মেঘবালিকার নিমন্ত্রণে পর্ব-০৯

0
144

#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#পর্ব-০৯
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

ভোরের আলো চোখে লাগতেই ঘুম ভেঙে গেলো ইরাবতীর। বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটলো। গিয়ে দেখলো ইশান ইতিমধ্যে রান্না কমপ্লিট করে ফেলেছে। ইরাকে দেখে সে স্বভাব সূলভ হাসলো।

‘তুমি টেবিলে বসে পড়ো। আমি সবকিছু নিয়ে আসছি।’

ইশান ইরাকে কখনো তুই কখনো তুমি বলে। যখন যেটা আসে। ইরা চলে গেলো। রুমে গিয়ে মেহেরকে ডেকে তুললো। তারপর দুজন মিলে একসাথে টেবিলে এসে বসলো। ইশান ততোক্ষণে সবকিছু নিয়ে এসে নিজেও বসেছে। তিনজন খাওয়া শুরু করলো। খাওয়ার একপর্যায়ে ইশান বলল,

‘আজ তুমি ওই বাড়িতে গিয়ে মেহেরের প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র নিয়ে আসতে পারবে আপা?’

মেহের চমকে তাকালো। মানুষটা এতো শান্ত!

ইরা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।

‘গ্রেট। আজ তবে মেহুর কলেজে যাওয়ার দরকার নেই। আগামীকাল থেকে না-হয় যাবে।’

ইরাবতী সম্মতি জানালো। মেহের আড়চোখে তার মানুষটাকে পরোখ করতে লাগলো। ইরা আপার কথাই তবে সত্য। মানুষটা তার প্রতি কোনোরূপ রাগ বা অভিযোগ প্রকাশ করছে না। বরং নিজের দায়িত্ব পালন করতে চেষ্টা করছে। মেহের লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। খাওয়া শেষে ইশান নিজের রুমে চলে গেলো। ইরাবতী মেহেরকে উঠিয়ে ঠেলে সেদিকে পাঠালো। নিজে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে রান্নাঘরে চলে গেলো।

বিয়ের এক রাত পর মেহের নিজের স্বামীর রুমে প্রবেশ করলো। ধীর পায়ে হেটে গিয়ে ইশানের সামনে দাড়ালো। ইশান তখন সেল্ফের পাশে দাড়িয়ে বই নেড়েচেড়ে দেখছে। মেহের কে দেখে শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ও তুমি, গতকালের জন্য দুঃখীত। আমার উচিত হয়নি ওভাবে দরজা লাগিয়ে রাখা। আজ থেকে তুমি এ রুমেই থাকবে। যা আমার তা তোমারও। সুতরাং অস্বস্তি অনুভব করবে না। কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বলবে। মন খারাপ হলেও আমাকেই বলবে। কোনো প্রয়োজন হলেও আমাকেই বলবে। আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।’

মেহের ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেললো। আছড়ে পড়লো ইশানের বুকে। ইশান সরিয়ে দিলো না। বরং নিজেও জড়িয়ে নিলো। মেহেরের মাথায় হাত ভুলিয়ে দিয়ে বলল,

‘হুস কাঁদে না। পরিবারের জন্য মন খারাপ করবে না। তারা তোমার উপর রাগ করে আছেন, কিন্তু সেটা সারাজীবন স্থায়ী হবে না। তারা ঠিকই তোমার সাথে কথা বলবেন।’

মেহেরের কান্নার বেগ পাড়লো। ইশান চুলের ভাঁজে ঠোঁট ভুলিয়ে নিলো।

‘মন খারাপ কেন তোমার মেহু?’

মেহের কাঁপতে লাগলো।

‘ইশান বিছানায় বসিয়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে দিলো। কিন্তু আবারও মেহেরের গাল ভিজতে লাগলো। ইশান গোপনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো।

‘এভাবে কাঁদলে শরীর খারাপ করবে তোমার।’

মেহেরের প্রচন্ড রাগ হলো। টেনে ধরলো ইশানের চুল। ইশান হতভম্ব হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। মেহের নাক টেনে টেনে বলল,

‘একদম ভালোবাসা দেখাতে আসবেন না। বাজে লোক কোথাকার। আমি কি কিছু বুঝি না?’

ইশানের শান্ত কন্ঠ,

‘কিসের কথা বলছো? তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?’

‘তো রাখবো না? আপনি আমাকে মারছেন না কেন? ধমকাচ্ছেন না কেন? বকে দিচ্ছেন না কেন? কেন দিচ্ছেন না?’

ইশান হাসলো,

‘আমি কখনো আমার বউকে বকবো না, মারা তো দূরের কথা। ‘

‘কেন বকবেন না?’

‘তাকে ভালোবাসা যায় বকা যায় না।’

মেহের ছলছল চোখে তাকালো। আহ্লাদী হয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেললো। ইশান আলতো করে জড়িয়ে ধরলো।

‘তুমি শুধু শুধু কাঁদছো কেন?’

মেহেরের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো,

‘পাষাণ লোক কোথাকার। আমার সাথে ভালো ব্যবহার করে আমাকে শাস্তি দিচ্ছে।’

বিয়ে করা বউয়ের হুটহাট কান্নাকাটির জন্যে ইশান বিরক্ত নয়। পরিবার ছেড়ে এসেছে কাঁদতেই পারে। তার উচিত বুক পেতে দেওয়া। যাতে তার বউ মন ভরে কাঁদতে পারে। ইশান তাই করলো। মেহেরকে নিজের কোলে বসিয়ে বুকে চেপে ধরলো। হেসে বলল,

‘এবার তুমি কাঁদতে শুরু করো। আমি ঘড়ি দেখবো, ঠিক কতো ঘন্টা কাঁদলে তুমি জানতে হবে না?’

মেহেরের কান্না পালিয়ে গেলো কোথাও। ইশানের এতো কাছে এসে তার শরীর কাঁপছে। লোকটা তার স্বামী। সেটা ভাবতেই তার বুকে মৃদু কম্পন অনুভব হচ্ছে। কিন্তু নিজের করা কাজের কথা মনে হলে গলা ধরে আসছে। কি হতো আরও অপেক্ষা করলে!

মেহেরকে অবাক করে দিয়ে ইশান ওষ্ঠে ডুবে গেলো। ছেড়ে দেওয়ার পর মেহেরের ঠোঁট তিরতির করে কাঁপতে লাগলো। চোখের কোণা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ইশান অবাক হয়ে বলল,

‘তোমার কি বেশি লেগেছে?’

মেহের ইশানের থেকে দূরে সরে গেলো।

‘আপনি নয়। আমি নিজে যখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো তখনই আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতো সম্পর্ক হবে। তার আগে আমরা নামমাত্র সম্পর্ক বয়ে বেড়াবো।’

ইশান কিছু বললো না তাকিয়ে রইলো। মেহের নিজের উপর রেগে দেয়ালে আঘাত করতে গিয়েও করলো না। নিজেকে তার কিট মনে হচ্ছে। কি জঘন্য মেয়ে সে। সে মরে যাচ্ছে না কেন?

মেহের চোখমুখ শক্ত করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। ইশান শুধু দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। রেডি হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ইরাবতীর রুমে উঁকি দিলো। ইরাবতী তখন ওয়াশরুমে। এই ফাঁকে সে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। যেখানে মেহের দাড়িয়ে আছে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ভার্সিটিতে যাচ্ছি, টিউশনি করিয়ে ফিরতে সন্ধ্যা হবে। তুমি ঠিকঠাক খেয়ে নিও। রান্না করা আছে। রাতের রান্না আমি এসেই করবো। একা বাসায় বোরিং লাগতে পারে। সেজন্য মোবাইল রেখে যাচ্ছি রুমে। বই ও আছে। যা ইচ্ছে হয় করো।’

মেহেরকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ইশান কপালে ঠোঁট স্পর্শ করলো। তারপর প্রস্থান করলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

এই সময়টুকু একটা টু শব্দ ও করেনি মেহের। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে। নিজেকে আরও ঘৃণ্য মনে হচ্ছে তার। এটা কিরকম শাস্তি, কিরকম রাগ প্রকাশের ধরণ ইশানের! চিল্লিয়ে চড় থাপ্পড় মেরে দিতে পারতো। মেহের একদমই বাঁধা দিতো না। এমন ভালোবাসা তো মেহের চেয়েছিল এতোদিন। আজ তবে সেগুলো নিতে কষ্ট হচ্ছে কেন? মেহেরের ঠোঁট কেঁপে উঠলো। ফুপিয়ে উঠলো নিঃশব্দে। তাকে কি তবে সারাজীবন এভাবেই নিজের ভিতর গুমরে মরতে হবে!

*
বাসা থেকে বের হয়ে ইরাবতী আগে খান বাড়িতে গেলো। তাকে দেখে কেউ খুশি হবে না সেটা সে জানে। কিন্তু তবুও ছুটে আসতে হলো। নাতাশা ইরার জন্য নাস্তা নিয়ে এলো। ইরা হেসে বলল,

‘আমি বেশিক্ষণ বসবো না আপু। হসপিটালে যেতে হবে। সেজন্য ভাবলাম যাওয়ার আগে মেহেরের সব প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যাই।’

‘তুমি বসে নাস্তা করো, আমি ওর প্রয়োজনীয় সবকিছু প্যাক করে এনে দিচ্ছি।’

ইরা মাথা নাড়ালো। নাতাশা চলে যেতেই সিঁড়ি বেয়ে নামলেন মমতা খান। সোফায় বসে ইরাবতীর সাথে চোখাচোখি হতেই হাসলেন। এ বাড়ির সবাই এতো হাস্যোজ্জ্বল যে ইরাবতীর দেখতেও ভালো লাগে।

মমতা খান চোখের চশমা ঠিক করে বললেন,

‘বাবা ভাইর মাথা গরম। সেজন্য গতকাল অনেক কিছু বলেছে। আমি তো পেটে ধরেছি। মা হয়ে কিভাবে রাগ করে থাকি বলো তো ইরা? ও কেমন আছে এখন? আজ প্রথমবার খান বাড়িতে সকালে উঠে কেউ চিৎকার চেচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলেনি। এটা খাবো না ওটা খাবো না বলে বায়না ধরেনি। তোমার আঙ্কেল টেবিলে বসে নাস্তা না করে উঠে অফিসে চলে গেছেন। কিসের জন্যে জানো? তার পাশে তার মেয়ে বসেনি বলে। এতো আদর দিয়ে একমাত্র মেয়েকে মানুষ করেছেন। ভাইদেরও চোখের মনি ও। বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। সবার মধ্যেই গুমোট ভাব। আমার বাড়ির প্রাণকে তোমার ঘরে নিয়ে গেছো ইরা। কেমন আছে আমাদের প্রাণ?’

ইরা মমতা খানের হাত ধরলো।

‘আপনাদের মতো হয়তো এতবড় বাড়ি নেই আন্টি। কিন্তু আমি ওর কোনো অযত্ন হতে দিবো না। আমি ও আমার ভাই সাধ্যমতো চেষ্টা করবো ওকে ভালো রাখার। আপনি চাইলে ওকে দেখতে যেতে পারেন। কয়েকদিনের জন্য বেড়াতেও নিয়ে আসতে পারেন। ও তো এখনো ছোট। কি না কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আবেগের বশে। আমাদের বড়দের কি রাগ করলে চলবে বলুন? বাচ্চারা ভুল করলে আমাদের শুধরে দিতে হবে। এটা তো আমাদের দায়িত্ব।’

সিঁড়িতে দাড়িয়ে সব শুনলো মাহির। এগিয়ে এসে বলল,

‘আপনার লো ক্লাস জ্ঞান আপনার কাছেই রাখুন। ও এতোটাও ছোট নয়। কোনটাতে পরিবারের মান সম্মান নষ্ট হবে সেটা ও ভালো করেই বুঝে। দোষটা আমাদেরই। আদরে বাঁদর বানিয়েছি তো। তার প্রতিদান সেজন্য এভাবে দিলো।’

ইরাবতী কিছু বলতে পারলো না। এই মানুষটার সামনে তার সবকিছু থেমে যায়। নাতাশা বড়ো একটি ট্রলি ব্যাগ এনে রাখলো।

‘সবকিছু দিয়েছি।’

ইরা উঠে দাঁড়ালো৷ তার মনে হলো যাওয়ার আগে কিছু একটা মাহিরকে বলা উচিত। ট্রলি হাতে নিয়ে সে মাহিরের সামনে গিয়ে দাড়ালো। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,

‘বাঁদর হোক আর যাই হোক মানুষটা তো আপনাদেরই। নিজের মানুষদের উপর রাগ ধরে রাখতে হয়না। ছোট্ট একটি জীবন কে কবে মারা যাবো তার কোনো ঠিক নেই। আজ আপনি কথা বলছেন না ধরুন কাল ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে গেলো। তখন আপনি সারাজীবন আফসোস করবেন যে কেন কথা বললেন না।

তারপর মমতা খানের থেকে বিদায় নিলো।

‘আমি আসছি আন্টি।’

মমতা খান গভীর মমতা নিয়ে তাকালেন। নাতাশা জড়িয়ে ধরে বলল,

‘আবার এসো। মেহেরকে বলো ওর প্রিয় লেখকদের কিছু বইও দিয়েছি। যদি আরও লাগে তাহলে ওর ভাইয়াকে দিয়ে সব বই পাঠিয়ে দিবো। আর মাহদি তার পু পু কে মিস করে।’

ইরাবতী আড়চোখে মাহিরের দিকে তাকিয়ে প্রস্থান করলো। মাহির সেদিকে তাকিয়ে রইলো দীর্ঘক্ষণ।

(চলবে)