মেঘবালিকার নিমন্ত্রণে পর্ব-০২

0
160

#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#পর্ব-০২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

বাতাসে গুনগুন আওয়াজ। তীব্র বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে চারিদিকে। সময়টা মধ্যরাত। ডিউটিতে ব্যস্ত হসপিটালের সব নার্স ও ডক্টররা। পাইভেট মেডিক্যাল এর থাই গ্লাস দিয়ে বাহিরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুয়ার চেষ্টা করছে সাদা অ্যাপ্রোন পরিহিত একটি মেয়ে। পড়োনের সুতির সবুজ শাড়িটা কিছুটা অগোছালো। মাথার চুল উষ্কখুষ্ক। ডিউটির ফাঁকে বৃষ্টি বিলাস করার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু মাঝে মধ্যে কয়েক ফোঁটা হাতে এসে পড়লেও পুরোপুরি বৃষ্টি পড়ছে না। রমনীর বৃষ্টি বিলাসে ব্যাঘাত ঘটাতে তীব্র জোরে সাইরেন বাজিয়ে হসপিটালের গেইট দিয়ে ঢুকলো একটি এ্যাম্বুলেন্স। হসপিটালের সব নার্স ডক্টর তৎক্ষনাৎ ছুটলো সেদিকে। রমনীর ভ্রু কুঁচকে গেলো। স্টেচার নিয়ে দুজন গেলেই এনাফ সেখানে সবাই ছুটে যাচ্ছে কেন? কৌতূহল নিয়ে সে উঁকি দিলো নিচে। এ্যাম্বুলেন্স থেকে বের করা হলো একজন গর্ভবতী নারীকে। প্রসবের বেদনায় ছটফট করছে সে। রমনীর বোধগম্য হলো এ্যাম্বুলেন্সে করে আসা সবাই নিশ্চয়ই বড়লোক কোনো বাড়ির মানুষ। তখনই তার চিরচেনা সেই কালো টয়েটো গাড়ি এসে থামলো এ্যাম্বুলেন্স এর পেছনে। প্রায় দেড় বছর পর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির গাড়িটা দেখে চিনতে একদম ভুল হলো না ইরার!

কালো টয়েটো গাড়ি থেকে দুজন বডিগার্ড সহ নেমে এলো জাতীয় দলের ক্রিকেটার মাহির খান। ততোক্ষণে প্রসব বেদনায় ছটফট করা নারীটিকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মাহির খানের পর গাড়ি থেকে নেমে এলেন আরও অনেকজন। এক ঘন্টার ভেতরে পুরো হাসপাতাল চত্বরে একের পর এক গাড়ি এসে থামলো। প্রাইভেট মেডিক্যাল এর সবচেয়ে বেস্ট ডক্টর ও নার্সদের নিযুক্ত করা হলো সেই রমনীর চিকিৎসার জন্য। হসপিটালের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাড়িয়ে বা বসে আছেন গর্ভবতী নারীটির সব আত্নীয় স্বজন। ইরাবতী অপারেশন থিয়েটারে। বাকি ডক্টর নার্সদের সাথে তাকেও ঢুকতে হয়েছে।

খান গোষ্ঠীর সবার আতংক কমাতে অপারেশন থিয়েটার থেকে ভেসে এলো সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া এক নবজাতকের আত্নচিৎকার। পৃথিবীর আকাশ বাতাস মানবজাতি সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে যেন আমি এসে গেছি।

বাচ্চার বাবার নাম মাহতাব খান। সম্পর্কে মাহিরের একমাত্র বড় ভাই। সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চার বাবা সে। পরিবারের সবার মুখে হাসি। কিন্তু চিন্তিত মাহতাব। মাহির ভাইকে জড়িয়ে ধরেলো,

‘ডোন্ট থিংক ব্রো। আওয়ার চ্যাম্প ইজ কাম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। সো বি ইজি ম্যান।’

মাহতাব ফুপিয়ে উঠলো।

‘ও যেন সুস্থ থাকে ভাই। আমার আর কিছু চাই না।’

মাহির মাক্সের আড়ালে হাসলো। তার ভাইটা বড্ড ভালোবাসে নিজের প্রিয়তমাকে। সে পিঠ চাপড়ে সাহস দিলো।

ইরার কোলে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটি। উত্তেজনায় হাত কাঁপছে ইরার। এর আগে প্রথম যখন কাজে যোগ দিয়েছিল তখন এমন হতো তার। কিন্তু সেটন অভ্যাসে পরিণত হওয়ার কারণে নার্ভাসনেস কেটে গেছে অনেক আগে। আজ অনেকদিন পর ইরার হাত পা কাঁপতে লাগলো। মাহির খানের পরিচিতদের কারো বাচ্চা বলেই কি এই কাঁপা-কাঁপির কারণ তবে? ডক্টর ইরাকে বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে যেতে বললেন। ইরা ধীর পায়ে হেঁটে বাচ্চা নিয়ে বের হলো। খান পরিবারের সবার তখন একসাথে এদিকেই তাকিয়ে। মাহিরের মা মিসেস মমতা খান এগিয়ে এলেন। নবজাতককে দেখে চোখে অশ্রু নিয়ে হাসলেন। মাহির মাহতাবকে টেনে নিয়ে এলো।

‘নিজের প্রথম সন্তানকে কোলে নাও ভাইয়া।’

সেই কন্ঠ। ইরার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো। অপারেশন থিয়েটারে ঢুকার সময় যে মাক্স ইরা পড়েছিল সেটা এখনো লাগানো তার মুখে। সুতরাং মাহির তাকে চিনতে পারবে না। মাক্স হীন থাকলেও চিনতে পারতো কি না সন্দেহ! মাহির নিজের মাক্স খুলে ফেলেছে অনেক আগে। ইরার দিকে না তাকিয়ে বলল ‘ভাইয়ার কোলে দিন চ্যাম্পকে।’

মাহতাব কাঁপা কাঁপা হাত মেলে দিলো। ইরা মাস্কের আড়ালে হাসলো। সদ্য জন্ম নেওয়া নিজের বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো মাহতাব। কপালে চুমু খেলো নিবিড়ভাবে। কানে আযান দিলো নিজের সন্তানের। মাহতাবের কোল থেকে একে এক সবাই কোলে নিলো। সবার শেষে নিলো মাহির। মমতা খানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চ্যাম্প আমার মতো দেখতে হয়েছে তাই না মা?’

তখনই একটি কিশোরী মেয়ে পাল্টা উত্তর দিলো, ‘একদম না সে আমার মতো দেখতে হয়েছে।’

‘একদমই নয় মেহের, চ্যাম্প আমার মতো দেখতে হয়েছে।’

মাহির ও মেহের কথা কাটাকাটি করতে লাগলো। মমতা খান দুজনকে ধমকে থামিয়ে দিলেন। নবজাতককে নিজের কোলে নিয়ে ইরাকে বললেন, ‘আমাদের ঘরের লক্ষী সুস্থ আছে তো?’

ইরা হেসে মাথা নাড়িয়ে মাহিরের পাশ দিয়ে চলে গেলো। যেতে যেতে আড়চোখে দেখতে ভুললো না। ঠিক কতোদিন পর মানুষটাকে দেখছে সে। কয়েকঘন্টায় ভালো করে খেয়াল করেনি সেদিন। তবে আজ ভালো করে দেখে নিচ্ছে। কি আছে মানুষটার মধ্যে।

ফ্রেশ হয়ে ইরাবতী ফিরে এলো। ততোক্ষণে মাহতাবের স্ত্রী নাতাশাকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। ডক্টরের সাথে ইরাবতী সেই কেবিনে প্রবেশ করলো। আগের মতো মাক্স পড়া নেই আর। কেবিনে প্রবেশ করতেই চোখ কপালে ডক্টরের। ইরাবতীকে ফিসফিস করে বললেন, ‘বুঝলে ইরা বড়লোক বাড়ির কাজকর্মই আলাদা। হসপিটালের সবচেয়ে বড়ো ও আধুনিক কেবিনটা নিয়ে নিলো। গোষ্ঠীর কেউ মনে হয় বাকি নেই আর। সবাই এখানে।’

ইরা হেসে ফেলল শব্দহীন। নাতাশার সবকিছু চেক করে ডক্টর ডিটেইলস এ সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ইরা বেবিকে খাওয়াতে হবে বলে নাতাশাকে ইশারা করলো। নাতাশা বুঝতে পারলো না কিছু। অগত্যা ইরা নিজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।

‘আপনারা যদি এখন কেবিনটা খালি করে দিতেন তাহলে ভালো হয়। বাচ্চা ও মায়ের একান্ত সময় প্রয়োজন।’

ইরার কথা বলার মধ্যেই মাহিরের অবাক দৃষ্টি নিজের দিকে আছে সেটা দেখে নিলো। গলা শুকিয়ে গেলো তার। মমতা খান বললেন,

‘আমি বউমাকে সাহায্য করতে পারবো। আপনাকে দরকার হবে না আসতে পারেন।’

থমথমে পায়ে ইরা তৎক্ষনাৎ প্রস্থান করলো। কেবিনের বাহিরে হাঁটতে হাঁটতে সে যখন জানালার কাছে পৌঁছালো তখনই কানে ভেসে এলো সেই পরিচিত কন্ঠস্বর।

‘হাই মিস! চিনতে পেরেছেন?’

ইরা অবাক হয়ে তাকালো। মানুষটা তবে তাকে মনে রেখেছে। ভাবতেই ইরার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। মাহির এগিয়ে এসে দাঁড়ালো ইরাবতীর নিকট।

‘কেমন আছেন আপনি?’

ইরার গলা যেনো কেউ চেপে ধরেছে। শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিক হয়ে গেলো তার। হাস ফাঁস করতে লাগলো সে। মাহির ইরাবতীকে দেখে নিয়ে বলল, ‘আপনি কি অসুস্থ?’

ইরা মাথা নাড়িয়ে না করলো।

‘কবে হাঁপাচ্ছেন কেন?’

কি বলা উচিত ভেবে পেলো না ইরা। মাহির চিন্তিত স্বরে বলল, ‘আপনি আমায় চিনতে পেরেছেন তো মিস? ওইযে প্রায় দেড় বছর আগে আপনি আমাকে আশ্রয় দিলেন। মনে নেই?’

ইরা দৌড়ে প্রস্থান করলো। মাহির অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবলো কি হলো এটা!’

হসপিটালের একটি ওয়াশরুমে দাড়িয়ে হাঁপাচ্ছে ইরা। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল এতোক্ষণ। এভাবে দৌড়ে আসাতে মাহির নিশ্চয়ই চমকে গেছে? সে কি এখন ইরাকে নিয়ে ভাবছে? ইরার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। মাহির নিশ্চয়ই এবার তাকে নিয়ে চিন্তা করবে। অ-প্রেমিকের মস্তিষ্কে নিজেকে নিয়ে ভাবনার সূত্রপাত করতে পেরে ইরার দারুণ আনন্দ হলো। মুহূর্তেই ঠিক হয়ে গেলো সে। ওয়াশরুমের আয়নার তাকিয়ে বার-বার লজ্জা পেয়ে মুখ ঢাকতে লাগলো। এই এডাল্ট বয়সে এসে এমন আবেগি হওয়া ইরাকে মানায় কি না সেটা নিয়ে আপাতক ভাবছে না সে। সে শুধু বর্তমান উপভোগ করছে। সবকিছুই উপভোগ করা উচিত। বয়সের মাপকাঠিতে কেন সে নিজেকে সঁপে দিবে?

ইরা প্রায় দশ মিনিট পর বের হলো। বের হয়েই সম্মুখে মাহির কে স্বয়ং উপস্থিত থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেলো সে। মাহির তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ইরার দিকে এগিয়ে এসে প্রথমবারের মতো জিজ্ঞেস করলো,

‘আপনার নাম টা?’

‘ইরাবতী আমিন!’

(চলবে)