মেঘবালিকার নিমন্ত্রণে পর্ব-০৮

0
160

#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#পর্ব-০৮
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

খান বাড়ি নিস্তব্ধতা ধারণ করেছে। প্রতিটি মানুষের নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যাচ্ছে না। ঝড় আসার পূর্বে যেমন প্রকৃতি শান্ত থাকে ঠিক তেমনই অবস্থা। খান বাড়ির নিস্তব্ধতার অবসান ঘটিয়ে গেইট দিয়ে ঢুকলো একটি কালো টয়েটো গাড়ি। সেটা থেকে নেমে এলো মাহির ও ইরাবতী।

ইশান ইরাবতীকে দেখে মাথা নিচু করে ফেললো। মেহের ফুপিয়ে কাঁদছে। ইরাবতী ভাইয়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। মাহিরের দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালো। মাহির মেহের ও ইশানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বলল,

‘আপনার ভাইকে আপনিই জিজ্ঞেস করুন।’

অজানা ভয়ে ইরাবতীর বুক কাঁপতে লাগলো। তার হাতটা জ্বলছে। মাহির শক্ত করে ধরেছিল। হয়তো রাগে। কিন্তু কিসের এতো রাগ তার ইরাবতীর প্রতি?’

ইরাবতী ইশানকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি হয়েছে ভাই? তুই এখানে কেন? মেহের কাঁদছে কেন? ‘

ইশানের নিচু কন্ঠস্বর,

‘ আমি মেহেরকে বিয়ে করেছি আপা। ‘

ইরাবতী ভয়ানকভাবে চমকে গেলো। জীবনে কখনো সে এভাবে চমকে যায়নি।

মাহির ইশানের শার্টের কলার টেনে ধরলো।

‘কতো বড় সাহস তোর। আমার বোনকে বিয়ে করে আবার সেটা বড়মুখ করে বলছিস।’

মেহের মাহিরের হাতে হাত রাখলো। জোর করে ছাড়িয়ে নিলো ইশানকে।

‘তুমি আমার স্বামীকে এভাবে অসম্মান করতে পারো না ভাইয়া। ‘

মাহতাব ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

‘ তুই ভালোবাসিস আমাদের বলতে পারতি। আমরা খুঁজ খবর নিয়ে বিয়ে দিতাম। তা না মানসম্মান নষ্ট করে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করেছিস। তোকে কি আমরা ভালো কোনো শিক্ষাই দিতে পারিনি মেহের?’

মেহের কাঁদছে। ইশান মেহেরের দিকে তাকালো না। সেভাবেই নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাহিরের মাথা গরম। ইশানের নাক বরাবর ঘুষি মারলো।

‘ কিসের ভালোবাসা ভাইয়া? এসব থার্ডক্লাশ লোকের সাথে তো কথা বলাই উচিত নয়। তোর কতো বড়ো সাহস তুই আমার বোনকে বিয়ে করে আমারই বাড়িতে দাড়িয়ে আছিস। ‘

মাহতাব এসে ছাড়িয়ে নিলো। ইশানের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। ইরাবতী তখনও ঘোরে। মেহের শাড়ির আঁচল দিয়ে ইশানের নাকের রক্ত মুছে দিলো। বাবা ভাইয়ের আদরের পরীটা চিৎকার করে বলল,

‘ যে বাড়িতে আমার স্বামীর কোনো সম্মান নেই সে-ই বাড়িতে আমি এক মুহুর্তও থাকবো না। ‘

এবার মাথা তুললো ইশান। মেহের স্পষ্ট দেখলো ইশানের ঠোঁটের কোণে তাছ্যিলের হাসি। হয়তো সেটা বলছে, ‘স্বামীর অসস্মান? তুমি যে তোমার স্বামীকে কাপুরুষ প্রমাণ করলে সেটা?’

ইশান মেহেরের হাত ধরে ইরাবতীর সামনে গেলো। ইরাবতী স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে। ইশান বলল,

‘ আমি কাউকে কিছু বলবো না আপা। তুই তো আমাকে চিনিস। তোর কি আমার উপর রাগ হচ্ছে আপা? রাগ হলে তুই আমাকে মারতে পারিস।’

ইরাবতী ছলছল চোখে তাকালো। ইশানের নাকের কোণে রক্তের দাগ স্পষ্ট। মাহিরের দিকে তাকালো করুন চাহনিতে। মাহির মুখ ফিরিয়ে নিলো রাগে। ইরাবতীর গাল বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়লো। ইশানকে বলল,

‘আমি আমার ভাইকে চিনি। সে কোনো কারণ ছাড়া এতবড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আমার দরজা তোদের জন্য খুলা থাকবে।’

মেহের নিজের পরিবারের দিকে তাকালো,

‘ তোমাদের অমতে বিয়ে করেছি। সেজন্য তোমরা আমাকে দোষ দিও। কিন্তু ওকে নয়। ওর কোনো দোষ নেই। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। ‘

মেহের একবার সোফার দিকে তাকালো। তার বাবা মুখ ফিরিয়ে বসে আছেন।

খান বাড়ির কোনো নারী টু শব্দ ও করলেন না। মেহের ইশানের হাত ধরে খান বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে গেলো। ইরাবতী পেছনে ফিরে মাহিরের রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখশ্রীর দিকে তাকালো। তার কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু। তার লুকিয়ে রাখা প্রেমিকা মন বুঝে গেলো এ জনমে নিজের ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ বোধহয় আর হবে না!’

*
ইরাবতী সবার আগে ফ্ল্যাটে ঢুকলো। তারপর বরণ করলো মেহেরকে। ইশান নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। মেহের অসহায় চোখে ইরার দিকে তাকালো। ইরা হাসলো,

‘তুমি বরং আমার রুমে এসো। ফ্রেশ হয়ে কাপড় চেঞ্জ করে নিবে। ততোক্ষণে আমি খাবার গরম করে নিবো।’

মেহের মাথা নাড়ালো। ফ্রেশ হয়ে যখন টেবিলে এলো তখনো ইশানের রুমের দরজা বন্ধ। ইরা দরজায় টুকা দিলো। ইশানের গলা ভেসে এলো,

‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।’

ইশান এলো দশ মিনিট পর। চোখমুখ লাল হয়ে ফুলে গেছে। হয়তো কেঁদেছে অনেক। ইরা কোনো প্রশ্ন করলো না। নিশ্চুপে খাওয়া শেষ করলো। খাওয়া শেষে ইশান চলে গেলো নিজের রুমে সাথে ঠাস করে দরজা লাগাতে ভুললো না। মেহের বুঝতে পারলো আজ তাকে ইরার সাথে থাকতে হবে।

অন্ধকার বারান্দায় সোডিয়ামের মৃদু আলো এসে জায়গা করে নিয়েছে। দাড়িয়ে থাকা দুজন রমনীর মুখ হলদেটে আলোয় সুন্দর দেখতে লাগছে। ইরাবতী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘তুমি অনেক বড় ভুল করে ফেললে মেহের। আমি আমার ভাইকে চিনি। ও তোমাকে রাগ দেখাবে না বরং এমন আচরণ করবে যে তুমি প্রতিক্ষণ আফসোস করবে কেন সে তোমাকে রাগ দেখাচ্ছে না। তুমি ছটফট করবে সে কেন তোমাকে কষ্ট না দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করছে।’

মেহের হেঁচকি তুলে কাঁদছে।

‘আমি এতোকিছু ভাবিনি আপু। আমি জাস্ট পারছিলাম না। আমার ওকে নিজের করে পাওয়ার জেদ চেপে বসেছিল। সেজন্য ডেস্পারেট হয়ে এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’

ইরাবতী মেহেরকে নিয়ে রুমে এলো। খুঁজে একটি ঔষধ বের করে দিলো। মেহের তা দেখে মারাত্মক লজ্জা পেলো। ইরাবতী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘এটা খেয়ে নাও। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই হোক তোমরা কাছাকাছি এসেছিলে। বাই এনি চান্স যদি কিছু হয়ে যায়। রিস্ক নেওয়া যাবে না। সামনে তোমাদের ভবিষ্যত পড়ে আছে। তার উপর দু’জনের সঠিক বনিবনা কবে হবে কেউ জানো না। সুতরাং এরমধ্যে তৃতীয় কেউ চলে এলে তোমরা অথৈ জলে পড়ে যাবে।’

মেহের ঔষধ টা খেয়ে নিলো। বিছানার এক কোণে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলো।

অন্ধকার বারান্দায় ডায়েরি নিয়ে বসেছে ইরাবতী। সোডিয়ামের আলোয় লেখা বুঝতে বা লিখতে অসুবিধা হচ্ছে না তার। ইরাবতী অনেক ভাবলো। ভেবে কাঁপা হাতে লিখলো,

‘আপনার আমার হওয়াটা হলো না। জীবনটা এতো জটিল কেন বলুন তো? আমরা যখনই কিছু সহজ ভাবি তখনই সেটা জটিল রুপ ধারণ করে কেন? আজ আমি আপনার চোখে আমার ও আমার পরিবারের জন্য স্পষ্ট ঘৃণা দেখেছি মাহির। ভালোবাসার মানুষের চোখে ঘৃনা দেখে আমার তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমার মস্তিষ্ক মেনে নিলো আপনার আমার এক হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু মন! তাকে কিভাবে মানাবো মাহির? সে তো প্রতিনিয়ত আপনাকে চায়। আমার এক তরফা ভালোবাসা কালের গর্বে হারিয়ে যাবে মাহির সেটা ভাবলেই আমার কান্না পাচ্ছে। পৃথিবী জানে ইরাবতী কাঁদতে জানে না। অথচ রাতের আঁধারে কাঁদার জন্য আমি একটি বুক খুঁজি। যে বুকে আমি নির্দ্ধিধায় কাঁদতে পারবো। যে বুকে মাথা রেখে বলে ফেলতে পারবো হাজারো মন খারাপের কথা। যে মানুষটাকে ইচ্ছে হলেই শুনিয়ে দিতে পারবো কেন আমার মন খারাপ হয় বার-বার? কেন আমি গুমরে মরি বুকের ভিতর!

জানেন মাহির? আমার এতো ভালোবাসা আপনি কখনো জানবেন না সেটা ভাবতেই আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আপনি কি দারুণ ভাবে ঠকে গেলেন মাহির। ইরাবতীকে না পেয়ে ঠকে গেলেন। সাথে কি নিষ্ঠুরভাবে ইরাবতীর হৃদয় ভেঙে দিলেন। অথচ জানলেন না ইরাবতীর হৃদয় শুধু এবং শুধুমাত্র এক আপনার জন্যই ভাঙে আবার জোড়া লাগে!

পৃথিবীর নিষ্ঠুর নিয়মে আমি ফেঁসে গিয়ে আজ আপনাকে চিরতরে হারিয়ে ফেললাম। এইজন্য আমি পৃথিবীকে কখনো ক্ষমা করবো না। ক্ষমা করবো না আমার লুকোনো প্রেমিকা মনকে যে এখনো আপনার দহনে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত!

(চলবে)