মেঘবালিকার নিমন্ত্রণে পর্ব-০৫

0
146

#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#পর্ব-০৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

আকাশে মেঘের ঘনঘটা। মেঘ ডাকছে শব্দ করে। মাঝে মধ্যে ধরনী সাদা হয়ে আবার কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। মাহির কি এই সময়টাকে কনে দেখা আলো ধরে নিবে? কিন্তু সেটা তো দিনের বেলায় হয়!

চোখটা সর্বপ্রথম মাহিরই ফিরিয়ে নিলো। কেশে গলা পরিষ্কার করে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেষ্টা করলো। ইরা চমকে চোখ নামিয়ে নিলো। মাহির ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকিয়ে বলল,

‘ আপনি এই সময় এখানে? ’

‘ হসপিটাল থেকে ফিরছিলাম। ’

‘ সেদিন আমাদের বাড়ির গেইটের সামনে কি করছিলেন? ’

ইরাবতীর কথা আটকে গেলো। সে চোখ বন্ধ করে ফেললো। মনেপ্রাণে চাইলো মাটি ফাঁক হয়ে যাক। সামনে দাড়ানো মাহির তার ভ্রম হোক।

মাহির ইরাবতীে বন্ধ চোখের দিকে তাকালো,

‘ আপনি কি কোনোভাবে লজ্জা পাচ্ছেন? ’

ইরাবতী ফট করে চোখ মেলে তাকালো। মাহির তার প্রেমিক না। সুতরাং লজ্জা পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু মাহির কি জানে ইরাবতী মনে মনে মাহিরকে নিয়ে সংসার সাজিয়ে ফেলেছে।

মাহির উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। ইরা ইতস্তত করে বলল,

‘সেদিন আপনাদের বাড়িতে গেছিলাম। বের হওয়ার সময় আপনার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। ব্যস এতোটুকুই।’

ততোক্ষণে এগিয়ে এসেছে মাহিরের বন্ধুগণ। নাবিদ মাহিরের পিঠ চাপড়ে বলল,

‘কি বন্ধু তলে তলে এতোকিছু?’

নিবিড় রেগে বলল,

‘এই তোর বন্ধুত্ব, শালা প্রেম করিস অথচ আমাদের বলিসনি।’

সৈকত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ইরার দিকে। শাওন নিরব দর্শক। সে চোখমুখ গম্ভীর করে দাড়িয়ে আছে।

মাহির হেসে ফেলল,

‘তোরা যা ভাবছিস তা না। উনি একজন নার্স। আমার পরিচিত।’

সৈকত ভ্রু টানটান করে ফেলল,

‘শুধুই পরিচিত?’

নাবিদ লাফিয়ে ইরাবতীর পাশে গিয়ে দাড়ালো।

‘আপনার কি কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে মিস?’

ইরাবতী চোখ বড়বড় করে তাকালো। নিবিড় রাগী স্বরে বলল,

‘লজ্জা করেনা বউ রেখে আরেক মেয়েকে বয়ফ্রেন্ড আছে কি না জিজ্ঞেস করিস?’

‘তোর জ্ঞান তোর স্টুডেন্টদের দিস। এইযে মিস, আপনার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?’

ইরা মাথা নাড়িয়ে না করলো। নাবিদ উচ্ছসিত হয়ে বলল,

‘তাহলে তো হয়েই গেলো। আমাদের মাহিরের ও গার্লফ্রেন্ড নেই। আপনি হয়ে যেতেই পারেন। কি বলেন?’

মাহির ঠাস করে নাবিদের মাথায় চড় মারলো। নাবিদ অসহায় চোখে তাকালো,

‘তুই আমাকে মারতে পারলি? তোর একটা গতি করছিলাম। তার প্রতিদান এভাবে দিবি?’

মাহির ইরাবতীর’কে বলল,

’আপনি কিছু মনে করবেন না। ওরা মজা করছে।’

ইরাবতী মনে মনে বিরবির বলল, ‘না না একদমই না। আমি কেন কিছু মনে করবো? আপনার দামড়া বন্ধুদের বলুন আরও কিছু বলতে। আমি কিছুই মনে করবো না।’

এবার নিশ্চুপ শাওন কথা বলে উঠলো,

‘আপনি মনে হয় বৃষ্টিতে আটকে পড়েছেন।’

‘জ্বি।’

‘চলুন আপনাকে এগিয়ে দিবো। আমিও বের হবো।’

নিবিড় ভ্রু কুঁচকে তাকালো,

‘তুই কেন পৌছে দিবি? আমরা থাকতে তোর হঠাৎ দরদ উতলে পড়ছে কেন? মতলব কি তোর?’

শাওন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। ইরা মাথা নাড়িয়ে মানা করে বলল,

‘আমি একাই যেতে পারবো ভাইয়া। আপনারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করবেন না।’

পরোপকারী নাবিদ হাহাকার করে উঠলো,

‘কি বলছেন আপনি এসব? আমাদের ক্রিকেটার থাকতে কি না আপনি একা একা যাবেন। মাহিরের এক্সক্লুসিভ গাড়িতে করে আপনি বাসায় যাবেন আপু।’

মাহির কপালে আঙুল দিয়ে টুকা মেরে হাসলো।

‘চলুন আপনাকে পৌঁছে দেই।’

ইরাবতী আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো খুশি হলো। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলো না।

সেই কালো টয়েটো গাড়িতে উঠে বসলো ইরা। মাহির নিজে ড্রাইভ করছে। ইরা চিন্তিত স্বরে বলল,

‘ আপনি বডিগার্ড ছাড়া বের হলেন যে? ’

মাহির ড্রাইভিং এ মনোযোগ রেখে বলল,

‘ এই সময়টা আমি একা স্পেন্ড করি বন্ধুদের সাথে। গার্ড সাথে নেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। ’

বাহিরে তখন প্রচন্ড বৃষ্টি। ইরাবতী গাড়ির কাঁচের ফাঁকে হাত বের করে বৃষ্টি ছুয়ে দেখছিল। মাহির সাবধান করলো,

‘ হাত ভেতরে ঢুকিয়ে নিন। কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ’

ইরা তৎক্ষনাৎ হাত ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো। মাহির আচমকা প্রশ্ন করল,

‘ আপনার পরিবারে কে কে আছে? ’

‘বাবা, মা আমি ও ছোট ভাই। আমি চাকরিসূত্রে এই শহরে থাকি। বাবা মা ভাইকে নিয়ে ময়মনসিংহে থাকেন। ’

‘ধরুন ইরাবতী, আপনি হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পেয়ে গেলেন বা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু আপনার সাথে ঘটে গেলো। তবে কি আপনি চমকে যাবেন? ‘

‘ আমি সহজে চমকাই না। ‘

মাহির মৃদুস্বরে হাসলো,

‘ দরুন চমকানোর মতোই কিছু ঘটলো তবুও চমকাবেন না? ‘

ইরাবতী মাহিরের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো,

‘ চমকে যাওয়ার মতো কিছু হলে আমি যদি চমকে না-ও যাই, তবু্ও মিথ্যা করে চমকে যাবো না-হয়। ‘

মাহির এবার শব্দ করে হাসলো,

‘ আপনি তো দারুণ। ‘

দুজনের টুকটাক কথার মধ্যে ইরাবতীর ফ্ল্যাটের বিল্ডিং এর সামনে গাড়ি থামালো মাহির। তখনও বাহিরে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। মাহির গাড়ির পেছন থেকে ছাতা হাতে নিলো। মাক্স পরে বের হয়ে ইরাবতীর দিকে এগিয়ে এলো। ইরাবতী ইতস্তত করে গাড়ির বাহিরে পা রাখলো। মাহিরের এক হাত ছাতা ধরে আছে। আরেক হাতে সে ইরাবতীর শাড়ির আঁচল তুলে ধরলো। ইরাবতীর হাতে দিয়ে বলল,

‘ আঁচল সামলে রাখুন ভিজে যাবে। ‘

একই ছাতার নিচে দুজন। বৃষ্টির ফোঁটারা রাস্তায় পড়ে একটু একটু করে ইরাবতীর পায়ের দিকের শাড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছে। সে এক হাতে শাড়ি সামলিয়ে মাহিরের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে গেইট দিয়ে প্রবেশ করলো। মাহির পা থামালো। ইরাবতীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল,

‘ আজ তবে এ পর্যন্তই। আমি আসি তাহলে। ‘

ইরাবতী মাহিরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাঁটার তালে তাদের দুজনের অনেকবারই কাঁধে কাধ লেগেছে। ইরাবতীর শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা এখনো কাটেনি। সে লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ ভেতরে এসে এক কাপ কফি খেয়ে যান। বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভিং কিন্তু বিপদজনক হতে পারে। ‘

মাহির একটু ইতস্তত করলো। ইরা অনুনয় করে বলল, ‘প্লিজ। ‘

মাহির ইরার সাথে বিল্ডিং এ প্রবেশ করলো। লিফট দিয়ে পৌঁছে গেলো ইরার ফ্ল্যাটে। মুখ থেকে মাক্স খুলে সোফায় শরীর ছেড়ে বসে পড়লো। ইরা হেসে বলল,

‘ আপনি বরং আগে ফ্রেশ হয়ে নিন। ‘

মাহির উঠে ইরার দেখানো বেডরুমে চলে গেলো। এই ঘরে সে আগেও একবার এসেছে। সেই দেড় বছর আগে। এক রাত ঘুমিয়েছে এই খাটে। মাহির ফ্রেশ হয়ে বারান্দার কাছের লম্বা জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালো। ইরাবতী তখনই দু মগ কফি হাতে ঢুকলো। মাহিরের পাশে দাড়িয়ে একটি কাপ এগিয়ে দিলো। মাহির কাপ হাতে নিতে নিতে খেয়াল করলো ইরাবতী শাড়ি চেঞ্জ করে ফেলেছে। এখন তার পড়োনে একটি লং স্কার্ট ও টিশার্ট। গলায় ওড়না। ইরাবতীকে এখন কিশোরী লাগছে। কে বলবে এই মেয়ে নার্সিং পাশ করে চাকরি করছে! ‘

কফিতে চুমুক দিয়ে দুজন বৃষ্টি দেখতে দেখতে সময়টা উপভোগ করতে লাগলো। মাহির আচমকা প্রশ্ন করলো,

‘ বিয়ে করছেন কবে? ‘

ইরা চমকে গেলো না। বরং হেসে ফেললো।

‘ বিয়ে যখন হওয়ার তখনই হবে। সেজন্য চিন্তা ভাবনা করছি না। ‘

‘কোনো পছন্দ…? ‘

ইরা এবার মাহিরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মাহিরের পড়োনে লাল শার্ট। পড়োনে ডেনিম জিন্স। পায়ে বুট জুটো। একদম সুপুরুষ লাগছে ইরার চোখে। সে মাহিরের দিকে তাকিয়ে ঘুর লাগা কন্ঠে শুধালো,

‘ আছে কেউ…। ‘

মাহির চমকে গেলো কি? মাহির ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল,

‘ জানতে পারি সে কে? ‘

‘ আপনি অবশ্যই জানতে পারেন সে কে। কিন্তু আমি আপনাকে আপাতত জানাতে চাচ্ছি না। ’

মুখের উপর এমন জবাবে মাহির চুপ হয়ে গেলো। ইরা হেসে বলল,

‘ তবে যেদিন তাকে জানাবো সেদিন আপনিও জানতে পারবেন। ’

মাহির কফির মগ ফিরিয়ে দিলো,

‘ এবার আমাকে যেতে হবে যে মিস। আপনার একটি কফির ট্রিট পাওনা রইলো আমার কাছে। আচমকা কখনো দেখা হয়ে গেলে আবারও কফির কাপে চুমুক দিয়ে আড্ডা হবে। ’

মাহির বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বিদায় নিলো। ইরাবতী ছলছল চোখে বারান্দা হতে দেখতে লাগলো কালো টয়েটো গাড়িটা গেইটের সামনে থেকে সাই-সাই করে চলে যাচ্ছে।

(চলবে)