ছিল। কারণ এই পথে যে একবার আসে, সে কোনোদিন কাউকে নিজের সিক্রেট বলে না। তবে ভায়োলেট বুঝে গিয়েছিল। সত্যি বলতে ভায়োলেট না থাকলে আমার ফেরা হতো না। ওর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি সত্যি। তবে ওই একদিনই সে আমাকে এমনভাবে বুঝিয়েছে, আমি ধীরেধীরে উপলব্ধি করতে পারি কীসের ভেতর ঢুকে পড়েছি। কখনো মনে হত সুইসাইড করি, কখনো মনে হতো পালিয়ে যাই, আর কখনো ভাবতাম আত্মসমর্পণ করি। কিন্তু পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। যেখানে পাবে সেখানেই মেরে ফেলবে। এটাই ওদের রুলস। আমি পরে জানতে পারলাম যদি পালিয়ে যাই তখনও ওরা আমাকে খুঁজে বের করবে। কারণ ওদের তথ্য আমি জানি। আর এগুলো প্রকাশ পাবে সেই ভয়ে ওরা আমাকে খুঁজে বের করেই সরাসরি মেরে ফেলবে, কোনো ছাড় নেই। আমার কাছে অস্ত্র ছিল। একদিন সেগুলো ব্যাগসহ বাসার পিছনে ফেলে দিলাম। যোগাযোগ করলাম ভায়োলেটের সঙ্গে। ও আমাকে বলল আত্মসমর্পণ করার প্রয়োজন নেই। এতে আমার পরিবারের জন্য হুমকি হয়ে যাবে। আর আমি নিজেও বাঁচতে পারবো না। ভায়োলেট টাকা পয়সা জোগাড় করে পাঠালো। আমি পালিয়ে এলাম ভারত, তারপর নেপাল। দীর্ঘদিন পর ভায়োলেটের সঙ্গে যোগাযোগ হল। ও আমাকে ওয়াদা করিয়ে ছাড়ল আর কোনোদিন যেন দেশে না ফিরি। ও নিজেই আমার কাছে চলে আসবে। অনেক বছর বাবা মাকে দেখিনা। ওরা ভেবেছিল আমি মরেই গেছি। ভায়োলেটের কারণেই যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে। ওরা শুধু জানে তাদের ছেলেটা বেঁচে আছে, কোথায় আছে সেটা জানে না।’
জাহ্নবী ও সারল্য চুপ করে শুনলো রুশো’র কথা। তারপর সারল্য বলল, ‘আপনি পুলিশকে জানালে তারা আপনার নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতো না?’
রুশো উত্তর দিলো, ‘এই নিরাপত্তায় আমি যেখানেই যেতাম ওরা ঠিকই আমায় খুঁজে বের করতো। আর সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলতো। কারণ আমি পরিচয় গোপন রেখেই পুলিশের কাছে এমন এক তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলাম, যেটা ওদের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়েছে। ওরা আমাকে কিছুতেই ছাড় দেবে না। আজও যদি ওরা আমার খোঁজ পায়, আমি নিশ্চিত এখানে এসে মেরে রেখে যাবে।’
জাহ্নবী উঠে এসে ভায়োলেটকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুই একদম ঠিক কাজ করেছিস বোন। রুশোর এসব কথা কাউকে জানানোর মতো না। এমনকি এখনও আমাদেরকে জানিয়ে ঠিক করলি না। তবে আমাদের ওপর ভরসা রাখ, আমার জান থাকতে এসব কেউ কোনোদিন জানতে পারবে না।’
সারল্য রুশোকে বলল, ‘তবে ভাই তুমি খুব মহান একটা কাজ করেছো ওদের তথ্য ফাঁস করে। লাইফ রিস্ক নিয়েও এমন কাজ কেউ করে না।’
রুশো ভায়োলেটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ও না থাকলে আমি একা একা কিছুতেই পারতাম না। আমি আজীবন এই মেয়েটার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।’
রুশো আরও একবার ভায়োলেটকে জড়িয়ে ধরলো। নাস্তা চলে এলো টেবিলে। নেমে এলো নিরবতা। অনেক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। নিরবতা ভেঙে সারল্য’ই প্রথম কথা বলল, ‘বিজনেস নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা ভায়োলেট। তুমি ওটার প্রতিষ্ঠাতা সবসময় থাকবে। ওটাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমাদের। তোমাদের জন্য আমরা যতটুকু পারি, সর্বোচ্চ করবো।’
ভায়োলেট হাসতে হাসতে বলল, ‘বিজনেসটা আপুর। আমি মাঝেমাঝে ওর কাছে টুকটাক হাত খরচ চেয়ে নেবো।’
জাহ্নবী বলল, ‘হ্যাঁ ওটা আমার। তবে সন্তান মানুষ করলেই মা হওয়া যায় না। জন্ম দিতে হয়। যে ওটাকে জন্ম দিয়েছে, সেও মা। তুই অত বড় উদ্যোগ নিয়ে শুরু না করলে আমার জীবনেও সাধ্য হতো না ওরকম আইডিয়া নিয়ে কাজ করার।’
ভায়োলেট বলল, ‘ব্যবসার কথা থাক। খাওয়া শুরু করো। বাবা মা কেমন আছে?’
জাহ্নবী একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘মাকে আজকাল খুব অচেনা লাগে রে। মানুষটা আর আগের মতো নেই। ঘরে আবদ্ধ থাকতেই যে ভালবাসতো, সে এখন খোলা প্রকৃতির স্পর্শ চায়। আমাকে প্রায়ই ফোন করে চুপ করে থাকে। বুঝতে পারি কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। কিন্তু কিছু বলে না। তবে না বললেও আমি বুঝি।’
‘মাঝেমাঝে মায়ের কাছে যেও। সময় দিও।’
‘মাকে চলে আসতে বলি আমার বাসায়। প্রথম প্রথম আসতো না। এখন ডাকলে আসে। তবে বাবা তোকে টাকা দিয়েছিল শুনে মা যতটা অবাক হয়েছে তার চেয়ে বেশী অবাক হয়েছে তুই টাকাটা ফেরত দিয়েছিস সেটা শুনে। আমি বলেছি বাসার ইন্টেরিয়র করতে যত টাকা লাগবে সব আমি দেবো। মা তো এখন আত্মীয় স্বজন সবাইকে গর্ব করে আমাদের দুই বোনের কথা বলে বেড়ায়।’
ভায়োলেট হেসে বলল, ‘আর মেজোপু কেমন আছে?’
জাহ্নবী খানিকটা উদাস গলায় বলল, ‘ওকে আজকাল ঠিক বুঝতে পারিনা আমি।’
ভায়োলেট দূরের সমুদ্রের দিকে তাকালো। সমুদ্রটাকে ওর খুব রহস্যময় লাগে। মানুষের জীবনটাও সমুদ্রের মতোই রহস্যময়।
খাওয়া শেষ করে ভায়োলেট পুলের এক পাশে এসে দাঁড়ায়। জাহ্নবী এসে দাঁড়াল ওর পাশে। জানতে চাইলো, ‘তুই এখন খুব সুখে আছিস না রে?’
ভায়োলেট বলল, ‘তা তো আছিই। রুশোর কাছে আসার জন্য আমাকে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে সেটা শুধু আমিই জানি। একটা স্টার্টআপ সাজানো, দাঁড় করানো.. এক বছরের বেশী সময় ধরে আমি শুধু প্রস্তুতিই নিয়েছি। কত রিসার্চ, কত স্টাডি, কত ছোটাছুটি! ‘
জাহ্নবী বলল, ‘বাকি জীবনটা তোর খুব সুখে কাটবে রে।’
জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে ভায়োলেট প্রশ্ন করল, ‘তুমি কেমন আছো আপু?’
উচ্ছ্বসিত শোনালো জাহ্নবীর গলা, ‘খুব ভালো রে। আমি যেমন কল্পনা করতাম, একটা বারান্দা থাকবে আমার। খোলা বারান্দা, মাথার ওপর চাল থাকবে না। বৃষ্টি হলেই সেখানে দাঁড়িয়ে ভেজা যাবে। থাকবে একটা আরাম কেদারা, একটা সিগারেটের অ্যাস্ট্রে।’
ভায়োলেট প্রশ্ন করল, ‘আর একটা নিজের মানুষ?’
জাহ্নবী চমকে উঠলো। মুচকি হেসে খানিকটা উদাস গলায় বলল, ‘একটা মানুষ? হুম। সেই মানুষটাকে ভাগ্য করে এভাবে পেয়ে যাবো তা কী কখনো ভেবেছি? প্রকৃতি কীভাবে যেন মানুষের সব শূন্যতা একদিন পূরণ করে দেয়।’
‘সবারই কী দেয়?’
‘অপেক্ষা করলে, মনেপ্রাণে চাইলে, হয়তো দেয়।’
সারল্য এসে জাহ্নবীকে বলল, ‘তুমি সমুদ্রে নামবে বলছিলে না? চলো।’
সারল্য’র হাত ধরে বালিতে নেমে গেল জাহ্নবী। আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে চলে গেল বহুদূর। দূর হতে ভায়োলেট ওদেরকে দেখছিল। জাহ্নবীর জীবনটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, দেখতে আনন্দ হচ্ছে ওর। তবে সামারের জন্য মন খারাপ লাগছে। জীবনটা বড়ই অদ্ভুত, রহস্যময়।
নিজের কাঁধের ওপর রুশোর মাথা অনুভব করলো ভায়োলেট। রুশো দুহাতে তাকে আলিঙ্গন করে বলল, ‘কী হয়েছে আমার পাখিটার?’
‘ভাবছি রুশো। জীবন কী বিচিত্র তাইনা?’
‘হুম।’
রুশোর স্পর্শ স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয় ভায়োলেটের কাছে। এই স্বপ্ন পূরণের জন্য তাকে কম কষ্ট করতে হয়নি। দিনশেষে মানুষ যা চায়, তাই পায়, তবে ছুটতে হয়। ছুটতে না জানলে জীবনে প্রাপ্তির খাতায় কিছুই লেখা হয়ে ওঠে না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দূরের সমুদ্রের দিকে তাকায় ভায়োলেট। উচ্ছ্বসিত জাহ্নবী সমুদ্রের জলে লাফালাফি করছে। পানি ছুড়ছে সারল্য’র দিকে। ওর মনটা ভীষণ ভালো হয়ে যায়। হঠাৎ সমুদ্রের ওপর সুবিশাল আকাশের দিকে চোখ যায় তার। আকাশে তুলোর মতো স্বচ্ছ শুভ্র মেঘ উড়ছে। মেঘগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে ওরা একেকটা ফুল, মেঘের ফুল। তার চিবুক ছুঁয়ে থাকা রুশোকেও এইমুহুর্তে একটা মেঘফুল বলেই মনে হয় ভায়োলেটের।
সমাপ্ত