মেঘবালিকার নিমন্ত্রণে পর্ব-০৩

0
146

#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#পর্ব-০৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

চারিদিকে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশে পেজা তুলোর মতো মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাহির মেঘময় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘আপনার নামটা কোথাও শুনেছি, কোথায় শুনে থাকতে পারি বলুন তো?’

ইরা চমকালো,

‘কোথায় শুনেছেন?’

মাহির কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,

‘আ হ্যা মনে পড়েছে। মেহের এই নামে একজন রাইটারের বই পড়ে। বাই এনি চান্স আপনি কি..

‘আমি সে নই, এক নাম অনেকেরই হতে পারে।’

ইরাবতী কোনোদিকে না তাকিয়ে দ্রুত প্রস্থান করলো। মাহির অবাক চোখে তাকিয়ে ইরাবতীর প্রস্থান দেখতে লাগলো। বিরবির করলো, ‘ইরাবতী আমিন! নামটায় কি সেকেলে ভাব আছে?

মাহির ইরাবতীর যাওয়ার দিকে ফের তাকালো। অগোছালো সবুজ সুতির শাড়ি চোখে পড়তেই ফের বিরবির করলো।

‘উমম ভারতের নব্বই দশকের হিরোইন দের মতো ভাইব আছে তো! নামটাও সেরকমই! মন্দ না।’

দুদিন পর নাতাশাসহ খান পরিবারের সবার বিদায় নিলেন হসপিটাল থেকে। কিন্তু এরমধ্যে মাহির খানকে দেখেনি ইরাবতী। সেদিন প্রস্থান করে সে নিজেও আফসোস করেছে। মানুষটা কতো আগ্রহ দেখিয়ে তার সাথে কথা বলছিল। আর সে কি না চলে এলো! মাহির খান নিশ্চয়ই তাকে ভাবওয়ালী ভাবছে? মাহির এখন নিউজিল্যান্ডের মাঠে ছক্কা মারার প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। নিউজে সবই দেখেছে ইরাবতী৷ ডিউটিরত অবস্থায় খেলা দেখার সময় নেই বলে আবারও আফসোসে ডুবে গেলো সে। এই দুই তিন দিনে মেহেরের সাথে ভাব হয়েছে তার। মেহের যে লেখিকা ইরাবতী আমিনের মারাত্মক ভক্ত তা সে টের পেয়েছে। মাহিরের মতো করে মেহেরও একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল তার নাম জানার পর। মেহের ও তার মধ্যে নাম্বার আদান-প্রদান হয়ে গেছে। ইরাবতী কথায় কথায় বলেছে সে লেখিকা ইরাবতী না হলেও তার বই সে পড়ে এবং হুমায়ূন আহমেদের মারাত্নক একজন ভক্ত। ব্যস সাহিত্যের মানুষ মানে নিজের বন্ধু! মাহের হেসে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, ‘তাহলে তো আমরা বন্ধু বলো?’

ইরাবতী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মাহির এর প্রতি তার অনুভূতি বেড়েই চলেছে। মেহেরের সাথে ভাব জমানোটাও মাহিরের সান্নিধ্যে থাকার জন্যে। পাওয়া না হোক, মানুষটাকে সে সামনাসামনি দুচোখ ভরে দেখতে পারবে। বিভিন্ন বাহানায় চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকবে। গোপনে গেঁথে ফেলবে প্রেম কাব্য। সবসময় সবকিছু কেন দুই দিক থেকে হবে? পৃথিবীর কোথাও লেখা নেই যে মেয়ে হয়ে ছেলেদের জন্য পাগলামি করা যাবে না। ছেলেরা যেমন মেয়েদের পেছনে ঘুরে ইরাবতী ও ঠিক সেরকমই ঘুরবে। হয়তো একদিন সুযোগ বুঝে বলে দিবে মনের কথা! মাহির প্রত্যাখ্যান করলেও সে দুঃখ পাবে না। পৃথিবীর কোথাও এটাও লেখা নেই যে ‘ভালোবাসলেই পেতে হবে।’ ভালোবাসা পবিত্র। সেটা মনের ব্যাপার। শরীর না ছুঁয়েও যুগের পর যুগ ভালোবাসতে পারবে ইরাবতী। মাঝে মধ্যে মাহিরের জন্য আফসোস করে না-হয়। বলবে,

‘আপনি খাঁটি ভালোবাসা চিনলেন না ক্রিকেটার। নিজেকে নিজে ঠকালেন এতো শুদ্ধ ভালোবাসা পাওয়া থেকে।’

ইরাবতীকে প্রত্যাখ্যান করলে মাহির অবশ্যই ঠকবে। আর কেউ না জানুক, ইরাবতী জানে তার মতো ভালো ক্রিকেটার মাহির খানকে কেউ বাসবে না, কেউ না!

*
গোধুলি বিকেল। আজ রাতের শিফটে ডিউটি ইরার। টিভিতে খুব মনোযোগ দিয়ে সে খেলা দেখছে। মাহিরের হাফ সেঞ্চুরি হতে আরও ছয় রান লাগে। তখনই মাহির দুর্দান্ত একটি ছয় মারলো। ইরাবতী পাগলের মতো নাচতে লাগলো। পড়োনে স্কার্ট ও শার্ট। মুখে হাত দিয়ে হাসতে হসতে সোফায় গড়িয়ে পড়লো। স্কিনে তখন হেলমেট ও ব্যাট হাতে দাড়ানো মাহিরের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখাচ্ছে। সে উপরে দুহাত ও মুখ তুলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি সন্তুষ্টি জানাচ্ছে। ইরাবতী সে দৃশ্য দেখে মুচকি হাসলো। আচমকা কিশোরীদের মতো চঞ্চল হয়ে উঠলো তার মন। হাত দিয়ে উড়ন্ত চুমু দিলো মাহিরকে। তখনই টিভি স্কিনে মাহিরের দাঁত বের করা হাসি মুখ ভেসে উঠলো। ইরাবতীর মনে হলো মাহির তাকে লজ্জা দিতে হাসছে। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে সোফায় শুয়ে পড়লো। কুশন জড়িয়ে লজ্জাবতীর মতো লজ্জা পেতে লাগলো।

গতবারের ম্যাচটা হারলেও আজকের টা জিতে গেলো বাংলাদেশ। ইরাবতী মুচকি হেসে বলল, ‘আজ জিতে গেলেন কেন বলুন তো ক্রিকেটার? উমম আমি খেলা দেখেছি বলে। সেদিন ডিউটির জন্য দেখতে পারিনি বলে আপনার জিতার জন্য একটি দোয়ার হাত উঠেনি। সেজন্য আপনি সেদিন জিততে পারেননি। তবে আজ সে হাত উঠেছে এবং আপনি জিতেছেন। বুঝেছেন মিস্টার ক্রিকেটার?’

নেট দুনিয়া থেকে ইরাবতী মাহিরের অসংখ্য ফটো কালেক্ট করেছে। সেগুলোর মধ্যে বাছাই করে কতোগুলো ছবি দিয়ে এলবাম বানিয়েছে সে। ঘুমানোর আগে হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুয়ে দেখে সে। কল্পনায় সাজিয়ে নেয় কতো কি৷ এডাল্ট ইরাবতীর জীবনে প্রেমের বর্ষণ হয়ে নামা ব্যক্তিটা কি কখনো জানবে, ‘তার জন্য কেউ এতো প্রেম ভালোবাসা বুকে নিয়ে বেছে আছে! নাকি সেলিব্রিটি ও সাধারণ মানুষ দুটোর বেড়াজালে গোপন থেকে যাবে ইরাবতীর প্রেম কাব্য! ক্রিকেটার মাহির খানের নিকট মেঘবালিকার নিমন্ত্রণ পৌঁছবে কি!

*
মেহের এইবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে। সুতরাং তাকে আপাতত সাহিত্য থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। পরীক্ষা নিকটে তার। পুরোদমে পড়ছে সে। পরীক্ষা পর তারা বন্ধুরা মিলে একটি ট্যুর দিবে। মাকে রাজি করাবেন তার ছোট ভাই মাহির খান। বিনিময়ে তাকে অবশ্যই ভালো করে পরীক্ষা দিতে হবে। ট্যুরটা হাত ছাড়া করবে না বলে মেহের পড়া চোর থেকে গুড স্টুডেন্ট হতে চেষ্টা করছে।

মেহের যখন পদার্থের সব অপদার্থ অংক কষতে ব্যস্ত তখন তার দরজায় এসে দাড়ালেন বাসার একজন সার্ভেন্ট৷ মেহের জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি বললেন, ‘আপনার সাথে কে যেনো দেখা করতে এসেছে ম্যাম।’

মেহের কিঞ্চিৎ চিন্তিত হলো। কে দেখা করতে আসতে পারে তার সাথে? সে চিন্তিত মুখ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো। সোফায় বসা নীল শাড়ি পরিহিত রমনীটির মুখ দেখতে পেতেই সে হেসে এগিয়ে আসলো। ইরাবতী উঠে জড়িয়ে ধরলো মেহেরকে। মেহের অবাক হয়ে উচ্ছ্বস্বিত কন্ঠে বলল,

‘ওহ্ গড আপু তুমি এসেছো। আমি অনেক খুশি হয়েছি।’

ইরাবতী হেসে বলল, ‘তুমি সেই কবে বলেছিলে আসার জন্য, কিন্তু সময়ের অভাবে আসা হয়নি। আজ সময় করে চলে আসলাম।’

তন্মোধ্যে সিঁড়ি দিয়ে নামলেন মমতা খান। কোলে হসপিটালে জন্ম নেওয়া সেই নবজাতক। ইরাকে দেখে তিনি চিনতে পারলেন। এগিয়ে এসে সোফায় বসলেন। ইরা সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছেন আন্টি?’

‘ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো?

ইরা হেসে উত্তর দিলো। মমতা খান কোলের শিশুটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চিনতে পারছো আন্টিকে? তুমি জন্ম নিয়ে প্রথম তার কোলেই উঠেছিলে নানু ভাই।’

সার্ভেন্ট নাস্তা এনে রাখলো। ইরা জিজ্ঞেস করলো, ‘নাম কি রেখেছেন আন্টি?’

মেহের শিশুটিকে কোলে নিয়ে বলল, ‘মাহদি খান।’

মমতা খান মৃদু চেচিয়ে বললেন, ‘ও ঘুমিয়ে পড়েছে, উঠে যাবে মেহের।’

মেহের ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘উঠলে উঠে যাক। সারাদিন তুমি কোলে নাও, আমাকে নিতে দাও না।’

ইরা ওর ছেলে মানুষি দেখে হাসলো। তখনই উপর থেকে ভেসে এলো কারো গলা,

‘মা আমার কফি কোথায়?’

মমতা খান সার্ভেন্টকে তাড়া দিলেন। মাহিরের ঘরে এখনো কফি পৌঁছায়নি কেন?’

ইরা নিরব শ্রোতার মতো সব দেখলো। মনে মনে শব্দ করে হাসলো। সে জানে আজ বাংলাদেশের সব ক্রিকেটার নিউজিল্যান্ড থেকে ফিরেছে। ভোরে বিমান ল্যান্ড করেছে বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে। এখন মধ্যদুপুর। মাহির বাসাতেই থাকবে তার বিশ্বাস ছিল।

ইরাবতী আড়চোখে উপরের দিকে তাকালো। মানুষটা বের হচ্ছে না কেন?’

মমতা খান মৃদু স্বরে বললেন, ‘একি মা তুমি তো কিছুই খাচ্ছো না।’

মেহের ঠোঁট চেপে হেসে বলল, ‘আপু মনে হয় লজ্জা পাচ্ছে মা।’

মমতা খান অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি লজ্জা পাচ্ছো?’

ইরাবতী নিরিহ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমার পেটে ভরা আন্টি। আমি কিছুই খেতে পারবো না। প্লিজ জোর করবেন না।’

ইরাবতী নিজের ব্যাগ থেকে বই বের করে মেহেরের দিকে এগিয়ে দিলো।

‘হুমায়ূন আহমেদের বই। আমি জানি তুমি পরীক্ষা দিবে। সেজন্য উপহার দিলাম। পরীক্ষার পর পড়ো।’

মেহের খুশি হয়ে গেলো। ইরাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ও আ’ম সো হ্যাপি। ‘

ইরা হেসে ফেললো। ঘুরেফিরে তার নজর উপরের দিকেই স্থির!’

(চলবে)