মেঘবালিকার নিমন্ত্রণে পর্ব-০৭

0
149

#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#পর্ব-০৭
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

বৈশাখ মাস। কাঠফাটা রোদ্দুরে চামড়া পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা মানুষের। কলেজ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ভার্সিটি গেইটের সামনে দাড়িয়ে আছে মেহের। মাঝে মধ্যে উঁকিঝুকি দিচ্ছে ক্যাম্পাসে। মেহেরের কলেজের নতুন বান্ধবী আনিশা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেহের নামক পাগল বান্ধবীর কান্ডে বিরক্ত সে। আনিশা অধৈর্য হয়ে নাকমুখ কুঁচকে ফেললো। মেহেরের বেনী ধরে টান দিয়ে বলল,

‘ আর কতো ইয়ার? সামান্য একটা ছেলের জন্য এতো ছ্যাচড়ামি করছিস কেন? ‘

মেহের তৎক্ষনাৎ বলল,

‘ ও সামান্য ছেলে নয়। ‘

আনিশা নিজের চশমা ঠেলে দিলো,

‘ তবে কি তৃতীয় লিঙ্গের? ‘

মেহের ঠাস করে ওর মাথায় মেরে বলল,

‘তুই চুপ থাক মা। আজেবাজে কথা বলে মাথা খাবি না। ‘

মেহের পুনরায় ক্যাম্পাসের ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ক্যাম্পাসের মাঠে এসে দাড়ালো ইশান। সাথে একটি মেয়ে। তার সাথে মাঠে বসে কিছু নিয়ে ডিসকাস করছে সে। মেহেরের মন খারাপ হয়ে গেলো। মেয়েটার সাথে কিসের এতো কথাবার্তা ইশানের? তার সাথে তো কখনো টু শব্দ ও করে না।

মেহের রাগে আনিশার হাত খামচে ধরলো। আনিশা চমকে হাত ছাড়িয়ে নিলো। কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,

‘ মেরে ফেলবি নাকি? ‘

মেহেরের চোখে পানি। আনিশা হাতের ব্যাথা ভুলে বান্ধবীর দিকে দুঃখী চোখে তাকালো। উঁকি দিয়ে ইশানকে দেখে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

‘ এক ছেলের জন্য আর কতো বেহায়া হবি? মাহির ভাই জানতে পারলে কি হবে ভেবেছিস? কিসের জন্য তুই এই ছেলের পেছনে পড়ে আছিস বল তো? তোর কি নেই? ছেলেটার সাথে তোর স্ট্যাটাস যায় না মেহের। প্লিজ সময় থাকতে নিজেকে সামলে নে। ‘

মেহের নাক টেনে বলল,

‘ সম্ভব না। আমি ফেঁসে গেছি ইয়ার। ‘

আনিশা পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ কি করবি এখন? আরও কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকবি? ‘

মেহের চোখে পানি নিয়ে হাসলো,

‘ তাকে এক পলক দেখার আশায় ছুটে এসেছিলাম। দেখে নিলাম। চল কোচিং এর টাইম হয়ে গেছে। ‘

আনিশা করুন চাহনি নিয়ে তাকালো। তার বান্ধবীটা এতো আবেগি কেন? বড়োলোক পরিবারের দুঃখ বুঝতে না পারা মেয়েটিকে দুঃখে ডুবানোর অপরাধে ইশান আমিন নামক পুরুষটিকে জেলে নিবে সে। বাবার মতো যখন পুলিশ হবে তখন ইশানকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে। পাছায় বারি দিয়ে বলবে,

‘ আমার বান্ধবীকে কাঁদানোর মজা বুঝ শালা। অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলে আমার বান্ধবীকে কাঁদাস কতো বড় সাহস তোর। ‘

আনিশা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। মেহেরের এই অল্প বয়সী এক তরফা প্রেমের পরিণতি সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা কেন বুঝেও বুঝতে চাইছে না? সে কি জানে না সমাজ পরিবার তাদের দুই মেরুর মানুষকে কখনো এক হতে দিবে না! আনিশার মনে হলো ইশান আমিন নামক ছেলেটি প্রচন্ড বুদ্ধিমান। নিজের দিক থেকে সে একদম সঠিক। মেহেরের অল্প বয়সী আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না। কখনোই না!

মেহেরের এক তরফা প্রেম এভাবেই চলতে থাকলো। ফাস্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেও তার পরিবর্তন হলো না। আনিশার বুক কাঁপে। তার বান্ধবী যে খুব শীগ্রই ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাকা হবে তা নিয়ে সে শতভাগ নিশ্চিত!

অঘটন ঘটলো একদিন। কিশোরী বয়স অতিক্রম করা মেহেরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যৌবনের খেলা। নারী অঙ্গে সে শাড়ি জড়িয়েছে সেদিন। বিকাল পাঁচ টা নাগাদ ইশান টিউশনি থেকে ফিরে। সেই সময় জলজ্যান্ত পুরুষটিকে গাড়িতে টেনে তুললো মেহের। ইশান হতভম্ব। ড্রাইভিং সিটে আনিশা বসে। সে ব্যাকসিটের লাইট অফ করে দিলো। অন্ধকারে ইশান স্পষ্ট টের পেলো তার ওষ্ঠে কেউ নিজের ওষ্ঠ ডুবিয়ে দিয়েছে। ইশান ছটফট করতে লাগলো। মন সেই স্পর্শে হারিয়ে যেতে চাইলেও মস্তিষ্ক বাঁধা দিলো। সে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। মেহের ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ভেজা কন্ঠে প্রচন্ড জেদ নিয়ে বলল,

‘ আজ আমি এমন কিছু করবো যার কারণে আপনি না চাইতেও সারাজীবন আমার কাছে আমার হয়ে থাকতে বাধ্য হবেন মিস্টার ইশান আমিন। আমাকে কাদানোর জন্য, প্রত্যাখ্যান করার জন্য, আমার ভালোবাসাকে ছোট করে দেখার জন্য, আমাকে অবহেলা করার জন্য এটা আপনার শাস্তি। আপনি আমাকে নিজের করে নিবেন না। সেজন্য আপনাকে নিজের করতে আমাকে এই পথ অবলম্বন করতেই হলো। সেজন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ‘

ইশানের মাথা ঘুরতে লাগলো। মস্তিষ্ক খুঁজতে শুরু করলো কি করতে চাইছে মেহের। কিন্তু মেহের সেটার সুযোগ দিতে চাইলো না। লাল রঙের শাড়ির আঁচল টা নিজের স্থান থেকে খসে পড়লো। ইশানের শার্টের বোতামগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেললো মেহের। টেনে ইশানকে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে।

ইশানের বয়স বাইশ ছুঁইছুঁই। সদ্য যৌবনে পা রাখা ছেলেটি কেঁপে উঠলো। ঘেমে উঠলো আচমকা। নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। হাত দিয়ে ঠেলতে গিয়ে স্পর্শ পেলো নরম কিছুর। ইশানের মাথা ঘুরে গেলো। শ্বাস-প্রশ্বাস দীর্ঘ হতে শুরু করলো। এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ইশান কি করবে বুঝতে পারছে না। জীবনে প্রথমবার তার কিছু একটা হয়ে গেলো। মস্তিষ্ক হেরে গেলো তার কাছে। মেহেরে ডুবে গেলো বড্ড অগোছালো ভাবে।

বাহিরে কালবৈশাখী ঝড়। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ইরা সবসময়ের মতো ইশানকে দেখতে গেলো। চাবি দুজনের কাছেই থাকে বলে দরজা খুলতে কাউকে ডাকতে হয়না। ইশানকে পড়ার টেবিলে না দেখে চিন্তিত হলো ইরা। রান্নাঘরে থাকতে পারে ভেবে সেদিকে এগিয়ে গেলো। ইশান আজ টিউশনি থেকে ফিরে রান্না করেনি। অবাক হলো ইরা। এমনটা কখনো হয়না। ভাবলো একদিন ব্যতিক্রম হতেই পারে। হয়তো কোনোকিছুতে আটকে পড়েছে তার ভাইটা।

ইরার চিন্তা বাড়লো। রান্না শেষ করে সে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলো। হাতে মুঠোফোন। ইশানের মোবাইলে কল ঢুকলেও রিসিভ হচ্ছে না। রাত আটটা বেজে গেছে। কোথায় যেতে পারে ইশান!

গাড়ি একটি নির্জন জায়গায় রেখে কিছুটা দূরে গাছের নিচে দাড়িয়ে আছে আনিশা। ঝড় থেমেছে অনেকক্ষণ। লজ্জায় তার গাল লাল হচ্ছে। যতোই অন্ধকার থাকুক তার কানে স্পষ্ট পেছন থেকে শীৎকার ভেসে এসেছে। লজ্জায় আনিশা তৎক্ষনাৎ নেমে যেতে পারেনি। কারণ তখন বাহিরে প্রচন্ড ঝড়। ঝড় থামতেই সে গাড়ি লক করে নেমে এসেছে। চোখ ঘুরিয়ে সে গাড়িটার দিকে তাকালো। অধৈর্য হয়ে হাতের ফোন চেপে মেসেজ পাঠালো মেহেরের মোবাইলে।

ব্যাকসিটে বসা দুজনের উপর ঝড় বয়ে গেছে। বর্তমানে দুজন মাথা নিচু করে বসে আছে। মেহের শাড়ি ঠিক করে পড়ে নিয়েছে। ইশানও নিজেকে ঠিকঠাক করে নিয়েছে। দুজন দুজনের দিকে তাকাতে পারছে না। ইশানের মাথা নিচু লজ্জায়, অপরাধবোধে, আর মেহেরের মাথা নিচু ভয়ে।

মৌনতা ভেঙ্গে মেহের কথা বলে উঠলো। প্রচন্ড ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

‘ কি করবেন এখন? ‘

ইশানের চোখ লাল। সে চোখ তুলে তাকালো। মেহের ভয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। ইশানের চোখ ফেটে যেকোনো সময় জল গড়িয়ে পড়বে। সে শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ তুমি যা চাও তাই করবো। এতোকিছু করেছো প্লান করে তোমার প্লানটা পুরোপুরি সাকসেসফুল করবো। সেটাই তো চেয়েছিলে তুমি! ‘

প্রথমবার ইশান মেহেরকে তুমি করে বললো। মেহের সাময়িকভাবে খুশি হলো। ইশান পুনরায় শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করবো না। না করতে পারবো নিজেকে। নিজের পুরুষত্বের উপর যার কন্ট্রোল নেই সে কাপুরুষ। আমি আজ থেকে কাপুরুষ হয়ে গেলাম। তোমাকে ধন্যবাদ মেহের আমাকে নিজের এই সত্তার সাথে পরিচয় করানোর জন্য। ‘

মেহের বিস্মিত চোখে তাকালো। ইশানের কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। মেহেরের বুক কেঁপে উঠলো। টের পেলো ভালোবাসা পাওয়ার নেশায় সে কতোবড় ভুল করে ফেলেছে!

*
ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে জানালার পাশের চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছিল ইরা। তার ঘুম ভাঙলো ডোরবেলের শব্দে। ইশান এসেছে ভেবে সে তৎক্ষনাৎ দরজা খুলে দিলো। দরজার বাহিরের পুরুষটিকে দেখে মনে প্রজাপতি উড়তে লাগলো তার। হাসিমুখে প্রশ্ন করলো,

‘ আরে আপনি হঠাৎ? ‘

মাহিরের চোখমুখ ভয়ানক। গম্ভীর স্বরে বলল,

‘ আপনাকে আমার সাথে এক্ষুনি যেতে হবে মিস ইরাবতী আমিন!’

(চলবে)