মেঘবালিকার নিমন্ত্রণে পর্ব-১৩

0
130

#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#পর্ব-১৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

রাত নয়টা। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাহিরে তুমুল বর্ষণ। বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে নিস্তব্ধ রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে একটি কালো টয়েটো কার। বৃষ্টির ঝাপটায় বাহিরের সবকিছু অস্পষ্ট। মাহির তবুও জ্বলজ্বল চোখে কাউকে খুঁজতে চেষ্টা করছে। রাস্তার মোড় ঘুরলো। অন্ধকার রাস্তায় চোখ পড়তেই দোকানের একটি সিঁড়িতে সোডিয়ামের আলোয় কাউকে বসে থাকতে দেখলো। মাথা সম্ভবত নিচু করা। শাড়ির রঙ দেখে মাহির নিশ্চিত হয়ে গেলো নারীটি কে।

হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে ব্যস্ত ইরা। দিনদুনিয়া খেয়াল নেই তার। তন্মধ্যে তার সামনে এসে দাড়ালো দুটো পা। ইরাবতী শব্দ পেয়ে চমকে মুখ তুলে তাকালো। সোডিয়ামের আলোয় ব্যক্তিটির মুখ হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। কিন্তু তাকে চিনতে একটুও অসুবিধে হলো না ইরার। ইরা কান্না ভুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সামনে দাঁড়ানো প্রিন্সের মতো দেখতে পুরুষটির দিকে।

মাহির রাগে কাঁপছে। ইরাবতীর হাত ধরে টেনে দাঁড় করালো। নিজের সাথে চেপে ধরলো শক্ত করে।

‘মেরে ফেলবো, একদম মেরে ফেলবো।’

ইরা মাথা নিচু করে রেখেছে। মাহির ইরার নিচু করে রাখা মুখটা হাতের সাহায্যে উঁচু করলো।

‘কি করেছেন আপনি জানেন? বাড়ির সবাই আপনার চিন্তায় অস্থির। আর আপনি কি না এখানে বিরহে কাঁদতে ব্যস্ত।’

ইরা নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। মাহির ছাড়লো না। বরং নিজের সাথে চেপে ধরলো সর্বশক্তি দিয়ে।

‘এতো মোচড়ামুচড়ি করছেন কেন?’

ইরা শান্ত হয়ে গেলো। মাহির দু’হাত দিয়ে ইরার মুখটা তুলে ধরলো। তিরতির করে কাঁপছে ইরার ঠোঁট। সাথে ভেজা শাড়ি লেপ্টে গেছে অঙ্গে। মাহির নিজেকে আটকে রাখলো না। বরং ডুবে গেলো ইরাবতীর তিরতির করে কাঁপতে থাকা ওষ্ঠে।

ইরাবতী চোখ বড়বড় করে নিলো। যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারলো তখন তার হাতে কিছু নেই। আকাশ থেকে বৃষ্টিরা ছোঁয়ে যাচ্ছে দুজনের ঠোঁটের ফাঁকফুকুর। ইরাবতী গভীর আবেশে চোখ বন্ধ করলো।

বজ্রপাতের শব্দে মাহিরের হুস এলো যেনো। ঠোঁট ছেড়ে ইরাবতীর ঘাড়ে মুখ রেখে জোরে জোরে শ্বাস ফেললো। ডাকলো,

‘ইরা, ইরা, ইরা।’

ইরা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। মাহির আবারও ডাকলো,

‘ইরা, ইরা, ইরা আমার ইরা।’

ইরা এবার শব্দ করে কাদছে। মাহির ইরাবতীকে তেমন অবস্থাতেই কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো গাড়ির দিকে।

গাড়ির ড্রাইভিং সিটে ইরাকে নিয়েই বসলো। ডোর লক করে ইরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলো শক্ত করে। ইরা কাঁদতে ব্যস্ত। কাঁদুক মাহির বাঁধা দিবে না। মাহির গাড়ি থেকে মোবাইল বের করে ইশানকে মেসেজ করলো। জানিয়ে দিলো তারা সোজা খান বাড়িতে যাবে। ইরাকে নিজের কোর্ট পড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘আপনার এ রুপ যেন আমি ছাড়া আর কেউ না দেখে ইরা। মেরে ফেলবো, একদম মেরে ফেলবো।

মাহির প্রায় আধাঘন্টা মোবাইলে কাজ করলো। ততোক্ষণে ইরার কান্না থেমে গেছে। সে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। মাহির সিট বেল্ট বেঁধে ইরাকে নিজের সাথে নিয়েই গাড়ি স্টার্ট করলো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

সাইনবোর্ডে বড়বড় অক্ষরে লেখা ‘কাজি অফিস।’ মাহির সেখানেই গাড়ি থামালো। তারপর ইরাকে আবারও কাঁধে তুলে নিলো। উদ্দেশ্য কি বুঝতে পেরে ইরাবতীর চোখ বড়বড় হয়ে গেলো।

সাদা পাঞ্জাবি পড়া কাজি বড় আতংক নিয়ে বসে আছেন। তার দু’পাশে দাড়িয়ে আছে নিবিড় ও নাবিদ। সৈকত ছুরি হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে। মাহিরকে দেখে উঠে দাড়ালো সে। ইরার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হেসে বলল,

‘সুন্দরী নার্সকে শেষমেশ পটিয়ে নিলে বন্ধু। কোথায় আমি ভেবেছিলাম একটু আধটু চান্স নিবো।’

মাহির কিছু বললো না। ইরাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে দিলো। কাজি বড়বড় চোখে মাহিরকে দেখছেন।

‘আপনি ক্রিকেটার মাহির খান না?’

মাহির মাথা নাড়ালো। তিনি এবার বিস্ময় নিয়ে বললেন,

‘হায় আল্লাহ। আপনি কি না এভাবে বিয়ে করবেন।’

‘তো?’

ভদ্রলোক কে এবার খুশি হতে দেখা গেলো।

‘আমার কি সৌভাগ্য বাংলাদেশের একজন ক্রিকেটারের বিয়ে আমি নিজে পড়াবো। তাও কি না গোপন বিয়ে।’

মাহির রেগে বলল,

‘গোপন বিয়ে মানে? কোনো গোপন বিয়ে না। সময় হলে এমনি মিডিয়ায় খবর পৌঁছে যাবে। আপনি আপনার কাজ করুন।’

এতোক্ষণে মুখ খুললো শাওন।

‘উকিল মা-বাপ কাকে দিবি? সাক্ষী কে?’

নাবিদ হৈহৈ করে উঠলো,

‘আমি উকিল বাপ হবো দোস্ত।’

সৈকত শব্দ করে হেঁসে ফেললো। মাহির নিজেও শরীর দুলিয়ে হাসছে। ইরা এদের কান্ড দেখে মাথা নিচু করে হাসলো। কাজি সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন,

‘আপনিই হবেন?’

মাহির হাসি থামিয়ে বলল,

‘আরে না কাজি সাহেব। ও তো আমার বন্ধু। আমি ব্যবস্থা করেছি তারা ইতিমধ্যে অর্ধেক পথ চলে এসেছেন মনে হয়। আরেকটু অপেক্ষা করুন।’

নাবিদ মুখ ভেংচি কাটলো,

‘আমি থাকতে অন্য কেউ কেন মামা? তোর বউকে দিন-রাত মা মা করে মুখে ফ্যানা তুলতাম, সেটা মানলি না। এবার দেখিস ভাবি হিসেবে কি কি করি। তোকে যদি জ্বলিয়ে পুড়িয়ে..

নাবিদের কথা থেমে গেলো। দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন দুজন ব্যক্তি। তাদের দেখে মাহির উঠে দাড়ালো। সালাম দিয়ে বললো,

‘আসুন আঙ্কেল আন্টি।’

দুজনকে বসতে দেওয়া হলো। কাজি চশমা টেনেটুনে বললেন, ‘আপনারাই উকিল মা বাপ হবেন?’

শাওন হতভম্ব হয়ে বলল,

‘মা তুমি…

শাওনের মা মুখ ঝামটি মারলেন।

‘সোনার টুকরো মেয়ে। বলেছিলাম পটাতে পারলে পটিয়ে নে। পারলি না। মাহির বাবা ঠিক পটিয়ে নিলো দেখলি তো।’

শাওনের বাবা হেসে ফেললেন। তাদের মাহির মেসেজে সব বলেছে। বাকিটা তার বন্ধুরা সামলে নিয়েছে।

শাওনের মা বললেন,

‘কনের মাথায় কাপড় নেই কেন?’

মাহির ইরার শাড়ির আঁচল ধরলো। কিন্তু তা ভেজা। অগত্যা হেসে বলল,

‘পরের বার না-হয় মাথায় কাপড় দিবে আন্টি। আজ আমিই তার মাথার কাপড় হই।’

শাওনের মা মুগ্ধ হলেন। শাওনকে ইশারায় বুঝালেন, ‘শিখ। দেখে কিছু শিখ।’

মাহির নিজের দু’হাত ইরাবকীর মাথার উপরে মেলে ধরলো।

‘কাবিন পাঁচ লাখ দিন।’

কাজি বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। মাহিরকে কবুল বলতে বলা হলে সে ইরার নিচু মুখের দিকে তাকালো। তার মনে হলো,

‘এই অসম্ভব সুন্দর মনের মেয়েটিকে তার ভালোবাসা উচিত।’

মাহির কবুল বললো। কাজি ইরাকে কবুল বলতে বললেন। ইরা এবার নড়েচড়ে বসলো। মুখ তুলে আড়চোখে মাহিরকে দেখে নিলো। ফিসফিস করে বলল,

‘ইরাবতী দয়া নিতে পছন্দ করে না ক্রিকেটার।’

‘ক্রিকেটার মাহির খান আপনাকে দয়া করছে না ইরাবতী। যদি পারেন আপনি দয়া করে বিয়ে করে তাকে ঠকিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে নিন। ইরাবতী আমিনকে না পেলে মাহির খান ঠকে যাবে যে ম্যাডাম।’

ইরা তিনবার কবুল বলে ফেললো। কাজি মোনাজাত শেষ করলেন। শাওনের মা দুজনের হাত এক করে দিলেন।

‘সুখী হও বাবা।’

ইরাবতীর সব স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হলো। তলপেটে মুচড় দিয়ে উঠলো হঠাৎ। চিনচিনে ব্যথায় ঠোঁট কামড়ে ধরলো সে। কাজি অফিস থেকে বেরিয়ে সবাই গাড়িতে উঠলো। শাওন, সৈকত, নাবিদ ও নিবিড় নিজেদের গাড়িতে চলে গেলো আগে আগে। শাওনের মা বাবা ও চলে গেলেন। মাহিরের হাতের ভাঁজে তখনো ইরাবতীর হাত। মাহির ইরাকে আবারও কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো গাড়ির দিকে।

মাহিরের উপর চেপে বসে আছে ইরা। মাহির কিছুটা নির্জনে এসে গাড়ি থামালো। ইরাকে খেয়াল করেছে সে। বলল,

‘কোনো সমস্যা হচ্ছে?’

ইরা ঠোঁট কামড়ে ব্যাথা সহ্য করছে। মাহির ব্যস্ত হলো।

‘না বললে বুঝবো কিভাবে বউ?’

‘মনে হয় মেয়েলি প্রব্লেম হয়ে গেছে।’

মাহির চিন্তিত স্বরে বলল,

‘পেটে ব্যাথা করছে তোমার? বলোনি কেন এতোক্ষণ?’

মাহির ইরার উন্মুক্ত পেটে হাত রাখলো। ইরা লজ্জিত হলো।

‘মনে হচ্ছে আপনার প্যান্টা টা নষ্ট হয়ে গেছে।’

মাহির চোখে চোখ রাখলো। কানে চুল গুঁজে দিয়ে বলল,

‘হয়ে যাক।’

ইরা কিছু বললো না। ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো। মাহির বুঝলো ইরা ব্যথায় ভিতরে ভিতরে কাতরাচ্ছে। সে গাড়ি ড্রাইভ করা শুরু করলো। থামালো ইরার হসপিটালের সামনে। হসপিটালের সামনের ফার্মেসি গুলো অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে।

‘কোনটা আনবো?’

‘জয়া।’

‘কোনো ঔষধ খাও?’

ইরা ঔষধের নাম বলে দিলো। মাহির ইরাকে সিটে বসিয়ে ডোর লক করে বেরিয়ে গেলো। ইরা কাচ নামিয়ে ডেকে বলতে চাইলো মাক্স পড়ে যান। কিন্তু ততোক্ষণে মাহির চলে গেছে।

ফার্মেসিতে গিয়ে মাহির তাড়াহুড়ো করে বলল,

‘এক প্যাকেট জয়া দিন।’

ভদ্রলোকের মুখের হা টা ভয়াবহ রকমের বড় হলো। মাহির তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারলো সে মাক্স পড়েনি। কিছুটা ইতস্তত করে বলল,

‘এক ঘন্টা আগেই বিয়ে করেছি। বউ গাড়িতে বসে আছে। আপনি যদি জলদি করে আমাকে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো দেন তাহলে আমি জলদি ফেরত যেতে পারি।’

ভদ্রলোক খাতা ও কলম এগিয়ে দিলেন।

‘একটা অটোগ্রাফ অলরাউন্ডার।’

মাহির তড়িৎ গতিতে অটোগ্রাফ দিলো। ভদ্রলোক তাতেও থামলেন না। একটা সেলফি তুলে নিলেন। তারপর মাহিরকে প্রয়োজনীয় ঔষধ ও জয়ার প্যাকেট প্যাক করে দিলেন। মাহির টাকা দিতে চাইলে তিনি নিলেন না। বরং বললেন,

‘আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারবো তার বিনিময়ে?’

মাহির নিজেই এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বৃষ্টি মাথায় করে দৌড় দিলো অন্ধকার রাস্তার দিকে। গাড়িতে উঠে বসে ডোর আবারও লক করলো। ইরার দিকে সব এগিয়ে দিয়ে। গাড়ির বক্স থেকে বের করলো টিশার্ট টাউজার। সেগুলো ইরার দিকে এগিয়ে ধরলো।

‘কাপড় চেঞ্জ করো আগে। পেছনে চলে যাও।’

ইরা ইতস্তত করলো। মাহির বুঝতে পেরে বলল,

‘আমি তাকাবো না পেছনে।’

ইরা কাপড় ও জয়ার প্যাকেট নিয়ে পেছনে চলে গেলো। মাহির সামনের দিকে শক্ত হয়ে তাকিয়ে রইলো। তার নির্লজ্জ মন বার-বার চাইছে পেছনে থাকাতে। মাহিরের হঠাৎ লুকিং গ্লাসে চোখ পড়লো। গলা শুকিয়ে গেলো তার। ঢুক গিলে নিজেকে ঠিকঠাক রাখতে চেষ্টা করলো। ইরা সামনে এসে বসলো। মাহির ইরার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘তোমাকে বড্ড আবেদনময়ী লাগছে ইরা।’

ইরার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে লাগলো। মাহির এক টানে নিজের শার্ট খুলে ফেললো। ইরাকে চমকে যেতে দেখে হেসে বলল,

‘ভেজা কাপড় শরীরে রাখতে ইচ্ছে করছিল না। এভাবেই ড্রাইভিং করবো।’

ইরা ঔষধ খেয়ে নিলো। চোখ তুলে নির্লজ্জের মতো মাহিরকে দেখতে লাগলো। মাহির গাড়ি থামিয়ে ইরাকে নিজের উপর বসিয়ে সিট বেল্ট বাঁধলো। বলল,

‘তোমাকে এভাবে রেখে ড্রাইভিং করতে ভালো লাগে।’

ইরা ঘোরের মধ্যে ছিল যেনো। এতোক্ষণে খেয়াল করলো মাহির তাকে বিয়ের পর থেকেই তুমি বলে ডাকছে। ইরার ভাবনার মাঝে তার কপালে ছুয়ে গেলো একটি উত্তপ্ত ঠোঁট। ঠোঁটের মালিক যেনো বুঝিয়ে দিলো,

‘ইরা, ইরা, ইরা। আমার ইরা। শুধুই আমার।’

(চলবে)