মেঘবালিকার নিমন্ত্রণে পর্ব-০৪

0
160

#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#পর্ব-০৪
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

বাহিরে তীব্র রোদ৷ খান বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে দুটো বেজে গেছে। কিন্তু উপর থেকে মাহির একবারও নেমে আসেনি। এখন খাওয়ার সময়। খান বাড়ির সবাই নিশ্চয়ই খেতে বসবে। ইরাবতীর অস্বস্তি লাগলো। এতো বেহায়া হয়ে যার জন্য আসলো তাকেই এক নজর দেখতে পারলো না। সে মেহের, নাতাশা ও মমতা খান থেকে বিদায় নিলো। তারা খেয়ে যেতে জোর করলেও শুনলো না ইরা। তার মনে তীব্র বিষাদ। ক্রিকেটার মাহির খান কি করে এতো নিষ্ঠুর হতে পারলো? ইরাবতী এই যে ডিউটির শিফট আরেকজনের সাথে চেঞ্জ করে এসেছে কার জন্য? যার জন্য এতোকিছু সে ব্যক্তির কোনো খবর নেই! ইরাবতীর কান্না পেলো। নিজের পরিবর্তন দেখে তার মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করলো। সে কখনো এমন ছিল না। চাপা স্বভাবের মেয়ে সে। সাথে কঠোর পরিশ্রমী। সে শেষ কবে কান্না করেছে তা সে নিজেও জানে না। এমন শক্ত খোলসে আবরিত মেয়েটিকে বহু বছর পর কাদানোর দায়ে মাহির খান কি তার হয়ে যেতে পারে না? ইরাবতী চোখে হাত ভুলিয়ে গেইট পেরুলো। পেছন ফিরে পুনরায় বাড়িটির দিকে তাকালো। তৎক্ষনাৎ চোখে পড়লো বাগানের দিকের বারান্দায় কফি মগ হাতে দাড়িয়ে আছে এক সুদর্শন পুরুষ। সে আর কেউ নয় ইরাবতীর প্রেম পুরুষ। যাকে এক পলক দেখার আশায় ছুটে এসেছে সে।

মাহির মোবাইলে কিছু করতে ব্যস্ত। ইরাবতী উঁকি দিয়ে আরেকটু ভালো করে দেখতে চেষ্টা করলো। দারোয়ান ইরাবতীকে উঁকি দিতে দেখে সন্দেহের চোখে তাকালেন। ইরা থমথম কন্ঠে বলল, ‘আমাকে খান বাড়ির সকলে চিনেন। অমন চোরের মতো আমাকে পর্যবেক্ষণ করবেন না। আমি চোর বা ক্রিমিনাল নই।’

দারোয়ান পান খাওয়া ঠোঁট বাঁকালেন। অর্থাৎ এমন কতো পরিচিত মানুষ আসা যাওয়া করে।’

ইরাবতী বারান্দার দিকে ফের তাকালো। তখনই চোখে চোখ পড়ে গেলো মাহিরের। সে অবাক হয়ে হাত নাড়িয়ে হাই দিলো। মাহিরের উদাম গা। ইরাবতী দূর থেকে দেখেও কেঁপে উঠলো। মাহিরের হাই এর পরিবর্তে হাসি উপহার দিয়ে হাঁটা ধরলো।

রোদের তাপ কিছু টা কম। রৌদ্রজ্বল দুপুরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে নব্বই দশকের মতো নীল শাড়ি পরিহিতা এক রমনী। কানের পাশে জায়গা করে নিয়েছে পথের ধারের ভৃঙ্গরাজ ফুল। সাধারণের মধ্যেও যেনো সে অসাধারণ কেউ।

*
সামনে বইমেলা। ইরাবতী পুরোদমে পান্ডুলিপিতে মনোনিবেশ করেছে। ডিউটির পর তার সময়টা পান্ডুলিপির পেছনেই ব্যয় করতে হয়। তার আর সব উপন্যাসের বইয়ের থেকে এই বইটা হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার পাঠকেরা এইবার অন্যরকম কিছু পেতে চলেছে। ইরাবতী ডায়েরির ভাজে লিখলো,

‘আপনি জীবনে আসার পর আমার সবকিছু অন্যরকম হচ্ছে। আমার এইবারের বইটা আমি আপনাকেই উৎসর্গ করবো আমার অ-প্রেমিক। কাহিনির ভাজে আপনাকে লুকিয়ে রাখবো ক্রিকেটার। আচ্ছা মাহির আপনি যখন আমার অনুভূতি সম্পর্কে অবগত হবেন তখন কি চমকে যাবেন? ঠাঁই দিবেন আপনার বক্ষে? নাকি ছুঁড়ে ফেলে দিবেন ময়লা আবর্জনার মতো!’

ইরাবতীর মন খারাপ হয়ে গেলো। সে ডায়েরি বন্ধ করে চায়ে চুমুক দিলো। পুনরায় পান্ডুলিপিতে মনোনিবেশ করতে চাইলেও পারলো না৷

*
মেহেরের এসএসসি পরীক্ষা শেষ পর্যায়ে। বন্ধুরা মিলে প্লান করেছে ময়মনসিংহে যাবে। মেহেরের এক বন্ধুর গ্রামের বাড়ি সেখানে। যেই ভাবা সেই কাজ। মাহিরকে দিয়ে অনুমতি নিয়ে নিলো সে। এবার শুধু পরীক্ষাটা শেষ হওয়ার পালা।

মাহির সবসময়ই ব্যস্ত থাকে। প্রতিদিন মাঠে গিয়ে খেলা প্রেকটিস করা তার রুটিন। সাথে নিজেকে ফিট রাখতে বিভিন্নরকম জগিং তো আছেই। তার এই ব্যস্তময় জীবনে এখনো কোনো নারীর আগমন ঘটেনি। স্কুল ও কলেজ লাইফে একটা দুটো রিলেশনে জড়িয়েছিলো বটে। বাট ওগুলো শুধু নামেই রিলেশন ছিল। ভার্সিটিতে পা রাখার পর সে পুরো সময়টা পড়াশোনা ও খেলাধুলাতে দিয়েছে। তার কাছে এখন ওগুলো সময় নষ্ট মনে হয়। কখনো যদি করে তো বিয়ে করবে। কিন্তু সেটা কবে কখন কিভাবে সে নিজেও জানে না। তার শুধু একটা মানুষ চাই। যে সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ হবে। যাকে দেখলে মাহিরের বুক কাঁপবে। কাছে পাওয়ার যন্ত্রণায় বিষিয়ে যাবে মন। যার চোখে চোখ রেখে সে কাটিয়ে দিতে পারবে পুরো এক জনম।

মাহিরের আঠাশ বছরের জীবনে এখনও তেমন কেউ আসেনি। কিন্তু সে হতাশ হয়নি। সে জানে সৃষ্টিকর্তা সবার জন্যই কেউ না কেউ রেখেছেন। মাহিরের ফ্যান কম নয়। অসংখ্য প্রপোজাল আসে তার জন্য। অসংখ্য চিঠিও আসে। স্যাোশাল সাইডে আসে অগণিত প্রেমের প্রস্তাব। কিন্তু সেগুলো দেখার সময় বা প্রয়োজন তার নেই। সেলিব্রিটি জীবনের মধ্যে মাহিরের আরেকটি জীবন আছে। যেটাতে শুধু তার পরিবার আর বন্ধুগণ। রাতের আঁধারে আজও চায়ের দোকানে আড্ডায় বসে তারা। অনেকে বিয়ে করেছে আবার কেউ কেউ চাকরি করছে। ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও কেউ কারো খোঁজ নিতে ভুলে না।

আজ চায়ের টঙ দোকানে বন্ধুদের আড্ডা বসেছে। ডাক্তারির অ্যাপ্রোন হাতে ঝুলিয়ে দাড়িয়ে আছে একটি ছেলে। নাম শাওন। পেশায় একজন হার্ট সার্জন। তারপর আছে নাবিদ। পেশায় সে গোয়েন্দা অফিসার। নাবিদের পাশে দাড়ানো কুঁকড়া চুলের ছেলেটির নাম সৈকত। সে একজন গিটারিস্ট, সাথে ভালো গান করে। তারপর দাড়িয়ে আছে মাহির ও তার পাশে নিবিড়। যে একজন পাবলিক ভার্সিটির প্রফেসর।

চায়ের দোকানে বসেছে সবাই। রাতের অন্ধকারে দূর থেকে কেউ তাদের স্পষ্ট দেখতে পারবে না। তাছাড়া চায়ের দোকানটা কিছু টা নির্জন জায়গায়। তার উপর রাত এগারোটার সময় তেমন কেউ আনাগোনা করছেনা এদিক দিয়ে। ব্যস্ত জীবনের একটি দিন বন্ধুরা আড্ডা দেয়। শুক্রবার হলো সেই দিন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বন্ধুরা নানান কথা বলতে লাগলো। তাদের মধ্যে নাবিদ ও নিবিড় বিবাহিত। নাবিদ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

‘তোরা কি কেউ বিয়ে করবি না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?’

সৈকত গিটারে টংটাং শব্দ তুলে বলল,

‘কেন নিজের বিবাহিত জীবনের ঝামেলা সবার জীবনেও চাস নাকি?’

নাবিদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো,

‘বিবাহিত জীবন ঝামেলা?’

‘অফকোর্স৷ আজকাল যে-ই হারে ডিভোর্স হচ্ছে। বিয়ে নাম শুনলেই তো কলিজা কাঁপে দোস্ত।’

নিবিড় কিটকিটে হাসি দিয়ে বলল,

‘তবুও একটা চান্স তো নেওয়াই উচিত বন্ধু। বিয়ে না করলে তুমি কিভাবে বুঝবে অবিবাহিত ও বিবাহিত জীবনের পার্থক্য?’

শাওন চোখের চশমা ঠিক করে বলল,

‘পার্থক্য কি?’

নিবিড় ও নাবিদ একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো। নাবিদ চোখ মেরে বলল,

‘আগে একা ঘুমাতাম, এখন বউ নিয়ে ঘুমাই। এটাই পার্থক্য।’

শাওনের মুখ হা হয়ে গেলো। কান দুটো ঝা ঝা করতে লাগলো তার। দুম করে নাবিদের বাহুতে মেরে বলল,

‘ছিহ্ তোরা শালা পুলিশেরা এতো অশ্লীল হোস কেন?’

নাবিদ চোখ বড়বড় করে বলল,

‘হিসেব অনুযায়ী তো ডাক্তারেরা লুচু হয়। তুই আমার মতো নিরীহ অফিসারকে কোন যুক্তিতে অশ্লীল বলিস?’

এতোক্ষণ মাহির নীরব শ্রোতা ছিল। এবার সে মুখ খুলল,

‘শাওনরে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেই, কি বলিস তোরা?’

নিবিড় ও সৈকত হইহই করল,

‘আমি দুটো রোস্ট বেশি খামু মামা।’

মাহির শব্দ করে হাসলো,

‘আগে পাত্রী খুঁজ। আমাদের নিরীহ শাওনের জন্য একটা নিরীহ মেয়ে খুঁজতে হবে। নাহলে দেখা গেলো কোনো ভাবে যদি দজ্জাল বউ জুটে তো বেচারার জীবন ত্যানা ত্যানা।’

নিবিড় চট করে বলল,

‘তোর ফ্যান ফলোয়ারসে তো কতো মাইয়া ঝুইলা আছে। তাগো মধ্যে থাইকা একটা নিরীহ মাইয়া খুইজ্জা বাইর করলে কেমন হয়?’

শাওন নাক সিটকালো,

‘ওরকম ছ্যাচড়া মেয়ে আমার লাগবে না।’

সৈকত ভ্রু কুঁচকে তাকালো,

‘তো কিরকম মেয়ে চাই তোর?’

শাওনের গম্ভীর চেহারায় উজ্জ্বলতা দেখা দিলো,

‘খুব সাধারণ কেউ, কিন্তু মনে হবে অসাধারণ।’

তাদের আড্ডার মধ্যে বাহিরে গুড়ুম গুড়ুম মেঘ ডেকে উঠলো। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামলো ধরনীতে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দৌড়ে চায়ের ভেতরে এসে দাড়ালো শাড়ি পরিহিত এক রমনী। বন্ধুরা কারো আগমনে চোখ তুলে তাকালো। পরিচিত কারো মুখশ্রী চোখে পড়তেই মাহির এগিয়ে গেলো। রমনীটি বৃষ্টির দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। নিজের পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব করে সে চোখ তুলে তাকালো। তৎক্ষনাৎ চমকে গেলো সে। বিরবির করল, ‘ক্রিকেটার!’

সোডিয়ামের মৃদু আলো ও হলুদ আলোর বাল্বে মুখশ্রী হলুদ দেখাচ্ছে। চোখে চোখ পড়ে গেলো। শুভদৃষ্টি হলো কি তবে?’

(চলবে)