মেঘবালিকার নিমন্ত্রণে পর্ব-০১

0
276

#সূচনা_পর্ব
#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

গভীর অমানিশা! নিদ্রায় আচ্ছন্ন ইরা হঠাৎ মুখের উপর কারো গরম নিশ্বাস অনুভব করলো৷ আগুন্তক খুবই মনোযোগ দিয়ে ইরার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে নিচ্ছে। ইরা তন্দ্রাঘোর কাটাতে চেষ্টা করলো। বহু ক্লান্তির পর নিদ্রায় ডুবে গিয়েছিল সে। টেনে আঁখি দ্বয় খুলতেই আবছা অন্ধকারে অনুভব করলো কোনো আগুন্তক এর ছায়া। আগুন্তক ইরার উপর ঝুঁকে আছেন। হয়তো অন্ধকারে স্পষ্ট করে দেখার জন্য এতো এগিয়ে এসেছে সে৷ ইরা চমকালো না৷ সে সহজে চমকায় না৷ সে জানে তার জায়গায় অন্য কেউ হলে চিৎকার করতো। ইরা উঠে বসলো। আগুন্তক চমকে সোজা হয়ে দাড়ালো। হয়তো এমনটা আশা করেনি। বেডসাইড টেবিল ল্যাম্পটি অন করে দিলো ইরা। পিটপিট করে তাকালো আগুন্তকের দিকে। আগুন্তকের মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠলো।

‘আপনি চমকান-নি ইমপ্রেসিভ!’

ইরা চোখ ঢলে নিলো। তাকাতেই চমকে গেলো সে। আখিঁ দ্বয় বড়বড় হলো তার। আগুন্তক হাসলো,

‘এবার কিছুটা চমকে গেছেন মনে হয়!

ইরা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। জীবনে প্রথমবার তার জ্ঞান হারাতে ইচ্ছে হলো। আগুন্তক নিজের দিক থেকে বললেন,

‘একচুলি আমি একটা বিপদে পড়ে এখানে এসেছি। আপনার বারান্দার দরজা খোলা ছিল। নাহলে আমি ভেতরে ঢুকতাম না। তবে এতে সুবিধা হয়েছে, আমি নিজেকে সেভ করতে পেরেছি।’

‘আমি কি স্বপ্ন দেখছি?’

আগুন্তক হাসলেন।

‘আপনি একদমই স্বপ্ন দেখছেন না মিস।’

ইরা খাট থেকে নেমে দাড়ালো। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে রুমে এলো ফের। আগুন্তক কে নিজের বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেলো সে৷ আগুন্তক বললেন,

‘কিছু ঘন্টার জন্যে আপনার এই বেডটা আমি নিয়ে নিলাম মিস। আমি একটু ঘুমাবো৷ তার বিনিময়ে যতো টাকা চান পেয়ে যাবেন। গুড নাইট।’

এটাই ছিল রাতের শেষ আলাপ। ইরা মেঝেতে তখনো বিস্মিত হয়ে বসে আছে৷ জীবনের এ পর্যন্ত সে এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। একজন সেলিব্রেটি তার ঘরে! তাও সে যাকে কি না ইরা মাত্রাধিক পছন্দ করে। এই সময়ের জনপ্রিয় একজন ক্রিকেটার মাহির খান!

বাড়িতে গেলে যাকে নিয়ে বাবা মেয়ে তর্ক-বিতর্ক করে। টিভিতে খেলা দেখার ফাঁকে যাকে নিয়ে গসিপ চলে দীর্ঘক্ষণ। ইরা বুঝতে পারছে না সে কি করবে। ক্রিকেটার মাহির খান কি এমন বিপদে পড়লেন যার জন্য তাকে ইরার ঘরে বারান্দা দিয়ে প্রবেশ করতে হলো!

ইরা একজন নার্স। সদ্য নার্সিং পাশ করেছে সে। এই ছোট ফ্ল্যাটে সে একা থাকে চাকরিসূত্রে। তার পরিবার থাকেন ময়মনসিংহ এ।

ইরার ভাবনার মধ্যে মাহির কুঁকড়ে উঠলো। শব্দে চমকে তাকালো ইরা। মাহির কুঁকড়ে গিয়ে বলল, ঘরে ফাস্টএইড বক্স আছে?’

ইরা তৎক্ষনাৎ বের করে দিলো। মাহির এর হাতে চুরির আঘাত। এতোক্ষণ চোখে না পড়লেও এখন পেড়েছে ইরার। সে নিজ হাতে ড্রেসিং করিয়ে দিতে লাগলো। কিভাবে আঘাত লেগেছে সেটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না। এতবড় একজন ক্রিকেটারের সাথে কথা বলা তো দূর সামনে যে দাড়িয়ে আছে তাতেই অস্বস্তি হচ্ছে ইরার।

মাহির নিজ থেকেই বললো, ‘ওই ওদের থেকে বাঁচতে গিয়ে হাতে লেগে গেছে আরকি।’

ইরার ড্রেসিং করিয়ে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। মাহির ঘুমে তলিয়ে গেলো তৎক্ষনাৎ।

সারারাত ইরা দু’চোখের পাতা এক করতে পারলো না। বিস্ময়ে ঘুম বিদায় নিয়েছে অনেক আগে।

সকালের সূর্য উঠতেই মাহির রুম থেকে বের হলো। কিচেনের দিক থেকে শব্দ কানে আসতেই সেদিকে এগিয়ে গেলো। দেখলো ইরা নাস্তা তৈরি করছে।

মাহিরকে দেখে ইরা এগিয়ে এলো।

‘আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই হোক আপনি আমার অতিথি।’

মাহির হাসলো।

‘আপনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি। আমি কয়েক ঘন্টা পরই বিদায় নিবো৷ আপনাকে এতো কষ্ট করতে হবে না।’

‘সেটা তো হবে না স্যার, আপনি অতিথি আমার। না খাইয়ে রাখি কি করে?’

মাহির মাথা চুলকে চলে গেলো। ইরা সব খাবার টেবিলে রেখে নিজেও ফ্রেশ হয়ে নিলো। সকালের জন্য খুবই সাধারণ খাবার। ইরার মাথায় অন্য চিন্তা। আজ তার ডিউটি আছে। ফোন করে কয়েক ঘন্টা ছুটি নিয়ে নিয়েছে সে।

খাবার খেয়ে মাহির বারান্দা দিয়ে নিচে তাকিয়ে রইলো।গেইটের সামনে কালো রঙের টয়েটো গাড়িটা এসে থামতেই সে মুখে মাক্স পড়ে নিলো। ইরার দিকে কৃতজ্ঞতা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলো।

সেই যে চলে গেলো, তারপর এক বছর হয়ে গেলো তাদের কখনো আর দেখা হয়নি। ইরা জানে দেখা হবে না। সেলিব্রিটি মানুষের সাথে তার মতো সাধারণ মানুষের দেখা হওয়াটা অপ্রত্যাশিত বটে। কিন্তু তবুও ইরার মনের কোথাও আজও সেই অন্ধকারের আবছায়া ফটোফ্রেমের মতো আটকে আছে। ইরা নিজের মনকে শাসায়। কোথায় চাঁদ আর কোথায় ব্রাহ্মণ্য! এই জীবনে তাদের আর দেখা না হোক।

কিন্তু মন কি বারণ শুনে? তার মস্তিষ্ক জানে সে সেই মানুষটার কাছে তেমন ইম্পর্ট্যান্ট কেউ নয়। হলে নিশ্চয়ই মানুষটা তার নাম জানতে চাইতো? মাহির খান ইরার নাম পর্যন্ত জানেন না। কখনো যদি দেখা হয় তো চিনতেও পারবেন না হয়তো। এতো বড় একজন মানুষ তার মতো একজন সাধারণ মেয়েকে মনে রাখতে যাবেন কোন দুঃখে?

মাহির খানকে টিভিতে দেখে যায় ইরা। এতো সুদর্শন একজন পুরুষ নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ড আছে। সেখানে তার চান্স শূন্য। কোনোদিক থেকেই তার কিছু নেই। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বড় হওয়া ইরা অনেক কষ্টে পড়াশোনা করেছে। তার আরেকটা গোপন পরিচয় আছে। সে লেখালেখি করে। বই বের হয়েছে আটটা। কিন্তু সেটা কেউ জানেন না। পরিবারের কেউ সাহিত্য কি তা বুঝেন না। মা বাবা পড়াশোনা করেন নি তেমন। ইরার একটি ছোট ভাই আছে। যে এইবার কলেজে পড়ছে। গোপন এই পরিচয়ে ইরার অনেক খ্যাতি রয়েছে। ফেসবুকে তার বর্তমান ফলোয়ারস পঞ্চাশ হাজার। রাইটার পেইজ ফলোয়ারস একশ হাজার ছাড়িয়ে। বাস্তব জগতে ইরাকে কেউ লেখিকা হিসেবে চিনে না। তার পাঠকেরা কখনো লেখিকা ইরাবতী আমিন কে দেখেনি। ইরাবতী শুধু লিখেই যায়। অটোগ্রাফও দেয় গোপনে। কিন্তু কখনো কাউকে দেখা দেওয়া হয়নি। সে রহস্য করতে পছন্দ করে। ইতিমধ্যে তার অনেক পাঠককেই সে দেখেছে। তার অনো ক্লাসমেইট তার লেখার ভক্ত ছিল। তারা লেখিকা ইরাবতী আমিনের অনেক গল্প করেছে তার কাছে। ইরাবতী শুধু হাসতো। রহস্যময় এই দুনিয়ায় সামান্য রহস্য করতে পেরে তার দারুণ আনন্দ হয়!

ইরাবতী জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। আকাশ কালো হয়ে আছে। বৃষ্টি নামছে যখন-তখন। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ইরার মন খারাপ হয়ে গেলো। আজ তার জন্মদিন। সেটা মাত্রই মনে পড়লো তার। ইতিমধ্যে তার ফেসবুক একাউন্টে অজস্র উইশ জমা হয়ে গেছে। ইরাবতী ডাটা অফ করে রাখলো। অঙ্গে জড়িয়ে নিলো নীল রঙের একটি শাড়ি। মুঠোফোন চেপে পছন্দের একটি গান ছেড়ে দিলো। বিষন্ন আকাশ থেকে টপাটপ করে বারান্দায় বৃষ্টির ফোঁটারা পড়তে শুরু করেছে তখন। ইরাবতী বারান্দায় চলে গেলো। দুহাত দু’দিকে মেলে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে গুনগুন করলো বিষন্ন মনে।

‘এই মন কেমনের জন্মদিন।
চুপ করে থাকা কঠিন,
তোমার কাছে খরস্রোতাও গতিহীন।
নতুন সকাল গুলো কপাল ছুলো তোমারই..
দূরে গেলেও এটাই সত্যি তুমি আমারই
শুধু আমারই…

বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার ইরাবতী। অঙ্গে লেপ্টে আছে শাড়ি। শ্যামলা পেট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এই মুহুর্তে যদি কোনো পুরুষ ইরাবতীকে দেখতো তো প্রেমে আছাড় খেয়ে পড়তো। গানের পর গান পাল্টে গেলো। ইরাবতী গুনগুন করলো।

‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন,
কাছে যাবো কবে পাবো ওগো তোমার__নিমন্ত্রণ!’

মেঘবালিকার নিমন্ত্রণ কি তবে পৌঁছে যাবে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত ক্রিকেটার মাহির খানের কাছে? ব্যাট দিয়ে ছক্কা মারতে মারতে কি তার একবারও ইরাবতীর কথা মনে পড়েনি? অনুভব হয়নি কেউ তাকে অদূর বাংলাদেশ হতে মন কেমনের বৃষ্টির দিনে প্রেমের নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে!

ব্যাট নিয়ে মাঠে নামতে নামতে মাহিরের শরীরে বাতাস লাগলো। বুক ধক করে উঠলো। অস্ট্রেলিয়ার আকাশে মেঘ জমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে!

(চলবে)